পুরো পৃথিবীতে অপরাধী সংগঠনগুলোর সংখ্যা প্রায় অর্ধলক্ষের উপরে। শুধু মাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ত্রিশ হাজার। ২০০৭ এর হিসেব অনুযায়ী ইউনাইটেড স্টেটস জুড়ে সংগঠনগুলোর সক্রিয় সদস্য প্রায় আট লক্ষের বেশি। এছাড়াও লোকাল কমিউনিটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নয় লক্ষেরও বেশি সদস্য। যার পরিমাণ দিনের পর দিন বেড়েই যাচ্ছে। ‘দ্য গ্যাং বুক অফ ২০১২’ অনুযায়ী, ঐ সময় শিকাগোতে সংগঠিত হয় ৫৩২টি মার্ডার। শিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মতে এর প্রায় আশি শতাংশ মার্ডারের জন্য সংগঠনগুলো দায়ী। শিকাগোতে দেড় লক্ষ, গ্যাং ক্যাপিটেল অফ আমেরিকা খ্যাত লস এঞ্জেলেসে একলক্ষ বিশ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে যারা পুরোপুরি অপরাধী সংগঠনগুলোর হয়ে করে।
ম্যাক্সিকো, চায়না, জাপান, অস্ট্রলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, রাশিয়া সহ পুরো পৃথিবী জুড়ে এমন কয়েক হাজার সংগঠন রয়েছে যাদের মূল লক্ষ টাকা কামানো এবং নিজেদের শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, টাকার বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গুলোতে মদত দেওয়া, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, পতিতাবৃত্তি, এমনকি পলিটিকাল অ্যাসাসিনেশন গুলোতেও তারা জড়িত।
সদস্য সংখ্যা, আন্তর্জাতিক প্রসার, স্থানীয় প্রভাব এবং সহিংসতার মাত্রার উপর ভিত্তি করে এমনই পাঁচটি অপরাধী সংগঠনকে নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
আরিয়ান ব্রাদারহুড (Aryan Brotherhood)
আরিয়ান ব্রাদারহুড হচ্ছে পৃথিবীর সবচাইতে কুখ্যাত এবং প্রভাবশালী অপরাধী সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি। মাত্র দশ হাজার সদস্যের এই দলটি মূলত ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট প্রিজন গ্যাং’ হিসেবে খ্যাত। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোনো গ্যাং এর আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে মারামারি সহ বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা লেগে থাকাটা আমেরিকার কারাগারগুলোর নিত্যদিনের ঘটনা। ঝামেলাগুলো এক পর্যায়ে হত্যাতে গিয়েও পৌছায়। মূলত এসব ব্যাপারে কর্তৃত্ব ফলাতে, নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য কয়েকজন মিলে সান ফ্রান্সিসকোর ‘সান কুয়েনটিন’ কারাগারে ১৯৬৪ সালের দিকে সংগঠনটির পরিচালনা শুরু করে। বিভিন্ন দল থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আস্তে আস্তে দলটিতে নতুন সব সাদা চামড়ার সদস্য যুক্ত হতে থাকে। এর কিছু দিনের মধ্যে এটি আমেরিকার সবচাইতে হিংস্র এবং চরমপন্থী প্রিজন গ্যাং হিসেবে পরিচিতি পায়।
কারাগারের বাইরে হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, পতিতাবৃত্তির সাথে যুক্ত থাকলেও, সবচাইতে বেশি হত্যাকান্ডগুলো কারাগারের ভিতরে সম্পন্ন করে। ফেডারেল বুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এর মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে সংগঠিত হওয়া প্রায় ৩০ শতাংশ হত্যাকান্ডের জন্য আরিয়ান ব্রাদারহুড দায়ী। যদিও কারাগারে তাদের সদস্য সংখ্যা মাত্র দশমিক শূন্য এক শতাংশ। কারাবদ্ধ ড্রাগ লর্ডদের বাহিরের ব্যবসায়িক কাজে সহযোগীতা করা, টাকার বিনিময়ে অন্য কোনো দলের সদস্যদের হত্যা করা, জেল পালাতে সাহায্য করা, কারাগারের বাইরের দলীয় সমস্যার জের ধরে কারাগারের ভিতরে অন্য দলের সদস্যদের হত্যা করার মত জঘন্য কাজ গুলো তারা বেশি করে থাকে।
সংগঠনটি এবি, দ্য ব্যান্ড বা দ্য ওয়ান-টু নামে পরিচিত। অন্যান্য অপরাধী সংগঠনগুলোর মত এদের শরীরেও ট্যাটু আঁকা থাকে। কথিত আছে, কেউ যদি দলটির সদস্য হতে চায় তাহলে তাদের কথামত নির্দিষ্ট কোনো ব্যাক্তিকে হত্যা করতে হবে।
ইয়াকুজা (Yakuza)
ইয়াকুজা মূলত অন্যান্য অপরাধী সংগঠনের তুলনায় তাদের কম হিংস্রতার কারণে জনপ্রিয়। জাপানের প্রায় সব ধরনের বৈধ অবৈধ ব্যবসায় তাদের শেয়ার আছে। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক, আন্তর্জাতিক আমলাদের সাথে তাদের উঠাবসা। এটি এমন একটি দল যাদের নিজস্ব কর্পোরেট হ্যাডকোয়ার্টার, বিজনেস কার্ড আছে। নির্ভয়ে নিজেদের প্রভাব জাহির করার মাধ্যমে চটকদার স্যুট গায়ে চাপিয়ে কর্পোরেট আমলাদের মত লাক্সারিতে করে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা রয়েছে।
সবচাইতে পুরোনো অপরাধী সংগঠনগুলোর মধ্যে ইয়াকুজা অন্যতম। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা হয় সতেরো শতকের দিকে। এদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় দুইলক্ষ পঁচিশ হাজারের বেশি। এলাকা, ব্যবসার ধরনের উপরে নির্ভর করে দলটি বিভিন্ন ভাবে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান চারটি দল ইয়ামাগুচি-গুমি, সুমিইউশি-কাই, ইনাগাওয়া-কাই, আইযুকুতেতসু-তাই। এদের মধ্যে সবচাইতে বড় দলটি ইয়ামাগুচি-গুমি। এই দলটির সদস্য সংখ্যা প্রায় পঞ্চান্ন হাজার, যারা প্রায় ৮৫০টি আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
সংগঠনটি শুরুর দিকে বিভিন্ন ধরনের ক্যাসিনো পরিচালনা করতো। নিজেদের জুয়া খেলার ক্লাবগুলোর নিরাপত্তা দেওয়া, পতিতাবৃত্তি, চোরাচালানী ছিল প্রথম দিকের ব্যবসা গুলোর মধ্যে অন্যতম। পরবর্তিতে অবশ্য সব ধরনের বৈধ, অবৈধ ব্যবসায় জড়ায়। কন্ট্রাক্ট কিলার ভাড়া দেওয়া, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান বা ব্যবসায়িকদের নিরাপত্তা দেওয়া, পতিতাবৃত্তি, মাদক ব্যবসা সহ নানান কাজে। মজার বিষয় হচ্ছে, জাপানের সাধারণ জনগণ অনেক ব্যাপারে পুলিশ বা অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে এই দলটির উপর বেশি আস্থাশীল।
এত বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করে টিকে থাকার মূল কারণ হচ্ছে দলীয় সদস্যদের বিশ্বস্ততা। দলীয় প্রধানদের বিশ্বস্ত হওয়ার জন্য ইয়াকুজার সদস্যরা তাদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন রাখে। কোনো একটা মিশনে ব্যর্থ হলে প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে নিজের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলার নজিরও রয়েছে। মূল কার্যক্রম জাপান ভিত্তিক হলেও কুরিয়া, চায়না, রাশিয়া, ইউএসএতেও এদের প্রভাব রয়েছে।
সন্সসেভসকায়া ব্রাতভা ( Solntsevskaya Bratva)
সন্সসেভসকায়া ব্রাতভা বা সন্সসেভসকায়া ব্রাদারহুড রাশিয়ার সবচাইতে আক্রমনাক্তক, হিংস্র এবং শক্তিশালী অপরাধী সংগঠন। তবে সংগঠনটির সম্পর্কে তথ্য খুব কমই রয়েছে। যতটুকু জানা যায়, ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দলটির প্রতিষ্ঠাতা সেরগেই মিখাইলভ (Sergei Mikhailov)। নিজেকে তিনি মাফিয়া প্রধান থেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। অবৈধ ব্যবসার পাশাপাশি রাশিয়া এবং রাশিয়ার বাইরে প্রায় একশোর উপরে বৈধ ব্যবসাও আছে। নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য হত্যা, গুম, অপহরণের মত হিংস্র কাজগুলো তাদের নিত্যদিনের রুটিন ওয়ার্ক। বিশেষ করে ব্যবসায় নিকট প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাফ করে দেওয়া, পতিতাবৃত্তি, অস্ত্র ব্যবসা, অর্থপাচার, স্টক ফ্রড, অনলাইন স্ক্যাম, হ্যাকিং ইত্যাদি অবৈধ কাজগুলো হিংস্রতার সাথে করে থাকে। এছাড়াও এরা রাশিয়ান আন্ডারওয়ার্ল্ডের ছোট বড় ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশনগুলোকে ভার্চুয়ালি ডমিনেট করে থাকে।
বেকার যুবক, মেধাবী ছাত্র, শক্তিশালী এবং কোনো অপরাধের সাথে জড়িত আছে এমন লোকদের দলের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করে থাকে। দলের ভিতরে একে অপরকে ভাই বলে ডেকে থাকে এবং প্রত্যেকে ‘ব্রাদারহুড কোড’ মেনে চলে। এদের মিত্র সংগঠনগুলো হলো চাইনিজ ট্রেডস, আলবেনিয়ান মাফিয়া, ইতালিয়ান মাফিয়া ফেমিলি, সারবিয়ান মাফিয়া, কলাম্বিয়ান কার্টেলস।
রাশিয়া ছাড়াও লস এঞ্জেলেস, শিকাগো, মিয়ামি, ইউক্রেইন, ইতালি, হাঙ্গেরি, ইজরায়িল, ফ্রান্স, কানাডা সহ ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। বার সদস্যের একটি কাউন্সিল এ দলটির পরিচালনায় রয়েছে। যারা ‘সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত। দলটির বার্ষিক আয় প্রায় আট বিলিয়ন ডলার।
লস সেতাস (Los Zetas)
ইউএস গভমেন্টের মতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে অগ্রসর, বাস্তবধর্মী, দক্ষ এবং সবচাইতে হিংস্র দলটি হলো মেক্সিকান অপরাধী সংগঠন লস সেতাস। ১৯৯৯ থেকে চলমান দলটির প্রতিষ্ঠাতা Osiel Cárdenas Guillén এবং Arturo Guzmán Decena নামের দুইজন ড্রাগ লর্ড। দলটির বর্তমান প্রধান ওমার ত্রিভিলু মুরালেস।
লস সেতাস মূলত মেক্সিকান আর্মির একটি এলিট ফোর্স ছিল। ১৯৯০ এর দিকে অন্য আরেকটি দল ‘গালফ কার্টেল’এর সাথে যুক্ত হয়ে অপরাধ জগতে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করে। সময়টা তখনকার যখন পুরো মেক্সিকো জুড়ে মেক্সিকো আর্মির ‘এন্টি ড্রাগ অপারেশন’ চলছিল। ১৯৯৯ এর শেষের দিকে অবশ্য গালফ কার্টেল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লস সেতাস নিজেদের দল পরিচালনার কাজে মন দেয়।
দলটির সদস্য সংখ্যা কম হলেও দলের প্রত্যেকে উন্নত প্রযুক্তির সাথে পরিচিত এবং প্রশিক্ষিত। পুরো একটি শক্তিশালী মিলিটারি ফোর্স। সংগঠনটি এতোই প্রভাবশালী যে, ২০১২ সালের দিকে মেক্সিকো মেরিনের কাছে সংরক্ষিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়া এক নেতার লাশ চুরি করতেও সফল হয়।
হেল’স এঞ্জেলস (Hell’s angels)
‘হার্লি ডেভিটসন’ মোটরসাইকেল চড়ে মহড়ায় বের হওয়া কুখ্যাত ‘উইংড ডেথ হেডস’ জ্যাকেট পরিধানরত দলটি হেল’স এঞ্জেলস। পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় মোটরসাইকেল ক্লাবগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিজেদের আইন-মেনে-চলা সংগঠন হিসেবে পরিচয় দেয়া দলটির সদস্যরা সবচাইতে বেশি আইন ভঙ্গ করে থাকে। ইন্টারন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এঞ্জেন্সির তালিকা ভুক্ত ‘বিগ ফোর’ উল্লেখ্য চারটি মোটরসাইকেল গ্যাং পেগান, আউটলস এবং ব্যানডিডোসের মধ্যে হেল’স এঞ্জেলস অন্যতম। ডাকাতি, মাদক ব্যবসা, অবৈধ পণ্য পাচার আর বিশেষ করে ইউএসএ এবং কানাডার নৈশপ্রমোদ ইন্ড্রাসটিগুলোতে হেল’স এঞ্জেলসের প্রভাব রয়েছে।
সংগঠনটি ১৭ মার্চ, ১৯৪৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ফোনটানাতে আমেরিকান যুদ্ধ অভিবাসী একটি বিশপ পরিবার প্রতিষ্ঠা করে। মূলত ‘Pissed off bastard of Bloomington’ এর মত ছোট বড় অনেকগুলো মোটরসাইকেল ক্লাবের সদস্যদের একত্রিকরণের মাধ্যমে সংগঠনটি সামনের দিকে আগায়। সারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০টি দেশে ৪২৫টি দলে বিভক্ত। হেল’স এঞ্জেলস মূলত ওয়ার্ল্ড ওয়ার দুই’য়ে চায়নাতে অংশগ্রহন করা একটি বিমানবাহিনীর দল। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে দলটির সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা অরভিড ওলসেন এই নামটি দেন।
হেল’স এঞ্জেলস এর সদস্য হতে হলে অবশ্যই আপনাকে ৭৫০সিসির উপরে মোটর সাইকেল চালানোর বৈধ লাইসেন্সধারী হতে হবে।