ছোটবেলা থেকে আমাদের অনেকেই এই কথাটা শুনে এসেছি, ওকে দিয়ে এটা হবে না, ও এটা পারবে না, ওর মাথায় এটা বোঝার মতো ঘিলু নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার আমাদের অনেকেই অনেক সময় একরকম ভেবেই নিয়েছি, আসলেই মনে হয় আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, আমার মাথায় অন্যদের মতো বুদ্ধি নেই। আমি পারব না কাজটা। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? সত্যিই কি আমাদের একজনের মাথায় ব্রেইন কম, আবার আরেকজনের মাথায় বেশি? এজন্যই কি একজন লেখাপড়ায় খুব ভালো হয়, আবার আরেকজন লেখাপড়ায় খুব খারাপ? নাকি আমাদের একেকজনের মস্তিষ্কের ফাংশনই করা থাকে এরকমভাবে যে, একজন লেখাপড়ায় ভালো হবে, একজন হবে খারাপ; আবার একজন অলস হবে খুব, আবার একজন কর্মঠ!
আসলে এগুলো কিছুই না। মস্তিষ্ক আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উদ্দীপনা আর আমাদের কাজেরই ফল। মস্তিষ্ক অনেকটা প্লাস্টিকের মতো। আমরা চাইলেই একে আমাদের মনমতো যেকোনো রূপ দিতে পারি। আর একেই বলা হয় ব্রেইন প্লাস্টিসিটি তথা মস্তিষ্কের প্লাস্টিকত্ব। আর আজকে কথা হবে এটা নিয়েই।
নিউরনের জীবনবৃত্তান্ত: জন্ম এবং মুছে যাওয়া
জন্মের পর একজন নবজাতকের মস্তিষ্কে তার জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে স্রোতের মতো বিভিন্ন তথ্য আসতে থাকে। এই তথ্যগুলোকে তখন প্রক্রিয়াজাত করার পর মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট স্থানে পাঠানোর জন্য নিউরনগুলো একে অপরের সাথে সাথে সিন্যাপ্স কানেকশন তৈরি করে এবং সংকেতগুলো যাওয়ার জন্য রাস্তা তৈরি করে, যেভাবে টেলিফোনের লাইন তৈরি করা হয়। রাস্তাগুলো দিয়ে নির্দিষ্ট সংকেত মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে থাকে। যেমন- চোখের রেটিনা সবসময় মস্তিষ্কের অক্সিপোটাল লোবের প্রাইমারি ভিজ্যুয়াল এরিয়ায় সংকেত প্রেরণ করে, শব্দ থেকে পাওয়া সংকেতগুলো সবসময় কান থেকে বাম পশ্চাৎ মস্তিষ্কের শব্দ প্রক্রিয়াকরণ এরিয়ায় (Wernicke’s area) যায়।
জীবনের প্রথম কিছু বছর মস্তিষ্কের বৃদ্ধি খুব দ্রুতগতিতে হতে থাকে। প্রতিটি নিউরন পরিণত হয়ে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা (অ্যাক্সন এবং ডেনড্রাইট) তৈরি করে। এর মাধ্যমে মস্তিষ্ক নতুন স্মৃতি গঠন এবং সংকেত আদান-প্রদান করে থাকে। একদম প্রাথমিক দিকে আমাদের প্রতিটি নিউরনে প্রায় ২,৫০০ সিন্যাপ্স থাকে। যখন বাচ্চার বয়স ২ থেকে ৩ বছর হয়, তখন এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫,০০০ এ, যা আমাদের পরিণত বয়সের মস্তিষ্কের সিন্যাপ্স সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ! কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বয়সের সাথে সাথে এ সংখ্যা কমতে থাকে। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি কমতে থাকে, তাকে বলা হয় Synaptic Pruning বা সিন্যাপ্টিক ক্ষয়।
এই ক্ষয় আমাদের দুর্বল সিন্যাপ্টিক কানেকশনগুলোকে মুছে ফেলে এবং অন্যান্য সিন্যাপ্টিক কানেকশনগুলো তখন মজবুত ও দৃঢ় হতে থাকে। আমাদের অভিজ্ঞতা এবং অনুশীলন নির্ধারণ করে, কোন কানেকশনগুলো দৃঢ় হবে এবং কোন কানেকশনগুলো মুছে ফেলা হবে। আমাদের নিউরনগুলোর টিকে থাকার জন্য কোনো উদ্দেশ্যের প্রয়োজন রয়েছে। উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো নিউরন টিকে থাকে না। সেটি মৃত নিউরনে পরিণত হয়। যে প্রক্রিয়ায় কোনো নিউরন ধ্বংস হয়, তাকে বলা হয় অ্যাপোপ্টসিস (Apoptosis)। এই প্রক্রিয়ায় যে নিউরনগুলো কোনো সিগন্যাল গ্রহণ করে না, তারা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে মরে যায়। ব্রেইন প্লাস্টিসিটির মাধ্যমে খুব সহজেই এই সিন্যাপ্টিক ক্ষয়ের পরিমাণ কমানো যায়।
প্লাস্টিক মস্তিষ্ক
ব্রেইন প্লাস্টিসিটি মানে এই না যে, আমাদের মস্তিষ্ক প্লাস্টিকের তৈরি। যেকোনো বয়সে মস্তিস্কের পরিবর্তন হয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকেই বলা হয় ব্রেইন প্লাস্টিসিটি। এর মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ক যেকোনো বয়সে নতুন নিউরন কানেকশন তৈরির মাধ্যমে এবং নতুন নিউরন গঠনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। এটি আমাদের যেকোনো কিছু শিখতে এবং নতুন অভ্যাস গঠন করতে সাহায্য করে। আমরা যখন নতুন কিছু শিখতে যাই, তখন আমাদের মস্তিষ্কে বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদানের ক্ষরণ হয় এবং মস্তিষ্কে একটি সাময়িক পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে সেটা শর্ট টার্ম মেমোরিতে পরিণত হয়। আবার সেটিকে বারবার পুনরাবৃত্তি করলে, নতুন নিউরাল কানেকশন তৈরি হয়ে মস্তিষ্কে স্থায়ী পরিবর্তন সাধন করে সেটা লং টার্ম মেমরিতে পরিণত হয়। তাই কোনোকিছু শিখতে চাইলে বা নতুন অভ্যাস গঠন করতে চাইলে, আমাদের বেশি করে সেটি অনুশীলন করতে হয়। এটি আমাদের খারাপ অভ্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা যদি দীর্ঘদিন ধরে কোনো অনিয়ম করে থাকি, খারাপ কোনো কাজ করে থাকি বা মাদক গ্রহণ করে থাকি, তবে তার জন্যও আমাদের মস্তিষ্কে পরিবর্তন সাধিত হয় এবং নেতিবাচক প্লাস্টিসিটি তৈরি হয়।
আমাদের প্রতিদিনের প্রতিটি আচরণ এবং কাজ মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে থাকে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন হরমোন শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর সাথে সাথে মস্তিষ্কেও ক্রিয়া করে। সেগুলো নিউরো ট্রান্সমিটার ছাড়া নিউরনের গঠনেও বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। আমরা জানি, আমাদের প্রতিটি মনোভাব, প্রতিটি কাজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হরমোন নিঃসরণ হয়ে থাকে। যেমন আমরা যখন খুশি থাকি, তখন এন্ডোর্ফিনস, ডোপামিন এবং সেরাটোনিন নামের হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। এগুলোকে বলা হয় ‘হ্যাপিনেস হরমোন’! আবার যখন রেগে থাকি, তখন কর্টিসোল বা স্ট্রেস হরমোন নিঃসরিত হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই হ্যাপিনেস হরমোনগুলো আমাদের মস্তিস্কে পজিটিভ প্লাস্টিসিটি তৈরি করে থাকে, স্ট্রেস হরমোনগুলো তৈরি করে নেগেটিভ প্লাস্টিসিটি। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের স্ট্রেস হরমোনগুলোর কার্যকারিতা আমরা পরিবর্তন করতে পারি নিজেদের মনোভাব দিয়েই। আমরা যদি অবসাদ বা স্ট্রেসকে নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে না করে ভালো বা বিভিন্ন কাজের সহায়ক মনে করে থাকি, তাহলে সত্যিই সেটি আমাদের কাজটি দ্রুত শিখতে বা করতে সাহায্য করে এবং বেশকিছু অন্যান্য হরমোন নিঃসরণ করে যা আমাদের হার্টের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও আমরা যখন কোনো কাজ বেশ চাপ নিয়ে শিখি এবং করার চেষ্টা করি, তখন তার জন্য যে সিন্যাপ্স কানেকশনটি তৈরি হয়, সেটি বেশ দৃঢ় হয়। এটি সহজে মুছে যাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা থাকে না। এ থেকেই দেখা যায়, আমাদের মনোভাব ও কাজকর্মই নির্ধারণ করে, আমাদের মস্তিষ্কের গঠন কেমন হবে।
বাস্তব জীবনে কিছু ব্রেইন প্লাস্টিসিটির উদাহরণ
আমাদের চারপাশেই রয়েছে ব্রেইন প্লাস্টিসিটির হাজারো উদাহরন।
১) লন্ডনের ক্যাব ড্রাইভার
গবেষণায় দেখা যায়, লন্ডনের ক্যাব ড্রাইভারদের হিপোক্যাম্পাস স্বাভাবিক মানুষদের তুলনায় বেশ বড় হয়। কারণ তাদের অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি রাস্তার মানচিত্র মনে রাখতে হয়। হিপোক্যাম্পাসই আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা এবং রাস্তা চিনতে সাহায্য করে। ড্রাইভারদের নিয়মিত গাড়ি চালানো এবং তাদের রাস্তা মনে রাখার জন্যই তাদের হিপোক্যাম্পাস বড় হয়ে যায়।
২) স্কুলের শিক্ষার্থী ও তাদের আইকিউ
আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রায়ই শুনতে হয়, ওকে দিয়ে সম্ভব না, ওর মাথায় বুদ্ধি নাই এবং এরকম আরো অনেক কিছু। এটি আসলে বাচ্চাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটি তাদের ভবিষ্যতেও খুব বাজে প্রভাব ফেলে থাকে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট ড. ক্যারল ডোয়েক তার গবেষণায় প্রমাণ করেন, যখন শিক্ষার্থীদের বোঝানো হয় যে তাদের বুদ্ধিমত্তা আসলে ফিক্সড নয় ও তারা চাইলেই ভালো করতে পারে, এটি তাদের রেজাল্ট এবং মানসিকতায় অভাবনীয় পরিবর্তন এনে থাকে। শুধুমাত্র এটি বিশ্বাস করেই যে ‘তাদের দ্বারাও ভালো করা সম্ভব’, তারা ভালো ফলাফল করে থাকে। সুতরাং ব্রেইন প্লাস্টিসিটি দ্বারা কী করা সম্ভব, এটি অনুধাবন করাই শিক্ষার্থীদের আইকিউ বৃদ্ধি করে থাকে।
নেতিবাচক প্লাস্টিসিটি: ছোট হওয়া মস্তিষ্ক
এগুলো ছাড়াও ব্রেইন প্লাস্টিসিটির অনেক নেতিবাচক উদাহরণও দেখা যায়। যেমন- গৃহপালিত হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ককে ছোট করে দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, নেকড়ে এবং কুকুর একই প্রজাতির হলেও কুকুরের মস্তিষ্ক নেকড়ের তুলনায় বেশ ছোট। এটি কুকুর মানুষের সাথে বাস করা শুরুর পর ক্রমান্বয়ে হয়েছে। কারণ কুকুরদের এখন আর খাবার খুঁজতে হয় না, শিকারও করতে হয় না। তাই তাদের মস্তিস্কের কাজ কমে গেছে এবং তা ক্রমেই কার্যক্ষমতা হারিয়ে আকারে ছোট হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীর ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায় তাদের মস্তিষ্ক বুনো প্রাণীদের তুলনায় ছোট। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, আমরা গৃহে বসবাস করা শুরু করার পর আমাদের মস্তিষ্কও আমাদের আদিপুরুষদের তুলনায় ছোট হয়ে আসছে!
নিজের মস্তিষ্ক নিজে গড়া
ব্রেইন প্লাস্টিসিটির ধারণা থেকে এখন সহজেই বলা যায় যে, আমরা চাইলেই আমাদের মস্তিষ্ককে আমাদের নিজের মতো করে গড়ে নিতে পারি। এজন্য প্রয়োজন শুধু চর্চা করা। আমাদের মস্তিষ্ক কেমন হবে, তা সম্পূর্ণ আমাদের কাজের উপর নির্ভর করে। আমরা যদি আমাদের দৈনন্দিন স্বভাবের উপর একে ছেড়ে দিই, তবে তা আমাদের দৈনন্দিন স্বভাবগুলো নিয়েই বেড়ে উঠবে। আবার আমরা চাইলেই আমাদের মনমতো একটি মস্তিষ্ক গড়ে তুলতে পারি। তবে এমন মস্তিষ্ক গড়ে তোলার জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি পদ্ধতি।
১) আজীবন শেখা
গবেষণায় দেখা যায়, আমরা যতদিন নতুন নতুন জিনিস শিখতে থাকি, ততদিন আমাদের মস্তিষ্কও পরিবর্তন হতে থাকে। ছবি আঁকা ব্রেইন প্লাস্টিসিটি বাড়ায়। সাথে সাথে ছোটবড় সকলেরই বুদ্ধিমত্তা ও মনোযোগ বৃদ্ধি করে। গান শেখা ও মিউজিক তৈরি করাও নিউরো প্লাস্টিসিটি, স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রায় ৪০০ এর মতো গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, নাচ ব্রেইন প্লাস্টিসিটি এবং মস্তিষ্কের উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। নতুন কোনো ভাষা শেখা মস্তিষ্কের আকৃতি বৃদ্ধি করে। এমনকি সাধারণ মানুষের তুলনায় দোভাষী ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের আকার বড় থাকে।
২) শারীরিক কসরত
দৈনন্দিন মাত্র ৩০ মিনিটের ব্যায়াম ব্রেইন প্লাস্টিসিটিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শারীরিক কসরত বিভিন্ন ব্রেইন কেমিক্যালের মাত্রা বৃদ্ধি করে যা নতুন নিউরন ও নিউরাল কানেকশন গঠনে সাহায্য করে এবং সিন্যাপ্স কানেকশনগুলো মুছে যাওয়া থেকে রোধ করে। হাঁটা একটি খুবই ভালো মস্তিষ্কের ব্যায়াম। এটি নিউরন কানেকশনগুলোকে তরতাজা রাখে। এছাড়া ইয়োগা, মার্শাল আর্ট ব্রেইনের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করে।
৩) মেডিটেশন
মস্তিষ্ককে শান্ত রাখা একটি যথেষ্ট কঠিন কাজ। গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশনের সময় মস্তিষ্ক এমন কিছু কেমিক্যাল ক্ষরণ করে যা মস্তিষ্কের কোষ বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে, মনোযোগ বৃদ্ধি করে, নিউরাল কানেকশনগুলোকে শক্তিশালী করে। অর্থাৎ মস্তিষ্কের উন্নতির জন্য মেডিটেশন একটি যথেষ্ট কার্যকরী প্রক্রিয়া।
৪) পুষ্টি এবং খাবার
যেসব খাবার এবং পুষ্টি উপাদান আমাদের নিউরন এবং নিউরোট্রান্সমিটার গড়তে সাহায্য করে, সেগুলো নিয়মিত খাওয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্রেইন প্লাস্টিসিটি বৃদ্ধি করতে পারি। যেমন-
- ডার্ক চকলেট এবং কোকোয়ায় ফ্লেভানল পাওয়া যায়
- জামে পাওয়া যায় পলিফেনল
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, বিশেষ করে DHA (docosahexaenoic acid), মস্তিষ্কের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
- ভিটামিন-ডি এবং ভিটামিন-ই
- ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থিওনেট
- কারকুমিন হলুদে পাওয়া যায়।
- গটু কোলা (একটি এশিয়ান ভেষজ)
- গিঙ্কগো (একটি পরিচিত স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিকারক উপাদান)
খুশি থাকার জন্য ব্রেইন প্লাস্টিসিটি
একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবন গঠনে ব্রেইন প্লাস্টিসিটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। যেহেতু আমাদের বুদ্ধিমত্তা বদলাতে পারে, তার সাথে সাথে আমরা আমাদের আবেগ এবং অন্যান্য অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আমরা চাইলেই খুশি থাকা শিখতে পারি। Shawn Achor বিশ্বের একজন বিখ্যাত খুশি থাকার এক্সপার্ট এবং The Happiness Advantage নামের বেস্ট সেলিং বইটির লেখক। তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে খুশি থাকা শেখান! তিনি শিক্ষার্থীদের খুশি থাকার জন্য কিছু সাধারণ পদ্ধতি শিখিয়ে থাকেন। নিয়মিত প্রতিদিন এর একটি পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে তিন সপ্তাহের মাঝে উল্লেখযোগ্যভাবে একজনের ইতিবাচক মনোভাব এবং আত্মতুষ্টি বৃদ্ধি পাবে। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে-
- তিনটি বিষয় বা ঘটনা লেখা, যার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ
- কাউকে ইতিবাচক কিছু বলা বা লিখে পাঠানো
- ২ মিনিটের জন্য মেডিটেশন করা
- ১০ মিনিট ব্যায়াম করা
- বিগত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি লেখা
সুস্থ অভ্যাস গঠনে
আমরা প্রত্যেকেই চাই আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলো মুছে ফেলতে এবং সুস্থ অভ্যাস গঠন করতে। কিন্তু ব্যাপারটা অতটাও সহজ নয়। আমরা চাইলেই আমাদের অভ্যাসগুলোকে বদলে দিতে পারি না। আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলোও ব্রেইন প্লাস্টিসিটিরই ফসল। কিন্তু দুটি সহজ উপায় অবলম্বন করে সহজেই আমরা নতুন সুস্থ অভ্যাস গড়ে ফেলতে পারি আমাদের সুপার পাওয়ার ব্রেইন প্লাস্টিসিটি ব্যবহার করে।
ছোট ছোট পদক্ষেপ নিন
আমরা যখনই নতুন কোনো অভ্যাস গঠন করতে চাই, প্রথমেই বড় বড় পদক্ষেপ নিয়ে ফেলি বা নেবার চেষ্টা করি। বড় পদক্ষেপগুলো খুব আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়। এর ফলে আমরা সহজেই হতাশ হয়ে যাই। এজন্য শুরুতে ছোট পদক্ষেপ নিয়ে শুরু করুন। ধরুন আপনি প্রতিদিন হাঁটার অভ্যাস শুরু করতে চান। এজন্য আপনি প্রথম দিনই যদি ১ মাইল হাঁটা শুরু করেন, তাহলে আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন, আর হাঁটতে ইচ্ছা করবে না। এজন্য প্রথমে ১০ মিনিট করে শুরু করুন। ধীরে ধীরে সময় বাড়ান। এতে করে অভ্যাসটি ধরে রাখা সহজ হবে।
চেইন ব্রেক করবেন না
যখন আপনি অভ্যাসটি তৈরি করতে থাকবেন, চেইন ব্রেক করবেন না। প্রতিদিন চেষ্টা করতে হবে কাজটি একটু হলেও করার। এতে করে নতুন সিন্যাপ্স কানেকশন তৈরি হবে এবং ধীরে ধীরে আমরা কাজটিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবো।
মস্তিস্কের রোগ এবং ব্রেইন প্লাস্টিসিটি
মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় নিউরোপ্লাস্টিসিটি বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। আলঝেইমার, পারকিন্সন, হান্টিংটন সহ বিভিন্ন রোগে মস্তিস্কের অনেক কোষ নষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে ব্রেইন প্লাস্টিসিটি এদের চিকিৎসায় বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। স্ট্রোক এবং অন্যান্য ব্রেইন ইনজুরির পর দেখা যায় ব্রেইন প্লাস্টিসিটির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে এর পরিমাণ আরো বাড়ানো যায় এবং মস্তিষ্কের যে জায়গাগুলোর ক্ষতিসাধন হয়েছে, তা পূরণ করা যায়। যেসব রোগীর প্যারালাইসিস রয়েছে, তাদের চিকিৎসার জন্যও বর্তমানে ব্রেইন প্লাস্টিসিটির ব্যবহার করা হচ্ছে। এজন্য তাদের মস্তিষ্কে ধীরে ধীরে উদ্দীপনা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়, যা পুরনো নিউরনগুলোকে কার্যক্ষম এবং নতুন নিউরন সৃষ্টিতে সাহায্য করে। এছাড়া মানসিক রোগের চিকিৎসাগুলোতে ব্রেইন প্লাস্টিসিটির মাধ্যমে ব্রেইনের গঠন পরিবর্তন করার মাধ্যমে রোগটিকে সারানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সুতরাং ব্রেইন প্লাস্টিসিটি নিয়ে আরো গবেষণা এবং জানার মাধ্যমে স্ট্রোক, স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি, অস্থিরতা, হতাশা, সিজোফ্রেনিয়া, ডিমনেশিয়াসহ অন্যান্য মানসিক রোগের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা যাবে।
শেষ কথা
আমরা শুরুতেই দেখেছিলাম যে, শিক্ষার্থীরা যখন ব্রেইন প্লাস্টিসিটির ব্যাপারটি বুঝতে পারে, তখন তাদের ফলাফল ভালো হওয়া শুরু করে। Carol Dweck-এর গবেষণা থেকে আরো জানা যায় ছোট এবং বড় উভয়ের মস্তিষ্কে দু’ধরনের মনোভাব বা মাইন্ডসেট দেখা যায়-
১। ফিক্সড মাইন্ডসেট এবং ২। গ্রোথ মাইন্ডসেট
যেসব মানুষের ফিক্সড মাইন্ডসেট থাকে, তারা মনে করে তাদের বুদ্ধিমত্তা এবং আইকিউ সবসময় একই থাকবে। এসকল মানুষ যখন বেড়ে ওঠে, তখনও বদলায় না। তারা নিজেদেরকে আরো বুদ্ধিমান ও ভালো করে গড়ে তোলার চাইতে নিজেদের ভুলগুলো ঢাকতে এবং হতাশাগুলো এড়িয়ে চলতে বেশি পছন্দ করে। যারা গ্রোথ মাইন্ডসেটের অধিকারী, তারা বিশ্বাস করে এবং জানে তারা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে। এ ধরনের মানুষ হতাশাকে ভয় পায় না। এমনকি তারা এগুলোকে তাদের পরবর্তী সাফল্যের ধাপ হিসেবে বিবেচনা করে। বিখ্যাত ব্যক্তিরা সকলেই গ্রোথ মাইন্ডসেটকে বরণ করে নিয়েছেন।
এখন আপনি যদি বুঝতে পারেন আপনি ফিক্সড মাইন্ডসেটের মানুষ, তাহলে হতাশ হবার কিছুই নেই। কারণ ব্রেইন প্লাস্টিসিটিই আপনাকে সাহায্য করতে পারে একটি গ্রোথ মাইন্ডসেট তৈরি করতে। শুধু বিশ্বাস করে নিন, আপনার মস্তিষ্ক বদলাতে পারে। আর এই বিশ্বাসটিই বদলে দেবে আপনার মস্তিস্ককে। এমনকি এই আর্টিকেলটা পড়ার পরই আপনার মস্তিষ্ক আর আগের মতো নেই!