মাইন্ডগেম নামটা শুনেই অনেকে নাক সিটকায় যে, ফুটবল তো মাঠের খেলা, তবে এই ‘মাইন্ডগেম’ জিনিসটা আবার কি? আধুনিক ফুটবলে এমন সব ছোটখাটো বিষয় নিয়ে এত বেশী ইম্প্রুইজেশন হয় যে, রেগুলার দর্শক বাদে অনেকে আসলেই আশ্চর্য হয়ে যাবেন। শুধু এতটুকু জেনে রাখুন যে, এই খেলাটা আসলেই একটা যুদ্ধ, এত দ্বৈরথ, চর্চা বা উত্তেজনা আর কোনো খেলায় নেই।
যুদ্ধে মাইন্ডগেম তো প্রায়ই ব্যবহৃত হয়। যেমন- যুদ্ধে মাইন্ডগেমের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির হিরোশিমা, নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা নিয়ে। অনেক নথির ভাষ্যমতে, আসলে পারমাণবিক বোমা দুটোই ছিল। দুটো মেরে আমেরিকা মেসেজ পাঠায়, “Accept defeat, these are just samples. More to come”। ওরা ফাঁদে পা দেয়। মহাভারতে যখন অর্জুন কর্ণের শেষ মহারণ হয়, তখন অর্জুনের মামা কর্ণের রথের সারথি শল্য, যিনি ছলনার শিকার হয়ে বিপক্ষে যুদ্ধ করছিলেন, তিনি ভাগ্নেকে প্রতিশ্রুতি দেন যুদ্ধকালীন সময়ে কর্ণকে বাক্যবাণে নিস্তেজ করবেন। বাস্তবিকই কর্ণের মনোবল অনেকটা ভেঙে দিয়েছিলেন সারাদিন কুকথা বলে।
তবে কি আমি ইতিহাস লিখছি? না, ঠিক এই কাজটাই স্যার আলেক্স ফার্গুসন করেছিলেন লিভারপুলের উঠতি তারকা হেন্ডারসনের প্রতি। তখন নতুন নতুন খেলছে ও লিভারপুলের হয়ে, ফর্ম বেশ ভালো। লিভারপুলের সাথে তাদেরই মাঠে খেলার আগে স্যার আলেক্স ফার্গুসন বলে বসলেন যে, হেন্ডারসনের খেলার স্টাইলে সমস্যা আছে, ও বল পায়ে থাকলে পিঠ বাঁকিয়ে খেলে। এভাবে খেললে ইনজুরিতে পড়বেই! ওই ম্যাচে দারুণ ফর্মে থাকা হেন্ডারসন ঠিকমতো পাসও দিতে পারছিলো না, দুঃস্বপ্নের একটা ম্যাচ ছিল বলা চলে। ম্যানইউ ২-১ এ জিতে যায় লিভারপুলের মাঠে।
মাইন্ডগেমে যদি কেউ একজন সর্বকালের সেরা থাকে, সেটা ফার্গুসন অবশ্যই। মাইন্ডগেম আরো আগে থেকেই ছিলো। তখন এই মাইন্ডগেমটা ডাগআউটেই সীমাবদ্ধ থাকত। প্রতিপক্ষের কোচ একটা ডিফেন্ডার সাব করে নামালে অন্য কোচ একটা ফরোয়ার্ড নামাতো, এমন সব মাইন্ডগেমগুলা মাঠেই হতো। বলা চলে ফার্গুসনই আধুনিক মাইন্ডগেমের প্রবাদপুরুষ। তারপর যদি কেউ সেটাকে অন্যপর্যায়ে নিয়ে গিয়ে থাকে সেটা জোসে মরিনহো।
স্যার ফার্গির মাইন্ডগেম খানিকটা ছলনা ছিল। প্রায়ই দেখা যেত, একটা ম্যাচের কয়েকদিন আগে তিনি বলতেন যে, ইনজুরির কারণে তাঁর দলের অমুক স্ট্রাইকার বা উইংগার খেলতে পারবে না। প্রতিপক্ষের কোচ ওকে নিয়ে ঘাটতেন না না, ওকে আটকানোর কৌশল ভাজতেন না, প্রতিপক্ষের যে ডিফেন্ডার ওকে মার্ক করার কথা ছিলো সে তাকে নিয়ে হোমওয়ার্ক করতো না। অথচ ম্যাচের দিন দেখা যেত, ঐ তথাকথিত ইঞ্জুরড প্লেয়ারকে ঠিকই মাঠে নামিয়ে দিয়েছে! প্রতিপক্ষের যে ডিফেন্ডারের ওকে মার্ক করবে, তার তখন সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন দেখার অবস্থা!
এর উল্টোটাও ঘটত। প্রায়ই পুরো লাইনআপ বলে দিতেন ম্যাচের দুদিন আগে। এটা ট্যাকটিকস তৈরি করার ফোকাস ঘুরিয়ে দেয়ার সর্বোত্তম উপায় ছিল। প্রতিপক্ষ কোচ ভাবতেন এই লাইন আপ বলে দেয়াটা সে বিশ্বাস করবে কি করবে না। কারণ মাইন্ডগেমার ফার্গিকে কেউ বিচার না করে বিশ্বাস করতো না! কোচ প্রতিপক্ষের সব বিস্তারিত তথ্য তাঁর দলের সামনে এনে দেন। কোচ যখন বিক্ষিপ্ত আচরণ করে, সেটার সরাসরি প্রভাব খেলায় পড়ে। স্যার অ্যালেক্সের এসব মাইন্ডগেম প্রতিপক্ষের কোচদের জন্য আসলেই ত্রাস ছিল।
রেফারিদের হ্যান্ডল করার মাইন্ডগেমটা আরো অসাধারণ। উনি এমন চালে সমালোচনা করতেন যে, রেফারিরা খানিকটা প্রভাবিত হতোই। ম্যানইউর প্রতি রেফারিদের অবিচারের হরেক কিচ্ছা ম্যাচের আগে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলতেন, অনেক রেফারি তখন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিদের মতো ব্যালান্স করতে গিয়ে খানিকটা অন্যায় সুবিচার করেই ফেলত! এভারেজ সব টিম তিন মিনিট এক্সট্রা টাইম পেলেও ফার্গির ম্যানইউ প্রায়ই মিনিট দুয়েক বেশি পেত, এই টাইমটার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ফার্গি টাইম‘। ম্যানইউর বেশ অনেক জয়সূচক গোল এই ফার্গি টাইমে করা।
ফার্গি তার প্লেয়ারদের সাথেও মাইন্ডগেম খেলতেন। হেয়ারড্রায়ার নামে তাঁর একটা থেরা্পি ছিলো। এর মানে হলো, ম্যাচে খারাপ খেলা প্লেয়ারকে খেলা শেষে তাঁর সামনে দাঁড় করিয়ে এমন ঝাড়ি দিতেন যে, ম্যানইউ ক্যাপ্টেন রয় কিনের মতে, ভেজা চুল শুকিয়ে দাঁড়িয়ে যেত! সেই থেকে এর নাম হেয়ারড্রায়ার। এটাকে ঠিক মাইন্ডগেম বলা যায় না। তবে ফার্গুসন তাঁর প্লেয়ারদের নিয়ে খেলতেন!
রোনালদো তখন ভালো গোল পাচ্ছিলো পজিশন চেঞ্জ করায়। তবুও নতুন সিজনের আগে ফার্গুসন ওকে বললেন, “তোমার গোলস্কোরিং অগ্রগতি আমার অতটা ভালো লাগছে না। এই সিজনে ২৫ এর বেশি গোল ভুলেও পাবে না। বাজি লাগতে পারি।” রোনালদো বললো ও করতে পারবে। পাঁচশ ডলারের বাজি ছিল। সেবার টোটাল চল্লিশের উপর গোল করেছিল ও। চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল ম্যানইউ। একই রকম বাজি নিস্টেলরয়, রুনিদের সাথে খাটিয়ে সফল ছিলেন ফার্গি।
উপরের যতগুলা পয়েন্ট পড়েছেন, ফার্গি-টাইম বাদে সবগুলা জোসে মরিনহো আরো ইম্প্রুভাইজড ভাবে প্রয়োগ করেছেন। মিলিতোকে দিয়ে তিরিশের বেশি গোল আদায় করেছেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে। জোসের হাফ টাইম স্পিচ নাকি সবচেয়ে বিখ্যাত। ইন্টার মিলানে থাকাকালীন ইব্রাহিমোভিচকে একবার হাফটাইমে বলেন, “তোমার কোনো জমজ ভাই আছে? নাইলে মাঠে এতক্ষণ কে ছিল এটা? আসল ইব্রা কখনো বুলশিট হতে পারে না।” দ্বিতীয়ার্ধে ইব্রা জোড়া গোল করে ম্যাচটা জিতিয়ে দিয়েছিল। গত মৌসুমের আগের মৌসুমে চেলসিতে ম্যানেজার থাকাকালীন ফুলহ্যামের সাথে একটা অ্যাওয়ে ম্যাচের প্রথমার্ধের খেলায় মরিনহো এতটা বিরক্ত ছিলেন যে, ড্রেসিংরুমে এসে হাফটাইমে একটা শব্দও বলেন নি দলের সাথে। দলও তেতে গেলো, দ্বিতীয়ার্ধে তিন গোল দিয়ে ৩-০তে জিতে যায় চেলসি।
ড্রেসিংরুমে জোসের এসব আরো অনেক ঘটনা ইব্রার আত্মজীবনীতে আছে। মরিনহোর ক্যারিয়ারের সেরা মাইন্ডগেমটা ধরা খেয়ে যায় গত মৌসুমের আগের মৌসুমে। সিজনের শেষদিকে এসে হোমে সান্ডারল্যান্ডের কাছে হেরে বসে তারা, মূলত ঐদিনই শিরোপা হারিয়ে ফেলে চেলসি। ঐ সিজনে ম্যানসিটি ছিল অসাধারণ। কিন্তু জোসে কোনো স্কোরিং স্ট্রাইকার, ক্রিয়েটিভ সেন্টার মিডফিল্ডার ছাড়া দলকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, শেষ চার ম্যাচ জিতলেই চ্যাম্পিয়ন হতো চেলসি, কিন্তু হোমে সান্ডারল্যান্ডের কাছে হারায় শিরোপা খুইয়ে বসে। কি ছিল সেই মাইন্ডগেম? ছোটঘোড়া! হ্যাঁ , চাপ এড়াতে বারবার নিজের দলকে ‘লিটল হর্স’ বলছিলেন তিনি। এতে করে মিডিয়া হাইপ কমে গিয়েছিলো চেলসির উপর থেকে। প্রায় উতরে গিয়েছিলো তারা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
এই ‘লিটল হর্স’-এর কাউন্টার দিতে গিয়ে আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারও প্রেশার দিতে চাইছিল জোসেকে ‘ফিয়ার অব ফেইলিউর‘ বলে। তবে যে রিপ্লাইটা জোসে ওয়েঙ্গারকে দিয়েছিলো, সেটা উনি ভুলে যেতেই চাইবেন। তাকে বলেছিলেন ‘স্পেশালিস্ট ইন ফেইলিউর‘! তবে তার পরের বার মৌসুমের শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এবার তাঁর দলই ফেভারিট। মূলত এর মাধ্যমে তিনি নিজের টিমকেই চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন যে, নিজেদের সেরা হওয়ার যোগ্যতা প্রমান করো! ঠিকই সেবার লীগ জিতে যায় তাঁর দল চেলসি।
একপর্যায়ে ফার্গিও জোসের মাইন্ডগেমকে সমীহ করতেন বেশ ঠারেঠুরেই। রিয়াল বনাম ম্যানইউ ম্যাচের আগে ফার্গি বলেন,“I think Jose plays mind games, he enjoys that part. He enjoys it better than I do, he has this mischievous side and you are never quite sure what he is up to. My advice to myself is not to go down to his road, not to contest that because he is a genius b*****r, and so I let him get on with it. I am not up to him anymore!” ঠিক তারপরেই স্বভাবজাত মাইন্ডগেম খেললেন ফার্গি ম্যাচ উত্তেজনা লঘু করতে- “As long as he brings me a decent bottle of wine, I’ll let him off.” কারণ জেদি জোসে মরিনহোর টিম ডিফেন্সিভলি আনব্রেকেবল হয়, এটা উনি বিলক্ষণ জানতেন। তাই স্লো বল খেলালেন ফার্গি। শেষবধি ম্যাচটা হেরেই যান ফার্গি।
তবে সবার্ জন্য মাইন্ডগেম না। ফার্গির উত্তরাধিকারী ম্যানইউ কোচ মোয়েস বলেছিলেন, “Bring on Jose you mind game. I’m up to it!” উনি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিনিময়ে জোসের কাছ থেকে বেশ বড়সড় প্রশংসা পেয়েছিলেন, তবে সাথে আকাঙ্ক্ষিতভাবে ৩-০তে পরাজয়ও!
বেশ ভালো এবং ঐতিহাসিক একটা মাইন্ডগেম মানচিনিও খেলছিলেন। সাত ম্যাচ বাকি থাকতে ম্যানইউ থেকে আট পয়েন্ট পিছিয়ে ম্যানসিটি। মানচিনি প্রতিদিনই বলতেন যে, টাইটেল তাদের হাত থেকে ছিটকে গেছে, তারা ভাবছেও না শিরোপা নিয়ে। দক্ষ ফার্গির টিমেরও গা ছাড়া ভাব এসে যায় ফেভারিট তকমা পেয়ে। শেষমেষ পয়েন্ট হারাতে হারাতে সেই ম্যানসিটির কাছে লীগও হেরে বসে ম্যানইউ। মানচিনি পরে স্বীকার করেন যে, একটা ঘন্টার জন্যও আশা ছাড়েননি তিনি, ড্রেসিংরুমকে ছাড়তে দেননি আশা। শুধু প্রতিপক্ষকে আত্মতুষ্টিতে ফেলতেই এসব কথা বলা হয়েছিল। ফলাফল অর্ধশতাব্দী পর সিটির প্রথম লীগ শিরোপা জয়।
মানচিনি পারলেও রাফা বেনিতেজ পারেন নি। লিভারপুল সেবার হাড্ডাহাড্ডি টাইটেল রেসে, ম্যানইউর সাথে। এ অবস্থায় ফার্গির রেফারিদের প্রভাবিত করা নিয়ে বারবার তাকে বিধতে থাকেন রাফা বেনিতেজ, বলেন- “Ferguson was “the only manager who would not be punished” for outspoken attacks on referees. He can say anything here what I can’t.” মাস্টার অব মাইন্ডগেম ফার্গুসনের সাথে এসব চাল লাভে দেয়নি। ম্যানইউ ঠিকই লিভারপুলকে চার পয়েন্টে হারিয়ে লীগ জিতে নেয়।
রাফা বেনিতেজ প্রচুর মাইন্ডগেম খেলছেন একসময়, ওয়েঙ্গারও কিছু কিছু। তবে তখন ইপিএলে জোসে আর ফার্গির মতো দুজন মাস্টারমাইন্ড অব মাইন্ডগেম থাকায় ওরা দুজন দাঁড়াতেই পারেনি খুব একটা। মাইন্ডগেম অনেক মুনি ঋষির মতো লোককেও টলিয়ে দিতে পারে। রিয়াল মাদ্রিদের তখন কোচ হয়ে এলেন জোসে মরিনহো। জোসের কাছে তখন পেপ কোপা দেল রের ফাইনাল হারলো। জোসে খোঁচা দিলেন, “I’m sorry, Pep isn’t getting the unfair refreering decision in his way he used to have”। সেদিন প্রেসে দেখা গিয়েছিল ভদ্রলোক পেপ-এর অন্য মূর্তি। “You f***king boss” টাইপ কথা কয়েকবারই বলে ফেলছিলেন তিনি।
এটা সত্য যে, মাইন্ডগেম সেখানেই খেলা হয়, যেখানে কম্পিটিশন আছে। পিএসজি বা বায়ার্নের এখন লীগে মাইন্ডগেমের দরকার হয় না, যেহেতু বলা চলে তাদের লীগ ট্রফি জয় প্রায় নিশ্চিতই থাকে। রিয়াল-বার্সাও ভ্যালাদোলিদ বা এলচের মতো ছোট দলের সাথে এসব করে না। যেখানেই প্রচন্ড কম্পিটিশন, মাইন্ডগেম সেখানেই। দিন শেষে ফুটবল পায়ের খেলা হলেও, কার্লো আনচেলত্তি বা পেপ গার্দিওলার মতো ভদ্র কোচরা এক্সট্রিম মাইন্ডগেম ছাড়া সাফল্য পেলেও ফুটবলের কঠিন সমরক্ষেত্রগুলোতে এর বেশ প্রভাব আছে, এটা অনস্বীকার্য। এটা এমন একটা আর্ট যে জিনিসটা ফ্যানদের নব্বই মিনিটের খেলার বাইরেও খোঁজখবর নিতে উত্সাহিত করে, খেলা দেখার একটা উদগ্র ইচ্ছা তৈরি করে, একটা আবহ তৈরি করে।
মাইন্ডগেম ছিল, আছে এবং থাকবে।