বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পীর-আউলিয়া নিজ ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে উপমহাদেশে ইসলামের ভিত্তি মজবুত করেছেন। এই আত্মত্যাগী সাধকগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় শুধু ধর্মপ্রচারই করেননি, বরং অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় শাসকদের দুঃশাসন ও অনাচার থেকে জনগণকে রক্ষা করে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। যেসব আউলিয়া, পীর ও সাধক বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে প্রথমেই যার নামটি মনে আসে, তিনি হযরত শাহজালাল (রঃ)।
ঐতিহাসিকদের মতে, অলিকূলের শিরোমণি হযরত শাহজালাল (রঃ) ১২৭১ সালে রুম সালতানাতের (বর্তমান তুরষ্ক) কোনিয়া নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম শায়েখ-আল-মাশায়েখ মখদুম বিন মুহাম্মদ। তাঁর পিতা মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম কুরেশি ইয়েমেনের তাইজ-এর নিকটবর্তী ‘আজজান’ দুর্গের আমির এবং ইয়েমেনের সুলতানের হাদিস শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মাতার নাম ছিলো সৈয়দা হাসিনা ফাতিমা বিনতে জালালুদ্দিন সুরুখ বুখারী। পিতা ও মাতা উভয়ের দিক দিয়ে তিনি রাসুল (সঃ) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসেন (রঃ) এর বংশধর। হযরত শাহজালালের জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা এক খন্ড যুদ্ধে শহীদ হন এবং জন্মের তিন মাস পরে তাঁর মাতাও মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রতিপালনের ভার আসে মামা সৈয়দ আহমদ কবীরের উপর। তাঁর বাল্যকাল কাটে মামার বাসস্থান ও সাধনক্ষেত্র মক্কা শরীফে।
একাগ্র সাধনা এবং বিশ্বাসের বলে এই মহান সাধক নিগুঢ় আধ্যাত্মিক ক্ষমতা লাভ করেন। কিংবদন্তী আছে, তিনি যখন মক্কায় শিক্ষালাভ করছিলেন, তখন একদিন এক হরিণী বাঘের তাড়া খেয়ে তাঁর মামার কাছে নালিশ করে। আহমদ কবীর মনে মনে ভাবলেন বাঘটিকে ডান হাতের তিন ও বাম হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে চপেটাঘাত করে তাড়িয়ে দেবেন। মামার মনোষ্কামনা আধ্যাত্মিক ধ্যানবলে বুঝতে পেরে হযরত শাহজালাল নিজেই কাজটি করে ফেলেন। এই ঘটনার পরে তাঁর মামা তাঁকে বলেন, “তুমি কামিলিয়াত (আধ্যাত্মিক সম্পূর্ণতা) হাসিল করেছো, আমার কাছে শিক্ষা নেয়ার আর তোমার দরকার নেই।” হুজরা থেকে একমুষ্ঠি মাটি তুলে তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁর মামা বলেছিলেন, তুমি হিন্দুস্থান গিয়ে পবিত্র ইসলাম প্রচার শুরু করো; বর্ণে-গন্ধে এরকম মাটি যেখানে পাবে, সেখানে বসতি স্থাপন করবে।
মামার নির্দেশ মেনে ১৩০০ সালে তিনি হিন্দুস্থানে পৌছেন। একজন বিশিষ্ট শিষ্যকে যাত্রাপথে বিভিন্ন জনপদের মাটির বৈশিষ্ট্য তুলনা করে দেখার দায়িত্ব দেন। এই শিষ্যকে ‘চাষনী পীর’ উপাধি দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিলেটের মাটির সাথে মামার দেয়া মাটির মিল খুঁজে পান তিনি।
মক্কা থেকে হযরত শাহজালাল (রঃ) প্রথমে ইয়েমেন যান। সেখান থেকে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে দুই বছর পর হিন্দুস্থান অর্থাৎ ভারতবর্ষের দিল্লীতে পা রাখেন। সেই সময় দিল্লীর সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন খিলজী যার মুর্শিদ ছিলেন স্বনামধন্য পীর হযরত নিজাম উদ্দিন। তিনি হযরত শাহজালালের সাধুতা নিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দেহগ্রস্ত ছিলেন। তাঁকে আহবান করতে নিজাম উদ্দিন এক শিষ্যকে পাঠান। তাঁর সন্দেহের কথা টের পেয়ে হযরত শাহজালাল একটি কৌটায় জ্বলন্ত অঙ্গার ও তুলা পাশাপাশি রেখে শিষ্যটির হাতে পাঠিয়ে দেন। নিজাম উদ্দিন কৌটা খুলে হতবাক হয়ে যান। তুলা ও আগুন পাশাপাশি থাকার পরও তুলায় আগুন স্পর্শ করেনি।
এই বিস্ময়কর ঘটনায় নিজের অজ্ঞতা বুঝতে পেরে তিনি লজ্জিত হন। তিনি হযরত শাহজালাল (রঃ)-এর কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং নিজের পক্ষ থেকে দুই জোড়া কবুতর উপহার দেন। এই কবুতর হযরত শাহজালাল নিজের সাথে সিলেটে নিয়ে আসেন। এই কবুতরের জাতই বর্তমানে সিলেটে জালালী কবুতর হিসেবে পরিচিত। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই জালালী কবুতর যার বাড়িতে বাসা বাঁধবে, তার সমৃদ্ধির দিন আসবে।
ইয়েমেন থেকে বাংলার সুবিশাল যাত্রাপথে হযরত শাহজালালের সাথে একের পর এক আউলিয়া সহচর হিসেবে যুক্ত হতে থাকেন। তিনি যখন সিলেট পৌঁছেন, তখন তার সাথে ৩৬০ জন সুফি আউলিয়া ছিলেন। সিলেট সেই সময় গৌর গোবিন্দ নামক এক অত্যাচারী হিন্দু শাসকের অধীনে ছিলো। তার রাজ্যে মুসলিমদের গরু জবাই করা নিষেধ ছিলো।
তৎকালীন সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় বাস করতেন বোরহান উদ্দিন। তিনি শিশুপুত্রের আকীকার উদ্দেশ্যে গোপনে একটি গরু জবাই করেছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে গরুর মাংসের একটি টুকরা এক চিল গৌর গোবিন্দের প্রাসাদ প্রাঙ্গনে এনে ফেলে। অনুসন্ধান করে গৌর গোবিন্দ বোরহান উদ্দিনকে ধরে এনে তার ডান হাত কেটে দেন এবং তার নবজাত শিশুকে হত্যা করেন। বোরহান উদ্দিন সুলতান ফিরোজ শাহের নিকট প্রতিকার চাইলে সুলতান নিজ ভাগ্নে সিকান্দার গাজীকে গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।
সিকান্দার গাজী তার বাহিনী নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বদিকে উপস্থিত হন। কিন্তু গৌর গোবিন্দের বাহিনী অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। এভাবে কয়েকবার ব্যর্থ হয়ে তিনি জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হন। জ্যোতিষী বলেন, কোনো দরবেশের অধিনায়কত্ব ছাড়া গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করা যাবে না। সিকান্দার গাজী তখন হযরত শাহজালাল (রঃ) ও তার সহচরদের সাথে মিলিত হয়ে যৌথভাবে সিলেটের অভিমুখে রওনা দেন। এই বাহিনী বিনা বাধায় ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে কুমিল্লায় আসে। পরবর্তীতে গৌর গোবিন্দের রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে নবীগঞ্জের চৌকি পরগণায় উপস্থিত হন। সেখান থেকে বাহাদুরপুরে বোরাক নদীর তীরে আসেন। গৌর গোবিন্দ উক্ত নদীপথে আগেই নৌ-চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বলা হয় যে, হযরত শাহজালাল (রঃ) জায়নামাজে বসে সহচরদের নিয়ে নদী পার হন। তারপর শেখঘাটের দক্ষিণে বর্তমানে রেল স্টেশনের অদূরে সুরমা নদির তীরে আসেন। এখানেও নদীর খেয়া পারাপার বন্ধ থাকাতে আগের মতোই জায়নামাজে করে তিনি নদী পার হন।
একে একে সব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়াতে গৌর গোবিন্দ ভেঙ্গে পড়েন। শেষে তিনি একখন্ড লোহার ধনুক হযরত শাহজালালের কাছে প্রেরণ করে বলেন, কেউ এতে শর যোজনা করতে পারলে তিনি বিনা যুদ্ধে সিলেট ছেড়ে দেবেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) সঙ্গীদের আহবান করে বলেন, যে জীবনে আসরের নামাজ কাযা করেনি সে অগ্রসর হও। একমাত্র পাওয়া গেলো নাসির উদ্দিনকে।
এই নাসির উদ্দিন ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী। মহান আল্লাহর নাম নিয়ে তিনি ধনুতে শর যোজনা করে গৌর গোবিন্দকে প্রেরণ করেন। ভীত গৌর গোবিন্দ পালিয়ে গড়দুয়ারে টিলার উপর প্রাসাদে আত্মগোপন করেন। হযরত শাহজালাল (রঃ) শাহ চটকে আযান দিতে বলেন। আযান দেয়ার সাথে সাথে রাজার টিলার দুর্গ ভেঙ্গে পড়ে। গৌর গোবিন্দ পালিয়ে যান। “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি করতে করতে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সৈন্যবাহিনী সিলেটে প্রবেশ করে। জীবনের বাঁকি সময়টা হযরত শাহজালাল (রঃ) সিলেটেই অতিবাহিত করেন। ১৩৪৬ সালে এই মহান সাধক স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে যান।
বাংলাদেশে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সাথে যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে আছে হযরত শাহজালালের (রঃ) নাম। এক অনবদ্য সম্পর্ক মানুষ অনুভব করে তার সাথে। এই সম্পর্ক একইসাথে ভালোবাসার এবং শ্রদ্ধার। ইয়েমেনের লোককথায় এখনও পাওয়া যায় হযরত শাহজালালের নাম। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হন এই বাংলার মাটিতেই। বাংলাদেশের প্রধান এবং সর্ববৃহৎ বিমান বন্দরটি তাঁর নামে। বাংলাদেশের সবচাইতে অগ্রসর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টিও তাঁর নামে।
সিলেটের গণমানুষের কবি দিলাওয়ার রচিত একটি জনপ্রিয় গান আছে-
“তুমি রহমতের নদীয়া
দোয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া।
যেই দেশে আছিলা রসুল দয়ার পারাপার,
সেই দেশ হতে আইলায় তুমি রহমত আল্লাহর।
ছিলট ভূমি ধন্য হইলো তোমার পরশ পাইয়া,
দয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া।”
১৩৪৫ সালে বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা হযরত শাহজালালের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তার বর্ণনায় লম্বা গড়নের, কৃশদেহী, ফর্সা বর্ণের এক মানুষ ছিলেন হযরত শাহজালাল। সিলেটে হযরত শাহজালালের (রঃ) মাযারে রোজ হাজারো মানুষ আসেন শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। তাঁকে উসিলা হিসেবে ধরে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও মনোষ্কামনা পূরণ করতে আসে অগণিত মানুষ।