Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাহেলা জয়াবর্ধনে: নিঃস্বার্থ এক নেতার গল্প

ক্রিকেট খেলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে অধিনায়ক, খেলার মাঠে মোটামুটি সব দায়িত্বই অধিনায়কের হাতে ন্যস্ত থাকে। দলীয় অধিনায়ক কে হবেন, এটি ঠিক করার দায়িত্ব টিম ম্যানেজমেন্টের। টিম ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে প্রতিটি দলেরই একজন করে অধিনায়ক রয়েছেন। অধিনায়ক তো সব দলেরই আছেন, কিন্তু সব অধিনায়কই কি দলের নেতা হতে পেরেছেন? পাঠকরা হয়তো ভাবছেন, এটা আবার কেমন অদ্ভুত প্রশ্ন হলো! কারণ অধিনায়কের কাজই তো দলকে নেতৃত্ব দেওয়া, সুতরাং যার কাজই দলকে নেতৃত্ব দেওয়া, সে কেন নেতা হতে পারবে না?

আসলে নেতা হওয়াটা এতটা সহজ কাজ নয়। আর সহজ নয় বলেই ক্রিকেট বিশ্বে অসংখ্য অধিনায়ক থাকলেও নেতার সংখ্যা কিন্তু এর অর্ধেকও না। একজন অধিনায়ককে নেতা হতে গেলে তার কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র মাঠে দলকে পরিচালনা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, মাঠের বাইরেও খেলোয়াড়দের ভালো-মন্দ দেখতে হবে, এমনকি দরকার হলে দলের স্বার্থে নিজের সবধরনের স্বার্থ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নিজেকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে যাতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড সাথে থাকুক বা না থাকুক, দলের সব খেলোয়াড় তার উপর নির্দ্বিধায় আস্থা রাখতে পারে। গত দুই দশকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অসংখ্য অধিনায়কের মধ্যে খুব অল্প অধিনায়কই উপরোক্ত কাজগুলো করতে পেরেছেন। আর সেই অল্প ক’জন নেতার মধ্যে একজন হচ্ছেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। আজ আমরা মাহেলা জয়াবর্ধনের ক্যারিয়ারের আদ্যোপান্ত জানবো, জানবো কীভাবে তিনি একজন সাধারণ খেলোয়াড় থেকে অনন্য একজন নেতায় পরিণত হলেন।

প্রাথমিক ক্যারিয়ার

১৯৭৭ সালের ২৭ মে কলম্বোয় জন্মগ্রহণ করেন মাহেলা জয়াবর্ধনে, পুরো নাম দেনাগামাগে প্রমথ মাহেলা ডি সিলভা জয়াবর্ধনে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলার সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন মাহেলা, স্কুল ক্রিকেটে স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ের জন্য খুব কম বয়সেই স্পটলাইট পেয়ে যান তিনি। নালন্দা কলেজের হয়ে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার পুরস্কার হিসেবে পেয়ে যান অধিনায়কত্ব। মূলত এ সময়েই মাহেলার মধ্যে নেতৃত্ব গুণের বিকাশ ঘটতে থাকে।

১৯৯৫ সালে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে ঘরোয়া লিগে অভিষেক ঘটে মাহেলা জয়াবর্ধনের। পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নমনীয় স্বভাবের মাহেলা কঠিন সব ক্রিকেটীয় শট এত অবলীলায় খেলতেন যে, মনে হতো ক্রিকেট খেলাটা বুঝি মাহেলার জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ। এ ব্যাপারে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু কুমার সাঙ্গাকারা বলেন, “সেই স্কুলক্রিকেট থেকেই মাহেলাকে দেখে ভিতরে ভিতরে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হতাম, ব্যাটে-বলে টাইমিং করার ব্যাপারটা মাহেলা এতটা অনায়াসে করতো যে সেটা দেখে অবাক না হয়ে পারা যেত না। আমরা যেসব শট খেলতে নেটে কঠোর  পরিশ্রম করতাম সেগুলো মাহেলা সেই বয়সে অহরহ করে দেখাতো।” ঈশ্বর প্রদত্ত এই প্রতিভার কারণে মাত্র ২০ বছর বয়সেই দলে অভিষেকের সম্ভাবনা জোরালো হয় মাহেলা জয়াবর্ধনের।

জাতীয় দলে অভিষেক

অবশেষে সব গুঞ্জনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৭ সালের আগস্টে ভারতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লংকানদের হয়ে অভিষেক ঘটে মাহেলা জয়াবর্ধনের। সেই ম্যাচে রীতিমতো রানের ফোয়ারা বইছিল। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ভারতের করা ৫৩৭ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা সংগ্রহ করে ৬ উইকেটে ৯৫২ রান যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। এই রানের পাহাড়ে মাহেলার অবদান ছিল ৬৬ রান, শেষপর্যন্ত রান উৎসবের ঐ ম্যাচ নিষ্প্রাণ ড্রয়ের মাধ্যমেই শেষ হয়।

পরের বছর জানুয়ারিতে ওয়ানডেতেও অভিষেক ঘটে যায় মাহেলার, টেস্টের মতো ওয়ানডে অভিষেকটাও হয় সেই প্রেমদাস স্টেডিয়ামেই। প্রথম ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২১২ রানের চেজে সাত নম্বরে ব্যাটিং এ নেমে অপরাজিত থাকেন ১ রানে! পরের ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের করা ২৮১ রান তাড়া করে লংকানদের চার উইকেটের জয়ে ৭৮ বলে ৭৪ রান করে বড় অবদান রাখেন জয়াবর্ধনে। সে বছরেই জুনে গল টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন নাম্বারে ব্যাটিংয়ে নেমে খেলেন ১৬৭ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস। বোলিং সহায়ক পিচে মাহেলার এমন ইনিংসে ভর করেই শ্রীলঙ্কা জয় পায় ইনিংস ও ১৬ রানে, ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও তাই মাহেলা জয়াবর্ধনের কাছেই যায়।

১৯৯৯ সালের শুরুটাও দারুণভাবে করেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। ২৩ জানুয়ারি অ্যাডিলেডে ইংলিশদের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। এই সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ, যে ম্যাচে মুরালিকে বারবার নো বলের দায়ে অভিযুক্ত করার প্রতিবাদে মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। শেষপর্যন্ত ইংলিশরা সেদিন দাঁড় করায় ৩০২ রানের বিশাল এক সংগ্রহ। কিন্তু পাঁচ নম্বরে খেলতে নামা মাহেলা জয়াবর্ধনের ১১১ বলে ১২০ রানের অসাধারণ এক কাউন্টার অ্যাটাকিং ইনিংসে বিশাল এই সংগ্রহ শ্রীলঙ্কা টপকে যায় এক উইকেট হাতে রেখে, ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও পান মাহেলা। এর পরের মাসেই কলম্বোর সিংহলিজ স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ২৪২ রান করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পেয়ে যান মাহেলা। ম্যাচ ড্র হলেও ম্যাচসেরার পুরস্কার ঠিকই পান তিনি। সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুটা দারুণভাবেই হয়েছিলো তার।

অভিষেক বিশ্বকাপ

নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে প্রথম ম্যাচে সুযোগ না পেলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে ঠিকই সুযোগ পান ২২ বছর বয়সী মাহেলা জয়াবর্ধনে। প্রোটিয়াদের দেওয়া ২০০ রানের সহজ টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে লঙ্কানরা অল আউট হয় মাত্র ১১০ রানেই! সেদিন সাত নম্বরে খেলতে নামা মাহেলা করেন ২২ রান, যা ছিল দলের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। নিজের প্রথম বিশ্বকাপে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। কেনিয়ার বিপক্ষে ৪৫ রানই ছিল তার সেই আসরে সর্বোচ্চ সংগ্রহ। নিজের দল শ্রীলঙ্কার জন্যও আসরটি ছিল ব্যর্থতায় মোড়া, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপপর্বেই বিদায় নিতে হয় লংকানদের।

বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পরপরই অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান অর্জুনা রানাতুঙ্গা, দলীয় অধিনায়ক হিসেবে লঙ্কান বোর্ড নিয়োগ দেয় সনাথ জয়াসুরিয়াকে আর ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ পান মাহেলা জয়াবর্ধনে। মাত্র ২২ বছর বয়সী মাহেলাকে সহ অধিনায়ক করে বোর্ড একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে দেয় আর তা হলো ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটা মাহেলার উপরেই বর্তাবে। তবে এত অল্প বয়সে সহ অধিনায়কত্বের চাপ এসে পড়ায় মাহেলার পারফর্মেন্স গ্রাফ কিছুটা নিচে নেমে যায়। নিয়মিত বিরতিতে বড় ইনিংসের দেখা পেলেও বড় ইনিংসগুলোর মাঝে ধারাবাহিক পারফর্ম না করায় ওয়ানডেতে মাহেলার গড় ৩০ এর আশেপাশেই ঘুরতে থাকে।

দুঃস্বপ্নের ২০০৩ বিশ্বকাপ

২০০৩ বিশ্বকাপে মাহেলার বয়স ছিল ২৬ বছর, দলের সহ অধিনায়কের কাছ থেকে লংকানদের প্রত্যাশার পারদটাও বেশ উঁচুতেই ছিল। কিন্তু হায়! পুরো বিশ্বকাপটা দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ কাটে মাহেলা জয়াবর্ধনের জন্য। ১, ৫, ৯, ১, ০, ০ ও ৫ – নাহ এগুলো কোনো মোবাইল নাম্বারের ডিজিট নয়, ২০০৩ বিশ্বকাপের সাত ইনিংসে এগুলোই ছিল মাহেলার রানসংখ্যা! একবারের জন্যও দুই অঙ্কের রান দূরে থাক, ৫ রানের বেশিই করতে পারেননি তিনি! গড় ছিল মাত্র তিন। যদিও শ্রীলঙ্কা সেবার সেমিফাইনাল খেলেছিল, কিন্তু এমন জঘন্য পারফর্মেন্সের জন্য ওয়ানডে দল থেকেই বাদ পড়ে যান মাহেলা। অথচ বিশ্বকাপের কিছুদিন পরেই জয়াসুরিয়া অধিনায়কের পদ থেকে সরে যাওয়ায় অধিনায়কের দায়িত্বটা মাহেলারই পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেই দায়িত্ব পেয়ে যান মারভান আতাপাত্তু। সবমিলিয়ে এক ২০০৩ বিশ্বকাপ মাহেলাকে একধাক্কায় অনেক দূর পিছিয়ে দেয়।

ছবির মতোই ২০০৩ বিশ্বকাপটা ছিল মাহেলার জন্য হতাশাজনক; Image Source: cricwizz.com

তবে মাহেলার মত প্রতিভাকে খুব বেশিদিন দলের বাইরে রাখা যায় না, এক সিরিজ পরেই দলে আবার ফিরে আসেন মাহেলা। কিন্তু ২০০৩ বিশ্বকাপের দুঃস্বপ্ন কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না মাহেলা, ফলে দলে ফিরলেও রান ঠিক সেভাবে পাচ্ছিলেনই না! শেষপর্যন্ত মাহেলা নিজেকে ফিরে পান ইংলিশদের বিপক্ষে গল টেস্টে, সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে লঙ্কানরা ৯৪ রানের লিড নিলেও দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮৫ রানে ৫ উইকেট খুইয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। সেখান থেকে দলকে টেনে তুলেন মাহেলা, একপাশ আগলে রেখে মাহেলা ৮৬ রান করলে শ্রীলঙ্কা পেয়ে যায় ৩২২ রানের লিড তবে শেষপর্যন্ত মাত্র এক উইকেট না নেওয়ার আফসোসে ম্যাচটা ড্র করতে হয় লংকানদের। সেই সিরিজের শেষ টেস্টে ১৩৪ রান করে পুরোপুরি রানে ফিরে আসেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গল টেস্টে মাহেলা পেয়ে যান তার টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি।

অবশেষে অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া

২০০৩ সালের পর থেকেই মাহেলা ব্যাট হাতে ধারাবাহিক পারফর্ম করতে থাকায় তাকে অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার দাবিটা জোরালো হতে থাকে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় অধিনায়ক হিসেবে আতাপাত্তুর ভালো পারফর্মেন্স, এমনকি ২০০৪ সালে আইসিসি ওয়ানডে টিম অফ দ্য ইয়ারে অধিনায়কও ছিলেন মারভান আতাপাত্তু! তবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে শেষপর্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড! ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সফরের জন্য ঘোষিত দলে আতাপাত্তুকে বিশ্রাম দিয়ে মাহেলা জয়াবর্ধনেকে অধিনায়ক ও কুমারা সাঙ্গাকারাকে সহ অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয় লঙ্কান বোর্ড।  অধিনায়ক হিসেবে নিজের শুরুটা খুব বেশি ভালো হয়নি মাহেলার, বাংলাদেশ সফরে একটা ওয়ানডেতে হেরে যায় তার দল! অন্যদিকে ঘরের মাঠে পাকিস্তানের সাথেও টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে হেরে যায় শ্রীলঙ্কা।

তবে মাহেলা ইংল্যান্ড সফরে বিশাল এক বাজিমাত করে ফেলেন! লর্ডসে প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা ফলো-অনে পড়লেও দ্বিতীয় ইনিংসে মাহেলার অনবদ্য সেঞ্চুরিতে ম্যাচ ড্র করে শ্রীলঙ্কা, ম্যাচসেরার পুরষ্কারটাও পান মাহেলা। দ্বিতীয় টেস্টে লঙ্কানরা ছয় উইকেটে হারলেও শেষ টেস্টে মুরালি ম্যাজিকে ১৩৪ রানে ম্যাচ জিতে সিরিজ ড্র করে শ্রীলঙ্কা। আর ওয়ানডেতে তো ইংলিশরা দাঁড়াতেই পারেনি, পাঁচ ম্যাচ সিরিজের সবকটাতে জিতে ঘরের মাঠে ইংলিশদের ধবল ধোলাইয়ের স্বাদ দেয় মাহেলার দল। এরমধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ ওয়ানডেতে টানা দুটি সেঞ্চুরি করে দলের এই ৫-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে বড় অবদান রাখেন মাহেলা নিজেই। অধিনায়ক হিসেবে মাহেলার ভিতটা মজবুত হয়ে যায় এই সফরের পরপরই।

মহাকাব্যিক ৬২৪ রানের জুটি

২০০৬ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা, প্রথম টেস্টে কলম্বোর এসএসসিতে মুখোমুখি হয় দুই দল। প্রথম ইনিংসে প্রোটিয়ারা অল আউট মাত্র ১৬৯ রানে!  তবে ডেল স্টেইনের জোড়া আঘাতে মাত্র ১৪ রানে শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার সাজঘরে ফিরলে মনে হচ্ছিলো যে এই অল্প পুঁজিতেই বুঝি ম্যাচ জমিয়ে তুলে প্রোটিয়ারা! তবে এরপর যা হলো, সেটা শুধু প্রোটিয়ারা কেনো, লঙ্কানরাও তাদের স্বপ্নে ভাবতে পেরেছিল কিনা সন্দেহ! ১৫৭ ওভার ব্যাটিং করে ৬২৪ রানের পাহাড়সম এক জুটি দাঁড় করান কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে! এই ৬২৪ রানের জুটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক টেস্টেই নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট হিসেব করলেও যেকোনো জুটিতে সর্বোচ্চ!

মহাকাব্যিক সেই জুটি গড়ার পথে মাহেলা ও সাঙ্গা; Image Source: cricketcountry.com

জুটি ভাঙ্গে ব্যক্তিগত ২৮৭ রানে কুমার সাঙ্গাকারার বিদায়ে। তবে ব্যাট হাতে তখনো অবিচল মাহেলা বেশ ভালোভাবেই লারার ৪০১ রানের রেকর্ড ভাঙার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দ্রুত রান তুলতে গিয়ে আন্দ্রে নেলের বলে বোল্ড আউট হলে মাহেলার সেই মহাকাব্যিক ইনিংস থামে ৩৭৪ রানে! মাত্র ২৭ রানের জন্য লারার রেকর্ড মিস করলেও অন্য আরেকটি রেকর্ড ততক্ষণে মাহেলার দখলে চলে গেছে! ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান এই ৩৭৪ ই! তাছাড়া জয়াসুরিয়ার ৩৪০ রান টপকে লঙ্কান ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও নিজের করে নেন মাহেলা। শ্রীলঙ্কা এই টেস্ট জিতে নেয় এক ইনিংস ও ১৫৩ রানের ব্যবধানে আর ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও পান মাহেলা জয়াবর্ধনে।

পি সারা ওভালে পরের টেস্টে প্রোটিয়ারা ৩৫২ রান ছুঁড়ে দেয় লঙ্কানদের। মাহেলার ১২৩ রানে ভর করে এই রান তাড়া করে সিরিজ ২-০ তে জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা, সেসময়ে এটিই ছিল লঙ্কানদের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। এ ম্যাচেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম বছরেই আইসিসি টিম অব দ্য ইয়ারের অধিনায়ক নির্বাচিত হন মাহেলা জয়াবর্ধনে।

২০০৭ বিশ্বকাপ- অসাধারণ এক প্রত্যাবর্তন

এর আগের বিশ্বকাপে হতশ্রী পারফর্ম করায় ২০০৭ বিশ্বকাপে রান পাওয়ার ব্যাপারে আলাদা একটা মাহেলার উপরে ছিল, সেই চাপকে শক্তিতে পরিণত করে বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন মাহেলা। ৬০.৮৯ গড়ে ৫৪৮ রান করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন মাহেলা। তবে দুইটা ম্যাচের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। প্রথমটি হচ্ছে সুপার এইট রাউন্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি, শ্রীলঙ্কার করা ২৩৫ রানের জবাবে জয়ের পথে বেশ ভালোভাবেই ছিল ইংলিশরা। শেষ বলে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৩ রান, ক্রিজে ইনফর্ম ব্যাটসম্যান রবি বোপারা আর বোলিং এ দিলহারা ফার্নান্দো। ফার্নান্দো শেষবল করতে যাবে এমন সময়ে হুট করে মাহেলা ফার্নান্দোকে থামিয়ে বলেন “বোপারা কিন্তু স্লো বলের আশায় আছে, তুমি ভুলেও স্লো বল করো না বরং ফাস্ট একটা বল করো।” ফার্নান্দো আসলেই  তখন স্লো বল করার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু অধিনায়কের নির্দেশমতে সে কুইকার ডেলিভারিই করলো, আর স্লো বলের আশায় থাকা বোপারা দেরিতে ব্যাট চালানোয় হয়ে গেলেন বোল্ড! শুধুমাত্র মাহেলার ট্যাকটিকাল ব্রিলিয়ান্সের জন্য হারা ম্যাচ জিতে যায় লঙ্কানরা।

সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ উইনিং সেঞ্চুরি করার পথে মাহেলা; Image source: espncricinfo.com

সুপার এইটে দ্বিতীয় হয়ে সেমিফাইনালে যায় শ্রীলঙ্কা যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল নিউজিল্যান্ড। টসে জিতে আগে ব্যাটিং এ নেমে লঙ্কানদের শুরুটা মন্থর হলেও মাহেলার ১০৯ বলে ১১৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ২৮৯ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় শ্রীলঙ্কা যা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে ফাইনালে অজিদের সাথে আর পেরে উঠে নি মাহেলার দল, ৫৩ রানে হেরে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় লঙ্কানদের। সে বছর অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার এইটেই বিদায় নিতে হয় মাহেলার শ্রীলঙ্কাকে। অসাধারণ পারফর্ম করে ২০০৭ সালে উইজডেন বর্ষসেরা খেলোয়াড় হন মাহেলা। পরের বছর পাকিস্তানের মাঠে ফাইনালে ভারতকে ১০০ রানে হারিয়ে এশিয়া কাপের শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।

অধিনায়কের পদ থেকে সরে যাওয়া

অধিনায়ক হিসেবে মাহেলা বেশ ভালো সময় পার করছিলেন, কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ২০০৯ সালের শুরুতেই মাহেলা ঘোষণা দেন যে তিনি আর অধিনায়ক হিসেবে থাকবেন না! তার এই সিদ্ধান্তে ভক্তরা তো বটেই বোর্ডও বেশ অবাক হয়ে যায়। অধিনায়কত্ব ছাড়ার পেছনে সেরকম কোনো শক্ত কারণ মাহেলা দিতে পারেননি। অনেকের মতেই, সেসময়ে শ্রীলঙ্কার সহ অধিনায়ক ও মাহেলার সবচেয়ে কাছের বন্ধু কুমার সাঙ্গাকারাকে অধিনায়ক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যেই মাহেলা এভাবে হুট করে অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান। তবে অধিনায়কের পদ ছাড়লেও দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে মাহেলার প্রভাব মোটামুটি আগের মতোই রয়ে যায়, একারণে কিছুদিন পরেই মাহেলাকে সাঙ্গাকারার ডেপুটি করে দেয় লঙ্কান বোর্ড। সাঙ্গাকারার নেতৃত্বে ২০০৯ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে অসাধারণ খেললেও ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হেরে আবারো রানার আপ হয় শ্রীলঙ্কা।

টি-টুয়েন্টিতে নিজেকে প্রমাণ করা

কিছুটা ক্লাসিক ঘরনার ব্যাটসম্যান হওয়ায় টি-টুয়েন্টিতে শুরুর দিকে নিজের জাতটা ঠিক চেনাতে পারছিলেন না মাহেলা। যদিও শ্রীলঙ্কার টি-টুয়েন্টি দল কিংবা আইপিএল- দু জায়গাতেই নিয়মিত খেলে যাচ্ছিলেন মাহেলা, কিন্তু পারফর্মেন্স যা করছিলেন, তা তার নামের পাশে বেশ বিবর্ণই ছিল। মাহেলার টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসে ২০১০ সালে আইপিএলের একটি ম্যাচ। মাহেলার দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ২০০ রানের পাহাড় দাঁড় করায় কলকাতা নাইট রাইডার্স। রান তাড়া করতে নামার আগে এ ম্যাচে ওপেনিংয়ে নামার ইচ্ছার ব্যাপারে পাঞ্জাবের অধিনায়ক সাঙ্গাকারাকে জানান মাহেলা। সাঙ্গাকারা সম্মতি দিয়ে দেন আর ওপেনার হিসেবে সুযোগ পেয়েই খেলেন ৫৯ বলে ১১০ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। তার এই ইনিংসে ভর করে এক ওভার আগেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় পাঞ্জাব।

আইপিএলে ওপেনার হিসেবে সফল হওয়ায় ২০১০ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপেও ওপেনার হিসেবে খেলা শুরু করেন মাহেলা। এখানেও শুরুতেই বাজিমাত, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৫১ বলে ৮১ রান করেন জয়াবর্ধনে। তবে বাকি ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় শ্রীলঙ্কা মাত্র ১৩৫ রানে গুটিয়ে গেলে চার উইকেটে ম্যাচটা জিতে নেয় কিউয়িরা। গ্রুপ পর্বের শেষ ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৪ বলে ১০০ রান করে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটে প্রথম লঙ্কান ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। তার এই সেঞ্চুরিতে ভর করেই লঙ্কানরা দাঁড় করায় ১৭৩ রানের সংগ্রহ, যা জিম্বাবুয়েকে হারানোর জন্য যথেষ্টই ছিল।

২০১০ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে মাহেলা; Image Source: cricketdawn.com

পরের ম্যাচে সুপার এইটে স্বাগতিক উইন্ডিজের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা আর সেই ম্যাচেও অব্যাহত থাকে মাহেলার রান ফোয়ারা। ৫৬ বলে ৯৮ রানে অপরাজিত থাকলে মাত্র দু’রানের জন্য টানা দুইটি আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ম্যাচে সেঞ্চুরি করার বিরল রেকর্ড গড়া থেকে বঞ্চিত হন মাহেলা। পরের ম্যাচে অজিদের বিপক্ষে ব্যাট হাতে নিষ্প্রভ ছিলেন মাহেলা, লংকাও হেরে যায় ম্যাচটা। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচ জিতে শ্রীলঙ্কা চলে যায় সেমিফাইনালে। কিন্তু সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যাওয়ায় সেবারও শিরোপা না জিতেই ফিরতে হয় লঙ্কানদের। তবে ৩০২ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক জয়াবর্ধনেই হন।

২০১১ বিশ্বকাপ: আরেক ট্র্যাজেডি

৪ঠা এপ্রিল, ২০১১

পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে বিশ্বকাপ ফাইনালে মুম্বাইর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। টসে জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিলেন লঙ্কান অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা। কিন্তু শুরুতেই জহির খানের অসাধারণ বোলিং সাথে ভারতীয় ফিল্ডারদের অসাধারণ ফিল্ডিং এ শুরুতেই বেশ চাপে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। মুম্বাইর ফ্ল্যাট পিচে যেখানে বড় সংগ্রহের দরকার ছিল সেখানে পাওয়ার প্লের দশ ওভারে লঙ্কানদের রানরেট ছিল ওভারপ্রতি ৩ রান! মাহেলা জয়াবর্ধনে যখন ক্রিজে আসেন তখন শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ওভারে ৫৬/২। তখন মাহেলার উপর একইসাথে দুইটা দায়িত্ব, রানের গতি বাড়ানো সাথে নিজের উইকেট বিলিয়ে না আসা। মাহেলা জয়াবর্ধনে দুইটা দায়িত্বই বেশ ভালোভাবে সামলালেন, অপরপ্রান্তের কোনো ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে সেভাবে সমর্থন না পেলেও মাহেলা একাই বুক চিতিয়ে লড়ে গেলেন, খেললেন মাত্র ৮১ বলে ১০৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস।

ফাইনালে দুরন্ত সেঞ্চুরির পর মাহেলা; Image source: Cricfit

পরিস্থিতি আর পারিপার্শ্বিক চাপের কথা বিবেচনা করলে এই ইনিংসটাকে সহজেই বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে সেরা তিন ইনিংসের তালিকায় রাখা যায়। মাহেলার এই অসাধারণ ইনিংসে ভর করেই সেদিন শ্রীলঙ্কা ২৭৪ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায়। অথচ সেদিন যদি আরেকজন ব্যাটসম্যান মাহেলাকে ঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারতেন, তাহলে হয়তো সেদিন লংকানদের সংগ্রহ ৩০০ ছাড়িয়ে যেতো। তবে বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে এর আগে কোনো দলেরই ২৫০+ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড ছিল না। ফলে মনে হচ্ছিলো, ২৭৪ রানই বুঝি শ্রীলঙ্কার জয়ের জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু মুম্বাইর ফ্ল্যাটপিচ রাতের শিশিরের প্রভাবে আরো বেশি ব্যাটিং বান্ধব হয়ে যায়, গৌতম গম্ভীর আর ধনীর অসাধারণ দুইটি ইনিংসে বৃথা যায় মাহেলার অসাধারণ সেই সেঞ্চুরি, ছয় উইকেটের জয়ে দ্বিতীয়বারের মতন বিশ্বজয় করে ভারত। আর বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি করেও পরাজিত দলে থাকার দুঃসহ রেকর্ডের অধিকারী হয়ে যান মাহেলা জয়াবর্ধনে। এই পরাজয়ের পরে দল নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার জের ধরে অধিনায়কের পদ থেকে সাঙ্গাকারা ও সহ অধিনায়ক হিসেবে মাহেলা পদত্যাগ করেন।

দুর্দিনে আবারো লঙ্কার কাণ্ডারি

কিন্তু মাহেলা-সাঙ্গার পদত্যাগের পর দিলশানের নেতৃত্বে জঘন্য এক বছর পার করে শ্রীলঙ্কা, শেষপর্যন্ত ২০১২ সালে আবারো দলের দায়িত্ব নেন মাহেলা। দায়িত্ব নিয়েই শ্রীলঙ্কাকে আবারো সাফল্যের কক্ষপথে নিয়ে আসেন মাহেলা। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের সাথে ত্রিদেশীয় সিরিজে অসাধারণ ক্রিকেট খেলেও রানার আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। তবে ঘরের মাঠে পাকিস্তানকে ওয়ানডে ও টেস্ট সিরিজে ঠিকই হারায় শ্রীলঙ্কা। মাহেলা তার দলকে ঘরের মাঠে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য তৈরি করতে থাকেন। নেটে বোলিং দেখে ১৭ বছর বয়সী রহস্যময় স্পিনার আকিলা ধনঞ্জয়কে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে দলে নেন মাহেলা। মাহেলার ট্যাকটিসে ঘরের মাঠের সেই টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে অদম্য একদলে পরিণত হয়েছিলো শ্রীলঙ্কা, সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে হারানোর ম্যাচে ম্যাচসেরাও হন মাহেলা।

ফাইনালে উইন্ডিজের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা, প্রথম ১০ ওভারে উইন্ডিজ মাত্র ৩২ রান করায় মনে হচ্ছিলো উইন্ডিজকে বুঝি হেসেখেলেই হারাতে পারবে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে মাহেলার তূণের সেরা তীর মালিঙ্গাই হয়ে উঠলেন খরুচে বোলার! শেষপর্যন্ত উইন্ডিজদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৩৭ রানে যা কলম্বোর স্লো পিচে বেশ ভালো সংগ্রহ ছিল। তবে এই রানচেজে লঙ্কানরা ভালোমতোই ছিল কিন্তু বৃষ্টির আভাস দেখে রানরেট বাড়াতে হুট করে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে সেট ব্যাটসম্যান মাহেলা আউট হলে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে যায় লঙ্কান ব্যাটিং লাইনআপ। ঘরের মাঠে এত কাছ থেকে বিশ্বকাপ হারানোর দুঃখে তৎক্ষণাৎ টি-টুয়েন্টির অধিনায়ক হিসেবে সরে যান মাহেলা। পরের বছর অস্ট্রেলিয়া সফর শেষে টেস্ট ও ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবেও সরে যান মাহেলা।

অবশেষে বিশ্বজয়

২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক হিসেবে চান্দিমাল নিয়োগ পেলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্লো ওভাররেটের জন্য চান্দিমাল এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হওয়ায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডু অর ডাই ম্যাচে অধিনায়কের দায়িত্ব পান লাসিথ মালিঙ্গা যার আগে অধিনায়ক হিসেবে জাতীয় দলে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না! এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শ্রীলঙ্কা অলআউট মাত্র ১১৯ রানে! তখন মনে হচ্ছিলো, মাহেলা-সাঙ্গার একটা বিশ্বকাপের স্বপ্ন বুঝি অধরাই রয়ে যাবে। কিন্তু নেতাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে আর্মব্যান্ডের যে কোনো দরকার হয় না সেটা আবারো প্রমাণ করেন মাহেলা, মালিঙ্গাকে একপাশে রেখে পুরোম্যাচে নেতৃত্ব দেন মাহেলা নিজেই। মাহেলার অসাধারণ নেতৃত্বেই মাত্র ১১৯ রানের পুঁজি সত্ত্বেও ৫৯ রানে জিতে সেমিফাইনালে চলে যায় শ্রীলঙ্কা। এরপর উইন্ডিজকে সেমিতে হারানোর পর ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় লঙ্কানরা আর সেখানে আবারো মাহেলার চমক! আগে থেকেই ভারতের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা খুঁজে সেই অনুযায়ী ডেথ ওভারে বোলিং করার পরিকল্পনা সাজান মাহেলা আর এই ট্যাকটিসের কারণেই ভারতের ইনিংস মাত্র ১৩০ রানেই থেমে যায় যা ২.১ ওভার হাতে রেখেই শ্রীলঙ্কা টপকে গেলে অবশেষে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয় মাহেলার!

বিশ্বজয়ের পর বন্ধু সাঙ্গাকারাকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা মাহেলা; Image Source: itnnews

বিচিত্র এই পৃথিবীতে ঘটনাগুলো যেন আরো বেশি বিচিত্র, অফিসিয়াল অধিনায়ক হিসেবে ট্যাকটিসের সমস্তটা দিয়েও যেখানে মাহেলা অধিনায়ক হিসেবে দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি, সেখানে পর্দার আড়ালে থেকে যেবার নেতৃত্ব দিলেন সেবারই দল জিতে গেলো বিশ্বকাপ! অবশ্য এটা নিয়ে মাহেলার কোনো অতৃপ্তি ছিল না, তৃপ্তি নিয়েই ওই ম্যাচের পর টি-টুয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন মাহেলা। একইবছর পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের শেষ টেস্ট খেলেন মাহেলা। আর ঘোষণা দেন ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে থেকেও অবসর নেওয়ার। টি-টুয়েন্টির মতো অবশ্য ওয়ানডের বিদায়টা সুখকর হয়নি, দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে শ্রীলঙ্কা বিদায় নেয় আর মাহেলাও খেলে ফেলেন নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাহেলা; Image Source: espncricinfo.com

স্বার্থত্যাগের যত উদাহরণ

ওয়ানডেতে ৩৩.৩৮ গড় কিংবা টেস্টে ৪৯.৮৫ গড় আসলেই মাহেলার প্রতিভার সাথে ঠিক মানানসই নয়, কিন্তু পরিসংখ্যানের এই তথ্যগুলো আসলে সব কথা প্রকাশ করে না। মাহেলা কখনোই নিজের মনের মতো পজিশনে ব্যাটিং করতে পারেননি, যখন যে পজিশনে দলের তাকে দরকার হয়েছে, তখন সে পজিশনেই তিনি ব্যাটিং করেছেন। একারণেই ওয়ানডেতে ওপেনার হিসেবে মাহেলার গড় সবচেয়ে বেশি থাকা সত্ত্বেও তিনি ওপেনার হিসেবে খেলেছেন মাত্র ৩৪ ইনিংস! কারণ মাহেলা ওপেনিংয়ে চলে গেলে শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার আর তাল রাখতে পারতো না। দলে তরুণদের সুযোগ দেওয়ার কথা আসলে সবার আগে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন এই মাহেলাই, শ্রীলঙ্কার বর্তমান অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমাল যখন দলে তরুণ হিসেবে আসেন, তখন মাহেলা নিজের চার নম্বর পজিশন চান্দিমালের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন, নিজে নেমে গিয়েছিলেন পাঁচ নাম্বার পজিশনে। ২০১২ সালে অধিনায়কের দায়িত্বে ফিরেছিলেন শুধুমাত্র দলকে খাদের কিনারা থেকে ফেরানোর জন্যে, দল একটা গোছানো অবস্থায় আসার সাথে সাথেই আবারো অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান মাহেলা জয়াবর্ধনে।

অধিনায়কের আর্মব্যান্ড থাকুক কিংবা নাই থাকুক, ২০০৬ সালের পর থেকে প্রায় পুরোটা সময়ে দলের ট্যাকটিকাল ব্যাপারগুলো নিজে দায়িত্ব নিয়ে সামলাতেন মাহেলা। যার কারণে নিজের ব্যাটিংয়ের দিকে পূর্ণ মনোযোগ খুব কমই দিতে পেরেছেন মাহেলা। তাই শুধুমাত্র গড় দিয়ে শ্রীলঙ্কা দলের প্রতি একজন মাহেলার অবদান বোঝানো সম্ভব নয়, একজন নেতা হিসেবে মাহেলা প্রায় দশ বছর যেভাবে দলকে আগলে রেখেছিলেন, সেটা কোনো পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। মাহেলা অবসরে যাওয়ার পর একজন যোগ্য নেতার অভাবে শ্রীলঙ্কার ছন্নছাড়া অবস্থা দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় এই দলটার জন্য মাহেলার উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাঙ্গাকারার ব্যাটিং গড় মাহেলার চেয়ে যতোই ভালো থাকুক, একজন সাঙ্গাকারার চেয়ে একজন মাহেলার শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে অবদানটা বেশিই হবে। অনেকের মতে, ট্যাকটিকাল স্কিলে অর্জুনা রানাতুঙ্গার চেয়েও সেরা ছিলেন মাহেলা জয়াবর্ধনে! তাই শুধুমাত্র স্টাইলিশ ব্যাটিংয়ের জন্য নয়, শ্রীলঙ্কার জনগণ মাহেলা জয়াবর্ধনেকে মনে রাখবে একজন নেতা হিসেবেও, যিনি বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন তার দলকে।

ফিচার ইমেজ: Hindustan Times

Related Articles