তারা ছিলো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন জাতি। যুদ্ধ এবং শান্তি- উভয় ক্ষেত্রেই অগ্রগতি সাধন করেছিলো। লেখালেখি, শিল্প, নৌবিদ্যা এবং শাসনব্যবস্থাতে দেখিয়েছে অসাধারণ যোগ্যতা।
উক্তিটি স্প্যানিশ লেখক পমনিয়াস মেলা করেছিলেন ফিনিশীয় সভ্যতা নিয়ে। ইতিহাসে যে কয়েকটি জাতি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তার মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে তাদের অনুসরণ করেছে অনেকেই।
গল্পের শুরুটা নব্য প্রস্তর যুগে। ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে আস্তে আস্তে মানুষের বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে। সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে উগারিত, আরাদুস, তারাব্লুস (ত্রিপলি), বেরিতুস (বৈরুত) এবং টায়ারের মতো একের পর এক নগরী। লোকগুলো ইতিহাসে কানানাইট নামে পরিচিত। এই কানানাইটরা সময়ের সাথে সাথে তিনটি আলাদা অঞ্চলে বিভাজিত হয়ে পড়ে। দক্ষিণে ফিলিস্তিনীয়, মাঝখানে হিব্রু এবং উত্তর দিকে ফিনিশীয়। নিজেদের কেনানীয় বলে পরিচয় দেয়া এই ফিনিশীয় জাতি বিশ্ব সভ্যতায় নতুন মাত্রা যোগ করলো। শুধু বর্ণমালা বা নৌবাণিজ্য না, তারাই প্রথম উদাহরণ সৃষ্টি করলো সার্থক উপনিবেশবাদের।
পরিচিতি এবং উত্থান
গ্রিক শব্দ Phoinikes থেকেই মূলত ফিনিশীয় নামের উৎপত্তি, যার অর্থ Purple বা বেগুনি রং। প্রাচীন ভূমধ্যসাগরের বিশেষ খোলসযু্ক্ত মাছ এবং শামুক থেকে বেগুনি রং আহরণ করা হতো। আর এর সাথে জড়িতদের গ্রিকরা বলতো ‘বেগুনি বর্ণের মানুষ’। পরবর্তীতে পূর্ব ভূখণ্ডে বসবাস করা সেমেটিক গোষ্ঠীভুক্ত কেনানাইটরাই ফিনিশীয় বলে খ্যাত হয়। সর্বপ্রথম ফিনিশীয় শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় গ্রিক মহাকবি হোমারের লেখায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ সিরিয়া, উত্তর ইসরায়েল ও লেবাননের উপকূলীয় অঞ্চলে সংগঠিত বসতি স্থাপন করে তারা। আদি আবাস ছিলো পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে। অনেকেই তা বর্তমান বাইরাইন বলে দাবি করেন।
সে যা-ই হোক, ভূমধ্যসাগরীয় পূর্বাঞ্চলে কৃষিভূমির পরিমাণ কম থাকায় তারা সমুদ্রের দিকে ঝুকে পড়ে জীবন ও জীবিকার জন্য। খ্রিস্টপূর্ব ২৭০০ সালেই মিশরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৫৫০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে ফিনিশীয় অঞ্চল পরিণত হয় প্রদেশে। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে সিডন, টায়ার, বিবলোস এবং আরদুসকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। বলা বাহুল্য, এদের প্রথম তিনটি বর্তমান লেবানন এবং শেষটি বর্তমান সিরিয়ায় অবস্থিত। যদিও রাজনৈতিক কাঠামোর চেয়ে বাণিজ্যিক প্রতিপত্তি তৈরির প্রতিই তাদের অধিক মনোযোগী দেখা যায়। তবু মিশর, এশিয়া মাইনর, বলকান অঞ্চল এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এ প্রসঙ্গে বলেন-
ফিনিশীয়রা প্রথমদিকে ইরেথ্রিয়ান সাগরের উপকূলে বসবাস করতো। তারপর ভূমধ্যসাগরের তীরে আগমন করে এবং বর্তমানে (হেরোডোটাসের সময়) যেখানে আছে, সেখানে স্থায়ী হয়। অ্যাসেরীয় এবং মিশরীয়দের পণ্যসামগ্রী নিয়ে সমুদ্র বাণিজ্য ও অভিযাত্রা শুরু করে।” (Herodotus, the History – 1. 1)
রাজনৈতিক ধারাবিবরণী
সিডনের প্রধান্য ছিলো অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সাল পর্যন্ত। তারপর ধীরে ধীরে টায়ারের আধিপত্য বেড়ে যায়। ওল্ড টেস্টামেন্টে টায়ারের রাজা হিরাম ও জেরুজালেমের হিব্রু রাজা দাউদের মধ্যকার মিত্রতার কথা আছে। বলা হয়েছে,
টায়ারের রাজা হিরাম দাউদের কাছে দূত, কাঠ, ছুতার ও ভাস্করদের পাঠালেন। তারা একটা গৃহ নির্মাণ করলো দাউদের জন্য। (স্যামুয়েল, ২, ৫: ১০)
খ্রিস্টপূর্ব ৯৭০ সালের দিকে সলোমন ক্ষমতায় এলে দক্ষিণের শহরগুলো ফেরত পায় ফিনিশীয়রা। এ প্রসঙ্গে বাইবেলের অভিমত,
প্রভুর গৃহ ও রাজপ্রাসাদ- এই দুটি নির্মাণের জন্য সলোমনের বিশ বছর সময় লাগলো। যেহেতু টায়ারের রাজা হিরাম তার ইচ্ছা অনুসারে সমস্ত এরস কাঠ, দেবদারু কাঠ ও সোনা যুগিয়ে দিয়েছিলেন, সেজন্য কাজ শেষে সলোমন হিরামকে বিশটি শহর দান করলেন। শহরগুলো অবস্থিত ছিলো গ্যালিলিয়া প্রদেশেই। (রাজাবলি-১, ৯:১০)
সলোমনের পরেও ফিনিশীয়দের সাথে হিব্রুদের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিলো। খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ সালের দিকে হিব্রু রাজা উমরির ছেলে অহরের সাথে টায়ারের রাজা ইথোবেলের মেয়ে জেজেবেলের বিয়ে হয়। এরপরেও উভয়ের মাঝে সম্পর্ক ছিলো বেশ পোক্ত। কিন্তু ৮৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই তাদের শান্তিতে ভাগ বসাতে আসে অ্যাসেরীয় রাজা দ্বিতীয় আসুরবানিপাল। ফিনিশীয় অঞ্চলগুলো বাধ্য হলো কর দিতে। ৮৫৩ খ্রিস্টপূর্বেই তারা অ্যাসেরীয় বিরোধী সম্মিলিত প্রতিরোধ গঠন করলো। এরপর সুদীর্ঘ সময় ধরে ফিনিশীয়দের সাথে অ্যাসেরীয়দের সংঘাত ও টানাপোড়েন চলতে থাকে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ফিনিশীয়রা। নগরীর পর নগরী ধ্বংস করে দেয়া হয়। ৭০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যাসেরীয় রাজা সিনেচেরিব টায়ারের রাজা লুলিকে সাইপ্রাসে নির্বাসনে পাঠান। পরবর্তীতে মিশরের শক্তি বৃদ্ধি ঘটলে ফিনিশীয়রা মিশরীয়দের সাথে অ্যাসেরীয় বিরোধী জোট করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।
এদিকে ক্যালিডিয়দের হাতে ৬১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পতন ঘটে অ্যাসেরীয়দের। নেবুচাদনেজার (খ্রিস্টপূর্ব ৬০৪-৫৬১) জেরুজালেম দখল করে নেন ৫৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এর প্রায় ত্রিশ বছর পর টায়ার তার হস্তগত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে পারসিক সম্রাট সাইরাসের বিজয়ের আগপর্যন্ত ফিনিশীয়রা ছিলো ক্যালেডীয়দের অধীনে। পারস্য আমলেও তারা নৌশক্তিতে ব্যাপক পারঙ্গমতা দেখাতে সমর্থ হয়। গ্রিকদের সাথে পারস্যের সংঘাত হলে ফিনিশীয়রা পারস্যের পক্ষ নেয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ এবং ৫ম শতকে ফিনিশীয়রা গ্রিকদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে যায়। এরপর ৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসিডোনিয়ান বীর আলেকজান্ডার টায়ার অভিযান চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে পতন ঘটে যুগ যুগ ধরে আধিপত্য বিস্তার করে থাকা ফিনিশীয়দের।
ফিনিশীয় উপনিবেশ
ইতিহাসে তারাই প্রথম অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে সার্থক উপনিবেশ ধারণার জন্ম দেয়। অ্যাসেরীয় আক্রমণে সৃষ্ট অস্থিরতার আগেই ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত হয় উপনিবেশ। খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ সালের দিকে স্থাপিত হয় তিউনিশিয়ার উটি, ইজিয়ান সাগরের রোডস, মেলোস, সিয়েরো, থামোস এবং স্পেনের কেদিজ-এ। আস্তে আস্তে সাইপ্রাস, সিসিলি, মরক্কো এবং কিছু দ্বীপও নিয়ন্ত্রণে আসে।
খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকের মাঝামাঝি মালচুস গ্রিকদের পরাজিত করে কার্থেজ দখল করে। ফিনিশীয়দের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ছিলো উত্তর আফ্রিকার এই কার্থেজ। কিংবদন্তী অনুসারে কার্থেজ ৮১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রানী দিদোর মাধ্যমে স্থাপিত হয়। কার্থেজ শব্দটি এসেছে Qart-hadast থেকে, যার অর্থ নতুন গ্রাম। টায়ারের নেতৃত্বে গড়ে উঠা এই নগরী কালে কালে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য নিয়ে রোমকে পর্যন্ত নাকানিচুবানি খাওয়ায়। কার্থেজ ফিনিশীয়দের অধিকারে থাকে প্রায় দুইশো বছর। দীর্ঘ সংঘাতের পর ৩৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কার্থেজ গ্রিকদের কাছে নত হয়। পিউনিক যুদ্ধের সময় রোমানরা পুরোপুরি গুড়িয়ে দেয় নগরটাকে।
যা-ই হোক, ফিনিশীয়দের উপনিবেশের মোট সংখ্যা পঞ্চাশ ছিলো বলে দাবি করা হয়। বাণিজ্যিক প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য নতুন বাজার, বন্দর ও পণ্যের চাহিদার প্রয়োজনে গড়ে তোলা হয়েছিলো। কোনো কোনোটিতে কেবল স্থাপিত হয়েছিলো গুদাম ও বিক্রয় কেন্দ্র, কোনোটিতে নির্মিত হয়েছে দুর্গ, আবার কোনো উপনিবেশ ছিলো যথার্থভাবেই স্থায়ী।
প্রশাসন ব্যবস্থা
ইতিহাসের অধিকাংশ সময় ফিনিশীয় রাজনীতি ছিলো অনেকটা কনফেডারেশন ধরনের। গোড়ার দিকে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের করদ প্রদেশ হিসাবে থাকলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। মিশর, ক্রীট ও হিট্টাইটদের পতনের কারণে স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায় তারা। সিডানে Tetramnestos, টায়ারে Mattan এবং আরাদোসে Marbalos নামের তিনজন শাসক মিলে একটা কনফেডারেশন গঠন করে। এই কনফেডারেশন ছিলো মূলত গ্রিক শক্তির বিরোধী। তারপরেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেয়ে ফিনিশীয়রা বাণিজ্যিক প্রাধান্য বিস্তারে গুরুত্ব দিতো। কার্থেজের মতোন কিছু অঞ্চলের ছিলো পৃথক মুদ্রা।
প্রত্যেক শহরের আলাদা প্রতিরক্ষা, সৈন্য ও নৌবহর ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দিকে তিউনিশিয়া, উতিকা, হাদ্রমেতাম ও অন্যান্য স্বাধীন অঞ্চল নিয়ে কার্থেজ রাষ্ট্র গঠিত হয়। তবে তা ছিলো নগর রাষ্ট্র। ফিনিশীয়রা পারসিক অধীনে থাকার সময় ধনী ব্যবসায়ীদের নিয়ে জ্যেষ্ঠ কাউন্সিল গঠন করে, যা ছিলো অনেকটা রাজার উপদেষ্টা পরিষদের মতো। এরিস্টটল মনে করেন, সমস্ত ক্ষমতা পরিচালিত হতো দুজন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে। আজীবনের জন্য নির্বাচিত হতো ৩০০ সদস্যের বিশেষ সিনেট। আর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হতো ১০৪ সদস্যের সাধারণ সভা।
অর্থনীতি
প্রথম দিকে কৃষি ও পশুপালনের প্রতি নির্ভরশীল থাকলেও ক্রমে ফিনিশীয়রা বহির্বাণিজ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। উপত্যকায় আঙুর, জলপাই ও খেজুরের চাষ হতো। পশুর মধ্যে থাকতো গাধা ও ভেড়া। পরবর্তীতে নগরগুলো শিল্পজাত নানা পণ্যে ব্যাপকতা লাভ করে। জাহাজ নির্মাণে তাদের কৃতিত্ব প্রবাদ প্রতীম।
দুই ধরণের জাহাজ মূলত তৈরি করতো বাণিজ্যিক পণ্যের জন্য গোল জাহাজ এবং যুদ্ধের জন্য লম্বা জাহাজ। এছাড়া ছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ ধরার নৌকা। রাতে তারা যাতায়াত করতো ধ্রুবতারা লক্ষ্য করে। স্পেন থেকে রৌপ্য ও টিন, আফ্রিকা থেকে সোনা ও হাতির দাঁত এবং আরব থেকে সুগন্ধি দ্রব্য নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করতো। মিশরীয় ও হিব্রুদের সাথেও তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো সন্তোষজনক। রজার্স ও এডামস্ এ সম্পর্কে বলেন-
“ফিনিশীয়রা যথার্থভাবেই ইতিহাসে প্রথম বাণিজ্যিক পরাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। ভূমধ্যসাগরের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ এতটাই ফলপ্রসূ ছিলো যে, তার জনগনই ছিলো ভূমধ্যসাগরের নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী”।
বয়নশিল্পে ফিনিশীয়দের দক্ষতা ছিলো উল্লেখযোগ্য। মুরেক্স হোয়েল্ক প্রজাতির শামুক থেকে তৈরি করা হতো রং। হিব্রু গ্রন্থসমূহে ও গ্রীক মহাকবি হোমারের লেখায় তাদের কাঠ, কাপড় ও অলঙ্কারের প্রশংসা আছে।
ধর্মবিশ্বাস ও আচার
ফিনিশীয় ধর্মবিশ্বাসে কানানাইট প্রভাব বিদ্যমান। তারপরেও অঞ্চল ভেদে বিশ্বাস ও চর্চার মধ্যে যথেষ্ট ফারাক দেখা যেতো। বিবলোস এর প্রধান উপাস্য ছিলো এল, বাআলাত এবং আদোনিস। এল এর ধারণা নিহিত সেমেটিক বিশ্বাসের ভেতর। দেবতা হিসেবে এর প্রধান্য মেনে নেয়া হলেও দৈনন্দিন জীবনে এর কোন সক্রিয়তা দেখা যেতো না। অনেকটা গ্রীক দেবতা ক্রোনাসের মতো। ভূমি ও উর্বরতার দেবী ছিলেন বাআলাত। তাকে তুলনা করা যায় মেসোপটেমীয় সভ্যতার ইশতার এবং মিশরীয় সভ্যতার আইসিসের সাথে। অন্যদিকে আদোনিসকে পরিচিত করা যায় অনেকটা ঋতুচক্রের ব্যাক্তিরূপ হিসাবে। পাশ্ববর্তী মিশরীয় সংস্কৃতির ওসিরিসকে স্মরণ করা যায় এদিক থেকে। সিডনের প্রধান দেবতা বাআল, বিবলোসের এল-এর সাথে তুলনীয়। চন্দ্র, প্রেম আর প্রাচুর্যের জন্য দেবী আসতারতের উল্লেখ আছে শিলালিপিতে।
সিডনের রাজারা আসতারতের যাজক হিসাবে গণ্য হতেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতকের দিকে এশমুন নামক এক দেবতার নাম পাওয়া যায়। চিকিৎসার সাথে সম্পর্কিত এই দেবতাকে গ্রীক দেবতা আসক্লিপিয়াসের সাথে তুলনীয়। টায়ার অঞ্চলের প্রধান দেবতা মেলকার্ত। সমুদ্র, শিকার এবং রাজত্বের প্রতীক হিসাবে উপকূলবর্তী অঞ্চলে তার জনপ্রিয়তা ছিলো তুঙ্গে। টায়ারের মুদ্রায় তার ছবি অঙ্কিত ছিলো। হেরোডোটাস তার নামে নির্মিত একটা মন্দিরে গমন করেন। খুব সম্ভবত কার্থেজ থেকে আমদানী করা হয় মেলকার্তের ধারণা। অন্যান্য দেবতার মধ্যে আগুন ও আলোর দেবতা রেশেফ এবং শষ্যের দেবতা দাগুনের নাম গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া চিকিৎসা ও সর্পদেবতা শদ্রপা, লোহা ও নির্মাণসামগ্রীর দেবতা ছুসর, সততা ও ন্যায়বিচারের দেবতা সিদিক ও মিসোর এবং অন্যান্য বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেবতার সংশ্লিষ্টতা ফিনিশীয়দের জীবনে বৈচিত্র্য এনেছিলো। সাধারণত উপাসনার জন্য মন্দির নির্মিত হলেও নদী, পাহাড়, গাছ এবং পাথরকে পবিত্র স্থান হিসাবে গণ্য করা হতো। এজন্যই নদীর সাথে দেবতাদের নাম সংযুক্ত হতো। খাদ্য, পানীয় কিংবা পশু-পাখি বলি দেবার প্রথা বিদ্যমান ছিলো। বিভিন্ন দুর্যোগে কিংবা যুদ্ধে মানুষ বিশেষ করে শিশু বলি দেবার প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৯ সালে কার্থেজে মেলকার্তের উদ্দেশ্যে ৩০০০ বন্দিকে বলি দেবার কথা জানা গেছে।
কবর ও পরজীবন
কবর দেবার প্রথায় ফিনিশীয়দের সাথে মিশরীয়দের ব্যাপক সাদৃশ্য দেখা যায়। বিবলোস ও সিডনের কবরগুলো ৬ মিটার বা তারচেয়ে বেশি গর্ত ছিলো। সিডনের কবর ছিলো নিচে পাকা করা। মোতিয়া ও কার্থেজের নিদর্শন দেখে বলা যায়, কবর দেয় হতো লোকালয় থেকে দূরে। তিউনিশিয়ায় সমাধিসৌধ পাওয়া গেলেও ফিনিশীয়রা সমাধিতে সৌধ নির্মাণে অতোটা আগ্রহী ছিলো বলে মনে হয় না। কবর দেবার সময় সর্বত্র কফিনসহ কবরের প্রথা প্রচলিত ছিলো।
মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ফিনিশীয়রা খুব একটা গুরুত্ব দিতো না। মৃত ব্যাক্তি নিয়ে তাদের মাঝে খুব একটা কৌতূহলও ছিলো না। মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে তারা অস্তিত্বহীন মনে করতো বলেও অনেকে দাবী করেন।
বর্ণমালা ও লিখনপদ্ধতি
সভ্যতায় ফিনিশীয়দের সবথেকে বড় অবদান বর্ণমালা আবিষ্কার ও তার ব্যাপক প্রচলন। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৬০০ সালের মধ্যে খুব সম্ভবত তারা মিশরীয়দের থেকে প্রভাবিত হয়ে অপেক্ষাকৃত সরল লেখার পদ্ধতির জন্ম দেয়। কিছু কিছু শব্দ ও প্রয়োগরীতি হিব্রু থেকে উৎসারিত হলেও এরা পৃথকভাবে বেড়ে উঠেছে বলে দাবি করেছেন রজার্স ও এডামস্। বাণিজ্যিক কারণেই হিসাব ও সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। প্রয়োজন পড়ে অপেক্ষাকৃত সহজ বর্ণমালার। ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ২২ টি ব্যঞ্জনবর্ণ উদ্ভাবিত হয়। এই বর্ণমালাকে বলা হতো আবজাদ। প্রথম তিন বর্ণ ছিলো যথাক্রমে আলেফ, বেথ, জিমেল।
খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ সালের দিকে গ্রীকরা এর সাথে স্বরবর্ণ যোগ করে বর্ণমালায় পূর্ণতা আনে। গ্রীস থেকে এই বর্ণমালা যায় রোমানদের হাতে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ এই পদ্ধতি পরবর্তীতে গ্রহণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে। বর্তমানের অনেক ভাষার বর্ণমালাই তার বংশধর। ফিনিশীয়রা কাগজ, কালি ও কলমের বিবর্তনেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
পরিশিষ্ট
এশিয়ার মেসোপটেমীয় ও হিব্রু সংস্কৃতি, আফ্রিকার মিশরীয় সংস্কৃতি এবং ইউরোপের গ্রীক সংস্কৃতি মিলিত হয়েছিলো ভূমধ্যসাগরের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। ফিনিশীয়রা সকল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক জ্ঞানকে একত্রিত করে গড়ে তুলেছে সম্পূর্ণ স্বাধীন এক প্রাগ্রসর সংস্কৃতি, যা পরবর্তী সভ্যতাগুলোকে প্রভাবিত করেছে ব্যাপকভাবে। একারণেই মানুষের অর্থনৈতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ইতিহাসে তাদের সময়কাল প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের মিলনবিন্দু।