১৬৪২ সালের ২৪ নভেম্বর।
সুদূর নেদারল্যান্ডস থেকে আগত এক সমুদ্র অভিযাত্রী নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের নেশায় জাহাজে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আকণ্ঠ পিপাসার মতো তার সেই নৌভ্রমণ এশিয়ার সুদূর দক্ষিণে প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের মিলন এলাকায় নিয়ে এসেছিল। তবে তখনকার অভিযাত্রীরা শুধু আবিষ্কারের নেশায়ই নতুন পৃথিবীর সন্ধানে বেড়িয়ে পড়তেন- একথা সত্য নয়। বাণিজ্য ও সাম্রাজ্যের বেড়ে চলা ক্ষুধাও তাদের অভিযাত্রার অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করত। ফলে তাদের অভিযাত্রা হয়ে পড়ত ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসায় একতরফা মুনাফা অর্জনের উপায় খুঁজে বেড়ানো।
ওলন্দাজ অভিযাত্রী আবেল তাসমানের সমুদ্র অভিযাত্রায় তার নিজের আবিষ্কারের নেশা আর ইউরোপের বাণিজ্যের বাড়ন্ত ক্ষুধা মিলেমিশে ছিল- একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। আজ অস্ট্রেলিয়া উপকূলের দ্বীপ তাসমানিয়া তার নামেই পরিচিত হয়ে থাকে।
লিখিত দলিল দস্তাবেজ থেকে জানা যায় যে, আবেল তাসমান ১৬০৩ সালে বর্তমান নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিঞ্জেন প্রদেশের লুতজেগেস্ত নামের এক গ্রামে জন্মেছিলেন। সেসময় তার দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন নৌপথে সাফল্যের সাথে বিভিন্ন অভিযাত্রা পরিচালনা করছিল। সম্ভবত ছোটবেলা থেকেই তার মনে জাহাজে করে বিভিন্ন সাগরে অজানা দ্বীপের অনুসন্ধান করার ইচ্ছে জেগেছিল।
আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাবিক জীবনের শুরু হয় ১৬৩৩ সালে। এই বছরই তিনি নেদারল্যান্ডসের উত্তরাঞ্চলের ট্যাক্সেল এলাকা থেকে জাহাজে করে অজানা ভূখণ্ডের উদ্দেশে পাড়ি জমান। তবে এটি শুধুমাত্র আরম্ভ ছিল। তিনি তখনকার ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ অধ্যুষিত বাটাভিয়ায় অবতরণ করেন (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার এই অঞ্চল জাকার্তা নামে পরিচিত)। সেরাম দ্বীপে তিনি একটি অভিযাত্রায়ও অংশ নিয়েছিলেন। সেসময় এই অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের এক প্রাণঘাতী আক্রমণে তার কিছু সঙ্গী প্রাণ হারালেও ভাগ্যগুণে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
১৬৪২ সালে তাকে একটি বড় নৌ অভিযাত্রার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের তৎকালীন গভর্নর অ্যান্টনি ভ্যান ডেমিয়েন ছাড়াও কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য কর্নেলিস ভ্যান ডার লিজন, সলোমন সুইয়ার্স, জস্টাস স্কটেন ও কর্নেলিস উইটসেন তাকে এই অভিযাত্রায় অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক অনুমতি দেন। দক্ষিণ আফ্রিকা উপকূলের কেপ অভ গুড হোপ (উত্তমাশা অন্তরীপ), দক্ষিণ আমেরিকায় আর্জেন্টিনার কাছাকাছি স্ট্যাটেন দ্বীপ (বর্তমানে ইসলা দে লো এসতাদোস) ও বর্তমান পাপুয়া নিউগিনি অঞ্চলের সলোমন দ্বীপপুঞ্জে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা পরীক্ষা করা এই অভিযাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
১৬৪২ সালের ১৪ আগস্ট আবেল তাসমান তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে বাটাভিয়া থেকে সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেন। ৫ সেপ্টেম্বর তারা মরিশাস দ্বীপে পৌঁছান। পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি ও জাহাজ মেরামতের দরকারি কাঠ তারা মরিশাস থেকে পেলেন। মরিশাসের তৎকালীন ওলন্দাজ গভর্নর এড্রিয়ান ভ্যান ডার স্টেল তাদের অভিযানের প্রয়োজনে বিভিন্নভাবে সাহায্য করলেন। চার সপ্তাহ মরিশাসে থাকার পর তাসমান ও তার সঙ্গীরা ৮ অক্টোবর আবার সমুদ্রপথে জাহাজ ভাসালেন।
এবার তাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্বদিকে যতটা দ্রুত সম্ভব পাড়ি দেওয়া। বৈরী আবহাওয়ার কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন কিছুটা উত্তর-পূর্বদিকে যাওয়ার। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সলোমন দ্বীপপুঞ্জে সফলভাবে অবতরণ করা।
কিন্তু আবেল তাসমানের ভাগ্যে সম্ভবত অন্য কিছু লেখা ছিল।
১৬৪২ সালের ২৪ নভেম্বর আবেল তাসমানের জাহাজ এক অজানা দ্বীপে ভিড়ল। এই দ্বীপ তখন অবধি ইউরোপীয়দের কাছে অজানা ছিল।
তখনকার পশ্চিমা বিশ্বে ভারত মহাসাগরের সুদূর দক্ষিণ প্রান্তে এক বিশাল মহাদেশের অস্তিত্বের ধারণা বদ্ধমূল ছিল। এই কাল্পনিক মহাদেশ টেরা অস্ট্রালিস নামে পরিচিত ছিল। এই ভূখণ্ডের ধারণার পেছনে কোনো বাস্তব ভৌগলিক অভিজ্ঞতা বা মাপজোখের বাস্তবতা ছিল না, ছিল তখনকার ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কিছু প্রচলিত অনুমান। বলা হতো, উত্তরের বিস্তৃত মহাদেশীয় অঞ্চলগুলোর সাথে ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভারত মহাসাগরের দক্ষিণাঞ্চলে এক বৃহৎ মহাদেশ থাকার কথা। রোমান লেখক ম্যাক্রোবিয়াস থিওডোসিয়াসের লেখা থেকে এ তত্ত্বের কথা প্রথম জানা যায়। অনেকের মতে, ১৩ শতকের ইতালীয় পরিব্রাজক মার্কো পোলোও এই তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন।
আবেল তাসমানও হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি সেই কল্পিত মহাদেশের সমুদ্র উপকূলে এসে পৌঁছেছেন।
সেদিন আবেল তাসমান নেমেছিলেন এখনকার তাসমানিয়া দ্বীপের পশ্চিম তীরে। তার অবতরণের স্থানটি এখন ম্যাকুয়ার হারবার নামে পরিচিত। ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের গভর্নরের নাম অনুসারে তিনি এই নতুন অচেনা ভূখণ্ডের নাম রাখলেন ‘ভ্যান ডেমিয়েন’স ল্যান্ড’। এখানে এসে তিনি সম্ভবত কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন। নতুন এই দ্বীপটি ঠিক কতটা বড়? এটি কি বড় কোনো অজানা অনাবিষ্কৃত মহাদেশের কোনো প্রান্ত? নাকি নিউগিনি দ্বীপের অংশ?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে তিনি দ্বীপের আশেপাশের বিভিন্ন সমুদ্র অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তাসমানিয়া দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে যাওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল। তারপর দ্বীপটির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বার্নি আইল্যান্ড এলাকা ধরে এগিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আকস্মিক এক সামুদ্রিক ঝড়ে তার অভিযান সাময়িকভাবে ব্যর্থ হলো। যে উপসাগরীয় এলাকায় তিনি ঝড়ের কবলে পড়েছিলেন, পরে তার নাম হয় Storm Bay বা ঝঞ্ঝা উপসাগর। এর দু’দিন পর ১ ডিসেম্বর তিনি তাসমানিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ফোর্স্টিয়ার পেনিনসুলায় পৌঁছান। এই পুরো অঞ্চলের প্রায় সবটাই ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের কাছে অজানা ছিল।
তবে এমন ছোট ছোট দ্বীপের উপকূলে এসে হয়তো তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। কেননা তিনি বেরিয়েছিলেন কোনো এক বিরাট মহাদেশের খোঁজে। সুতরাং তাকে আবারও অজানার উদ্দেশে জাহাজ ভাসাতে হলো।
এবারে তার ইচ্ছে ছিল, উত্তরের দিকে জাহাজের মুখ ঘোরানো। কিন্তু সমুদ্রবায়ু জাহাজের গন্তব্য অনুযায়ী বেশ প্রতিকূল ছিল। সুতরাং, অনিচ্ছা থাকার পরও তাকে পূর্ব দিকে যাত্রা করতে হলো। মজার ঘটনা হচ্ছে যে, বাধ্য হয়ে জাহাজের দিক পরিবর্তনই আজও ইতিহাসের এক স্মরণীয় ঘটনার কারণ হয়ে আছে।
সেদিন ছিল ১৬৪২ সালের ১৩ ডিসেম্বর। আবেল তাসমান ও তার সফরসঙ্গীরা সম্পূর্ণ নতুন এক ভূখণ্ডে এসে পৌঁছুলেন। যে উপকূলে তারা অবতরণ করেছিলেন, তা ছিল বর্তমান নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ড বা দক্ষিণ দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। নিউজিল্যান্ড অঞ্চলে এটিই ছিল কোনো ইউরোপীয় অধিবাসীর প্রথম পা রাখা। আবেল তাসমান এই দ্বীপের নাম রাখলেন ‘স্ট্যাটেন আইল্যান্ড’। তিনি তখনও ভেবেছিলেন, তিনি দক্ষিণ-পূর্ব গোলার্ধের সেই কল্পিত মহাদেশের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে পা রেখেছেন।
এখান থেকে তিনি আবার জাহাজ নিয়ে প্রথমে উত্তরে ও পরে পূর্ব দিকে যাত্রা করলেন। নিউজিল্যান্ডের গোল্ডেন বে অঞ্চল থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে তিনি নোঙর ফেললেন। তার উদ্দেশ্য ছিল কোনো দ্বীপ থেকে পানের উপযোগী পানি সংগ্রহ করা। এজন্য সহযাত্রীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে কিছু নৌকা দিয়ে পাঠালেন। কিন্তু হঠাৎ এক মারাত্মক বিপত্তি এল। নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরিদের একটি দল দূর থেকে তাদের দেখে আক্রমণকারী হিসেবে সন্দেহ করেছিল। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী ‘ওয়াকা’ নামের নৌকায় যুদ্ধের সাজে এসে তারা একেবারে সশস্ত্র হয়ে হামলা করে বসলো। তাসমানের সঙ্গীরা এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। আদিবাসীদের ভারি গদার আঘাতে তাদের চারজন সঙ্গী নিহত হলো।
বিপদ দেখে আবেল তাসমান সেখান থেকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে সরে যেতে চাইলেন। সেসময় তিনি মাওরিদের আরও প্রায় ১২টি ‘ওয়াকা’ নৌকা দেখতে পেলেন। তার মধ্যে একটি নৌকা অন্যগুলোর চেয়ে সামনে এগিয়ে ছিল। তার জাহাজ থেকে তিনি ক্যানিস্টার কামান দাগলেন। গোলার আঘাতে মাওরি নৌকাটির সামনের অংশ ডুবে গেলো। এই দুর্ঘটনা ও হতাহতের জন্য তিনি উপসাগরটির নাম দিলেন ‘মার্ডারারস’ বে’ বা খুনিদের উপসাগর!
এবার ফেরার পালা। ইন্দোনেশিয়ার বাটাভিয়ার উদ্দেশ্যে ১৬৪৩ সালের ২০ জানুয়ারি টোঙ্গা দ্বীপের পাশ দিয়ে যাত্রা চলতে লাগল। সে বছরের ১৫ জুন আবেল তাসমান বাটাভিয়ায় পৌঁছলেন।
ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বড় কোনো মহাদেশ আবিষ্কার করতে না পারলেও আবেল তাসমান নতুন দু’টি ভূখণ্ড খুঁজে পেয়েছিলেন। তাসমানিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পা রাখা প্রথম শ্বেতাঙ্গ মানুষ হবার কৃতিত্ব তারই। প্রথমোক্ত অঞ্চলটির নাম তিনি ভ্যান ডেমিয়েন’স আইল্যান্ড রেখেছিলেন সত্য, কিন্তু আজ এটি তারই নামে ‘তাসমানিয়া’ হিসেবে পরিচিত।