১৯৩৮ সালের ৩০ অক্টোবর। হ্যালোউইন উপলক্ষে বেশ তোড়জোড় চলছে আমেরিকায়। আবার যুদ্ধ যুদ্ধ ভাবটাও লেগে আছে। চাপা থমথমে নীরবতাও তাই সঙ্গী। সে রাতে অরসন ওয়েলসের একটা রেডিও অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে হ্যালোউইন উপলক্ষে বিশেষ পর্বে এইচ জি ওয়েলসের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ এর রেডিও নাটক তৈরি করেন অরসন ওয়েলস। ৬২ মিনিটের এই অনুষ্ঠানকে যতটা সম্ভব বাস্তবের কাছাকাছি করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।
প্রথমে রোজকার অনুষ্ঠান শুরু হলো। এরপর হঠাৎ সংবাদ আসা শুরু করল। বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকাতে অনুষ্ঠানের মাঝে সংবাদ সাধারণ ঘটনা ছিল। নাটকে মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীরা পৃথিবী আক্রমণ করে এই গ্রহের মানুষদের মেরে ফেলছিল। সম্প্রচারের পর খবর পাওয়া যায় হাজারো মানুষ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, কেউ কেউ পাহাড়ের দিকে রওনা দিয়েছে, কেউ ভয়ে মারা গেছে, কেউবা করেছে আত্মহত্যা। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গাড়ির সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
এই কাহিনী এতটাই প্রচলিত হলো যে পরবর্তী আট দশক ধরে এর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা কেউ করেনি। মানুষের উপর গণমাধ্যমের প্রভাব বোঝাতে যত ঘটনার ব্যবহার করা হয়, তার অন্যতম একটি এটি। অনেক দেশের পাঠ্যবইতে স্থান পাওয়া এই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল অনেক মানুষ। ফলে প্রাক-বিশ্বযুদ্ধীয় এই মানুষগুলোর দাবির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা তখনই সম্ভব হয়নি। তাহলে ঐতিহাসিক মার্কারি থিয়েটারের সিবিএস রেডিওর সেই রাতের আসল ঘটনা কী?
প্রচলিত ঘটনামতে, নিউ ইয়র্কের হাজার হাজার বাসিন্দা সে রাতে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। একটু বেশি কৌতূহলে কেউ কেউ আবার রাস্তায় হাজির হয়েছিল আন্তঃগ্রহ যুদ্ধের নমুনা দেখতে। ১৯৫৪ সালে নিউইয়র্ক ডেইলি নিউজের রেডিও সম্পাদক বেন গ্রস তার স্মৃতিকথায় লেখেন, ১৯৩৮ সালের সেই সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের রাস্তাগুলোকে প্রায় মরুভূমির মতো লাগছিল।
সেদিনকার অনুষ্ঠানে অরসন ওয়েলসরা নানা রকম ধোঁকার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার একটি ছিল বারে বারে আমেরিকার সেনাবাহিনীর রেডিওতে যোগাযোগ। সাথেই ছিল নিউজার্সির প্রিন্সটনে গ্রোভারস মিল বলে একটি জায়গা যে মঙ্গলবাসীদের দখলে চলে যাবার সংবাদ। গ্রোভারস মিলের বাসিন্দারাও কম যায় না! রাস্তার উপর বিশাল উঁচু পানির ট্যাংকের টাওয়ারকে তারা মঙ্গলবাসীদের যুদ্ধজাহাজ বানিয়ে ছাড়লো।
অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পর গুজবের যে হাওয়া বাতাসে ছড়িয়ে ছিল, রেডিও গবেষকেরা তার সত্যতা যাচাইয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে যান। খবর আসছিল অনেক মানুষ আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসারত। কিন্তু সেখানে তারা এর কোনো প্রমাণ পাননি। এমনকি তারা নিউইয়র্কের ছয়টি হাসপাতালে পরিসংখ্যান চালিয়ে এমন একজনও রোগী পাননি, যারা ওই নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান শুনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট দাবি করে যে এই অনুষ্ঠান শুনে একজন হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন। এই মানুষটির সন্ধান পুলিশ পায়নি। পুলিশ রেকর্ডে পাওয়া যায় সেদিন রেডিও সেন্টারে অসংখ্য মানুষ টেলিফোন করেছিল, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। কিন্তু এর এক-তৃতীয়াংশ ছিল এমন মানুষ, যারা আহত মানুষদের রক্ত দিতে কোথায় যাওয়া লাগবে, এটি জানতে চেয়েছিল। বাকি এক অংশ গালি দিচ্ছিল এত বেশি ভয় দেখানোর জন্য, শেষ অংশ শুধুই অসাধারণ রেডিও নাটকের জন্য শুভকামনা জানাতে টেলিফোন করে।
১৯৩৮ সালের সেই সন্ধ্যায় বেশি মানুষ কিন্তু রেডিও অনুষ্ঠানটা শোনেওনি। তারা জনপ্রিয় ভেন্ট্রিলোকুইস্ট এডগার বারগিনের অনুষ্ঠান শুনছিল। দুটো অনুষ্ঠান একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে হচ্ছিল। এডগার বারগিনের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। একটি টেলিফোন পোল তৈরি করে পরিসংখ্যান করার পর জানা যায়, মাত্র ২ শতাংশ মানুষ ওই রাতে ‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ শুনছিল।
অরসন ওয়েলস বোকা ছিলেন না। ‘সিটিজেন কেইন’, ‘দ্য ম্যাগনিফিশেন্ট এম্বারসনস’, আর ‘ওথেলো’র মতো চলচ্চিত্রের পরিচালক খুব ভালোভাবেই জানতেন তিনি কী করছেন। যদিও তিনি অনুষ্ঠানটিকে বাস্তবের কাছে নিতে চেয়েছিলেন, সম্ভাব্য বিপদের কথা জেনেই তিনি কোনো ঝুঁকি নেননি। ফলে অনুষ্ঠানের শুরুতেই ঘোষণা করা হয়েছিল নাটকের বিষয়ে। নাটক চলাকালে ৪০ আর ৫৫ মিনিটে আবারো সতর্কবাণী দেওয়া হয়।
এতকিছুর পরে কি সত্যিই মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল?
সম্প্রচারের ছয় সপ্তাহ পর একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। তারা স্বীকার করে, দশ লক্ষের মতো লোকের ঘটনা সঠিক নয়। আর যারা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছিল, তারা শুধুই বিচলিত হয়েছিল। বিচলিত হওয়া আর আতংকিত হওয়াকে একসাথে মিশিয়ে সংবাদ চলছিল বাতাসে।
পরদিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘শিকাগো হেরাল্ড’, ‘এক্সামিনার’, ‘স্যান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকেলে’র প্রধান সংবাদ হয়েছিল এটি। সীমানা ছাড়িয়ে ‘বোস্টন ডেইলি গ্লোব’ বা ‘ডেট্রয়েট নিউজ’ও ছেপেছিল আতংকিত মানুষের ঢলের খবর। তখনকার দিনে ইন্টারনেট ছিল না, তাতেই পত্রিকাগুলো ১২৫০০ প্রবন্ধ ছেপে ফেলেছিল এই বিষয়ে।
এমন নয় যে সংবাদপত্রের খেয়েদেয়ে কাজ ছিল না, তাই একটা সংবাদ বানিয়ে ফেলেছে। তাদের আসলে গভীর একটা উদ্দেশ্য ছিল। যেমন নিউইয়র্ক টাইমসের শিরোনাম ছিল “রেডিও থেকে আতংক”। শিরোনাম দেখে মনে হবে রেডিও কোনো ধরনের ভয় ছড়াচ্ছে, সামনেও এমন হতে পারে, তাই শ্রোতাদের উচিত রেডিও থেকে দূরে থাকা। শিরোনামের মাঝে চাপা সাবধানবাণী দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা। পহেলা নভেম্বর সম্পাদকীয় মন্তব্যে লেখা ছিল, “রেডিও তুলনামূলক নতুন হলেও তার অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এখনো পর্যন্ত নিজেকে সামলাতে পটু হতে পারলো না সে”।
রেডিও আসাতে সংবাদপত্রের যুগ তখন শেষের দিকে। যখন তখন সংবাদ পেতে অভ্যস্ত হয়ে মানুষ রেডিওর দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। সাথে বিজ্ঞাপনদাতারাও অধিকতর জনপ্রিয় মাধ্যম বেছে নিচ্ছিল। এতে করে সংবাদপত্রের দুনিয়ায় ভাটা পড়লো। অরসন ওয়েলসের অনুষ্ঠানের পর সংবাদপত্র এই সুযোগ লুফে নেয়। বিনিয়োগকারীদের তারা বোঝাতে চাচ্ছিল, রেডিও যন্ত্রটাকে আসলে বিশ্বাস করা যায় না।
এতকিছুর পরেও মার্কারি থিয়েটারের কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং ক্যাম্পবেল স্যুপ কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করে। পরে অনুষ্ঠানটি ‘ক্যাম্পবেল প্লেহাউজ’ নামে চলত। কেউ একজন সিবিএস রেডিওকে পঞ্চাশ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। একটা মাত্র ক্ষতিপূরণ সিবিএস রেডিও দিয়েছিল। এক লোক দাবি করেছিল, জুতা কেনার জন্য জমিয়ে রাখা টাকা দিয়ে সে এলিয়েন থেকে বাঁচতে ট্রেনের টিকেট কেটে ফেলেছে! সিবিএস রেডিও তাকে জুতার টাকা দিয়ে দেয়।
এরপর থেকে রেডিও অনুষ্ঠান শুনে আতংকে পালিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন রকম মজা শুরু হয়। সত্যতা নিরূপণ হয়ে গেলেও সত্যের চেয়ে মিথ্যেটা বেশি মজার বলে সেটা নিয়েই মানুষ চর্চা করতে থাকে। সিবিএস রেডিও কাউকে থামাতে চায়নি। ফলে দশকের পর দশক ধরে মানুষের উপর মিডিয়ার প্রভাবের এই কল্পকাহিনী পৃথিবীব্যাপী মানুষের আস্থা অর্জন করে ফেলে।
‘ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ কিন্তু পৃথিবীর প্রথম রেডিও ধোঁকা নয়। ১৯২৬ সালের ১৬ জানুয়ারি বিবিসিতে অষ্টাদশ শতকের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে বলতে বারো মিনিটের একটি সংবাদ বুলেটিন দেয়া হয়, যেখানে বলা হয়েছিল লন্ডনে দাঙ্গা চলছে, মর্টার দিয়ে বিগ বেন উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, স্যাভয় হোটেল নাকি আগুনে পুড়ে শেষ।
অরসন ওয়েলস পরিচালিত সেই নাটকটির স্ক্রিপ্ট নিলামে তোলা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। নির্মাতা স্টিভেন স্পিলবার্গ এটি ২৪০০০ ইউরোতে কিনে নেন। ২০০৫ সালে তিনি টম ক্রুজকে নায়ক করে ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’ সিনেমা তৈরি করেন।
ফিচার ইমেজ- Youtube