
চীনের বর্তমান রাজধানী বেইজিং। কিন্তু চীনের আরেকটি ঐতিহাসিক শহর রয়েছে, যেখান থেকে সমগ্র চীন হাজার হাজার বছর শাসিত হয়েছে। সেই প্রাচীন রাজধানীটির নাম নানজিং। ৩য় শতক থেকে শুরু করে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই শহরটি। ইয়াংজি নদীর তীরে অবস্থিত নানজিংকে ‘চীনের প্রাচীনতম চার রাজধানী’র অন্যতম রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এমন সব গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে নানজিং এখনও দাঁড়িয়ে আছে স্বমহিমায়, যার চারদিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য আধুনিক ও প্রাচীন স্থাপত্যের সমাহার, সুউচ্চ ভবন ও চূড়ান্ত আধুনিকতার ছোঁয়া সমৃদ্ধ শহর। আজকে আমরা সেই ঐতিহ্যবাহী রাজধানী নানজিং সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

রাজধানী হিসেবে নানজিং
ইতিহাসের পালাবদলে নানজিং শহরটি কমপক্ষে ৭ বার রাজধানী হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। ২২৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম নানজিং রাজধানীর মর্যাদা পায়। ২২০ খ্রিস্টাব্দে চীনে ‘সান উউ’ বা ‘ডং উউ’ নামের একটি রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। ২৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উক্ত রাজবংশের শাসন অব্যাহত ছিল। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সান কুয়ান ২২৯ সালে নানজিংকে তাদের রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। ২৮০ সালে উক্ত রাজবংশের পতন ঘটলে নানজিং সাময়িকভাবে রাজধানীর মর্যাদা হারায়।

এরপর ৩১৭ সালে চীনে ‘জিন রাজবংশ’ নামের আরেকটি রাজবংশ শাসন প্রতিষ্ঠা করলে নানজিং ফের রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। এরপর ধারাবাহিকভাবে লুই সং রাজবংশ, কুই রাজবংশ, লিয়াং রাজবংশ ও চেন রাজবংশ নানজিংকে রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রাখে। ৫৮৯ সাল পর্যন্ত এসব রাজবংশের শাসন অব্যাহত ছিল।
৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে চীনে ‘ট্যাং রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হলে নানজিং আবার রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। এ দফায় নানজিং ৯৭৬ সাল পর্যন্ত রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল।
১৩৬৮ সালে চীনে ‘মিং রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা নানজিংকে তাদের রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করে। এতে নানজিং পুনরায় রাজধানীর মর্যাদা ফিরে পায়। এ দফায় টানা ২৭৬ বছর নানজিং রাজধানী হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকে। ১৬৪৪ সালে মিং রাজত্বের অবসান ঘটলে নানজিং রাজধানীর মর্যাদা হারায়।

১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে চীনে ‘থাইপিং হ্যাভেনলি কিংডম’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজ্যকে তারা নাম দিয়েছিল ‘শান্তির স্বর্গরাজ্য’। তারাও নানজিংকে তাদের রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করে। এ সময় নানজিংয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘তিয়াঞ্জিং’ রাখা হয়, যার অর্থ ‘স্বর্গীয় রাজধানী’। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে চীনে জাতীয়তাবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাংবিধানিকভাবে এই সরকার ‘রিপাবলিক অফ চায়না’ নাম ধারণ করে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সরকারের শাসন ব্যবস্থা বহাল ছিল। এই সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে কয়েকটি শহরকে চীনের রাজধানী করা হয়। এর মধ্যে ১৯২৮-১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নানজিংকে রাজধানীর মর্যাদা প্রদান করা হয়।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে চীন ও জাপানের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে ১৯৪০ সালে চীনে জাপানের অনুগত একটি পুতুল সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের নাম দেয়া হয় ‘রি-অর্গানাইজড ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট অফ দ্য রিপাবলিক অফ চায়না’। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই সরকার টিকে ছিল। উক্ত সরকারও নানজিংকে তাদের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা প্রদান করে। ১৯৪৯ সাল থেকে বেইজিং চীনের রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
যেসব কারণে নানজিং এখনো আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে
চীনের সুন্দরতম শহরগুলোর একটি হচ্ছে নানজিং। সমগ্র চীনের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা হারালেও নানজিং এখনো জিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী হিসেবে অধিষ্ঠিত আছে। সবুজ উদ্যান, প্রাকৃতিক হ্রদ, ছোট ছোট পাহাড়, ঐতিহাসিক ভবন ও নানা রহস্যময় স্থাপত্যের কারণে নানজিং এখনো বিশ্ববাসীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এসব ঐতিহাসিক স্থাপনায় ভ্রমণ করতে আসেন। এমন কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনার সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
প্রাচীন পাথুরে শহর
প্রাচীনকালে নানজিংয়ে একটি পাথুরে শহর গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, শহরটি ৪৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল। তাদের তথ্যানুসারে, ঝু রাজবংশের শাসনকর্তারা তাদের রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য এই শহরটি নির্মাণ করে। পরবর্তীকালে হান রাজবংশের শাসনকর্তারা এই শহরটির সম্প্রসারণ করেন।

শহরের পাথর নির্মিত দেয়ালগুলোর পরিধি প্রায় ৯,০০০ মিটার। শহরের মাঝখানে অবস্থিত একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঁ সাম্রাজ্যের শাসক সান কুয়ান (১৮২-২৫২) একটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করেন। পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ইয়াংজি নদী। সৈনিকদের নৌ-প্রশিক্ষণ ও বহিঃশত্রুদের পর্যবেক্ষণের জন্য এই কেন্দ্রটি ব্যবহৃত হত।
ফুল বৃষ্টির চত্বর
কথিত আছে, প্রায় ১,৪০০ বছর আগে এখানে অ্যাবট ইয়ংআং নামক একজন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক শান্তির বাণী প্রচার করতে নানজিং আসেন। ধর্ম প্রচারের একপর্যায়ে স্বর্গের কিছু ঈর্ষান্বিত দেবতার সাথে তার বাকযুদ্ধ শুরু হয়। এতে অভিমান করে দেবতারা অন্যত্র চলে যান। সেদিন আকাশ থেকে পানির বদলে ফুলের বৃষ্টি বর্ষিত হয়। তাই এই জায়গাটির নাম দেয়া হয় ‘ফুল বৃষ্টির চত্বর’।

১৯২৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত এই জায়গাটিতে অগণিত বিপ্লবীকে হত্যা করা হয়। সেই শহীদদের স্মরণ করতে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ জায়গাটিতে ভ্রমণ করতে আসেন।
সান ইয়াত-সেনের সমাধিস্তম্ভ
সান ইয়াত-সেন ছিলেন চীনের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রদূত। তার হাত ধরে ‘রিপাবলিক অফ চায়না’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি এর প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯২৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে তাকে নানজিংয়ে সমাহিত করা হয়। তার সমাধিকে কেন্দ্র করে ১৯২৯ সালে একটি দৃষ্টিনন্দন সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এতে চীনের স্থানীয় ও পশ্চিমা বিশ্বের স্থাপত্য শিল্পের সমন্বয় রয়েছে।

সমাধিস্তম্ভের প্রবেশ পথে ৩৯২ ধাপের পাথুরে সিঁড়ি এবং অভ্যন্তরে সান ইয়াত-সেনের একটি মার্বেল পাথরের তৈরি ভাস্কর্য রয়েছে।সমাধিস্তম্ভের বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে তার বিপ্লবী জীবনের নানা স্মৃতি ও কর্ম সংরক্ষিত রয়েছে। নয়নাভিরাম এই স্মৃতিস্তম্ভটি দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ নানজিংয়ে আগমন করে।
মিং জিয়াওলিং সমাধিস্তম্ভ
সান ইয়াত-সেনের সমাধিস্তম্ভ থেকে মাত্র এক কিলোমিটার পশ্চিমে মিং জিয়াওলিং সমাধিস্তম্ভ অবস্থিত। এখানে ঝু ইউয়ানঝং (১৩২৮-১৩৯৮) নামক একজন শাসক শায়িত আছেন, যিনি নানজিংয়ে মিং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাকে বলা হতো ‘ভিখারি শাসক’, কেননা রাজা হয়েও তিনি তেমন কোনো সম্পদের মালিক ছিলেন না।

কথিত আছে, সমাধিস্তম্ভটি নির্মাণ করতে প্রায় ১ লাখ শ্রমিক ও ৫ হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। নির্মাণকালে এর চারপাশে ২২.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু নানা যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে এই স্থাপত্য শিল্পটি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। অবশিষ্টাংশে একটি সুবিশাল প্রবেশ পথ রয়েছে। এছাড়া সেখানে ঝু ইউয়ানঝংয়ের সমাধি সংরক্ষিত রয়েছে। মিং আমলে নির্মিত সমাধিস্তম্ভগুলোর মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ।
সউল ভ্যালি মন্দির
সউল ভ্যালি মন্দির লিংগু মন্দির নামেও পরিচিত। সান ইয়াত-সেনের সমাধিস্তম্ভ থেকে মাত্র এক কিলোমিটার পূর্বে সউল ভ্যালি মন্দির অবস্থিত। পারপাল পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত এই বৌদ্ধ মন্দিরটির চারদিক ঘিরে রয়েছে উঁচু উঁচু পাইন গাছ, যা আর দশটি মন্দির থেকে তাকে আলাদা করে রাখে।
৫১৪ সালে এই মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীকালে মিং রাজারা এর সৌন্দর্যবর্ধন করেন। মন্দিরটিতে বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু জুয়ান জাংয়ের সমাধি সংরক্ষিত রয়েছে, যিনি একদা ধর্ম প্রচারের জন্য ভারত থেকে চীনে আগমন করেছিলেন। বর্তমানে মন্দিরটি ঘিরে একটি পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। ১৯৩০ সালে সেখানে একটি সুউচ্চ প্যাগোডা নির্মাণ করা হয়েছে। অনেকে এই মন্দিরটিকে বিশ্বের সেরা বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।
পার্পল পর্বত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র
বিখ্যাত পার্পল পর্বত পর্যবেক্ষণ ও আকাশ গবেষণার জন্য ১৯৩৪ সালে এই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। এটি চীনের অন্যতম বিখ্যাত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এখান থেকে পার্পল পর্বতের বেগুনি রংয়ের চোখ ধাঁধানো দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

অনেক আন্তর্জাতিক আকাশ গবেষণা সংস্থা গবেষণার জন্য এখানে আসে। চীনের প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত নানা যন্ত্রপাতি ও তথ্যাবলি এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া আকাশ গবেষণার আধুনিক যন্ত্রপাতিও এখানে সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে জায়গাটি সারা বিশ্বের গবেষক ও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
কনফুসিয়ান মন্দির
কনফুসিয়াস ধর্মের অনুসারীরা উপাসনার জন্য এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, মিং রাজাদের আমলে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে।

নানজিং শহরের দক্ষিণে কিউইহাই নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দিরটি এখন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মন্দিরের চারপাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্মারকগ্রন্থের দোকান। এসব দোকানে কনফুসিয়াসের বাণী সম্বলিত নানা দেয়ালচিত্র পাওয়া যায়। মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য টিকিট ক্রয় করতে হয়। এজন্য খরচ করতে হয় ৩০ ইউয়ান।
ঐতিহ্যবাহী নানজিংয়ের এসব ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন করতে প্রতি বছর যেমন অসংখ্য পর্যটক চীনে গমন করেন, তেমনি অসংখ্য ঐতিহাসিক, সাংবাদিক ও গবেষকও নানজিং আগমন করেন। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া এমন একজন সাংবাদিক ইভা র্যামেলু। তিনি তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,
হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হলো, আমি ইতিহাসের একটি সঠিক জায়গায় এসে উপনীত হয়েছি; যেখানে দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মিলন ঘটেছে- যিনি নানজিংকে প্রথমবারের মতো রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিলেন (সান কুয়ান) এবং যিনি শেষবারের মতো নানজিংকে রাজধানীর মর্যাদা দিয়েছিলেন (সান ইয়াত-সেন)। উভয়ে একই স্থানে (উভয়ের সমাধি পাশাপাশি) শায়িত আছেন। এর চেয়ে অসাধারণ বিষয় আর কী হতে পারে!