বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে তেল বা জ্বালানি বহুল আলোচিত একটি শব্দ। বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটের অনেক কিছুই এই তেলের সঙ্গে সম্পর্কিত। যে দেশ যত বেশি তেল বা গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ তাদের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোরও রয়েছে বেশ আগ্রহ। তেলের জন্য যুদ্ধকথন তাই আজ আর শুধু মুখের গল্প বা চায়ের কাপেই ঝড় তোলে না, কাগজে কলমেও এর প্রমাণ মেলে। বিগত পাঁচ দশক ধরে ছোট-বড় অনেক যুদ্ধের সূচনা এই তেলের কারণেই সংঘটিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এমনকি এখন সিরিয়া ও ইরাকে যে যুদ্ধ চলছে তার নেপথ্যেও রয়েছে এই তেল। বিভিন্ন যুদ্ধের ভুমিকায় তেলের কারণ উঠে এসেছে এই রকম পাঁচটি যুদ্ধ নিয়ে আমাদের আলোচনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
মানবসভ্যতার ইতিহাসে এযাবৎকালে সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। তৎকালীন বিশ্বে সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দুইটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়, মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেকগুলো কারণের মধ্যে ফ্যাসিবাদকে অন্যতম বলে ভাবা হয়। যদিও এই যুদ্ধের নেপথ্যে তেলের ভূমিকাও কোন অংশে কম নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন চীনে অভিযান চালায় তখন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সুসম্পর্ক হেতু জাপানে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। জাপানের অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল আমদানি করা তেলের ওপর। এতে জাপান যুক্তরাষ্ট্রের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে আক্রমণ চালায়। অন্যদিকে ইউরোপীয় রণক্ষেত্রে সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের তেলসমৃদ্ধ তলপেট দখল করাই ছিল জার্মানদের একটি প্রধান লক্ষ্য। ফলে, তেলের জন্যই যে যত যুদ্ধ তা আর না বোঝার কোন অবকাশ রাখে না।
১৯৫৩ সালের ইরান অভ্যুত্থান
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন মিলে ইরানে অভ্যুত্থান ঘটায়। এই অভ্যুত্থানের পেছনে তেলের স্বার্থ ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। সেই সময়কার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগের সরকারকে তারা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। এর প্রধান কারণ ছিল যে তিনি ইরানে ব্রিটিশ মালিকানাধীন তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেছিলেন। এরপর থেকেই মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে ইরানে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হয়। এর পরিণতিতেই কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হয়, ক্ষমতাচ্যূত হন রেজা শাহ পাহলভি। ১৯৭৯ সালে ঘটা এটি এমন এক অভ্যুত্থান যেটা ইরানকে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির উদারনীতি থেকে আয়াতুল্লাহ খামেনীর ইসলামি রক্ষণশীল দেশে পরিণত করে।
পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ
২ আগস্ট, ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে এই যুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল শেষ হয় ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম নামে সমধিক পরিচিত এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় ইরাক এবং ৩৪টি দেশের জাতিসংঘ অনুমোদিত যৌথ বাহিনীর মধ্যে। ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে ইরাকের কুয়েত আগ্রাসন এবং কুয়েতি ভূখণ্ড দখলের প্রেক্ষিতে ইরাকী বাহিনীর হাত থেকে কুয়েতকে মুক্ত করাই ছিল এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে যেসব যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হতো, সেগুলোতে একটা জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল ‘তেলের জন্য রক্ত নয়’। এই যুদ্ধে তেলের স্বার্থ যে সবচেয়ে বড় ছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ইরাক মূলত কুয়েতের তেল সম্পদের লোভেই প্রতিবেশি দেশ দখল করে নেয়। সাদ্দাম হোসেন অবশ্য কুয়েতকে তাদের একটি প্রদেশ হিসেবে দাবি করে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা কুয়েতকে দখলমুক্ত করে নেয়। এর মূলেও যে তেলের স্বার্থ রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। তারা চেয়েছে কুয়েতের বিপুল তেলের সরবরাহ যেন তাদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তাই তারা কুয়েতকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধ
২০০৩ সালের ২০শে মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ইরাক যুদ্ধ। এই আগ্রাসী বাহিনীতে অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড এবং অন্যান্য কয়েকটি জাতির সৈন্যদল অংশ নিয়েছিল। ইরাক আক্রমণ করার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ও কোয়ালিশন বাহিনী যে কারণ দেখিয়েছিল তা হল: ইরাক ১৯৯১ সালের চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণ করছে এবং তাদের কাছে এ ধরনের অস্ত্রের মজুদও আছে। তখন সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ইরাক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর জন্য বড় ধরণের হুমকি। কিন্তু লোক দেখানো এসব কারণের পেছনে যে মূল কারণ ছিল তেল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যখন ইরাক যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে, তখন তৎকালীন ইরাকি উপ-প্রধানমন্ত্রী তারেক আজিজ বলেছিলেন, ইরাকের তেলের লোভেই পশ্চিমা শক্তি এই যুদ্ধে যাচ্ছে। আরব বিশ্বে সে সময় এই ধারণাটাই আসলে বদ্ধমূল ছিল। ইরাকের রয়েছে বিপুল তেলসম্পদ। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, এই তেলের স্বার্থ ঐ যুদ্ধের অন্যতম কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন, যাদের কোন ভাবেই সাদ্দাম হোসেনের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বলা যাবে না, তারাও এক নিবন্ধে এ কথা স্বীকার করে। ইকোনমিস্টের ঐ নিবন্ধে বলা হয়, ইরাকের বিপুল তেল সম্পদ উন্মুক্ত করা এই অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। অন্যদিকে সাদ্দাম হোসেন যেভাবে এই তেলসম্পদকে ইরাকের প্রভাব বৃদ্ধির কাজে লাগাচ্ছিলেন, সেটা বন্ধ করাও পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্দেশ্য ছিল।
সিরিয়া এবং ইরাকের যুদ্ধ, ২০১১ থেকে বর্তমান
বর্তমানে সিরিয়া আর ইরাকের যুদ্ধ বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ইসলামিক স্টেট ঘোষণা করা সিরিয়ার তেলের যে ভাণ্ডার তার প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর লালায়িত চোখ বহু আগে থেকেই। এই যুদ্ধে তেলের যে বিরাট ভূমিকা আছে তা মোটামুটিভাবে সন্দেহাতীত। কথিত ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের আয়ের বড় উৎস তেল সম্পদ। তারা সিরিয়া তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলের বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করে। ইরাক যুদ্ধের পেছনেও ছিল পশ্চিমা দেশগুলোর তেলের স্বার্থ। ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট প্রতিদিন দুই মিলিয়ন ডলারের তেল বিক্রি করত বলে ধারণা করা হয়। ইরাকের মোসুলের কাছে অনেক তেলকূপও তাদের দখলে। এই তেল নাকি তারা চোরাচালানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পক্ষের কাছে বিক্রি করে। চোরাচালানিরা আবার এই তেল বিক্রি করে সিরিয়ার আসাদ সরকার থেকে শুরু করে প্রতিবেশি তুরস্কের কাছে। রাশিয়া আসলে তাদের অভিযোগে এই বিষয়টির দিকেই ইঙ্গিত করেছে। বিবিসির সংবাদ দাতা ফ্রাংক গার্ডনার বলছেন, তেল নিয়ে এই ব্যবসা যে চলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এতে তুরস্কের সরকার জড়িত থাকার কোন প্রমাণ এখনো নেই।
তেলের জন্য তৈলাক্ত রাজনীতি আজ আর মুখের কথা নয়। বিভিন্ন আগ্রাসানের নেপথ্যে রয়েছে তেলের জন্য লালসা। তেল পশ্চিমা বিশ্বের এক অপরিহার্য উপজীব্য। তেলের জন্য হাহাকার তাই পুরো বিশ্বে। আর এই তেলের বিভিন্ন উৎস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। এই তেলের জন্য এসব দেশকেও কম মূল্য দিতে হচ্ছেনা। প্রতিনিয়ত তেলের চাহিদা বেড়ে চলেছে আর তেল সমৃদ্ধ এসব দেশ দিন দিন আরও ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর কোন সমাধান অদূর ভবিষ্যতেও আছে কিনা তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।