Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোভিড সংক্রমণে জীবতত্ত্বগত লিঙ্গের কোনো প্রভাব আছে কি?

দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে আবারো কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অস্ট্রিয়াতে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২০ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছেন দেশটির সরকারপ্রধান। এরই মাঝে ‘দ্য সায়েন্টিস্ট’ ম্যাগাজিনে কোভিডের বিষয়ে গবেষণাধর্মী একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কোভিড সংক্রমণ মোকাবেলায় কারা বেশি শক্তিশালী? পুরুষ নাকি নারী? এই বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা এখনও চলছে। সেই গবেষণাভিত্তিক আর্টিকেলই প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনে। যদিও এই গবেষণাগুলোর ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা এখনও স্পষ্টভাবে কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। তবে সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন। 

করোনায় আক্রান্তে নারী-পুরুষ ভেদ নিয়ে চলছে গবেষণা; Image credit: Dave Cutler (artist)

২০২১ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত দ্য সায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনে গবেষণাধর্মী একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, কোভিডের প্রভাবে নারীদের চেয়ে পুরুষেরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। এই প্রবন্ধ সারাবিশ্বেই ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মূলত ২০২০ সালের আগস্ট মাসে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই বিষয়ে তাদের প্রথম গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল, ‘নারী-পুরুষভেদে কোভিডের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পার্থক্য’। এই গবেষণায় কোভিডের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভিত্তিতে নারীদেরকে পুরুষের তুলনায় অধিক শক্তিশালী বলা হয়েছে। সম্প্রতি ‘ন্যাচার’ ওয়েবসাইটে সেই গবেষণার ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রকাশিত হয়েছে নতুন আরেকটি গবেষণাপত্র, যার শিরোনাম— কোভিড সংক্রমণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ভিত্তিতে নারী-পুরুষের মাঝে সাদৃশ্য। 

গবেষণাপত্রগুলো কী বলছে?

প্রথম গবেষণাপত্রে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা প্রায় ২০০টি ইমিউন প্যারামিটার নিয়ে কাজ করেছেন। তার মাঝে সাইটোকাইনস অন্যতম। যখন সংক্রমণ ঘটে তখন পুরুষের মাঝে ইন্টারলিউকিন-৮ (IL-8) এবং ইন্টারলিউকিন (IL-18) অধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। ইন্টারলিউকিন হচ্ছে একরকমের শ্বেত রক্তকণিকার উপাদান। এই গবেষণামতে- এই উপদানটিই নারী-পুরুষের মাঝে সংক্রমণকালে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এছাড়া সংক্রমণকালে নারীদের মাঝে সিডি৮+ টি-সেল অধিক পরিমাণে থাকে, যা আসলে প্রতিরোধক অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। আর এই গবেষণামতে, টি-সেলের এই পার্থক্যের কারণেই করোনায় আক্রান্ত নারীদের তুলনায় পুরুষের মৃত্যুহার বেশি। 

মানবদেহের ইন্টারলিউকিন (আণবিক গঠন- সিমুলেশন চিত্র); Image Credit: Jmol Development Team/Wikimedia Commons

সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত অন্য আরেক গবেষণা মতে, সংক্রমণকালে নারীদের দেহে যেমন টি-সেল পুরুষের তুলনায় অধিকহারে থাকে, ঠিক তেমনি পুরুষদের দেহে কেমোকাইন সিসিএল৫ (CCL5) অধিক হারে থাকে। যে কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে তেমন কোনো বায়োলজিক্যাল পার্থক্য আসলে থাকে না। এই গবেষণাপত্রে তারা তিনটি ইমিউন প্যারামিটার নিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন। এবং আগের গবেষণায় IL-8 এবং IL-18 এর লেভেলে যে ভিন্নতার দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছিল তাকে ভুল প্রমাণিত করে। এই গবেষণাপত্রে তারা অভিযোগ করেন, আগের গবেষণায় কেবল জীবতত্ত্বগত লৈঙ্গিক পার্থক্যকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। অথচ এক্ষেত্রে কেবল লৈঙ্গিক পার্থক্যকে মূল্যায়ন না করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও অন্যান্য বিষয়গুলোও মূল্যায়ন করা জরুরি। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সাবরা ক্লেইন বলেন, নারীদের তুলনায় পুরুষেরা অধিক হারে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তাদের ইমিউনিটি নারীদের চেয়ে লৈঙ্গিক পার্থক্যের জন্য কম। এর পেছনে ছেলেদের মেয়েদের তুলনায় অধিক হারে ধূমপান এবং মদ্যপানের কারণও থাকতে পারে। এছাড়া লাইফস্টাইলও এর জন্য দায়ী হতে পারে। 

রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় লৈঙ্গিক প্রভাব

প্রথম গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে, মেয়েদের দুটো এক্স ক্রোমোজম থাকে আর ছেলেদের থাকে একটা। এবং এই এক্স ক্রোমোজমের সংখ্যা দুটি থাকায় মেয়েদের জিনে টল-লাইক রিসেপ্টর ৭ (TLR7) অধিক পরিমাণে থাকে। এই বিষয়টিই প্রথম গবেষণাপত্রে মেয়েদেরকে ছেলেদের তুলনায় অধিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এছাড়া ওকলাহোমা মেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। সেই গবেষণা থেকে বলা হয়, মেয়ে-ইঁদুরেরা ছেলে-ইঁদুরের চেয়ে সার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে বেশি শক্তিশালী।

তাকাহাসি নামের একজন গবেষক ব্যাখ্যা করে বলেন, যদি মেয়ে-ইঁদুরের শরীর থেকে গর্ভাশয়কে বাতিল করা হয় এবং এস্ট্রোজেন হরমোন-প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়; তবে ছেলে-ইঁদুর এবং মেয়ে-ইঁদুরের মধ্যকার উক্ত বৈষম্য উধাও হয়ে যায়। এছাড়া ইঁদুরের উপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, সার্স ভাইরাসে সংক্রমিত হবার পর যেখানে মেয়ে-ইঁদুরেরা প্রায় ৪০% পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে, সেখানে ছেলে-ইঁদুরগুলোর প্রায় সব মারা যায়। সিরিয়ার আরেক গবেষণায় বলা হয়েছে, কোভিড সংক্রমণে মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ফুসফুসে বেশি ক্ষতি হয়। 

কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রেও কি এই গবেষণার ফলাফল একইরকম থাকবে? এটা কি রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার পার্থক্য? নাকি জীবতত্ত্বগত হরমোনাল কোনো পার্থক্য?

চীনের একটি হাসপাতাল থেকে গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ-রোগীদের শরীরে সংক্রমণের পর সিডি৮+ টি-সেল বৃদ্ধি পায় এবং হেল্পার-সেল কমে যায়। অপরপক্ষে মেয়েদের শরীরে বি এবং টি-সেল অধিকহারে পাওয়া যায়, যা রোগ প্রতিরোধে বিশেষ উপকারী। ২০২০ সালে আগস্টে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটির গবেষক তাকাহাসি সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা আমাদের গবেষণায় যা বলতে চেয়েছিলাম তা হয়তো ভবিষ্যতের অন্য কোনো বড় গবেষণায় বিশেষ সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।

সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা হয়

অনেক গবেষকের মতে, টি-সেল এবং সাইটোকাইনসের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে; তা আসলে তেমন জরুরি বিষয় নয়। তাদের মতে, এই পার্থক্য আসলে তেমন বড় কোনো ব্যাপার নয়। যেমন, ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা-প্যান্ডেমিকের সময় নারীদের চেয়ে পুরুষের মৃত্যুহার অধিক ছিল। পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা গেছে, এটা আসলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পার্থক্যের জন্য ঘটেনি। এরকম ঘটনা ঘটার অন্যতম কারণ ছিল, পুরুষেরা নারীদের চেয়ে অধিক ধূমপান করত এবং মদপান করত। এছাড়া জর্জিয়া এবং মিশিগানের সমীক্ষা থেকে শাট্টাক হেইডর্ন দেখিয়েছেন, কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা শুধু শ্বেতাঙ্গ নারীদের চেয়েই অধিকহারে করোনায় আক্রান্ত হয় না, বরং শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের চেয়েও অধিকহারে আক্রান্ত হয়। তাই এই পদ্ধতিতে সমীক্ষা করা হলে পুরো গবেষণাই একরকম বর্ণবাদী পর্যায়ে চলে যায়।

সামাজিক দৃষ্টিকোণে খোঁজা হয়ে থাকে নারী-পুরুষের দায়; Image Source: Shutterstock

এছাড়া, ২০২০ সালের মে মাসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনার কারণে থাইল্যান্ডে ১৯ শতাংশ নারীর মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে পর্তুগালে ৫০ শতাংশ নারীর করোনায় মৃত্যু হয়েছে। যদি সত্যিই বায়োলজিক্যালি কোনো পার্থক্য থাকত, তবে সকল স্থানে নারীদের মৃত্যুহার সমান হবার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। সমীক্ষায় দেখা গেছে— যেসব দেশের নারীরা পূর্ণকালীন কর্মজীবী, সেসব দেশে করোনায় নারীদের মৃত্যুহার বেশি। এছাড়া এসব সমীক্ষার কোনোটিতেই ট্রান্সজেন্ডারদের পর্যবেক্ষণের জন্য রাখা হয়নি। ট্রান্সজেন্ডাররা এক্ষেত্রে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এরকমভাবে কোনো গবেষণা করা হলে, তাতে রাজনৈতিক ফায়দাই অধিক হবার সম্ভাবনা বেশি। ক্লেইন নামের এক গবেষক এই সম্পর্কে বলেন, “ব্যাপারটা খুবই অগোছালো হয়েছে। আমি এর মাঝে থাকতে চাইছি না।” কেউই আসলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না, এরকম লিঙ্গভেদে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার কোনো পার্থক্য সত্যিই আছে কিনা।

Related Articles