সমগ্র পৃথিবী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত। কোথাও আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার কমছে, কোথাও আবার বাড়ছে। ফলে কোথাও লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে, কোথাও সময়সীমা বাড়ানো হচ্ছে। তবে লিঙ্গভেদে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হারে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার যাদের বেশি
সাংহাই জিয়াওটং ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের একদল গবেষক ৯৯ জন কোভিড আক্রান্ত রোগীর উপর ৩০ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই রোগীরা জিনাইটান উহান হাসপাতালে ১ থেকে ২০ জানুয়ারির মধ্যে ভর্তি হয়েছিলেন। গবেষকরা দেখলেন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এমন রোগীদের মধ্যে পুরুষ রোগীর সংখ্যা নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ।
মৃত্যুর হারেও লিঙ্গভেদে ব্যাপক ব্যবধান দেখা গিয়েছে। ২১ থেকে ৩০ জানুয়ারি উহানের ২১টি হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায়, যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশই পুরুষ।
এরপর বিভিন্ন দেশে আরও বিশদ পরিসরে গবেষণা হয়েছে যা চীনের প্রথম গবেষণাকে সমর্থন করে। ইংল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে মারাত্মক অসুস্থ রোগী যারা নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ পুরুষ ছিল, এবং নারীর তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে পুরুষ মারা গিয়েছিল।
নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে চার হাজারেরও অধিক কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর উপর চালানো গবেষণায় দেখা যায়, ৬২ শতাংশ পুরুষ মারা গিয়েছে। তবে আক্রান্তের সংখ্যা নারী এবং পুরুষের ক্ষেত্রে সমান ছিল। পুরুষদের ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়া এবং মৃত্যুর প্রবণতা বেশি ছিল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০ মার্চ একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, পশ্চিম ইউরোপে করোনা ভাইরাসে মৃতদের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ। সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পুরুষদের আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার নারীদের তুলনায় বেশি। ২০ মে পর্যন্ত আইইডিসিআরের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের করোনা আক্রান্তদের ৬৮ শতাংশই পুরুষ। পুরুষদের মৃত্যুর হার যেখানে ৭৩ শতাংশ, সেখানে নারীদের ২৭ শতাংশ।
যেসব কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার পুরুষদের বেশি
এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২
কোভিড-১৯ সংক্রমণে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ এর ভূমিকা নিয়ে ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করা হয়। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডের ‘ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার গ্রোনিংএন’ এর কার্ডিওলজি অধ্যাপক এড্রিয়ান ভোরস।
হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক, ফুসফুস এবং শুক্রাশয়ে প্রচুর পরিমাণে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ পাওয়া যায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া, যেমন- পরিপাক এবং বিপাকে এই এনজাইম সহায়তা করে থাকে। বয়স্কদের কার্ডিওভাস্কুলার রোগের প্রবণতা বৃদ্ধির জন্যও এই এনজাইম দায়ী।
সুস্থ কোষের উপরিতলে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ রিসেপ্টর থাকে। করোনাভাইরাস এই রিসেপ্টরকে কাজে লাগিয়ে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে এবং সংক্রমণ শুরু করে।
এই গবেষণায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩৫০০ জন মানুষের রক্ত সংগ্রহ করে রক্তরসে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ এর ঘনত্ব নির্ণয় করা হয়। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, পুরুষের রক্তরসে নারীদের তুলনায় এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ এর ঘনত্ব বেশি রয়েছে। পুরুষের রক্তরসে এই এনজাইম বেশি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো শুক্রাশয়ে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ এর উপস্থিতি।
মূলত, রক্তরসে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ এর ঘনত্ব বেশি থাকায় পুরুষরা নারীদের তুলনায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেশি মারা যাচ্ছে, এই মর্মে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা
নারীদের প্রতি কোষে রয়েছে দুটি এক্স ক্রোমোজোম। অন্যদিকে, পুরুষের প্রতি কোষে রয়েছে একটি এক্স এবং একটি ওয়াই ক্রোমোজোম। এক্স ক্রোমোজোমে টিএলআর সেভেন নামক প্রোটিনের জন্য একটি জিন রয়েছে। টিএলআর সেভেন করোনা ভাইরাসের মতো একসূত্রক আরএনএ ভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারে। দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকায় নারীদের টিএলআর সেভেন প্রোটিনটি পুরুষের তুলনায় বেশি পরিমাণে থাকে।
এছাড়া, এক্স ক্রোমোজোমে প্রায় ৬০টি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জিন রয়েছে। নারীদের দুটি এক্স ক্রোমোজোম থাকায় কোনো কারণে একটি এক্স ক্রোমোজোমের রূপান্তর ঘটলেও নারীদের তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে, পুরুষের একটি মাত্র এক্স ক্রোমোজোম থাকায় কোনো কারণে এই ক্রোমোজোমের রূপান্তর ঘটলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
পুরুষের টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন রয়েছে। একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব পুরুষের টেস্টোস্টেরনের লেভেল কম তাদের কোভিড-১৯ মারা যাওয়ার ঝুঁকি বেশি। ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্ট্রেরন নামক হরমোন রয়েছে নারীদের যা নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
পুরুষদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নারীদের তুলনায় দুর্বল হওয়াতে তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্তের হারও বেশি।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজিস্ট ফিলিপ গোল্ডার বলেন, “পুরুষ এবং নারীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবধান রয়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের উপর এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে।“
ধূমপান
ধূমপানের ফলে এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ রিসেপ্টর বেশি পরিমাণে প্রকাশিত হয়। ফলে করোনাভাইরাস এনজিওটেনসিন কনভারটিং এনজাইম-২ রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে ধূমপায়ীদের সহজেই আক্রমণ করতে পারে। চীনে অর্ধেকেরও বেশি পুরুষ ধূমপান করে। অন্যদিকে মাত্র পাঁচ শতাংশ নারী ধূমপান করে। চীনে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে অধিক পুরুষের মৃত্যুর পেছনে ধূমপান একটি কারণ হতে পরে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, ধূমপায়ীরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে অধূমপায়ীদের তুলনায়।
আইইডিসিআরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে করোনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ধূমপায়ী তরুণরা। বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তদের ২৬ শতাংশ হলো ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এপিডেমিওলজি এণ্ড রিসার্চ বিভাগীয় প্রধান ডা. সোহেল রেজা চৌধুরীর মতে, “ধূমপান ফুসফুসকে দুর্বল করে। যেহেতু করোনা ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রকে প্রথমে আঘাত করে সেহেতু তরুণরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।“
স্বাস্থ্যবিধি
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, “নারীরা সাধারণত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকিতে যেতে চায় না এবং তারা খুব ভালোভাবে হাত ধুয়ে থাকে।“
জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কুনিহিরু মাতসুশিতা বলেন, “পুরুষরা সাধারণত কম স্বাস্থ্য সচেতন। তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধান মেনে চলে না, যেমন- হাত ধোয়া। তাই তাদের করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের প্রবণতা বেশি।“
পরিশেষে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে চলা এই যুদ্ধে জয়ী হতে সবার সচেতনতা কাম্য। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে সুস্থ রাখি।