পুরুষাঙ্গ কর্তন করার কেতাবি নাম হচ্ছে ‘খোজা’। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা কিংবা ছোটবেলায় পুরুষালী হরমোন জনিত ত্রুটির কারণেও মানুষ পুরুষত্ব হারিয়ে খোজা হতে পারে। প্রাচীন চীন, অটোমান, ভারতসহ অন্যান্য অঞ্চলে পুরুষত্বহীন খোজার চাহিদা ছিল। উচ্চ মূল্যের কারণে অতি-দরিদ্র পিতামাতারা তাদের ছেলে সন্তানকে খোজা বানিয়ে বিক্রি করে ফেলতো। উচ্চ মূল্য ছিল কারণ এদের দিয়ে রাজকীয় অন্দরমহলে কাজ থেকে শুরু করে হারেমের নারী পাহারার কাজও করানো হতো। এসব ক্ষেত্রে পুরুষত্বহীন করে রাজারা নিশ্চিত হতো তারা নারীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাবে না।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে
এসব ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃতভাবে খোজা হবার বাইরেও জোর করে পুরুষদের লিঙ্গ কেটে দেয়া হতো। জোর করে পুরুষাঙ্গ কেটে দেবার প্রধান কারণ ছিল শাস্তি দেয়া। শাস্তি হিসেবে পুরুষাঙ্গ কেটে দেবার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটতো যুদ্ধ পরবর্তী সময়গুলোতে। যুদ্ধে কোনো দল যখন পরাজিত হয়ে যেত তখন সকল সৈন্যকে বন্দি করে ফেলা হতো। তারপর তাদেরকে যত উপায়ে সম্ভব শাস্তি দেয়া ও অপমান করা করা হতো। শাস্তি হিসেবে যদি তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়া হয় তাহলে সেটি পরাজিতদেরকে শাস্তির পাশাপাশি প্রবল অপমানও করা হতো। এই কাজগুলো করার সময় বিজয়ী দল প্রচুর আনন্দও পেতো।
তার উপর বিপক্ষ দল যেন আর বংশবৃদ্ধি করতে না পারে তার ব্যবস্থাও করা হতো লিঙ্গ কেটে দেয়ার মাধ্যমে। গুরুতর কোনো শাস্তি দিয়ে সৈন্যকে ছেড়ে দিলে সে কয়েকদিন পর ঠিকই সেরে উঠবে এবং সন্তান উৎপাদন করতে পারবে। উৎপাদিত এই সন্তানগুলোই আবার পরবর্তীতে সৈন্য হয়ে উল্টো তাদেরকেই পরাজিত করে ফেলতে পারে। তাই পুরুষাঙ্গ কেটে দিলে সন্তান উৎপাদনের হার কমে যাবে, ফলে প্রতিপক্ষ অনেক বছর ব্যাপী দুর্বল থেকে যাবে, পাশাপাশি হত্যাকারী হিসেবে রাজ্যে দুর্নামও হবে না।
বিপক্ষ দল যদি কাছাকাছি এলাকার হয় তাহলে পুরুষাঙ্গ কেটে দিলে অতিরিক্ত একটি সুবিধাও যোগ হয়। পুরুষত্ব নেই বলে পরাজিত এলাকার মেয়েরা তাদেরকে বিয়ে করবে না বা তাদের সাথে সংসার করবে না। ফলে অল্প হোক বেশি হোক তারা ঝুঁকবে বিজয়ী এলাকার দিকে। ফলে পরোক্ষভাবে বিজয়ী দল পেয়ে যাবে নারীর কিছু অতিরিক্ত যোগান। একসাথে এতগুলো উপযোগ থাকার কারণে প্রাচীনকালে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরাজিত বন্দিদের লিঙ্গ কেটে দেয়া ছিল অন্যতম জনপ্রিয় একটি শাস্তি।
চক্রান্ত করে খোজাকরণ
মধ্যযুগে জর্জিয়ার রাজবংশের অন্যতম একটি দুঃখের অধ্যায় হচ্ছে রাজপুত্র ডেমনা (Demna)-র লিঙ্গ কর্তন। ডেমনা ছিল জর্জিয়ার রাজা পঞ্চম ডেভিডের একমাত্র পুত্র। সেই হিসেবে ডেমনাই ছিল রাজ সিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী। তার বাবাও তাকে পরবর্তী রাজা হিসেবে হিসেবে ঘোষণা করে দেন। ১১৫৫ সালের দিকে রাজা পঞ্চম ডেভিড মারা যায়। তখন থেকেই ন্যায্যত সিংহাসনের মালিক ডেমনা। কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ডেভিডের ভাই তথা ডেমনার চাচা। পুরুষত্ব না থাকলে রাজা হওয়া যায় না, তাই ডেমনার চাচা ডেমনাকে ধরে লিঙ্গ কেটে খোজা করে দেয়। ফলে সিংহাসনের পথ পরিষ্কার হয়ে যায় এবং সে হয়ে যায় রাজা তৃতীয় জর্জ। লিঙ্গ কর্তনের ফলে তৃতীয় জর্জ আরো কিছু সুবিধা পায়। লিঙ্গহীন হবার কারণে ডেমনার কোনো সন্তান হবে না বিধায় নিজের প্রজন্মের সন্তানদের জন্য সিংহাসনের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। তার উপর তৃতীয় জর্জ যেমন স্বজাতির সাথে শত্রুতা করেছে তেমন শত্রুর জন্মা হবে না ডেমনার উত্তরাধিকারে।
লিঙ্গ কর্তন যখন আশীর্বাদের শাস্তি
অনেক দেশেই শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত আছে। কোনো কোনো দেশে শক্তিশালী মানবতার কারণে মৃত্যুদণ্ডের আইন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঐসব দেশে অনেক অনেক বছর শাস্তি হবে কিন্তু মৃত্যুদণ্ড হবে না। রাজা বাদশাহদের আমলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছিল। কেউ কেউ দয়াবান ছিল কিন্তু তাতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। শাস্তি হিসেবে সারাজীবন কয়েদে আটকে রেখে খাইয়ে পড়িয়ে রাজকোষের সম্পদ নষ্ট করার তো কোনো মানে নেই। এর জন্য সহজ একটি সমাধান হতে পারে পুরুষাঙ্গ কেটে খোজা করে দেয়া। মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে অপরাধীকে খোজা করে দেয়াকে তাই একধরনের আশীর্বাদই বলা যায়।
এরকম ঘটনার দুটি আইনের উদাহরণ দেই। প্রাচীন চীনে যুদ্ধবন্দীদেরকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। অনেকদিন ধরে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৯৫০ অব্দে চৈনিক সম্রাট মু-এর মন্ত্রী মারকুইস লু অপরাধীর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের আইন শিথিল করেন এবং এর পরিবর্তে লিঙ্গ কর্তন আইন চালু করেন। আরেকটি উদাহরণ দেই আধুনিক কালের- ১৭৭৮ সালের আগে আমেরিকার ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে ধর্ষণ, বহুগামিতা ও সমকামিতার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। থমাস জেফারসন নামে বিখ্যাত একজন ব্যক্তি অপরাধীর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে লিঙ্গ কর্তনের সুপারিশ করেন।
আধুনিক কালেও বর্বরতা
শাস্তি হিসেবে পুরুষাঙ্গ কর্তনের নজির যে শুধু প্রাচীন রাজা বাদশাহদের আমলেই ছিল তা নয়, আধুনিক যুগেও এর নিদর্শন দেখা যায়। এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে ২০০৫ সালে আফ্রিকাতে। জানজাউইড (Janjaweed) নামে সুদানীয় একটি সশস্ত্র আদিবাসী আছে যারা সময়ে সময়ে ছোট ও বড় হামলা চালিয়ে থাকে। এদের বিস্তৃতি দারফুর, সুদান ও চাদ পর্যন্ত। ২০০৫ সালে এই মিলিশিয়ারা সুদানের দারফুর অঞ্চলে আক্রমণ চালায়। সেখানে তারা যত উপায়ে সম্ভব অত্যাচার চালায়। নারী পুরুষ সকলকে কচুকাটা করে মেরে ফেলে। মারার আগে নারীদেরকে ধর্ষণ করে এবং পুরুষদেরকে লিঙ্গ কেটে খোজা করে ফেলে দিয়ে যায়। প্রবল রক্তপাতের কারণে পুরুষদের প্রায় সকলেই সেখানে মারা যায়।
সময়ের দাবী
আজকের যুগে পত্রিকার পাতা খুললেই এক বা একাধিক ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ধর্ষণ অমানসিকতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে সহ ভারতীয় উপমহাদেশে এর মাত্রা অনেক বেশি। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও ধর্ষণ হয়, কিন্তু সেখানে ধর্ষণের পর খুন করে ফেলার মতো ঘটনাগুলো খুব বেশি ঘটে না, যেমনটা এই অঞ্চলগুলোতে হয়। এর সাম্প্রতিক কালের অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে কুমিল্লার তনু হত্যাকাণ্ড। তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ড্রেনে ফেলে রাখা হয়। তার উপর আছে কিছু পেডোফাইল (paedophile) বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ, যারা পাঁচ বছরের বাচ্চাকেও ধর্ষণ করে। এদের মস্তিষ্ক এতটাই জঘন্য যে, এরা ব্লেড দিয়ে কেটে ছোট শিশুর যোনিপথ প্রশস্ত করে।
এত পরিমাণ ভয়াবহতার বিপরীতে এদের শাস্তি হয় না তেমন। সময়সাধ্য প্রক্রিয়ায় এদের শাস্তি হচ্ছে হচ্ছে করে করে একসময় এরা পার পেয়ে যায়। তাই অনলাইন মাধ্যম সহ অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলোর দাবী ধর্ষণ ও চাইল্ড এবইউজের শাস্তি হিসেবে যেন লিঙ্গ কেটে দেয়া হয়। এর ফলে অপরাধীকে শাস্তি দেবার আইনি জটিলতা কমে যায় এবং দ্রুত সময়ে তা কার্যকরও হয়।