একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন তো। কোনো একদিন ঘুম থেকে উঠে আপনি দেখতে পেলেন, আপনার ইমেইল একাউন্ট ভরে গিয়েছে হাজার হাজার স্প্যাম ইমেইলে, আর আপনার একাউন্টে এই ইমেইল হামলা চালিয়েছে আপনার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটি। একবার ভাবুন তো, আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?
ঠিক এমনই একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছিল ১৮৩৫ সালে আমেরিকার দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের সময়। নিশ্চয়ই ভাবছেন, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে ইমেইল আসবে কোথা থেকে? সেই যুগে ইমেইল ছিল না, ঠিকই কিন্তু মেইল বা ডাকযোগে প্রেরিত চিঠি ছিল। হঠাৎ একদিন আমেরিকার দক্ষিণের শহর চার্লস্টনের ডাক অফিসে জাহাজে করে স্প্যাম ইমেইলের মতো হাজার হাজার চিঠি আসলো। গোটা শহরের মানুষ তো হতবাক। কারা চালালো এই চিঠি হামলা?
দাসপ্রথার প্রশ্নে আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের স্টেটগুলো তখন দ্বিধাবিভক্ত ছিল। দক্ষিণের স্টেটগুলো ছিল দাসপ্রথার পক্ষপাতী, অন্যদিকে উত্তরের স্টেটগুলো এই ঘৃণ্যপ্রথার বিরুদ্ধে। তাই দাসপ্রথার বিরুদ্ধে দক্ষিণের মানুষদের সচেতন করার জন্য ১৮৩৫ সালের জুলাই-আগস্টের দিকে উত্তর থেকে ডাকযোগে পাঠানো হয়েছিল হাজার হাজার প্রচারপত্র। আমেরিকার ইতিহাসে নজিরবিহীন এই ঘটনা ১৮৩৫ এর অ্যাবলিশনিস্ট প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইন হিসেবে পরিচিত। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে চার্লস্টন মেইল ক্রাইসিস হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বিরোধীপক্ষের চিঠি হামলা দক্ষিণের মানুষ সহজভাবে নেয়নি। বিক্ষোভে ফেটে পড়লো দক্ষিণীরা। শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি শান্ত হলো খোদ প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে। আমেরিকার দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে ১৮৩৫ সালের প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইন একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। অ্যাবলিশনিস্ট প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের আদ্যোপান্ত নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ফিচারটি।
আমেরিকার দাসপ্রথা এত আলোচিত কেন?
আমেরিকার দাসপ্রথা নিয়ে যে পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, তা পৃথিবীর অন্য কোনো কালের বা স্থানের দাসপ্রথা নিয়ে হয়নি। এর পেছনের কারণ সুস্পষ্ট। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপে দাসপ্রথা সব সময়ই ছিল। কিন্ত সেই দাসপ্রথা নির্দিষ্ট কোনো জাতি, ধর্ম বা গাত্রবর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সামাজিক মর্যাদায় কৃতদাস এমন অসংখ্য মানুষ যুগে যুগে এশিয়া ও আফ্রিকায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন। মিশরের মসনদে দাসেরা রাজত্ব করেছিল দীর্ঘদিন। ইতিহাসে তারা মামলুক হিসেবে পরিচিত। এদিকে দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুদ্দীন আইবেক নিজেও ছিলেন একজন দাস। কিন্তু আমেরিকায় গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে যেভাবে পণ্যায়ন করা হয়েছে, ইতিহাসে তা ছিল নজীরবিহীন। তবে এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই, আফ্রিকার কালো মানুষদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করার মতো ঘৃণ্য কাজের দায় যদি ইউরোপের সাদা মানুষের উপর বর্তায়, তবে সেই কালিমা মোচনের কৃতিত্বটাও কিন্ত তাদের সন্তানদেরই প্রাপ্য। উনবিংশ শতকের প্রথম অর্ধশত বছর আমেরিকার জমিন থেকে দাসপ্রথার শেকড় চিরতরে উপড়ে ফেলার জন্য চলেছে বেশ কয়েকটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন, আইনী যুদ্ধ এবং সশস্ত্র সংগ্রাম, যা শেষ অবধি ১৮৬০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেলে নিয়েছিল গৃহযুদ্ধের দিকে।
যেমন ছিল উনবিংশ শতকের আমেরিকা
উনবিংশ শতকে শিল্পবিপ্লবের সাথে সাথে ইউরোপে পেশি শক্তির প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই ফুরিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া ইউরোপে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিকাশ ও গণতন্ত্রের ধারণা মজবুত হওয়ার ফলে দাসপ্রথার কুৎসিত দিক মানুষের চোখে ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করলো। এছাড়া ইউরোপে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল অপ্রতুল, কিন্তু সেই অনুপাতে জনসংখ্যা ছিল বিপুল। ক্রমশ শিল্পোন্নত হতে থাকায় উনবিংশ শতকের শুরুতে পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্র চিরতরে বিদায় নিল। তদুপরি ফরাসি বিপ্লব গোটা ইউরোপকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যার একটি অনিবার্য পরিণতি ছিল দাসপ্রথার বিলুপ্তি এবং এতকাল ধরে চলে আসা শাসক ও অভিজাত শ্রেণীর সীমাহীন ক্ষমতাকে খর্বকরণ। ফলস্বরূপ উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপের পরাশক্তিগুলো দাসপ্রথা অবসানে তৎপর হয়।
এদিকে পরিবর্তনের এই হাওয়া শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ রইলো না, বয়ে এলো আটলান্টিকের ওপারেও। উনবিংশ শতকের প্রারম্ভে আমেরিকার উত্তরের স্টেটগুলোতে দাসপ্রথা ক্রমন্বয়ে বিলুপ্ত হতে শুরু করলো।
আমেরিকার ইতিহাস সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় যাওয়ার আগে এর ভৌগলিক বিবর্তন সম্পর্কে জানা দরকার। আমেরিকার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৭৭৫ থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত চলা স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে। অনেকের ধারণা, স্বাধীনতা অর্জনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমারেখা বুঝি এখনকার মতো ছিল। মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকার পঞ্চাশটি প্রদেশের মধ্যে মাত্র তেরটি প্রদেশ সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিয়েছিল। তেরটি রাজ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের পর বাকি ৩৭টি রাজ্য ধীরে ধীরে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিয়েছে। সেই ইতিহাস অবশ্য বেশ লম্বা।
প্রাথমিকভাবে যোগ দেওয়া তেরটি রাজ্যের সবগুলোই ছিল পূর্ব উপকূলের। উত্তর আমেরিকার মধ্যভাগের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিলো স্পেন ও ফ্রান্সের কলোনি। ১৮০৩ সালে ‘লুইজিয়ানা পারচেজ’ এর মাধ্যমে এগুলো আমেরিকার অন্তর্ভূক্ত হয়। এছাড়া পশ্চিম উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল স্প্যানিশ টেরেটরি, যেগুলো পরবর্তীতে মেক্সিকোর অন্তর্ভূক্ত হয় এবং মেক্সিকান-আমেরিকান যুদ্ধের পর যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে।
আমেরিকার মূল ভূখন্ডের একদম দক্ষিণের রাজ্য টেক্সাস একসময় ছিল মেক্সিকোর অংশ। তারপর ১৮৩৬ সালে টেক্সাস মেক্সিকো থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৮৪৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমানা বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া পুরো উনবিংশ শতক ধরে ধাপে ধাপে সংঘটিত হয়েছিল। এই ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, কার্যত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকাঠামোর আওতায় আসলেও আমেরিকানদের আদর্শিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট সর্বত্র একরকম ছিল না। আর এ কারণেই দাস প্রথা বিলোপের প্রশ্নে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
উত্তর বনাম দক্ষিণ
১৯৩০ সালের আগে মার্কিন দাসপ্রথা বিরোধীরা বিশ্বাস করতেন, সময়ের সাথে সাথে আমেরিকায় এই কুপ্রথা এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে এত সহজে দাসপ্রথার অবসান ঘটেনি। এর কারণ উনবিংশ শতকে কৃষিনির্ভর মার্কিন অর্থনীতি। দক্ষিণের অঞ্চলগুলো বিভিন্ন অর্থকরী ফসল, বিশেষত তুলা ও আখের এক বড় অংশ জোগান দিত। দক্ষিণের উৎকৃষ্ট জমিগুলোর বেশিরভাগই ছিল ধনী কৃষকদের দখলে। কৃষিক্ষেত্র তখনও যান্ত্রিকীকরণ না হওয়ায় তৎকালীন কৃষি ছিল পুরোপুরি পেশিশক্তি নির্ভর, আর আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা ছিল এই ধনী জোতদারদের শক্তির প্রধান উৎস। অধিকাংশ ধনী আখ চাষীদের ছিল নিজস্ব চিনির কল। তাই মার্কিন অর্থনীতিতে দাসদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য দক্ষিণের অধিকাংশ মানুষ ধনী জোতদার ছিল না। তারপরও এক হিসেবে দেখা গেছে দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন দাস মালিক।
এদিকে ব্রিটেনের মাটিতে ১৭৭২ সালেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও বিভিন্ন ব্রিটিশ কলোনিগুলোতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হতে সময় লেগেছে আরো ৬১ বছর। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ কলোনিগুলোতে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে । নিঃসন্দেহে আমেরিকার দাসপ্রথাবিরোধীদের কাছে এই ব্যাপারটি আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু ঐ সময় মিসিসিপি ও আলাবামায় দাসপ্রথার দ্রুত বিস্তারের ফলে একইসাথে তারা যথেষ্ট শংকিতও ছিলেন। বাস্তবতা হলো, ১৮৩০ এর দশকে আমেরিকার দাসপ্রথাবিরোধীদের ভিত তেমন মজবুত ছিল না। উপরন্তু মার্কিন অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র ছিল দক্ষিণে। ফলে দক্ষিণের দাসপ্রথা সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে খুব দ্রুত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হবে না সেটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল।
প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের সূচনা
দাসপ্রথা যখন দক্ষিণের মার্কিন সমাজে একদম জেঁকে বসেছে, তখন ১৮৩৩ সালে ফিলাডেলফিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় দ্য আমেরিকান এন্টি স্লেভারি সোসাইটি। এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত দাসপ্রথাবিরোধী কর্মী উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন। নবগঠিত এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধিকাংশ আমেরিকানই ওয়াকিবহাল ছিলেন না। সংগঠনটির সদর দপ্তর ছিলো নিউ ইয়র্কে। সংগঠনটির অর্থ সংকট ছিল, অভাব ছিল বড়সড় পৃষ্ঠপোষকের। তাছাড়া এই সোসাইটির প্রচারপত্র ‘এমানসিপেটর’ এরও কোনো বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল না। তাদের প্রকাশিত লেখাগুলোর বিষয়বস্তু ছিল নিউ ইয়র্ককেন্দ্রিক এবং পত্রিকাটির সম্পাদকীয়তে ক্ষুরধার লেখারও যথেষ্ট অভাব ছিল।
এছাড়া অভ্যন্তরীণ বিভাজন সংগঠনটিকে ক্রমে দুর্বল করে তুলছিল। একপর্যায়ে সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট আর্থার ট্যাপান পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর চিন্তাও করছিলেন। এদিকে অর্থ সংগ্রহ এবং দাতাদের অনুগ্রহ পেতে তাদের প্রয়োজন ছিল জোরেসোরে প্রচারণা চালানোর। ১৮৩৫ সালে মে মাসে বার্ষিক সভায় আর্থার ট্যাপানের ভাই লুইস ট্যাপান প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
ডেলিগেটরা এই প্রস্তাবে সম্মত হন। তারা জানতেন দক্ষিণের মাটিতে দাঁড়িয়ে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। ট্যাপান ভ্রাতৃদ্বয় ছিলেন প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের সিংহভাগ অর্থের জোগানদাতা। প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বিশ হাজার অধিবাসীর নামে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তবে জুলাই মাস নাগাদ নিউ ইয়র্ক পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পাঠানো প্রচার পত্রের সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজারে।
দক্ষিণে অ্যাবলিশনিস্ট প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের প্রতিক্রিয়া
১৮৩৫ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে প্রথমবারের মতো দাসপ্রথা বিরোধী প্রচারপ্রত্র নিয়ে রওনা হলো নিউইয়র্ক থেকে চার্লস্টনে নিয়মিত চলাচল করা কার্গো স্টিমার কলম্বিয়া। সে যাত্রায় পাঠানো প্রচারপত্রগুলো ১৮৩৫ সালের ২৯ জুন চার্লস্টনে প্রাপকদের হাতে পৌঁছালো। হতবুদ্ধি প্রাপকেরা অতিসত্ত্বর প্রচারপত্রগুলো ডাক অফিসে ফেরত দিলেন। ঘটনার প্রেক্ষিতে চার্লস্টনের স্থানীয় সংবাদপত্র সাউদার্ন প্যাট্রিয়ট বিষয়টিকে ডাক ব্যবস্থার বিশ্রীতম অপব্যবহার হিসেবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো। পাশাপাশি তারা বিষয়টিকে ‘নৈতিক বিষ’ আখ্যা দিয়ে এ ঘটনার আশু প্রতিকার কামনা করলো।
পরবর্তী চারদিন, অর্থাৎ পয়লা আগস্ট পর্যন্ত বন্দরে চিঠি আসতে থাকলো। চার্লস্টনের পরিস্থিত ক্রমে উত্তপ্ত হতে শুরু করলো। চার্লস্টনের পোস্টমাস্টার হিউগার নিউ ইয়র্কের পোস্টমাস্টারকে দাসপ্রথাবিরোধী প্রচারপত্র না পাঠাতে অনুরোধ করলেন। এছাড়া চার্লস্টনে একটি কাউন্সিল গঠিত হলো যারা তৎকালীন পোস্টমাস্টার জেনারেল আমোস ক্যান্ডালের নির্দেশনা আসার আগপর্যন্ত বন্দর থেকেই নিউ ইয়র্ক থেকে আসা প্রচারপত্রগুলো সন্তর্পণে সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে পোস্ট মাস্টার হিউগারকে সহায়তা করতে রাজি হলো। ডাকযোগে আবারো চিঠি হামলা হতে পারে এই সন্দেহে দাসপ্রথার সমর্থক উত্তেজিত জনতা চার্লস্টনের রাস্তায় রাস্তায় সমবেত হতে শুরু করলো। চার্লস্টনে মুক্ত কৃষাঙ্গদের স্কুল ও ক্যাথোলিক চার্চে তারা হানা দিল। এছাড়া পোস্ট অফিসে অনুপ্রবেশ করে তাদের কাছে যে কাগজগুলো আপত্তিকর মনে হলো সেগুলো সরিয়ে ফেললো। অত্যুৎসাহী জনতার এসব উচ্ছৃংখল কর্মকান্ডকে সাউদার্ন প্যাট্রিয়ট সময়োচিত নয় বলে আখ্যায়িত করলো। তবে একইসাথে তারা এটাও দাবি করল যে, চরমপন্থার মোকাবেলা চরমপন্থা দিয়েই করতে হয়।
শুধু চার্লস্টনেই নয়, দক্ষিণের অন্যান্য শহরেও দাসপ্রথা সমর্থকেরা ক্ষোভে ফেটে পড়লো। পুরো দক্ষিণ তখন দাসপ্রথা বিরোধীদের এহেন কর্মকান্ডে প্রচন্ড ক্রুদ্ধ। প্রচারপত্রগুলোতে দাসদের নির্যাতনের বিভিন্ন ছবি মুদ্রিত ছিল। এসব ছবি সম্ভাব্য দাস বিদ্রোহের ইন্ধন যোগাতে পারে এই আংশকায় তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। উত্তেজিত জনতা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে দাসপ্রথা বিরোধী প্রচারপত্রগুলো পুড়িয়ে ফেললো, পোড়ানো হলো দ্য আমেরিকান এন্টি স্লেভারি সোসাইটির নেতৃস্থানীয়দের কুশপুত্তলিকা। আইনসভার বৈঠকগুলোতেও চললো তুমুল আলোচনা ও হট্টগোল। দক্ষিণের রাজনীতিবিদরা এই কর্মসূচিকে তাদের সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। কারণ দাসপ্রথা সংবিধানে বৈধ।
এদিকে ৪ আগস্ট পোস্টমাস্টার হিউগারের চিঠি পোস্টমাস্টার জেনারেল ক্যান্ডালের কাছে পৌঁছালো। ক্যান্ডাল জানালেন, চিঠিগুলো থেকে প্রচারপত্র সরিয়ে ফেলা পোস্ট অফিসের জন্য আইনসিদ্ধ হবে না। তবে অভূতপূর্ব এই পরিস্থিতিতে তিনি চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারলেন না। ক্যান্ডালের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল নিউ ইয়র্কের পোস্ট অফিস। অবশ্য তারা চূড়ান্ত নির্দেশনা পাবার আগপর্যন্ত প্রচারপত্র সম্বলিত চিঠি পাঠানো মূলতবি রাখলো।
প্রেসিডেন্ট জ্যাকসনের হস্তক্ষেপ
ক্যান্ডাল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসনের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। জ্যাকসন জানালেন, দেশের শান্তি বিনষ্টকারী এসব কর্মকান্ডে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত। দেশের শান্তি-শৃংখলা অবনতি হতে পারে এই আশংকায় ক্ষুদ্ধ প্রেসিডেন্ট আরো জানালেন, যারা এসব কদর্য ও দুষ্ট কাজের সাথে জড়িত তাদের জীবন দিয়ে এর প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। তিনি পোস্টমাস্টার জেনারেলকে নির্দেশ দিলেন নিয়মিত গ্রাহক ছাড়া অন্য কারো কাছে এই অসন্তোষ সৃষ্টিকারী পত্রিকাগুলো যেন বিলি না করা না হয় এবং এসব কাগজের গ্রাহকদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে রাখতে, কারণ প্রচারপত্র কৃষ্ণাঙ্গদের সহিংস কর্মকান্ডের দিকে উত্তেজিত করে তুলছে।
প্রেসিডেন্ট জ্যাকসন মার্কিন কংগ্রেসে তার বার্ষিক ভাষণে দাসপ্রথাবিরোধী প্রচারপত্র অভিযানের কথা উল্লেখ করলেন। প্রেসিডেন্ট প্রস্তাব করলেন, দক্ষিণে দাসপ্রথাবিরোধী প্রচারপত্রগুলো পাঠানোর আগে ফেডারেল অথোরিটির সেন্সরশিপের আওতায় আনা হোক। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জ্যাকসনের এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করলেন তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সাউথ ক্যারোলিনার সিনেটর জন সি কালহোন। কালহোন প্রস্তাব করলেন, ফেডারেল অথোরিটি নয়, স্থানীয় ডাকঘরগুলোরই এই সেন্সরশিপের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। উত্তরের দাসপ্রথাবিরোধীরা দাবি তুলেছিলেন, ডাকযোগে কোনো কাগজ বা নথি প্রেরণ করা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার খর্ব করার এখতিয়ার কেন্দ্র সরকারের নেই।
কী লেখা ছিল প্রচারপত্রগুলোতে?
প্রচারপত্রগুলোর মধ্যে দ্য আমেরিকান এন্টি স্লেভারি সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকা ‘The Emancipator’ ছাড়াও আরো কিছু পত্রিকা, যেমন- ‘The Anti-slavery Record’ ও ‘The Slave’s Friend’ উল্লেখযোগ্য ছিল। প্রচারপত্রগুলোতে যে দাসপ্রথাকে নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো শক্ত যুক্তি কিংবা দাসপ্রথার অবসান নিয়ে গভীরভাবে ভাববার খোরাক ছিল, এমন নয়। অধিকাংশ লেখায় দাসদের দুঃখ-দুর্দশা এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় যেন সেগুলো মর্মস্পর্শী হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব লেখায় দাসপ্রথা অবসানের যুক্তি হিসেবে প্রচার করা হতো, সততা ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত সামান্য অর্থও অন্যায়ের মাধ্যমে উপার্জিত ঐশ্বর্যের চেয়ে উত্তম। কিন্তু দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলে বলতে হয়, এসব লেখা ছিল নিছক আবেগতাড়িত। কারণ দক্ষিণের সমাজে দাসপ্রথা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল। যে ব্যবস্থার সাথে অর্থনীতির মতো একটি সংবেদনশীল বিষয় জড়িত, সেটি খুব সহজেই আসলে বদলানো যায় না।
দক্ষিণের পাল্টা পদক্ষেপ
দক্ষিণের দাসপ্রথা সমর্থকরা পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে অর্থনৈতিক অবরোধের কথা ভাবছিলেন। অবশ্য এতে যে শীঘ্রই কোনো ফল আসবে না সেটা তারা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তারা আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আগ্রহী হলেন। তারা দাবি জানালেন, বিশিষ্ট দাসপ্রথা বিরোধীদের দক্ষিণের আদালতে এনে বিচারের সম্মুখীন করা হোক।
ভার্জিনিয়া কাউন্টির গ্র্যান্ড জুরি নিউ ইয়র্কের এন্টি স্লেভারি সোসাইটির নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। কলম্বিয়াতে রাজ্যের এটর্নি জেনারেলের অফিসে দক্ষিণ ক্যারোলিনার দাসপ্রথা বিরোধীদের বিচার করার অনুরোধ জানিয়ে বেশ কয়েকটি চিঠি পাঠানো হয়েছিল। প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তা ট্যাপান ভ্রাতৃদ্বয়ের উপর হামলার হুমকি দেওয়া হলো। এছাড়া দাসপ্রথা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকদের জীবন ও সম্পদের উপর উগ্র দাসপ্রথা সমর্থকদের হামলার আশঙ্কা দেখা দিল। স্থানীয় পোস্ট অফিসগুলোর উপর নির্দেশ ছিল দাসপ্রথা বিরোধীদের এই চিঠি ও প্রচারপত্রগুলো বিতরণ না করবার। ফলে নজিরবিহীন এই কর্মসূচি অল্প কিছুদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
শেষকথা
দাসপ্রথা সমর্থকদের উপর চালানো চিঠি আক্রমণ কি তবে ব্যর্থ হয়েছিল? নিঃসন্দেহে এই কর্মসূচি ছিল অবাস্তব। তাই অচিরেই দাসপ্রথা বিরোধীরা তাদের কৌশল বদলে ফেলেছিল। উদ্দেশ্যবিহীন চিঠি না পাঠিয়ে দাসপ্রথা বিরোধীরা সিনেটরদের কাছে চিঠির মাধ্যমে নিজেদের লিখিত বক্তব্য প্রেরণ করতে শুরু করলেন। তবে ১৯৩৫ সালের অ্যাবলিশনিস্ট প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল প্রচারণা।
এই কর্মসূচি দক্ষিণে যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর। প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তারা যতটুকু প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলেন বাস্তবে প্রতিক্রিয়া ছিল তারচেয়ে বহুগুণে বেশি। তবে এ কথাও সত্য যে, এ ধরনের চরমপন্থা দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলনকে খানিকটা হুমকির মুখে ফেলেছিল। সব মিলিয়ে এই ক্যাম্পেইন এমন একটি কাজ করতে পেরেছিল যা আমেরিকায় পূর্বে কখনো ঘটেনি। আর সেটা হলো দাসপ্রথার ইস্যুটি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। এই ঘটনার আগে আমেরিকায় দাসপ্রথা থাকবে কি না এই বিতর্ক শুধু সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। অ্যাবলিশনিস্ট প্যামফ্লেট ক্যাম্পেইন সেই বিতর্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল সবার মাঝে।