Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাচীন মিশরীয়দের পোষা প্রাণীর প্রেম

পৃথিবীতে সভ্যতার সূচনায় মিশরীয়দের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম এবং সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল মিশরীয় সভ্যতা। তাদের ছিল নিজস্ব স্বকীয়তা এবং রীতিনীতি যা অন্যদের থেকে সবসময়ই তাদেরকে আলাদা করতো। এমনই একটি বিষয় ছিল তাদের দেবদেবীর মূর্তিতে। মূর্তিগুলোর ছিল বিভিন্ন পশু-পাখির মাথা! আর দেবদেবীর সম্মানে তাই মীশরীয়রা পশুপাখি ভালবাসতো ভীষণ। দেবতার মন্দিরে তাই সিংহ, কুমির, জলহস্তির মতো আক্রমণাত্মক প্রাণীদেরও রাখা হতো পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে।

কোনো পশুর পূজা মিশরীয়রা করতো কিনা সে ব্যাপারে অনেক ইতিহাসবিদ সন্দেহ প্রকাশ করলেও মিশরীয়দের পোষা প্রাণী কিংবা গৃহপালিত প্রাণীর প্রতি যত্নশীলতার কথা সার্বজনীন স্বীকৃত। পোষা প্রাণীর প্রতি তাদের ভালবাসা এতোই গভীর ছিল যে কারো ঘরে যদি একটি পোষা বিড়াল মারা যেতো, তাহলে শোক পালন করতে গিয়ে সবাই চোখের ভুরু ছেঁটে ফেলতো। আর যদি কোনো কুকুর মারা যেতো, তাহলে তারা সমগ্র শরীর মুন্ডন করতো, একেবারে মাথা থেকে পা অবধি!

নিজেদের পোষা প্রাণীর সাথে প্রাচীন মিশরীয়রা (কল্পিত ছবি); historyforkids

ঐতিহাসিক জিমি ডান বলেছেন- “কুকুরই মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে অধিক পোষা প্রাণী যা তাদের শিকারে সহায়তা করতো, দেহরক্ষীর কাজ করতো। কুকুর ছিল তাদের পুলিশ।” হ্যাঁ, কুকুর মিশরীয়দের নিকট একটি অতি জনপ্রিয় প্রাণী ছিল এবং এখনো আছে। কুকুরের ডাককে আমরা বলি ‘ঘেউ’, আর মিশরীয়রা বলতো ‘ইউই’ এবং কুকুরকে তারা ডাকতোও এই নাম ধরেই। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দ থেকেই মিশরীয়রা কুকুরকে পোষা প্রাণী হিসেবে পালন করা শুরু করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়ের পাথরে খোদাইকৃত কুকুরের ছবি থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের একটি খোদাই করা কুকুরের ভাস্কর্যের গলায় কলার দেখা যায়। তাই অনেক ঐতিহাসিক মিশরীয়দেরই কুকুরের গলার কলারের আবিষ্কারক বলেন।

পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা কুকুরের ছবি; pinterest.com

একটি কুকুর পোষা ছিল তখন এক একটি পরিবারের আভিজাত্যের প্রতীক। কুকুরকে তারা নিজেদের পরিবারের সদস্যের মতোই যত্ন করতো। একটি পারিবারিক কুকুর মারা গেলে সে পরিবারে নেমে আসতো শোকের ছায়া। আরা চুল কামিয়ে ফেলার কথা তো আগেই জানালাম। কুকুরের প্রতি এই ভালবাসা ছিল ফারাও রাজাদেরও। ফারাও রাজা তুতানখামেন এবং রামেসিস, উভয়ের সমাধিতে যে চিত্র খোঁদাই করা তাতে দেখা যায় যে তারা রথে করে শিকার করছিলেন এবং সাথে ছিল কয়েকটি কুকুর।

ব্রোঞ্জের তৈরী বিড়াল; pictures-of-cats.org

কুকুরের কথা তো জানলেন, এবার তবে শুনুন বিড়াল কাহিনী। বিড়ালকে প্রাচীন মিশরীয়রা খুবই পবিত্র প্রাণী বিবেচনা করতো। তাদের বিড়াল দেবীর নাম ছিল ‘বাস্তেত’। ইংরেজিতে বিড়ালের প্রতিশব্দ ‘ক্যাট’ এর প্রচলন এই বিড়ালভক্ত মিশরীয়দের হাত ধরেই। তারা বিড়ালকে বলতো ‘কাট্টাহ’ যা থেকে ফরাসি ভাষায় এসেছে ‘কাটশ’, জার্মান ভাষায় ‘ক্যাৎস’ এবং ইংরেজিতে ‘ক্যাট’।

প্রাণী ভক্ত মিশরীয়রা প্রাণীদের জন্য, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিড়ালের জন্য নিজেদের স্বাধীনতাই বিসর্জন দিয়েছিল! ৫২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্য সেনাপতি ক্যামবাইস II মিশর আক্রমণ করেন। মিশরীয় সৈন্যরা ক্যামবাইসের সৈন্যদেরকে ‘পেলুসিয়াম’ নামক শহরের নিকট আটকে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের নির্বুদ্ধিতার নিকট আত্মসমর্পণ করে মিশরীয়রা। ক্যামবাইস জানতো মিশরীয়রা বিড়াল এবং অন্যান্য প্রাণীদের ভালবাসে। তাই তিনি তার সৈন্যদের ঢালের উপর বিড়াল দেবী ‘বাস্তেত’ এর ছবি আঁকিয়ে নিলেন যা ছিল বিড়ালের মতোই। একইসাথে তিনি নিজের সৈন্য বাহিনীর সামনে ছোটালেন অসংখ্য বিড়াল, কুকুর এবং আরও কিছু প্রাণী যা মিশরীয়রা পবিত্র মনে করতো। ফালাফল যা হবার তাই হলো। মিশরীয় সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলো।

যে বিড়ালের জন্য একদিন নিজেদের স্বাধীনতা খুইয়েছিল মিশরীয়রা, তার নিরাপত্তায় তারা সচেষ্ট থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিড়াল রক্ষায় তারা প্রণয়ন করেছিল কঠোর আইন। কেউ যদি কোনো বিড়াল হত্যা করতো এমনকি তা দুর্ঘটনাক্রমে হলেও, তার একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড! বিড়ালের জন্য মানুষ হত্যা, ভাবছেন এ কেমন বিচার? অধৈর্য হবেন না, আরও চমক বাকি রয়েছে। বিড়াল রপ্তানী করা নিষিদ্ধ করেছিল মিশরীয় সরকার। এমনকি বিড়ালের সকল ধরণের রপ্তানী/চোরাচালান এর উপর নজরদারি করার জন্য সরকারের আলাদা একটি অংশ (বর্তমানের মন্ত্রণালয়গুলোর মতো) ছিল যার কাজ ছিল এসব বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা এবং কোনোভাবে বিড়াল পাচার হয়ে গেলে তা ফিরিয়ে আনা ও পাচারকারীদের শাস্তি দেয়া।

এপিস বুল; bible-history.com

এপিস বুল বা এপিস ষাঁড় মিশরীয়দের নিকট কোনো পোষা প্রাণী নয়, একটি পবিত্র প্রাণী যা ‘পতাহ’ বা ‘তাহ’ নামক দেবতার প্রতিনিধিত্ব করে। এই প্রাণীটিকে তারা এতোটাই পবিত্র এবং সম্মানিত মনে করতো যে রাজার ক্ষমতার সাথে এর তুলনা করা হতো। প্রতীকীভাবে এর শক্তি অসীম বলে মনে করা হতো। ‘নার্মার্স পেলেট’ নামক একটি অত্যন্ত প্রাচীন এবং বিখ্যাত মিশরীয় প্রত্নবস্তুতে দেখা যায় একটি এপিস ষাঁড় একাই একটি শহর ধ্বংস করে ফেলছে, যা এই প্রাণীটিকে শক্তির আধার রূপে প্রতিষ্ঠিত করে।

মিশরীয়দের বাজপাখির প্রতীকী ছবি; pinterest.com

‘ফ্যালকন’ বা বাজপাখি ছিল রাজাদের একক ক্ষমতার প্রতীক। ফারাও রাজারা এই পাখি নিজেদের নিকট রাখতো ঐশ্বরিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। বাজপাখিগুলো মিশরীয় দেবতা ‘হোরাস’ এবং ‘মানতু’ এর শক্তির প্রতীক। বাজারের এদের দাম ছিল অন্যান্য সকল পাখির চেয়ে বেশি। আরেক প্রকার সারস পাখি ছিল যা জ্ঞানদেবতা ‘থথ’ এর প্রতিনিধিত্ব করতো। এই পাখিগুলোও অনেক দামী ছিল এবং ধনী লোকদের বাড়িতেই কেবল পোষা হতো। ‘সাকারা কমপ্লেক্স’ নামক মিশরের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে প্রায় ৫ লক্ষ মমিকৃত সারস পাখি পাওয়া যায়!

গেজেল বা এক বিশেষ প্রজাতির হরিণ; istockphoto.com

পোষা প্রাণীর মধ্যে আরও একটি জনপ্রিয় প্রাণী ছিল এই হরিণ। বর্তমানে এটি বিলুপ্ত এবং বেশ অদ্ভুত লাগলেও প্রাচীন মিশরে এই হরিণগুলো ছিল খুবই সাধারণ এবং সহজলভ্য। মিশরীদের ২১তম রাজবংশের রাণী আইজেমখেব এর নিকট ছিল উপরের ছবির মমিকৃত হরিণটি। রাণীর নিকট প্রাণীটি এতোই প্রিয় ছিল যে তিনি আদেশ দিয়ে যান যেন তার মৃত্যুর পর হরিণটিকে তার মতোই সমান যত্নে মমি বানিয়ে তার সাথে একই সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়। এসব ছাড়াও ব্যাবুন এবং বানরও মিশরীয়দের খুব প্রিয় পোষ্য ছিল। বানরকে তারা সুখের প্রতীক হিসেবে গৃহে পালন করতো। মিশরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মমিকৃত বানর এবং বেবুন পাওয়া যায়।

মিশরীয়দের সেই পোষা প্রাণীগুলো অদ্ভুত হোক আর গৃহপালিত হোক, তাদের প্রাত্যহিক জীবনে এই প্রাণীগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে। তারা বিশ্বাস করতো মৃত ব্যক্তিরও মৃত্যু পরবর্তী জীবনে খাবার প্রয়োজন আছে। আর সেই বিশ্বাস থেকেই তারা মৃত ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন প্রাণী মমি করে সমাধিস্থ করতো। অন্যদিকে জলহস্তি আর কুমির, উভয়েই ক্ষতিকর এবং ভয়ানক। কিন্তু এই প্রাণীগুলোও অনেকসময় মমি করে সমাধিতে দেয়া হতো এজন্য যে এই প্রাণীগুলো ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তির স্বর্গের স্থানটি অন্যকারো দ্বারা দখল হতে দেবে না!

জ্ঞান বিজ্ঞানের আজকের যুগে মিশরীয়দের এসব বিশ্বাস হয়তো অধিকাংশের নিকট ভ্রান্ত শোনাবে, কিন্তু তাদের নিকট এই ব্যাপারগুলো ছিল পবিত্র এবং সত্য। তথাপি প্রাণীদের প্রতি প্রাচীন মিশরীয়দের যে ভালবাসা তা সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। মিশরীয়দের বিশ্বাস আপনি গ্রহণ করুন আর নাই করুন, তাদের মতো করে আপনিও পশুপাখি ভালবাসতে পারেন। এসব পশুপাখি বেঁচে থাকলে বেঁচে থাকবে আমাদের পরিবেশ।

তথ্যসূত্র

১)  en.wikipedia.org/wiki/Cats_in_ancient_Egypt

২) en.wikipedia.org/wiki/Animal_mummy

৩) ancient-egypt-online.com/ancient-egyptian-animals.html

৪) ancient.eu/article/875/

Related Articles