বিশ্বজুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন করোনা ভাইরাস কভিড-১৯ এর ভয়াল থাবা। বাংলাদেশেও প্রতিদিন আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। নতুন করোনা ভাইরাস নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, স্কলাররাও উদ্বিগ্ন। ইউভাল নোয়াহ হারারিও ব্যতিক্রম নন। তিনি মনে করেন, এখন সময় বিশ্ববাসীর এক হওয়ার। দীর্ঘমেয়াদে বিচ্ছিন্ন থাকা কোনো সমাধান এনে দেবে না।
ইউভাল নোয়াহ হারারি একজন ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী। বর্তমানে জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস বিভাগের লেকচারার হিসেবে কাজ করছেন। স্যাপিয়েন্স, হোমো ডিয়াস এবং টুয়েন্টি ওয়ান লেসনস ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি- এই তিনটি বই লিখে বিশ্বজুড়েই সাড়া ফেলে দিয়েছেন অল্প সময়ের মধ্যে। তার বইগুলো ২৩ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রিত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি টাইম ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইটে লিখেছেন কভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য লেখাটি অনুবাদ করে দেয়া হলো।
অধিকাংশ লোকই করোনা ভাইরাসের মহামারীর জন্য বিশ্বায়নকে দায়ী করে। তাদের মতে, এ ধরনের মহামারী প্রতিরোধ করার একমাত্র উপায় পুরো বিশ্বের সবগুলো দেশকেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। সীমান্তে দেয়াল তুলো, বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করো, অন্য দেশের সাথে ব্যবসা রুখো- এগুলোই যেন বাস্তবিক সমাধান।
এটা ঠিক স্বল্পমেয়াদি কোয়ারেন্টাইন মহামারী প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত উপায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি আইসোলেশন অর্থনৈতিক ধ্বস সৃষ্টি করবে, যদিও সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে কোনো বাস্তবিক সমাধান এনে দিতে পারবে না। মহামারীর প্রকৃত প্রতিষেধক পৃথকীকরণ ব্যবস্থা নয়, বরং পারস্পরিক সহযোগিতাই পারে এটি দূর করতে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগের আগেও কোটি কোটি মানুষ মহামারীতে মৃত্যুবরণ করেছে। ১৪ শতকে কোনো বিমান বা প্রমোদতরী বলে কিছু ছিল না। তবুও মাত্র এক দশকের কিছু বেশি সময়ের মধ্যেই পূর্ব এশিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপে মহামারী প্লেগের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি থেকে ২০ কোটি মানুষ মারা যায়, যা সমগ্র ইউরাশিয়ার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি ছিল। ইংল্যান্ডে প্রতি দশ জনে চার জন মারা যায়। ফ্লোরেন্স শহরের এক লাখ জনসংখ্যার অর্ধেকই এই রোগে মারা যায়। প্লেগের কারণে মৃত্যুকে বলা হতো ‘ব্ল্যাক ডেথ’।
১৫২০ সালের মার্চ মাসে মাত্র একজন স্মল পক্স বাহক ফ্রান্সিসকো দে ইগুইনা মেক্সিকোতে পা রাখে। তখন মধ্য আমেরিকাতে কোনো বাস, ট্রেন এমনকি যোগাযোগ বা মালামাল বহনের জন্য কোনো গাধাও ছিল না। তারপরও ডিসেম্বরের মাঝেই সমগ্র মধ্য আমেরিকাতে স্মল পক্সের মহামারী প্রকট আকার ধারণ করে। এতে মধ্য আমেরিকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনগণ মারা যায়।
১৯১৮ সালে ফ্লুয়ের জীবাণু কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্বের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন মানুষ সংক্রমিত হয়, যা সে সময়ের সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি ছিল। এই ফ্লুতে ভারতবর্ষের আনুমানিক পাঁচ শতাংশ মানুষ মারা যায়। তাহিতি দ্বীপের ১৪ শতাংশ মানুষ মারা যায়। এই মহামারীতে সমগ্র বিশ্বে সম্ভবত দশ কোটি মানুষ মারা যায়, যা ছিল এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে। চার বছর ধরে চলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ মারা যায়নি।
১৯১৮ সালের পর গত শতাব্দীর বাকি সময়টুকোতে সাধারণ মানুষ মহামারীতে আরো বেশি আক্রমণযোগ্য হয়ে পড়েছে। কারণ এই সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েছে, একই সাথে পরিবহণ ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। মধ্যযুগের ফ্লোরেন্স শহরের তুলনায় টোকিও অথবা মেক্সিকো সিটির মতো আধুনিক মহানগরীতে জীবাণু ছড়ানোর সুযোগ অনেক বেশি। ১৯১৮ সালের পর বৈশ্বিক পরিবহণ ব্যবস্থারও অনেক উন্নতি ঘটেছে। প্যারিস থেকে টোকিও বা মেক্সিকো সিটিতে একটি ভাইরাস ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে চলে আসতে পারে। ফলে আমাদের মরণঘাতি প্লেগের পর একের পর এক সংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে এক সংক্রমণের নরকে থাকার কথা।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মহামারীর প্রকোপ ও প্রভাব- দুটিই নাটকীয়ভাবে কমে গিয়েছে। এটা ঠিক একবিংশ শতাব্দীতে এইডস ও ইবোলার ভয়ংকর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। কিন্তু এতে প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম মানুষ মারা গিয়েছে। কারণ জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের সেরা প্রতিরক্ষা আইসোলেশন নয়, বরং এটি হচ্ছে ইনফরমেশন বা তথ্য। মানবজাতি মহামারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে, কারণ জীবাণু আর চিকিৎসকদের প্রতিযোগিতায় জীবাণু নির্ভর করে নিজের জিনগত পরিবর্তনের ওপর। অন্যদিকে চিকিৎসকরা নির্ভর করেন তথ্যের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ওপর।
জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়
১৪ শতকে যখন ব্ল্যাক ডেথ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না কীসের কারণে এটা হচ্ছে! এর বিরুদ্ধে কী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবে তা-ও কারো উপলব্ধিতে আসছিল না। আধুনিক যুগের আগে মানুষ রোগের জন্য রাগান্বিত দেবতাদের কিংবা বিদ্বেষপরায়ন অসুরদের দায়ী করতো। তারা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার মতো কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকতে পারে এমন ধারণাও পোষণ করতো না। মানুষ তখন দেবদূত ও পরীদের সম্পর্কে বিশ্বাস করতো। কিন্তু এটা কখনো কল্পনা করতো না যে, এক ফোঁটা পানিতে মরণঘাতি শিকারি জীবাণুর বহর থাকতে পারে!
ফলে যখন প্লেগ বা স্মল পক্সের প্রকোপ দেখা দেয়, তখন প্রশাসন সর্বোচ্চ যা করতে পারত, তা হচ্ছে দেবতাদের সন্তুষ্টির জন্য প্রার্থনার ব্যবস্থা করা। এতে কোনো উপকার হয়নি। বরং, মানুষ যখন এসব প্রার্থনার জন্য জড়ো হতো, তখন সংক্রামক রোগ আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়তো।
গত শতাব্দীতে বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, নার্সরা তথ্য জমা করেছে। এসব তথ্য একত্রিত করে তারা মহামারী রোগের কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পেরেছে। একইসাথে এসব মহামারী কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তাও জানতে পেরেছে। বিবর্তন মতবাদ ব্যাখ্যা দিয়েছে কেন ও কীভাবে নতুন রোগ বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং পুরাতন রোগ আবার তীব্র আকার ধারণ করে। জেনেটিক্সের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জীবাণুর কার্যপ্রক্রিয়ার ওপর নজরদারি করতে পারছেন। মধ্যযুগের মানুষরা কখনো ব্ল্যাক ডেথের কারণ জানতে পারেনি। অন্যদিকে নতুন করোনা ভাইরাস শনাক্ত করা, জিনোম সিকুয়েন্স এবং সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত করনে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা বের করতে বিজ্ঞানীদের মাত্র দুই সপ্তাহ সময় লেগেছে।
বিজ্ঞানীরা যখন মহামারী রোগগুলোর কারণগুলো ধরতে পেরেছেন, তখন এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়ে গিয়েছে। ভ্যাক্সিনেশন, অ্যান্টিবায়োটিকস, উন্নত স্বাস্থ্যবিধি এবং অপেক্ষাকৃত ভালো মেডিকেল অবকাঠামো থাকার ফলে মানবজাতি এই অদৃশ্য শিকারির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে। ১৯৬৭ সালেও স্মল পক্স ১৫ মিলিয়ন মানুষকে সংক্রমিত করে এবং এতে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। কিন্তু পরবর্তী দশকেই স্মল পক্স ভ্যাক্সিনের বিশ্বব্যাপী প্রচারণা এতই সফল হয় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালে ঘোষণা দেয় মানবজাতির জয় হয়েছে। স্মল পক্স পরিপূর্ণভাবে নির্মূল হয়ে গিয়েছে। ২০১৯ সালে একজন ব্যক্তিও স্মল পক্সে আক্রান্ত হয়নি বা মারা যায়নি।
আমাদের সীমান্তকে পাহারা দিন
বর্তমান করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ইতিহাস আমাদের কী শিক্ষা দেয়?
প্রথমত, এটি আভাস দেয়, চিরস্থায়ীভাবে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে আপনি নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন না। বিশ্বায়নের পূর্বে মধ্যযুগেও মহামারী খুব দ্রুত ছড়াত। আপনি যদি এখন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ১৩৪৮ সালের ইংল্যান্ডের মতো করে ফেলেন, তাও যথেষ্ট হবে না। প্রকৃতপক্ষে আপনি যদি দেশকে বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে নিজেকে রক্ষা করতে চান, তাহলে আপনাকে মধ্যযুগে ফিরে গেলেও লাভ হবে না। যেতে হবে একেবারে প্রস্তর যুগে! সেটা কি আপনি করতে পারবেন?
দ্বিতীয়ত, ইতিহাস শিক্ষা দেয় প্রকৃত প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া যায় নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য বিনিময় এবং বিশ্ব সংহতির মাধ্যমে। যখন একটি দেশ মহামারীতে আক্রান্ত হয়, তখন তার উচিত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভয় উপেক্ষা করে অন্যান্য দেশের সাথে সৎভাবে তথ্য বিনিময় করা। একই সাথে অন্যান্য দেশকে এসব তথ্যে আস্থা রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, আক্রান্ত দেশকে সমালোচনা না করে তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে। আজ চীন সমগ্র বিশ্বকে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে শেখাতে পারে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন খুবই উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক আস্থা ও সহযোগিতা।
উপযুক্ত কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্যও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজন। মহামারী প্রতিরোধের জন্য কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা প্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি প্রতিটি দেশ একে অন্যকে অবিশ্বাস করে এবং মনে করে একাই তাদের দিক দেখতে হবে, তাহলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা বোধ করবে। যদি আপনার দেশে এখন ১০০ টি করোনা ভাইরাস রোগী ধরা পড়ে, আপনি কি সাথে সাথে সমগ্র শহর ও অঞ্চল বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন?
বৃহৎ পরিসরে এটা নির্ভর করে আপনি অন্য দেশগুলো থেকে কী সাহায্য আশা করেন। আপনার দেশের শহরগুলোকে বিচ্ছিন্ন রাখলে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আপনি যদি মনে করেন বন্ধু রাষ্ট্রগুলো আপনার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, তাহলে আপনি শহর বিচ্ছিন্ন করার মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে সাহস পাবেন। কিন্তু আপনার যদি মনে হয় অন্য দেশগুলো আপনার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সম্ভবত আপনি একদম দেরি না হওয়া পর্যন্ত দ্বিধান্বিত থাকবেন।
সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মহামারী সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি করা যে, এটি যদি যেকোনো একটি দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সমগ্র মানবজাতিই এর বিপর্যয়ে পড়বে। এর কারণ হচ্ছে ভাইরাসের বিবর্তন। করোনার মতো ভাইরাসগুলো প্রাণীদেহে জন্মায়, যেমন বাদুড়। তারা যখন প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহের সংস্পর্শে আসে, শুরুতে মানব পোষকের সাথে ভালোভাবে খাপ খাওয়াতে পারে না। পরবর্তীতে যখন মানবদেহে বংশবিস্তার করতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে কদাচিৎ মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তন হয়। বেশিরভাগ মিউটেশনই ক্ষতিকর নয়।
কিন্তু বার বার মিউটেশনের ফলে ভাইরাস আরো সংক্রামক হয়ে পড়ে অথবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতারোধী হয়ে ওঠে। ভাইরাসের এই পরিবর্তিত রূপটি তখন দ্রুত মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একজন মানুষ ট্রিলিয়ন সংখ্যক ভাইরাস বহন করতে পারে। এসব ভাইরাস প্রতিনিয়ত প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে। ফলে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে প্রতিনিয়ত ট্রিলিয়ন সংখ্যক নতুন সুযোগ হয় ভাইরাসগুলো মানবদেহে খাপ খাওয়ানোর জন্য। প্রতিটি মানব বাহক একটি জুয়ার মেশিনের মতো, যা ভাইরাসদের ট্রিলিয়ন সংখ্যক লটারি টিকিট দেয়। ভাইরাসের জন্য শুধু একটি টিকিট জেতার প্রয়োজন হয়।
এসব কোনো ফটকা বার্তা নয়। রিচার্ড প্রেস্টনের ‘ক্রাইসিস ইন দ্য রেড জোন’ বইয়ে ২০১৪ সালের ইবোলা রোগের মহামারীতে এমন ঘটনাক্রমের বর্ণনা পাওয়া যায়। মহামারী শুরু হয় যখন কিছু ইবোলা ভাইরাস বাদুড় থেকে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভাইরাসের কারণে মানুষজন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখনও ইবোলা ভাইরাসের অভিযোজন ক্ষমতা মানবদেহের চেয়ে বাদুড়েই বেশি ছিল। ইবোলা তুলনামূলক বিরল রোগ হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকার মাকোনা অঞ্চলের কোনো স্থানে এক সংক্রমিত লোকের দেহে একটি ইবোলা ভাইরাসের একটি জিন মিউটেশনের ফলে এটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
মিউটেশনের কারণে একে বলা হতো ইবোলা স্ট্রেইন বা মাকোনা স্ট্রেইন। এই মিউটেশনের কারণে এরা মানব কোষের কোলেস্টেরল পরিবাহকের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ফলে এই পরিবাহকগুলো কোলেস্টেরলের পরিবর্তে ইবোলা স্ট্রেইনগুলো কোষের ভেতর প্রবেশ করাতে থাকে। নতুন মাকোনা স্ট্রেইনগুলো মানবদেহে চার গুণ বেশি সংক্রামক হয়ে ওঠে।
আপনি যখন এই লেখা পড়ছেন, তেহরান, মিলান কিংবা উহানে হয়তো একইরকম মিউটেশন হচ্ছে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত কোনো রোগীর দেহে। প্রকৃতপক্ষেই যদি এমন হতে থাকে, তাহলে এটা শুধু ইরানি, ইতালিয়ান কিংবা চীনাদের জন্যই সরাসরি হুমকি নয়। এতে আপনার জীবনও ঝুঁকির মাঝে রয়েছে! সমগ্র পৃথিবীর মানুষের জীবন-মরণ প্রশ্নে করোনা ভাইরাসকে এই সুযোগ দেয়া যাবে না। এর মানে হচ্ছে আমাদেরকে প্রতিটি দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সত্তরের দশকে মানব সম্প্রদায় স্মল পক্স ভাইরাসকে বিলুপ্ত করতে পেরেছিল। এর কারণ হচ্ছে প্রতিটি দেশের মানুষদেরকেই স্মল পক্সের ভ্যাক্সিন দেয়া হয়েছিল। যদি একটি দেশও তার অধিবাসীদের ভ্যাক্সিন দিতে ব্যর্থ হতো, তাহলে এটি সমগ্র মানবজাতিকেই বিপর্যয়ে ফেলে দিত। কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত স্মলপক্স টিকে থাকত, এটি কোথাও না কোথাও বিবর্তিত হতো। ফলে এটি যেকোনো জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারত।
ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানবজাতিকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে পাহারা দিতে হবে। কিন্তু এটি দেশগুলোর মাঝে সীমান্ত নয়। বরং এটি মানববিশ্ব এবং ভাইরাস পরিমণ্ডলের মধ্যবর্তী সীমান্ত। পৃথিবী গ্রহে অগণিত ভাইরাস দেখা দিচ্ছে। নতুন নতুন ভাইরাসগুলো জিনগত পরিবর্তনের কারণে প্রতিনিয়ত বিবর্তিত হচ্ছে। মানববিশ্ব ও ভাইরাসের ক্ষেত্রের মধ্যে যে সীমান্তটি রয়েছে, তা প্রতিটি মানুষের দেহের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করেছে। যদি কোনো ভাইরাস পৃথিবীর যেকোনো স্থানে এই সীমান্ত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়, সমগ্র মানবজাতিই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
গত শতাব্দীতে মানুষ এই সীমান্তকে যতটা শক্তিশালী করেছে, তা পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। আধুনিক স্বাস্থ্যসেবাকে এই সীমান্তের দেয়াল হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। নার্স, চিকিৎসক আর বিজ্ঞানীরা হচ্ছেন এই সীমান্ত দেয়ালের পাহারাদার। তারা সীমান্ত পাহারা দেন এবং অনধিকার প্রবেশকারীদের সরিয়ে দেন। যদিও এই সীমান্তের বড় অংশ শোচনীয়ভাবে উন্মুক্ত। পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত। এটি আমাদের সবাইকেই বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে। আমরা স্বাস্থ্য নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে চিন্তা করতে অভ্যস্ত। কিন্তু ইরানি ও চীনাদের ভালো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করলে ইসরায়েলি ও আমেরিকানরাও মহামারী থেকে বেঁচে যায়। এই সহজ সত্যটি সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা উচিত। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও এটি এড়িয়ে যান।
একটি নেতৃত্বহীন বিশ্ব
আজ মানব সম্প্রদায় শুধুমাত্র করোনা ভাইরাসের জন্যই গভীর সংকটে পড়েনি। এর জন্য মানুষের মাঝে আস্থাহীনতাও দায়ী। মহামারী প্রতিরোধের জন্য জনগণের উচিত বিজ্ঞানীদের ওপর আস্থা রাখা, নাগরিকদের উচিত প্রশাসনের প্রতি ভরসা রাখা এবং প্রতিটি দেশের উচিত একে অন্যকে বিশ্বাস করা। গত কয়েক বছরে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিকরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি করেছেন, কর্তৃপক্ষকে পঙ্গু করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটিকেও ছোট করেছেন। ফলে আমরা এই সংকট মোকাবেলা করছি কোনো বৈশ্বিক নেতৃত্ব ছাড়া, যারা আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পারতেন, সংগঠিত করতে পারতেন এবং সমন্বিত বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার জন্য অর্থায়ন করতে পারতেন।
২০১৪ সালে ইবোলার মহামারীর সময় যুক্তরাষ্ট্র এরকম নেতার ভূমিকা পালন করেছিল। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও যুক্তরাষ্ট্র একইরকম ভূমিকা রাখে। অন্যান্য দেশরাও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে বিশ্ব অর্থনীতির বিপর্যয় রোধ করে। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক নেতার ভূমিকা থেকে সরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠানকে সাহায্যের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। একইসাথে বাকি পৃথিবীকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এখন আর কোনো প্রকৃত বন্ধু নেই, আছে শুধু স্বার্থের সম্পর্ক।
যখন করোনা ভাইরাস সংকট শুরু হলো, যুক্তরাষ্ট্র এক দিকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে এবং এখন পর্যন্ত নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা থেকে বিরত রয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের ওপর আস্থার সংকট এতটাই তীব্র যে, এটি নেতৃত্বের জন্য এগিয়ে আসলেও খুব অল্প সংখ্যক দেশই তাদের অনুসরণ করবে। ‘আমিই আগে?’ এরকম দর্শন নিয়ে চলা কোনো নেতৃত্বকে আপনি অনুসরণ করবেন?
যুক্তরাষ্ট্র যে শূন্যতা সৃষ্টি করে গিয়েছে, তা অন্য কারো দ্বারা পূরণ হয়নি। বরং উল্টোটা ঘটেছে। বিদেশিদের নিয়ে অযথা ভয়, বিচ্ছিন্নতাবাদ, বিশ্বাসহীনতা- এসবই যেন এখনকার আন্তর্জাতিক কাঠামোর বৈশিষ্ট্য। পারস্পরিক বিশ্বাস এবং আন্তর্জাতিক সংহতি ছাড়া আমরা করোনা ভাইরাসের মহামারী মোকাবেলা করতে পারব না। বরং এতে ভবিষ্যতে আরো মহামারীর সম্মুখীন হতে পারি আমরা। কিন্তু প্রতিটি সংকট একটি সুযোগও। আশা করা যায়, বৈশ্বিক বিভেদ যে কত বড় বিপর্যয় নিয়ে আসে, বর্তমান মহামারী তা মানব সম্প্রদায়কে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
বিশিষ্ট উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এই মহামারী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে সাম্প্রতিক সময়ে এর হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার। যদি এর তুলনামূলক ভাগ্যবান সদস্যরা ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য দেশগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তা, সরঞ্জাম ও স্বাস্থ্য কর্মী পাঠায়, তাহলে এটি প্রমাণিত হবে যে, ইউরোপীয় আদর্শ যেকোনো ফাঁপা বুলির চেয়ে অধিক কার্যকর। অন্যদিকে প্রতিটি দেশকে যদি শুধু নিজেদেরই সামলাতে হয়, তাহলে এটি হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য মৃত্যু ঘণ্টার সামিল।
এই সংকটময় মুহূর্তে সবচেয়ে বড় লড়াই চলছে মানবতার অভ্যন্তরে। মহামারীর ফলে যদি মানুষের মধ্যে বিভেদ আর বিশ্বাসহীনতা দেখা দেয়, তাহলে এটিই হবে ভাইরাসের সবচেয়ে বড় বিজয়। যখন মানুষে মানুষে বিভেদ আর সংঘাত দেখা দেবে, ভাইরাস হয়ে যাবে দ্বিগুণ। অন্যদিকে মহামারীর ফলে যদি বৈশ্বিক সংহতি বাড়ে, তবে তা শুধু করোনা ভাইরাসের বিপক্ষেই মানুষের বিজয় হবে না- ভবিষ্যতের সমস্ত জীবাণুদের বিরুদ্ধেও বিজয়।