ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় অমর একুশে বইমেলা। বাংলাদেশের বইপ্রেমীদের প্রাণের মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত এই মেলাটি এখন পরিণত হয়েছে উৎসবে। সারা পৃথিবীতেই এমন অনেক বইমেলা প্রাণ জুড়িয়ে দেয় বিশ্বের তাবৎ বইপড়ুয়াদের। বইয়ের লেখক থেকে শুরু করে প্রকাশনার প্রতিটি অংশের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠান, বইয়ের স্বত্ব কেনায় আগ্রহী ব্যক্তি এবং শিল্পমনস্ক মানুষের মিলনমেলায় রূপ নেয়া এমন কয়েকটি বিখ্যাত বইমেলার কথা থাকছে আজকের লেখায়।
কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা
এ বছর ২৫ জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা, চলবে ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ পর্যন্ত। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা হল এশিয়ার সবচেয়ে বড় বইমেলা। ঠিক আমাদের মতই ওখানেও এই বইমেলা গণ্য হয় উৎসব হিসেবে, কলকাতার একেবারে নিয়মিত জীবনযাপনের অংশ হিসেবে। আমাদের মতই, বই কিনি আর না-ই কিনি প্রতিদিন বইমেলায় যাওয়া চাই, এমন অসংখ্য মানুষ সেখানে আছেন। আর এ কারণেই, বইপ্রেমীদের বৃহত্তম সম্মিলনী হিসেবে কলকাতার বইমেলাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘অ-বাণিজ্যিক’ বই মেলা। বইমেলায় আগত মানুষের হিসেবে তো নিশ্চিতভাবেই এটি বলা যায়, কারণ এখন প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় এখানে।
১৯৭৬ সালে একেবারে ছোট পরিসরে ‘কলকাতা পাবলিশার্স এন্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ নামের একটি সংস্থার আয়োজনে এই বইমেলার প্রথম আয়োজন হয়েছিল। বইয়ের দোকানের স্বল্পতার বিপরীতে মানুষের বই কেনার আগ্রহের কথা বিবেচনা করেই শুরু হয়েছিল এই মেলা। সাধারণত প্রতি বছর জানুয়ারির শেষ বুধবারে শুরু হয় মেলা।
কলকাতা পাবলিশার্স এন্ড বুকসেলার্স গিল্ড ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয়োজনে ১৯৯২ এর আগ পর্যন্ত দুটো পৃথক বইমেলা হত কলকাতায়। সে বছর থেকেই দুটি মেলাকে একীভূত করে ফেলা হয়। এর আগে কলকাতার বিখ্যাত ‘ময়দান’ এর একপাশে মেলা আয়োজন করা হলেও ২০০৯ সাল থেকে এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে সায়েন্স সিটির কাছে ‘মিলন মেলা’ নামক জায়গায়।
প্রতি বছর কোন একটি দেশকে ‘মূল থিম’ এর মর্যাদা দিয়ে কলকাতা বইমেলা সাজানো হয়। ২০১৬ সাল ছিল চে গুয়েভারা’র বলিভিয়াতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ৫০ বছর পূর্তি, সে বছর এই বইমেলার মূল থিমের দেশ ছিল বলিভিয়া। ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে মনোনীত হয়েছিল কলকাতার বইমেলা। এ বছরের বইমেলা থিম নির্ধারিত হয়েছে কোস্টারিকা।
কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা
এ বছর ২৬ জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা, চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আরব বিশ্বের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম বইমেলা হল কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা। মিশরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই এই মেলার আয়োজন করে ‘জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অরগানাইজেশন’। আরবীয় প্রকাশনার জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই বইমেলাটিকে।
১৯৬৯ সালে কায়রোর বইমেলা শুরু হয়। মিশরের সরকারি প্রকাশক ও বিক্রেতাদের সংস্থা জেনারেল ইজিপশিয়ান বুক অরগানাইজেশন এই মেলার আয়োজন করে, সে বছরে কায়রো শহর প্রতিষ্ঠার ১০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। তখন থেকেই মেলা আয়োজনের দায়িত্বে আছে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এই আয়োজন।
পৃথিবীতে আরবি ভাষায় রচিত বইগুলোর গড়ে প্রতি পাঁচটির তিনটিই প্রকাশ করে কায়রো ভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থাগুলো। তাই আরব বিশ্বে বইয়ের জন্য সবচেয়ে বড় নাম হয়ে উঠেছে এই মেলা। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা মেলায় সভা, সেমিনার, লেকচার ইত্যাদি আয়োজনও থাকে। আরবি, ইংরেজি ও আরও কয়েকটি ভাষায় গোটা প্রদর্শনীর আয়োজনগুলো প্রদর্শিত হয় যাতে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছেই মেলা উপভোগ্য হয়ে উঠে। প্রতি বছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মিশরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয় কায়রোর বইমেলা।
লন্ডন বুক ফেয়ার
এ বছর মার্চের ১৪ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত চলবে লন্ডন বইমেলা। ইউরোপের বইপ্রেমীদের অন্যতম বৃহৎ মিলনমেলা ঘটে এখানে। ইউরোপিয়ান প্রকাশক, বিক্রেতা, এজেন্টদের তীর্থস্থান হিসেবেই খ্যাত লন্ডন বুক ফেয়ার।
১৯৭১ সালের নভেম্বরে একটি হোটেলের বেজমেন্টে লিওনেল লেভেনথাল নামক একজন প্রকাশকের উদ্যোগে এই বইমেলার গোড়াপত্তন হয়। প্রকাশকদের বইগুলো লাইব্রেরি মালিকদের কাছে সহজে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই মূলত নেয়া হয়েছিল এই উদ্যোগ। সেবারেই প্রতিষ্ঠা হয় ‘দ্য স্পেশালিস্ট পাবলিশার্স এগজিবিশন ফর লাইব্রেরিয়ানস (SPEX)’ নামক প্রতিষ্ঠান।
প্রথমবারের উদ্যোগের সফলতার কারণে ১৯৭২ সালের নভেম্বরে আবার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেবারেও অনুষ্ঠানটির সাফল্য দেখে নিয়মিতভাবে প্রতি বছর আরও বড় হতে থাকে আয়োজন। ১৯৭৫ সালে মেলার নাম দেয়া হয়, ‘SPEX’75: The London Book Fair’। দুই বছর পর থেকে SPEX অংশটি বাদ দিয়ে মেলা আয়োজিত হতে থাকে লন্ডন বুক ফেয়ার নামে।
২০০৬ সাল পর্যন্ত এই মেলা চলত অলিম্পিয়া এগজিবিশন সেন্টারে। সে বছর এটি সরিয়ে নেয়া হলেও ২০১৫ সালে আবার সেখানে ফিরিয়ে আনা হয় এবং এরপর থেকে সেখানেই এই আয়োজন চালিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই বইমেলায় এখন অন্তত ১০০ দেশ থেকে প্রকাশক, বিক্রেতা, এজেন্ট, লাইব্রেরিয়ান ও সাপ্লায়ার অংশগ্রহণ করেন।
টেলিভিশন, সিনেমা ও অডিও রেকর্ডের প্রতিষ্ঠানের নিকট বইয়ের স্বত্ব বিক্রি সহ প্রকাশনা শিল্পের যাবতীয় বাণিজ্যিক কাজ সম্পাদিত হয় এই মেলায়। কনফারেন্স, পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সভা, কর্মশালা, সেমিনার ইত্যাদির আয়োজন তো রয়েছেই।
বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা
আগামী ২৭ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম বইমেলাগুলোর একটি।
আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্স এর প্রতিষ্ঠিত ‘ফান্দাসিঁও এল লিব্রো’ নামক একটি অলাভজনক সংস্থা এই বইমেলার আয়োজন করে থাকে। লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, অনুবাদক, বিক্রেতা এবং প্রকাশনার সাথে জড়িতদের অংশগ্রহণে কনফারেন্স ও সভা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য। গবেষক ও লাইব্রেরিয়ানদের নিয়ে বিশেষ কনফারেন্স আয়োজন করা হয়।
১৯৭১ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে বুয়েন্স আয়ার্সে ৩৫টিরো বেশি বইমেলা আয়োজিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালে ‘আর্জেন্টাইন সোসাইটি অব রাইটার্স’ আর্জেন্টিনার সম্পাদনা সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করে এই বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৫ সালের মার্চে প্রথমবারের মত বুয়েন্স আয়ার্স আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সাড়ে সাত হাজার বর্গমিটার জায়গা নিয়ে অনুষ্ঠিত সেবারের মেলায় ৫০ জন লেখক এবং আর্জেন্টিনার বাইরের আরও ৭ টি দেশ অংশ নেয়। প্রথম বারেই বইমেলায় দর্শনার্থী হয়েছিল প্রায় দেড় লাখ।
এখন এই মেলার আয়োজন হয় আর্জেন্টাইন রুরাল সোসাইটির ৪৫ হাজার বর্গ মিটার এলাকা নিয়ে। অন্তত ৫০ টি দেশের অংশগ্রহণে এই মেলায় দর্শনার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লক্ষে। প্রতি বছর এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হওয়া এই মেলা চলে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলা
চলতি বছরের ১১ অক্টোবর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলা। ফ্রাঙ্কফুর্ট বই মেলাকে বলা হয় বাণিজ্যিক দিকে থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বই মেলা। আর দর্শনার্থীর আগমনের দিক থেকে ইউরোপে এর অবস্থান দ্বিতীয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রতি বছর অক্টোবরের মাঝামাঝিতে এই মেলার আয়োজন করা হয়। পাঁচ দিনব্যপী মেলার প্রথম তিনদিন থাকে কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আগমনকারীদের জন্য। পরবর্তী দুই দিন মেলা উন্মুক্ত থাকে সবার জন্য।
সারা পৃথিবী থেকে মানুষ এই মেলায় আসেন বইয়ের আন্তর্জাতিক প্রকাশনা স্বত্ব ও লাইসেন্সিং ফি নিয়ে দর কষাকষি করতে। ‘জার্মান পাবলিশার্স এন্ড বুকসেলার্স এসোসিয়েশন’ এর একটি সহযোগী সংগঠন এই মেলার আয়োজন করে। ১০০টিরও বেশি দেশ থেকে অন্তত ৭,০০০ সংস্থা অংশ নেয় এই মেলায়। আর এখন প্রায় তিন লক্ষ মানুষের আগমন ঘটে মেলায়। প্রকাশনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি ও বাণিজ্যের জন্য এই বইমেলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রকাশক, বইয়ের এজেন্ট, বিক্রেতা, লাইব্রেরিয়ান, গবেষক, শিল্পী, চলচ্চিত্র প্রযোজক, অনুবাদক, ছাপাখানা সংস্থা, ট্রেড এসোসিয়েশন, লেখক, সাংবাদিক, সফটওয়ার ও মাল্টিমিডিয়া পরিবেশক ইত্যাদি হরেক রকম মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই বইমেলা।
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার ইতিহাস সাড়ে পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরনো। ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছেই মেইনজে যখন জোহানেস গুটেনবার্গ ছাপাখানার প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেন, তখন স্থানীয় বই বিক্রেতাদের আয়োজনে প্রথমবারের মত বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। ছাপানো বইয়ের যুগ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ বাণিজ্যমেলাতে কেবল বইয়ের পান্ডুলিপি বিক্রি করা হত। এই বইমেলা শুরু হওয়ার পর এখানে বিদ্বান ব্যক্তিবর্গ ও বইয়ের ব্যবসায় আগ্রহী বণিকরা আসা শুরু করলেন। ১৭ শতকের শেষ পর্যন্ত এটি ছিল ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা। ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের যুগে লিপজিগ বই মেলা এর জায়গাটা দখল করে নিলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার হারানো শীর্ষস্থান ফিরে পায় ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা।
১৯৫০ সাল থেকে প্রতি বছর এই বইমেলা চলাকালীন ‘পিস প্রাইজ অব দ্য জার্মান বুক ট্রেড’ পুরস্কার প্রদান করা হয়। আরও একটি মজার পুরস্কার দেয়া হয় প্রতিবার। মেলায় প্রদর্শিত বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত নাম হয় যে বইয়ের, সেটিকেই এই পুরস্কারটি দেয়া হয়।
গুয়াডালাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলা (এফআইএল)
এ বছরের একেবারে শেষের দিকে, ২৫ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে গুয়াডালাজারা আন্তর্জাতিক বইমেলা। এটি হল স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের জন্য সবচেয়ে প্রখ্যাত বইমেলা। আগত দর্শনার্থীর দিক থেকে এর অবস্থান বুয়েন আয়ার্সের বইমেলার পরেই। এই বইমেলাটি এর স্প্যানিশ নামের আদ্যক্ষরগুলোর সমন্বয়ে পরিচিত ‘এফআইএল’ নামেও।
গুয়াডালাজারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে এই বইমেলা শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। মেক্সিকোর জালসিকোতে এটি আরম্ভ হয় প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ শনিবারে এবং চলে একটানা নয় দিন। ৪০ হাজার বর্গ মিটার জায়গা নিয়ে এই মেলার সর্বশেষ আয়োজনে ২০১৬ সালে অংশ নিয়েছে ৪৩ টি দেশ থেকে প্রায় দুই হাজার প্রকাশনা সংস্থা। সেবারে মেলায় দর্শনার্থী আসে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ জন।