Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রণতরী ইউএসএস কনস্টিটিউশন: সমুদ্রের বুকে দুই শতাধিক বছর

আগস্ট ১৯, ১৮১২

বেলা তখন প্রায় ২টা। দক্ষিণের মেঘলা দিগন্তে একটা পাল চোখে পড়ল ‘ইউএসএস কনস্টিটিউশন’ নাবিকদের। খবরটা শোনামাত্র একটু যেন চাঞ্চল হয়ে উঠলেন কনস্টিটিউশনের ক্যাপ্টেন আইজাক হাল। কারণ, সেই পাল ছিল ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির যুদ্ধ জাহাজ এইচএমএস গেরিয়ারের। 

এই সেই জাহাজ! যার কাছ থেকে মাসখানেক আগে কৌশলে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল কনস্টিটিউশন। এবার সুযোগ এসেছে সেই পরাজয়ের বদলা নেবার, মনে মনে ভাবলেন ক্যাপ্টেন হাল। সে বছরেরই জুন মাসে ব্রিটেনের সাথে যুদ্ধ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের। আর পরের মাসেই প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয় ইউএসএস কনস্টিটিউশন এবং এইচএমএস গেরিয়ার।

শিল্পীর তুলিতে সমুদ্রের বুকে পাল তোলা ইউএসএস কনস্টিটিউশন; Image Credit: angelfire.com

এক মাস আগে- জুলাই ১৬, ১৮১২ 

নিউজার্সির এগ হারবারের কাছে রয়্যাল নেভির পাঁচ যুদ্ধ জাহাজের বিশাল এক দলের সামনে পড়ে যায় ইউএসএস কনস্টিটিউশন। পালতোলা জাহাজের যুগ তখন। বাতাসের উপর নির্ভর করতো জাহাজের গতি। মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে বাতাস একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। সে অবস্থাতেই ব্রিটিশ যুদ্ধবহর আর ইউএসএস কনস্টিটিউশনের মাঝে শুরু হলো ঐতিহাসিক এক ধীরগতির ধাওয়া। রয়্যাল নেভির কামানের গন্ডি থেকে নিজেকে বাইরে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলো কনস্টিটিউশন, আর ব্রিটিশ জাহাজদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল কনস্টিটিউশনকে বাগে পাওয়া। সেই ইঁদুর দৌড়ে ক্যাপ্টেন আইজাক হাল আর তার সঙ্গীদের সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছিল ফরাসিদের থেকে অধিগ্রহণ করা ব্রিটিশ জাহাজ  এইচএমএস গেরিয়ার। 

টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে চলা এই গতির লড়াইয়ে হার মানেনি ইউএসএস কনস্টিটিউশন। নিজেদের জাহাজকে ভারমুক্ত করতে সমুদ্রের অতি মূল্যবান রসদ পান করার জন্যে রাখা ১০ টন পানি ফেলে দিতে হয়েছিল কনস্টিটিউশন থেকে। অবশেষে ১৮ জুলাই ভোরের দিকে তাড়া করে আসা জাহাজ বহরের আক্রমণ সীমানার বাইরে চলে আসে ক্যাপ্টেন হালের জাহাজ। ততক্ষণে বাতাসও বইতে শুরু করায় সেখান থেকে পালাতে সুবিধা হয় ইউএসএস কনস্টিটিউশনের। 

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা কনস্টিটিউশন জাহাজ; Image source: vamonde.com

ইঁদুরদৌড়ে জিতে সেদিন বহাল তবিয়তে ফিরতে পারলেও ব্যাপারটা আত্মসম্মানে লেগেছিল কনস্টিটিউশনের ক্যাপ্টেন আর নাবিকদের। তাই আজ আবার এইচএমএস গেরিয়ারকে সামনে পেয়ে পুরনো ক্ষোভ মনের ভেতরে জ্বলে উঠেছে সবার। নোভা স্কটিয়া উপকূল থেকে ৪০০ মাইলে দূরে মুখোমুখি হলো দুই জাহাজ। আকার-আকৃতিতে গেরিয়ার থেকে কিছুটা বড় ছিল কনস্টিটিউশন। দুটোই যুদ্ধের জন্যে নির্মাণ করা ফ্রিগেট ধরনের জাহাজ। নাবিক আর কামানের সংখ্যার হিসেবে পিছিয়ে থেকেও গেরিয়ার জাহাজের ক্যাপ্টেন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন নিজের জয় নিয়ে। আর তাতেই যুদ্ধ কৌশলে ভুল করে তারা। 

কনস্টিটিউশনকে দেখেই নিজেদের আগ্নেয়ক্ষমতা দেখানোর জন্যে তৎপর হয়ে উঠল এইচএমএস গেরিয়ার। আওতায় আসার আগেই কামান দাগিয়ে বধ করতে চাইল কনস্টিটিউশনকে। নিজেদের কামানগুলোকে ব্যবহার না করে কিছুটা রক্ষণাত্মকভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল কনস্টিটিউশন। রেঞ্জের বাইরে থেকে গেরিয়ারের করা মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ তেমন একটা ক্ষতি করতে পারল না ২৪ ইঞ্চির তিন আস্তরণে ঢাকা আমেরিকান ফ্রিগেটের শরীরে। যদিও হোয়াইট আর লাইভ ওক কাঠ দিয়েই তৈরি ছিল কনস্টিটিউশনের শরীর, কিন্তু ব্রিটিশ নাবিকদের কাছে মনে হলো এই জাহাজের খোল নিশ্চয়ই লোহা দিয়ে তৈরি। সেখান থেকেই কনস্টিটিউশনের নাম হয়ে যায় ‘ওল্ড আয়রনসাইডস’। 

ব্রিটিশ জাহাজের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে কনস্টিটিউশন; Image Source: historycentral.com

অবশেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে নিজেদের আগ্নেয়ক্ষমতার প্রদর্শন শুরু করলো কনস্টিটিউশন। তখন এক জাহাজ থেকে অপর জাহাজের দূরত্ব মাত্র ২৩ মিটারে দাঁড়িয়েছে। ১৫ মিনিট ধরে চলল ভয়ানক যুদ্ধ। একে অপরকে ঘিরে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতে থাকল জাহাজ দুটো। এরপরই প্রধান মাস্তুলের পেছনে থাকা মাস্তুলটি ভেঙে পড়ল গেরিয়ারের। সামনের মাস্তুলও বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারল না, সেই সাথে পতন ঘটল জাহাজের প্রধান মাস্তুলের। ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজটির অবস্থা দাঁড়াল পঙ্গু কোনো দানবের মতো। সারা শরীরে গোটা তিরিশেক ছিদ্র নিয়ে যুদ্ধে হার মানা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকলো না রয়্যাল নেভির জাহাজটির।

সেই তুলনায় তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি ওল্ড আয়রনসাইডসের। এখানে ওখানে কামানের গোলার চিহ্ন আর রক্তের দাগ তার  শরীরে পড়লেও বহাল তবিয়েতেই পাল তুলে বীরের বেশে যুদ্ধ ময়দান ত্যাগ করল কনস্টিটিউশন। সেদিনের ব্রিটিশ ফ্রিগেটের বিরুদ্ধে সেই জয় ক্যাপ্টেন হালকে যেমন জাতীয় বীরে পরিণত করল, তেমনি ওল্ড আয়রনসাইডসকে পরিণত করল ইতিহাসে। এখানেই শেষ নয়; ১৮১২ সালের সেই যুদ্ধে আরো ৭টি ব্রিটিশ জাহাজকে ঘায়েল কিংবা বন্দি করে ইউএসএস কনস্টিটিউশন। 

ইউএসএস কনস্টিটিউশনের দুর্লভ একটি ছবি; Image Source: seacoastnh.com

আলোড়ন তোলা এই জাহাজের শুরুটা খুব মসৃণ ছিল না। আমেরিকার বাণিজ্য জাহাজগুলোকে জলদস্যুর পাশাপাশি ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চ সেনাদের হাত থেকে রক্ষা করতে ছয়টি জাহাজ বানানোর নির্দেশ দেয় কংগ্রেস। সেই ছয় জাহাজের একটি এই কনস্টিটিউশন। এডমন্ড হার্টের শিপইয়ার্ডে ১৭৯৪-৯৭ সালের মাঝে নির্মাণকাজ চলে ইউএসএস কনস্টিটিউশনের। সেই বছরের সেপ্টেম্বরের ২০ আর ২২ তারিখে ইউএসএস কনস্টিটিউশনকে সমুদ্রে ভাসানোর দুটো চেষ্টাই বৃথা হয়। অবশেষে ১৭৯৭ সালের ২১ অক্টোবর ২,২০০ টনের ২০৪ ফুট দীর্ঘ জাহাজটি পানিতে ভাসানো হয়। ৪৪টি কামান-সমৃদ্ধ জাহাজটি ৪৫০ জন নাবিক নিয়ে ১৭৯৮ সালে প্রথম যাত্রা করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকে। তার প্রথম দায়িত্ব ছিল সেই পথে আমেরিকার বণিক জাহাজদের ফ্রেঞ্চ জলদস্যুদের থেকে রক্ষা করা।    

যুদ্ধ শেষ হবার পর ওল্ড আয়রনসাইডস নৌবাহিনীর ভূমধ্যসাগরীয় স্কোয়াড্রনের প্রধান হিসেবে বেশ কিছু সময়ের জন্যে দায়িত্ব পালন করে। নিজের কর্মযুগের শেষে ১৮৩০ সালে সমুদ্রে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ায় ইউএসএস কনস্টিটিউশনকে স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউএস নেভি। কিন্তু সাধারণ মানুষের মাঝে এ নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।  এই জাহাজ ইতিহাসের সাথে সাধারণ মানুষের মনেও এমন দাগ কেটে গিয়েছিল যা একে ধ্বংসের হাত থেকে ফিরিয়ে আনে। এমনকি অলিভার ভেন্ডেল হোমস সিনিয়র জাহাজটি বাঁচানোর প্রতিবাদস্বরূপ ‘ওল্ড আয়রনসাইডস’ নামের একটি কবিতাও লিখেছিলেন তখন। 

সবদিক বিবেচনা করে জাহাজটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকান নেভি। এবার আর হালকা জোড়া-তালি নয়, রীতিমতো পুনর্নির্মাণ করা হয় ওল্ড আয়রনসাইডসকে। জুন ২৪, ১৮৩৩ থেকে জুন ২১, ১৮৩৪ পর্যন্ত চলে সেই নির্মাণ কাজ। নতুন ঝা-চকচকে কাঠামো নিয়ে আবার সমুদ্রে নেমে পড়ে কনস্টিটিউশন। ১৮৪৪-৪৬ সালে আমেরিকার শুভেচ্ছাদূত হিসেবে বিশ্বের নানা বন্দরে ঘুরে বেড়ায় কনস্টিটিউশন। এ সময় ৫২,৩৭০ মাইল জলপথ পাড়ি দেয় জাহাজটি। 

ওল্ড আয়রনসাইডস; Image Source: Detroit Publishing Co., publisher 1915 to 1930

আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ওল্ড আয়রনসাইডস আফ্রিকান স্কোয়াড্রনের প্রধান হিসেবে বহরে যুক্ত হয় এবং সে সময় পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে দাস ব্যবসায়ীদের খোঁজে টহল দেয়া ছিল এর মূল কাজ। তবে দিনে দিনে বয়স বেড়ে চলায় সেনাবাহিনীতে থাকার ক্ষমতা কমে আসছিল পালতোলা এই জাহাজের। নিজের সময়ের অন্য সব জাহাজ থেকে বেশি দিন ধরে কাজে নিযুক্ত থাকলেও অবশেষে ১৮৫৫ সালে অবসর নেয় জাহাজটি। কিন্তু নিজেকে ইতিহাসের অঙ্গ করে নেয়া জাহাজটি তারপরও টিকে থাকে যুগের পর যুগ। 

১৯০৬-০৭ সালে বোস্টনে চলে মেরামতের কাজ। ইউএস নেভির পরিকল্পনা ছিল কনস্টিটিউশনকে তার ১৮১২ সালের সত্যিকারের যুদ্ধ সাজে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। ১৯২৫ সালে এই জাহাজ রক্ষা করতে এক ক্যাম্পেইনে অংশ নেয় পুরো যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলশিশুরা, যেখানে তারা ১ লক্ষ ৫৪ হাজার ডলার সংগ্রহ করে। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতীকী ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে নির্বাচন করা হয় ওল্ড আয়রনসাইডসকে। পালতোলা যুগ শেষ হবার পর ইঞ্জিনযুক্ত মোটর বোটের সাহায্যেই সমুদ্রে বের হতে হতো এককালের এই যুদ্ধ জাহাজকে। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২১ জুলাই প্রথম ভাসানোর ২০০ বছর পর আবারও সমুদ্র পরিভ্রমণে বের হয় ইউএসএস কনস্টিটিউশন। 

অবসর নেয়ার পর বেশ কিছুদিন ট্রেনিং জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করা হয় একে। পরবর্তীতে জাতীয় উল্লেখযোগ্য স্থাপনা জাহাজে চড়ে ঘুরে দেখার জন্য ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায় ইউএসএস কনস্টিটিউশন। বই থেকে সিনেমা, ওয়েবসাইট থেকে জাদুঘর- এ জাহাজের নামে সব কিছুই রয়েছে। থাকবেই না বা কেন? দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সমুদ্রের বুকে ছুটে চলার গৌরব কয়টি জাহাজেরই হয় বলুন!

Related Articles