Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অন্ধ সম্রাটের আখ্যান এবং গুলাম কাদিরের প্রতিশোধ

বাবর থেকে আওরঙ্গজেব অত্যন্ত দাপটের সাথে ভারত শাসন করলেও পরবর্তী মুঘল বংশধরেরা সেই ধারা বজায় রাখতে পারেননি। নাদির শাহ মুঘলদের তছনছ করে দেওয়ার পর ক্রমেই হীনবল হতে থাকে এই সাম্রাজ্য। অবশ্য তখনো অযোধ্যা, রাজস্থান বা হায়দ্রাবাদের রাজন্যদের পাশাপাশি মারাঠারা মুঘলদের নামেমাত্র অধীনতা স্বীকার করত। শক্তিহীন সম্রাটেরা নিজেদের ভরণপোষণের জন্য এসব আধা স্বাধীন শাসকদের ওপর নির্ভর করতেন।

স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল সম্রাটদের ভাগ্যে অনেক অপমানজনক ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু রোহিলা আফগান গোলাম কাদিরের পাল্লায় পড়ে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম যে হেনস্থা হয়েছিলেন, তার তুলনা মেলা ভাই। এসব নিয়েই আজকের আলাপ।

পূর্বকথন ও দ্বিতীয় শাহ আলম

১৭৩৯ সালের নাদির শাহী হামলায় মুঘলরা বিধ্বস্ত হলে উত্তর ভারতে মারাঠাদের খুবই বাড়বাড়ন্ত হয়। মুঘল দরবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন উজির উমাদ উল মুলক, তিনি নিজের স্বার্থে মারাঠাদের তোয়াজ করতেন। ওদিকে নাদির শাহের ভয়ে প্রচুর আফগান উত্তর ভারতে এসে আশ্রয় নেয়। এদের অন্যতম নেতা নাজিব খান দিল্লি দরবারে মারাঠাদের উপস্থিতি পছন্দ করছিলেন না। তার সাথে যোগ দেন অযোধ্যার নবাব সুজা উদ দৌলা। তারা আফগানিস্তানের প্রবল নৃপতি আহমেদ শাহ আবদালীকে ভারতে আমন্ত্রণ জানান। ১৭৬১ সালে পানিপথে সম্মিলিত সেনাদলের হাতে মারাঠারা শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। 

দ্বিতীয় শাহ আলম; Image Source: DNA India

যুবরাজ আলী গৌহর উজীর ইমাদের ভয়ে দিল্লি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। পানিপথের যুদ্ধের পর ইমাদকে সরিয়ে নাজিব উজীর হন এবং আবদালীর অনুমতি নিয়ে আলী গৌহরকে সম্রাট ঘোষণা করেন। তার নাম হয় দ্বিতীয় শাহ আলম। যদিও তিনি দিল্লিতে এসে সিংহাসনে বসেছিলেন আরো এক যুগ পর, ১৭৭২ সালে। এর আগেই ১৭৬৫ এর বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে বাংলার নবাব, অযোধ্যার নবাব এবং মুঘল সম্রাটের মিলিত বাহিনী হেরে গেলে মুঘলদের দীনতা আবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় শাহ আলমের আমলে দিল্লির লোকেরা ছড়া কাটত, 

সুলতানাত ই শাহ আলম
আজ দিল্লী তা পালাম

অর্থাৎ, শাহ আলমের রাজত্ব দিল্লি থেকে পালাম পর্যন্ত। পালাম হচ্ছে দিল্লির উপকণ্ঠের একটি জায়গা। 

রোহিলা আফগান ও গোলাম কাদির

আগেই বলা হয়েছে, প্রচুর আফগান উত্তর ভারতে বসবাস শুরু করেছিল। এদেরকে রোহিলা আফগান বলা হতো, কাজেই উত্তর ভারতে এদের আবাসভূমির নাম হয়ে যায় রোহিলাখণ্ড। মূলত কৃষিজীবী হলেও রোহিলারা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, অনেকেই ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে কাজ করত। 

পানিপথের যুদ্ধ; Image Source: India Today

 

১৭৭০ সালে নাজিব খানের মৃত্যুর পর তার ছেলে জাবিতা খানকে মীর বক্সী নিয়োগ দেওয়া হলে তিনি দিল্লি দরবারে নানা ঝামেলা পাকাতে থাকেন। ফলে ১৭৭২ সালে দ্বিতীয় শাহ আলম মারাঠাদের সাহায্যে দিল্লির দখল নেন। তবে শিখ, মারাঠা, অযোধ্যার নবাব, রোহিলাসহ নানা পক্ষে অনবরত যুদ্ধ চলতে থাকে, যার ফলে দেখা গেল, ১৭৭৭ সালে জাবিতা খানের রোহিলা ও ভাড়াটে শিখ সৈন্যরা খোদ মুঘল ও তাদের মিত্র মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধে রোহিলারা হেরে যায়। জাবিতার ছেলে গোলাম কাদির রোহিলাকে বন্দী করে সম্রাটের দরবারে পাঠানো হয়। বালক কাদিরকে খোজা করে প্রাসাদের ভৃত্যের কাজ করানো হতে থাকে।

দ্বিতীয় শাহ আলম পরে জাবিতা খানকে ক্ষমা করে আগের কিছু জমি ফিরিয়ে দেন, কাদিরকেও মুক্তি দেওয়া হয়। ১৭৮৫ সালে জাবিতা খানের মৃত্যু হলে গোলাম কাদির পিতার জমি-জায়গীরের মালিক হন।  

অরক্ষিত দিল্লি

দিল্লি দরবারে মারাঠারা তখন সর্বেসর্বা। মারাঠা সেনাপতি মহাদজী সিন্ধিয়াকে মুঘল সম্রাটের পক্ষে খাজনা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জয়পুর আর যোধপুরের রাজারা বকেয়া ৬৩ লক্ষ টাকা দিতে রাজি না হলে সিন্ধিয়া দলবল নিয়ে যুদ্ধে যান। কিছুদিন পর তার আরেক সেনাপতি অম্বাজী ইঙ্গলেও সিন্ধিয়ার সাথে যোগ দিলে দিল্লি দরবার অরক্ষিত হয়ে পড়ে। 

দিল্লির লাল কেল্লা; Image Source: DNA India

ওদিকে রাজপুতদের সাথে যুদ্ধের সময় মুঘল সেনাপতি ইসমাইল বেগ হামদানী মারাঠাদের পক্ষত্যাগ করে আগ্রার দখল নেন। তখন দিল্লি রক্ষার জন্য বিশেষ কোনো সেনাদল আর ছিল না। গোলাম কাদির এ সুযোগে ইসমাইল বেগের সাথে জোট বেঁধে দু’হাজার সৈন্য নিয়ে দিল্লি আক্রমণ করেন ও সম্রাটকে জিম্মি করে ফেলেন। মারাঠা প্রতিনিধিরা দিল্লি ছেড়ে পালায়। গোলাম কাদির নিজেই এবার মীর বক্সী উপাধি আদায় করে দোয়াব অঞ্চলে টাকা তুলে সেনাদল জড়ো করতে থাকেন।

ওদিকে সিন্ধিয়া রাজপুতদের সাথে যুদ্ধে সুবিধা করতে পারেননি তিনি। বেতনের দাবিতে মারাঠা ছাউনিতে নানা গোলমাল বাধে, ফলে চাইলেও সিন্ধিয়ার পক্ষে দ্রুত দিল্লি আসা সম্ভব হলো না। দিল্লির নিয়ন্ত্রণ চলে গেল গোলাম কাদিরের হাতে। তার মিত্র ইসমাইল বেগ আগ্রা আটকে মারাঠাদের ঠেকাবার ব্যবস্থা করলেন। সম্রাট এখন অসহায়। আগে তিনি ছিলেন মারাঠাদের পুতুল, এখন তাকে কব্জা করল প্রতিশোধের নেশায় মত্ত গোলাম কাদির রোহিলা।

গোলাম কাদিরের প্রতিশোধ

দিল্লি দরবারে মারাঠা বিরোধীরা গোলাম কাদিরকে সমর্থন জানান। গোলাম কাদির ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী আর খ্যাপাটে, নিজেকে দাবি করতেন ‘স্রষ্টার চাবুক’ বলে। হিন্দু মারাঠাদের বিরুদ্ধে ঘোষিত হয় যুদ্ধ। ১৭৮৮ এর ১৫ জুলাই শেষবারের মতো আফগানরা দিল্লি দরবার সম্পূর্ণ নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসে। প্রাসাদরক্ষীরা সব পালাল। ৩০ জুলাই সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমকে সিংহাসনচ্যুত করে বিদর বখত নামের এক যুবরাজকে সিংহাসনে বসানো হয়।

এবারে গোলাম কাদির অর্থ আর ধনরত্নের লোভে শুরু করলেন ভয়ানক অত্যাচার। প্রাসাদ আর ধনী ব্যক্তিদের আবাসে হানা দেওয়া হলো, বাদ গেল না হারেমের নারীরাও। রাজকন্যাদেরকে ধর্ষণ করে, অন্তঃপুর তছনছ করে গোলাম কাদির অন্যায়ের চূড়ান্ত করে ছাড়েন। রাজপরিবারের মোট ২১ জন নারী ও শিশু ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা পড়ে। যুবরাজদের চাবুক মেরে কারাগারে পাঠানো হয়। অপমানিত নারীরা অনেকেই যমুনায় আত্মঘাতী হন। 

সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটল ১৭৮৮ এর ১০ আগস্ট। খোদ দ্বিতীয় শাহ আলমের চোখ নিজের হাতে উপড়ে ফেলে এই আফগান রোহিলা। দুজন রাজকর্মচারী বাধা দিতে এলে তাদেরকেও কেটে ফেলা হয়। দরবারের চিত্রকরকে দিয়ে অন্ধ প্রাক্তন সম্রাটের ছবি আঁকানো হলো। মুঘল সম্রাটদের ইতিহাসে এমন ভয়ানক অপমানের ঘটনা অভূতপূর্ব।

মারাঠা ত্রাতা 

গোলাম কাদির ভয়ানক লোভী ছিলেন। তার মিত্র ইসমাইল বেগকেও তিনি লুটের বখরা না দিলে ইসমাইল সিন্ধিয়ার পক্ষে যোগ দেন। কিন্তু মারাঠাদের আসতে আসতেই প্রায় ১০ সপ্তাহ পার হয়ে যায়। সিন্ধিয়া সৈন্যদের বেতন-ভাতা জোগাড় করতে গিয়ে বেশ দেরি করে ফেলেছিলেন। কাদির আবার নদীর সমস্ত নৌকা ডুবিয়ে মাঝিদের সরিয়ে দিয়েছিলেন, ফলে সেনা চলাচল ব্যাহত হতে থাকে। 

মারাঠা সেনাদল; Image Source: Outlook India

 

মুঘল সম্রাট হীনবল হলেও তার চোখ উপড়ে নেওয়ার মতো বিষয়কে ভারতের কোনো রাজন্যই স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। হাজার হোক, তখনও ভারতকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীন বলেই প্রচার করা হয়। কাজেই গোলাম কাদিরের মিত্র বলে কেউ আর রইল না। সেনাপতি মহাদজী সিন্ধিয়া আগ্রা দখল করে নেন। 

১৭৮৮ এর অক্টোবরে মারাঠারা পুনরায় দোয়াব অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে দিল্লিতে হানা দেয়। বিপদ বুঝে গোলাম কাদির তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে পালান। পথিমধ্যে এক যুদ্ধে জিতলেও তার পক্ষে ক্রমাগত মারাঠা হামলা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছিল না। কাদিরের বড় দুর্গ আলীগড় মারাঠারা দখল করে নেয়। নভেম্বরের শেষ নাগাদ গোলাম কাদির আশ্রয় নেন মীরাট দুর্গে। যথারীতি মারাঠারা এসে দুর্গ অবরোধ করে। রাতে গোলাম কাদির দুর্গ ছেড়ে পালাতে গেলে মারাঠা অশ্বারোহীরা আক্রমণ করে। কাদির অন্ধকারে পথ হারিয়ে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ঐ ব্রাহ্মণ মারাঠা শিবিরে খবর দিলে পরদিন গোলাম কাদিরকে পাকড়াও করা হয়। 

গোলাম কাদিরের শেষ পরিণতি

মহাদজী সিন্ধিয়া পুনরায় দ্বিতীয় শাহ আলমকে সিংহাসনে বসান। অন্ধ সম্রাট বায়না ধরলেন, গোলাম কাদিরের চোখ তুলে ফেলতে হবে, নইলে তিনি বিবাগী হয়ে মক্কা চলে যাবেন। ১৭৮৯ এর ৩রা মার্চ গোলাম কাদিরের চোখ তুলে শাহ আলমের কাছে পাঠানো হয়। এরপর তাকে হাত-পা কেটে হত্যা করা হয়। কথা ছিল, গোলাম কাদিরের দেহ দিল্লিতে পাঠানো হবে, কিন্তু মৃত্যুর তিন দিন পর মৃতদেহ অদৃশ্য হয়ে যায়। স্থানীয় লোকেরা বলে, গোলাম কাদির রোহিলা ছিল শয়তানের শিষ্য এবং শয়তান ওর দেহ ফেরত নিয়ে গিয়েছে। 

দ্বিতীয় শাহ আলমের সমাধি; Image Source: lighteddream.wordpress.com

অন্ধ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ১৮০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন তার নাতি।

This article is about Mughal Emperor Shah Alam the Second and an Afghan warlord named Ghulam Qadir Rohila. 

References:

1. মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস, অনিরুদ্ধ রায়, প্রগতিশীল প্রকাশক, কলকাতা

2. The Hour of the Rohila 

3. Cursed by imperial birth

Featured Image: DNA India

Related Articles