আমরা যারা সিনেমা দেখি তাদের কাছে “জিন্দেগি না মিলে দোবারা” নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই সিনেমাতে ঋত্বিক, ক্যাটরিনা, অভয় দেওয়াল, ফারহান আখতার এর টমেটো খেলার উৎসবে মাতামাতি দেখে চোখ দুটো ছানাবড়া হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে আজ মুভিটির বিষয়বস্তু নিয়ে নয় বরং লা তোমাতিনা উৎসবটিকে ঘিরে দেশ-বিদেশের মানুষের আনন্দময় উচ্ছ্বলতার এক গল্প শোনাবো।
স্পেনের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ভ্যালেন্সিয়া শহর। আর তারই অদূরে ছোট্ট শহর বুঁয়্যোল-এ আগস্ট মাসের শেষ বুধবার সকালে হাজারো লোকের অংশগ্রহণে যে টমেটো ছোঁড়াছুঁড়ির উৎসব অনুষ্ঠিত হয় তা আর কারো খুব বেশি অজানা নয়। ইন্টারনেট এর এই যুগে এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানার লোভ কয়জনই বা সামলাতে পেরেছেন? কিন্তু তারপরও ঐ স্থানে উপস্থিত থেকে টমেটো হাতে করে অন্য আরেকজনকে ছুঁড়ে মারার যে আনন্দ তা আর আমরা পাচ্ছি কই?
আমাদের দেশেও সেই ধরনের কিছু খেলা হয় বইকি! রাঙামাটিতে বর্ষবরণের বৈসাবি অনুষ্ঠানে পানি ছোঁড়াছুঁড়ির যে খেলাটি হয় তার সাথে এই ‘লা তোমাতিনা’ র খানিকটা মিল আছে তা বলাই বাহুল্য। হিন্দুদের দোল বা হলির সাথেও এই খেলার খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু অমিল যে একেবারে নেই তা তো নয়। রিষ্ট পুষ্ট লাল টকটকে টমেটোর এমন ব্যবহার দক্ষিন এশিয়ার গরিব দেশে রীতিমত বিলাসিতার সামিল। টমেটো দেখলেই তা দিয়ে সালাদ, চাটনি, সস এই ধরনের খাবারের কথাই তো কেবল মনে পড়ে। এ নিয়ে খেলা? না বাবা, এর চাইতে টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলাটাই অনেক শ্রেয় মনে হতে পারে। তবে পুরো পৃথিবীর লোক তা মানবে কেন? তাই হাজার হাজার লোক প্রতি বছর এই খেলায় যোগ দিতে আসেন লক্ষ টাকা খরচ করে। এমনও বলা হয়ে থাকে এই দিনে স্থানীয় লোকের চাইতে পর্যটকের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। একটু অদ্ভুত ঠেকছে, তাই না? কিন্তু এই টমেটো ছোঁড়ার উৎসব নিয়ে পৃথিবীর লোকের উৎসাহের সীমা নেই।
এবার আসা যাক একটু ইতিহাসের দিকে। কীভাবে এই অনুষ্ঠানের শুরু হল? কেনই বা টমেটো ছোঁড়ার এই অনুষ্ঠান? সত্যি কথা বলতে এর কোন সদুত্তর আজও সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি যা আছে তা নিয়ে এক ধরনের অনুমান করা হয় ঠিকই, কিন্তু কোনটাই খুব যুক্তিযুক্ত ঠেকে না। কিন্তু শুরুটা যেভাবেই হোক না কেন, বর্তমানে এর আড়ম্বরতা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে।
মাঝে মাঝে হিংসেও হয় বটে। ৮০ টাকার উপর কিলো যে দেশে, সে দেশে শুধু খেলার ছলে এতো টমেটো নষ্ট করা শুনতেও কেমন যেন কানে এসে ঠেকে। শুনতে মনে হয়, এ আর কী? ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। ধনী দেশে তো এমন হবেই। হ্যাঁ প্রথম দিকে খানিকটা এমনি ছিল বৈকি। কারণ, বুঁয়্যোল শহরটিতে লোকসংখ্যা খুব নগণ্য। বাইরের লোকজনেরও তেমন আসা যাওয়া ছিল না। সেই তুলনায় এখানে টমেটোর চাষ হত প্রচুর। দামও ছিল বেজায় সস্তা। আর সেই সময় বিদেশে রপ্তানি করারও তেমন প্রচলন ছিল না বা সহজ ছিল না বলা ভাল।
উপযুক্ত ব্যবহারের অভাবে বেশির ভাগ টমেটো নষ্ট হয়ে যেত। কিছু লোক বুদ্ধি করে শহরের সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব সেইন্ট লুইস বার্ট্রান্ট এবং মা মেরিকে উৎসর্গ করে টমেটো ছোঁড়া উৎসবের সূচনা করে। ধীরে ধীরে এই উৎসব লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতি আগ্রহও দিন দিন বাড়তে থাকে। ফলে বাড়তে থাকে মানুষের সমাগম। লোক বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎসবের আকারও বাড়তে থাকে। ২০১২ সালে তো প্রায় ৪০ হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিল লা তোমাতিনা উৎসবে। প্রায় একশ’ মেট্রিক টনের মতো টমেটোর রস ছিটিয়ে সবাই মেতে উঠেছিল আনন্দ উৎসবে।
ছোট্ট একটা শহরে জনসংখ্যার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি মানুষের সেই ভিড় সামাল দিতে আর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কর্তৃপক্ষকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে। কিন্তু এতে তাদের সাপে বরই হল। পরের বছর থেকেই টিকিট ছাড়া শুরু করল কর্তৃপক্ষ। টিকিটের দাম মাত্র ১০ ইউরো, তবে এটা কেবল অনুমতিপত্র পাওয়ার জন্য। থাকা-খাওয়া আর যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে নিজেকেই। অবশ্য এ জন্য আছে ডজন ডজন বেসরকারি টুরিস্ট কোম্পানি। শুরু হয়ে গেল এই উৎসব কে কেন্দ্র করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয়। প্রতি বছর গড়ে ২০ হাজারের বেশি মানুষ ভিড় করে এই টমেটো খেলায়। করবেও না বা কেন? এ তো আর যেমন তেমন খেলা নয়। টমেটো নিয়ে মারামারি। রীতিমত যুদ্ধ। তাহলে বুঝতেই পারছেন, এটা এখন আর শুধু খেলাই নয়, একধরনের দর্শনীয় স্থান হয়ে দাড়িয়েছে পৃথিবীর বুকে।
দা গার্ডিয়ান এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ১০০ মেট্রিক টন অতিপাকা টমেটো আনা হয় গ্রামের খামারগুলো থেকে। এক ঘন্টা লড়াইয়ে ব্যয় হয় ১লাখ ৪০ হাজার ইউরো। সেই হিসাবে প্রতি মিনিটে খরচ ২ হাজার ৩০০ ইউরো। আমাদের মত গরীব দেশের জন্য যা চিন্তা করাই কঠিন ব্যাপার।
২০০২ সালে পর্যটকদের বিপুল উৎসাহ ও যোগদানের কারণে স্পেন সরকার একে ‘আন্তর্জাতিক পর্যটন উৎসব’-এর মর্যাদা দেয়। প্রতি বছর টমেটো দিয়ে এদিন শহরের রাস্তা নদী বানিয়ে ফেলে স্থানীয় লোকজনসহ পর্যটকরা। উৎসব সকালে শুরুহয়ে দুপুর পর্যন্ত চলে।
উৎসবের শুরুত বিশাল এক টুকরা মাংস রাখা হয় একটা পিচ্ছিল খাম্বার উপরে। শর্ত থাকে খাম্বা বেয়ে সেটিকে নামিয়ে আনতে হবে। এটা আনার সময় নাচ-গান আর হোস পাইপ দিয়ে পানিতে ভেজা চলতে থাকা। মাংসটি নামানো হলে শুরু হয় টমেটোর যুদ্ধ। একে অপরের গায়ে ছুঁড়ে থেতলে দেয় পাকা টমেটো। টমেটো খেলায় কিছু নির্দিষ্ট নিয়মও রয়েছে। যেমন- টমেটো ছোঁড়ার আগে ভালভাবে থেতলে নিতে হবে, টমেটো ভিন্ন অন্য কোন কিছু ছোড়া যাবে না, অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথে আর কোন টমেটো ছোড়া যাবে না ইত্যাদি।
টমেটো লড়াইয়ের যোদ্ধাদের অনেককেই পাশের বুঁয়্যোল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোসল সারার উদ্দেশ্যে। এ ছাড়া শহরের অলিগলির বাসাবাড়ির অনেক গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীকেও দেখা যায় হোসপাইপ নিয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের গোসলে সহযোগিতা করতে। উৎসব উপলক্ষে বুঁয়্যোল শহরের নানা স্থানে বসে গানের আসর। কুচকাওয়াজ, নাচানাচি এবং আতশবাজিও চলে সপ্তাহজুড়ে। টমেটো যুদ্ধের পর রাতে বসে রান্নাবান্নার প্রতিযোগিতা। এ যেন অন্য এক জগত। হাসি ঠাট্টা, হুল্লোড় সব দিকে।
তবে স্পেনের এই জনপ্রিয় খেলাটি আর শুধু স্পেনেই সীমাবদ্ধ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কলম্বিয়া, চিলিসহ বেশ কয়েকটি স্থানেই এখন প্রতিবছর আয়োজন হয় টমেটো লড়াইয়ের উৎসব। চিলির কুইলন শহরে বেশ ঘটা করে টমেটো যুদ্ধ উৎসবের আয়োজন করা হয়। গতবছর টমেটো ছুড়ে দেয়ার এ যুদ্ধে অংশ নেয় কমপক্ষে সাত হাজার মানুষ। সেখানে ব্যবহার করা হয় ৪০ টনেরও বেশি টমেটো। ওইদিন সব তরুণ-তরুণী শহরের রাস্তায় এসে হাজির হয়। চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো থাকে কয়েক টন পাকা টমেটো এবং বালতি বালতি তার রস। সবাই উপস্থিত হলে শুরু হয় ছোঁড়াছোঁড়ি। চিলিতে প্রথম উৎসবের আয়োজন করেন মিগুয়েল পেড্রেরস ও তার কয়েকজন বন্ধু। তবে বর্তমানে প্রশাসনই এর পুরো দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
পৃথিবীতে নানান দেশের নানান আচার। আমাদের দেশেও এমন অনেক ধরনের অনুষ্ঠান রয়েছে যা দেখতেও পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে লোক আসে। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়নে সেইভাবে বিদেশি পর্যটকদের উৎসাহিত করা যাচ্ছে না সঠিকভাবে। তা সত্ত্বেও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন দেশ থেকে পিপাসু মানুষ যোগদান করে। বর্ণিল এই শোভাযাত্রার মত বিদেশীদের আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের আছে প্রচুর উপাদান যা ধীরে ধীরে বিশ্ব সংসারে উম্মোচিত হবে এই আমাদের আশা।