Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কিশোরী জোয়ান অফ আর্ক-এর বিজয়গাঁথা

মেয়েটির গগনবিদারী চিৎকারে ভারী হয়ে আসে চারপাশ। সীন নদীর তীরে উত্তর ফ্রান্সের এক লোকালয়ে উঁচু পিলারে বেঁধে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে এক কিশোরীকে। অভিযোগ, সে ডাইনি।

শুধু একবার পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তাকে আবারো পোড়ানো হলো। তাতেও যখন তার দেহ ছাই হয়নি, তখন আদেশ হলো তৃতীয়বার পোড়াবার। অবশেষে ছাই হয়ে গেল তার পুরো দেহ। সেই ছাই ছড়িয়ে দেয়া হলো ফ্রান্সের সীন নদীতে। সাহসী মেয়েটি আর কেউ নন, ফ্রান্সের হিরোইন- জোয়ান অফ আর্ক (Joan of Arc)।

মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলে, তারিখটা ছিল ১৪৩১ সালের ৩০ মে। কিন্তু কেন? সেটা বুঝতে হলে জানতে হবে পেছনের ইতিহাস।

শিল্পীর তুলিতে অগ্নিদগ্ধ জোয়ান অফ আর্ক

১৪১২ সালের ৬ জানুয়ারি জোয়ানের জন্ম, ফ্রান্সের ডমরেমিতে, সামান্য এক কৃষক পরিবারে; বাবা জাক দ্য আর্ক (এ জন্যই নাম জোয়ান অফ আর্ক)। খুব ধার্মিকভাবে তার বেড়ে ওঠা, খামারের গবাদিপশুর দেখাশোনা আর সুই সুতোর খেলাতেই কেটে যেত সময়। যখন তার বয়স ১২, জোয়ান স্বপ্ন দেখতে লাগলেন ফেরেশতা আর সাধুরা তাকে এসে বলছে, ফ্রান্সকে রক্ষা কর! তখন থেকে জোয়ান বদ্ধপরিকর যে ফ্রান্সকে বাঁচাতে হবে।

ফ্রান্সের পরিস্থিতি তখন ছিল উত্তাল। চলছে ফ্রান্সের সিংহাসন নিয়ে শত বছরের যুদ্ধ (আসলেই যুদ্ধটার নাম ছিল ‘শতবর্ষী যুদ্ধ’)। পার্শ্ববর্তী ইংল্যান্ডের সাথে দ্বৈরথ তো আছেই। জোয়ানের জন্মের সময় রাজা ছিলেন ষষ্ঠ চার্লস, কিন্তু তিনি ছিলেন পাগল। তাই তার হাতে রাজ্য দেয়া চলে না, সুতরাং নতুন রাজা লাগবে। দ্বৈরথ শুরু হয়ে গেল রাজার কাজিন জন এবং ভাই লুই-এর মাঝে। ওদিকে লুই পরকীয়া করছিলেন রাণীর সাথে, আর জন অপহরণ করেছেন রাজপরিবারের শিশুদের- এমনটাই ছিল দাবি। এসব নিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা ফ্রান্সের।

ফ্রান্সের এ বাড়িতেই জন্ম জোয়ানের

চার্লসের ছেলের নামও ছিল চার্লস। তাকেই মনোনীত করা হলো ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে। কাছাকাছি সময়ে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড দু’দেশের রাজাই মারা গেলেন। ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন পঞ্চম হেনরি, রেখে গেলেন উত্তরাধিকারী শিশু ষষ্ঠ হেনরিকে। ফ্রান্সে প্রচলিত একটা ভবিষৎবাণী ছিল তখন, এক কুমারী মেয়ে ফ্রান্সকে রক্ষা করবে।

১৪২৮ সাল। জোয়ান চার্লসের সেনা কমান্ডার রবার্ট বড্রিকটের কাছে গেলেন, বললেন তিনি যুদ্ধ করতে চান। রবার্ট সামন্ত ডেকে এনে বললেন, এই মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাও বাপের কাছে, এরপর আচ্ছামত পেটাও। (মেয়েদের যুদ্ধে যাওয়া নিষিদ্ধই ছিল)

জোয়ান আবার ফিরে এলেন, ভবিষৎবাণী করলেন, অর্লিন্সের কাছে ফ্রান্স যুদ্ধে হেরে যাবে। সত্যি সত্যি ফ্রান্স হেরে গেল। তখন রবার্ট জোয়ানকে নিয়ে গেলেন ভবিষ্যৎ রাজা চার্লসের কাছে। অবশ্য তাকে চুল ছোট করে ফেলতে হলো। পড়তে হলো ছেলেদের পোশাক। জোয়ান তখন অনুমতি চাইলেন যুদ্ধে যাবার। একজন নাইটের বেশে। অনুমতি তিনি পেয়ে গেলেন, তার ব্যানার হলো যীশুর নাম।

লোকজন তখন বড্ড কুসংস্কারে বিশ্বাস করত। জোয়ানের ভবিষদ্বাণী সত্য হয়েছে দেখে লোকে তাকে ডাইনি মনে করতে লাগল। নিশ্চয়ই সে কালো জাদু করেছে। তাকে চার্চের প্রতিনিধিদের সামনে পরীক্ষা দিতে হলো, প্রমাণ করতে হল, জোয়ান কোনো ডাইনি নয়। পরীক্ষা পাশের পর জোয়ান হয়ে গেলেন সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন, নিলেন প্রশিক্ষণ।

তার নেতৃত্বে একের পর এক দুর্গ জয় করতে লাগল ফ্রান্সের সেনাবাহিনী। মে মাসের সাত তারিখে, লে তুরেলে দুর্গ অবরোধ করল ফ্রেঞ্চ বাহিনী। সে যুদ্ধে একটা তীর এসে জোয়ানের কাধে বিঁধে গেল, তিনি পড়ে গেলেন। কিন্তু এরপরই তিনি ফিরে এলেন এবং যুদ্ধ চালিয়েই গেলেন। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে ফ্রেঞ্চরা নব উদ্যমে আক্রমণ চালালো। সেদিন ইংল্যান্ড হেরে যায় যুদ্ধে। দুর্গ জয় করে নেয় ফ্রান্স।

এরপর জোয়ানের পরিকল্পনা অনুযায়ী রেইমস নগরী বিজয়ের পালা। ঠিকই জোয়ানের নেতৃত্বে তারা জিতে নিল রেইমস। কেন এই নগরী? কারণ এই নগরীতেই ফ্রেঞ্চ রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান হয়। ১৬ জুলাই নগরী হাতে আসবার পরদিনই, ১৭ জুলাই “ভবিষ্যৎ-রাজা” চার্লসের মাথায় মুকুট পরানো হয়। সেদিন থেকে তিনি ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস। ঠিক তার পাশেই ছিলেন জোয়ান অফ আর্ক।

চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে পাশেই দাঁড়িয়ে জোয়ান

সেপ্টেম্বরের আট তারিখ ফ্রেঞ্চরা চেষ্টা করল ইংলিশদের অধিকার থেকে প্যারিস ছিনিয়ে নিতে। কিন্তু সেদিনের যুদ্ধে জোয়ানের পা আহত হয় ক্রসবো’র আঘাতে। এবং এবারো তিনি যুদ্ধ চালিয়ে নিতে লাগলেন।

১৪৩০ সালের মে মাসে, কম্প্যেন যুদ্ধের সময় বার্গান্ডিবাসীদের হাতে জোয়ান ধরা পড়ে গেলেন। তারা তাকে জেলে পুড়ে দিল। বেশ কয়েকবার জোয়ান চেষ্টা করলেন জেল থেকে পালাবার, কিন্তু পারলেন না। এজন্য তাকে রাখা হলো টাওয়ারে। তিনি ষাট ফুট উঁচু টাওয়ার থেকে লাফ দিলেন। সেই দুর্গের চারদিকে পানিপূর্ণ পরিখা ছিল। তিনি সেখানে পড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। গুরুতর আহত না হলেও চলতে পারার মতো সুস্থ তিনি ছিলেন না যখন জ্ঞান ফিরল। তাকে ইংলিশদের কাছে ১০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে দেয়া হলো, যার মানে এখনকার হিসেবে কয়েক মিলিয়ন ডলার।

ইংলিশদের প্রধান শত্রুই ছিল জোয়ান অফ আর্ক নামের এই কিশোরী, ধরা পড়বার আগ পর্যন্ত তাদের বিশ্বাসই হয়নি এই মেয়ে তাদের এত পরাজয়ের কারণ! এই মেয়ের কারণেই ইংলিশ সেনাবাহিনীর মনোবল চুরমার হয়ে গেছে! কীভাবে তাদের মনোবল আবার চাঙ্গা করা যায়?

তারা জোয়ানকে ডাইনি হিসেবে প্রমাণ করতে চাইলো। কেবল কালো জাদুর সহায়তায়ই এই মেয়ে ইংলিশদের পরাজিত করেছে। একে সরিয়ে দিলেই ইংলিশ বাহিনীর আর কোনো বাধা নেই- এই বিশ্বাসটা সকলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চাইল তারা।

তাকে ডাইনি আর ধর্মহীনতার দায়ে ফাঁসিয়ে দেয়া হলো। চার্চের প্রতিনিধিরা তাকে স্বীকার করে নিতে বলল, সে কোনো স্বপ্ন দেখেনি, কেউ স্বপ্নে তাকে কিছু বলেনি। তারা তাকে সৈন্যের পোশাক খুলে ফেলতে বলল।

কিন্তু জোয়ান কিছুই করলেন না।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, ফ্রান্সের রাজা চার্লস আদৌ উদ্ধার করতে গেলেন না জোয়ানকে। ইংলিশ চার্চ কথা দিল, জোয়ান চার্চে গিয়ে কনফেশন নিতে পারবেন যদি তিনি সৈন্যদের পোশাক ছেড়ে মেয়েদের পোশাক পড়েন আবার, আর চার্চের কাছে কনফেশন দেয়া মানে পাপমুক্ত হয়ে যাওয়া। জোয়ান মেনে নিলেন। কিন্তু আসলে তাকে মিথ্যে বলা হয়েছিল।

তাই আবার সেনার পোশাক পড়ে নিলেন জোয়ান। চার্চের প্রতি অবাধ্যতার জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। অন্য সকল ডাইনির মতন তারও ভাগ্যে রইল আগুনে পুড়ে মৃত্যু। সীন নদীর তীরে ব্যস্ত লোকালয় রোয়াঁ’র বাজারে উইঞ্চেস্টারের কার্ডিনালের আদেশে তাকে তিনবার পোড়ানো হলো। এরপর ছাই ছিটিয়ে দেয়া হলো নদীতে। তার বয়স ছিল আত্র উনিশ।

প্যারিসে জোয়ানের স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া মূর্তি

জোয়ান অফ আর্কের নামে অনেক জিনিসই পরবর্তীতে প্রচলিত হয়। যেমন, ২০১৬ সালের মার্চে পুরনো একটা রিং নিয়ে দাবি করা হয়, এটা জোয়ান অফ আর্কের ছিল এবং সেই রিং কেবল জোয়ানের নামের জন্য ৩ লক্ষ পাউন্ডে বিক্রি হয়ে যায়! বলা হয়, আগুন ধরাবার আগে জোয়ান এ রিঙটা খুলে দিয়েছিলেন কার্ডিনালকে। এছাড়াও ১৮৬৭ সালে এক জার ছাই আবিষ্কৃত হয় প্যারিসে, যেখানে লিখা ছিল সেটা নাকি জোয়ান অফ আর্কের অবশেষ!

প্যারিসের নটর ডেম ক্যাথেড্রালে জোয়ান অফ আর্ক এর আধুনিক মূর্তি

পঁচিশ বছর পর পোপ তৃতীয় ক্যালিক্সটাস ঘোষণা দিলেন, জোয়ান আসলে নিষ্পাপ ছিলেন। চার্চ মিথ্যা রায় দিয়েছিল। পাঁচশ বছর পর ১৯২০ সালে, ক্যাথোলিক চার্চ জোয়ানকে একজন সেইন্ট হিসেবে ঘোষণা করে। তার মৃত্যুদিবসে (৩০ মে) ক্যাথলিকরা এখন উদযাপন করে। ফ্রান্স এবং সেনাবাহিনীর প্যাট্রন সেইন্ট এখন জোয়ান।

এক সময়ের ডাইনি অপবাদের দায়ে পুড়ে মরা জোয়ান অফ আর্ক আজ ফ্রান্সের জাতীয় বীর।

তথ্যসূত্র

১) “Joan of Arc: A History” by Helen Castor

২) “Joan: The Mysterious Life of the Heretic Who Became a Saint” by Donald Spoto

৩) “The Trial of Joan of Arc” by Daniel Hobbins (Translation)

৪) theguardian.com/world/2006/dec/17/france.alexduvalsmith

৫) en.wikipedia.org/wiki/Joan_of_Arc

Related Articles