Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডেভিড সিলভা: নিভৃতে থাকা এক জাদুকর

দুই বছরের একজন বাচ্চা ‘ফুটবল’ ‘ফুটবল’ বলে ছুটে বেড়াচ্ছে, আর সামনে থাকা যেকোনো একটা গোলাকার বস্তু পেলেই হলো, সে আম হোক কি কমলা, ফুটবল হিসেবে আপন করে নিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। আপনার দৃশ্যপটে ভেসে ওঠা ব্যাপারটি বেশ মধুর মনে হলেও ডেভিড সিলভার দাদী একরাশ বিরক্তি নিয়েই তাকাতেন নাতীর দিকে। বিরক্তি থাকলেও একমাত্র নাতীর আবদার মেটাতে দিনের পর দিন পাপোষ কিংবা কাপড় দিয়ে বল তৈরি করে গেছেন। কিন্তু ছোট্ট সিলভার পায়ে সেই বল টিকতো বড়জোর ঘন্টা-দুয়েক। তারপর?

অগত্যা, অন্দরমহল থেকে গোলাকার কোনো একটা ফল বাইরে এনে তা দিয়েই অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে ড্রিবলিং করার খেলায় মত্ত। ছেলের এহেন কর্মকাণ্ডের একটা পরিণতি দরকার। পুলিশ অফিসার বাবা ফার্নান্দো ছেলের তিন বছরের মাথায় ক্রিসমাস উপহার হিসেবে নিয়ে এলেন একটি চর্মগোলক। ডেভিডের চোখে সে কী দীপ্তি, আনন্দ যেন আর ধরছে না!

ব্যক্তি জীবনে জেসিকা সুয়ারেজের সাথে ঘর বাঁধলেও সিলভার প্রথম প্রেম যে সেই ক্রিসমাসে পাওয়া ফুটবলের সাথে ছিল, তা হয়তো স্বয়ং সিলভাও অস্বীকার করবেন না। সেই প্রেমে যেমন ছিল উত্থান-পতন, ছিল সর্বজয়ের সুখও। যে প্রেমের রসায়নে তাবৎ ফুটবলপ্রেমীরাও হয়েছেন মুগ্ধ। আজ আমরা জানবো সিলভার গত দুই দশক জুড়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাওয়ার গল্প।  

স্পেনের দক্ষিণ উপকূল গ্রান ক্যানারিয়ার পাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে মৎস্যজীবিদের গ্রাম আরগিনেগিন। কিছুটা ঘুমন্ত এই গ্রামের পরিবেশ স্পেনের ব্যস্ততম শহরের থেকে বেশ আলাদা। প্রশান্তির একটা ভাব বিরাজমান পুরো গ্রাম জুড়ে। সিলভার জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই স্প্যানিশ গ্রামটিতেই। বাবা স্প্যানিশ হলেও মা এভা ছিলেন জাপানিজ বংশোদ্ভুত। ১৯৮৬ সালে যখন ঘর আলো করে সিলভার জন্ম, বাবা-মা তাকিয়ে দেখলেন, ছেলে ঠিক যেন মায়ের চোখগুলোই পেয়েছে। সেই থেকে সিলভার আদুরে ডাক নাম ‘এল চিনো’, যার অর্থ ছোট চোখ। মায়ের থেকে যদি চোখ পেয়ে থাকেন, তাহলে আরগিনেগিন থেকে সিলভা পেয়েছিলেন একরাশ সৌম্যভাব। বল পায়ে সিলভার মতো ঠাণ্ডা মাথার শান্ত ও অলস সৌন্দর্য্যে ঘেরা মিডফিল্ড-মায়েস্ত্রো বর্তমান ফুটবলে কতজন আছেন, তা হয়তো হাতের কর দিয়েও গুনে ফেলা যাবে।

ফুটবল মাঠে ছোট্ট সিলভা; Image Credit : Celebrities

আরগিনেগিন গ্রামটি স্পেনের মূল শহরগুলো থেকে বেশ দূরে। এদিকে নিজ গ্রামেও নেই কোনো অনুর্ধ্ব-১০ বয়সভিত্তিক দলও। তাই ছোট্ট সিলভা পড়লেন বিপাকে। খেলার মতো কোনো দলই যে নেই তার! তবে সুখকর বিষয় ছিল যে, বাবা ফার্নান্দো এক সময়ে সেমি-লোকাল ক্লাবের ফুটবলার ছিলেন। তাই অগত্যা বাবার সাথেই ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকতেন সিলভা। কোনো এক ভরদুপুরে ছেলের সাথে যখন ফুটবল নিয়ে নিজের কারিকুরি দেখাচ্ছিলেন বাবা ফার্নান্দো। হুট করে দুর্ঘটনাবশত তার করা জোরালো শটে বাম হাতটি ভেঙেই যায় ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের সিলভার। তখন তার বয়স সবেমাত্র ৬। ডাক্তার এসে প্লাস্টার দিয়ে হাত বেঁধে দিতে দিতে ঘোষণা করলেন, এক মাস ধরে ফুটবল স্পর্শ করা সম্পূর্ণ বন্ধ। কিন্তু যার প্রথম প্রেম ফুটবলের সাথে, তার সামান্য হাত ভাঙাতে কী-ই বা আসে যায়! পরদিনই বাবাকে ডাকলেন সিলভা। বললেন, ‘বাবা, ফুটবল তো হাত দিয়ে খেলে না কেউ।’ বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্লাস্টার করা হাত ঝুলিয়ে বল নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। হতভম্ভ ফার্নান্দো সেইদিনই মনস্থির করলেন, ছেলেকে তিনি ফুটবলারই বানাবেন।

সেদিন নির্দোষ মনে বলে ফেলা কথাটিই শুরুর দিকে যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছিল সিলভার দিকে। ভাগ্যের পরিহাসও বলা যায় ব্যাপারটিকে। কারণ, নিজের প্রথম ক্লাব স্যান ফার্নান্দোতে সিলভার জায়গা হলো গোলবারের নিচে। যদিও খুব অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ভুল ভাঙে ক্লাবটির। বল পায়ে দুর্দান্ত দক্ষতা জাহির করে গোলবার থেকে সিলভা চলে আসেন উইংয়ে। নিজ গ্রাম থেকে বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে স্যান ফার্নান্দোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে বাধা এলেও অবিচল ছিলেন সিলভা। সেই সময় সিলভার কাজই ছিল দুইটি – বাসায় এসে টিভি সেটের সামনে বসে ফুটবল দেখা, আর সেটিই মাঠে গিয়ে অনুকরণের চেষ্টা। সেই সময় ২১ নাম্বার জার্সি পড়ে লা লিগা মাতিয়ে বেড়াচ্ছিলেন মাইকেল লাউড্রপ। লাউড্রপে এতটাই মজেছিলেন সিলভা যে পরবর্তীতে নিজের পুরো ক্যারিয়ারই পার করে দিয়েছিলেন লাউড্রপকে আদর্শ মেনে পরা ২১ নাম্বার জার্সিতে। লাউড্রপের পায়ের ম্যাজিক যেন সিলভার স্বপ্নাতুর চোখকে আরো উজ্জ্বল করে তুলতে পারতো।

ডেভিড সিলভা; Image Credit: Justin Sherman/These football times

এদিকে নিজের প্রিয় জায়গা উইং ফিরে পেয়ে স্যান ফার্নান্দোর হয়ে জাদুকরী সব মুহূর্ত তৈরি করা শুরু করলেন এই কিশোর। স্যান ফার্নান্দোর কোচ ও সিলভার মেন্টর ভিসেন্তে মিরান্ডা সিলভার প্রতিভা দেখে ফার্নান্দোকে উপদেশ দেন ছেলেকে ট্রায়ালের জন্য নিয়ে যেতে স্পেনের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। ভিসেন্তের কথায় আত্মবিশ্বাস নিয়ে সিলভাকে নিয়ে রাজধানীতে আসেন বাবা ফার্নান্দো।

মিরান্ডার কথাকে সঠিক প্রমাণ করে রিয়াল মাদ্রিদ ট্রায়ালেও সিলভা চমকে দেন সবাইকে। তৎকালীন মাদ্রিদ কোচ ভিসেন্তে দেল বস্ক নিজে এসে সিলভার খেলা দেখেন। এত কিছুর পরও একটা কিন্তু রয়ে যায় রিয়াল মাদ্রিদের মনে। শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল ছিলেন সিলভা। ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে ইউরোপের প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে নিজের সামর্থ্যের কতটুকুই বা উজাড় করে দিতে পারবেন, তা নিয়েই সন্দিহান ছিল ক্লাবটি।

বাস্তবতার নির্মম শিকার হয়ে একরাশ দুঃখ নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ট্রায়াল থেকে বাড়ি ফিরেন সিলভা। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন এই বুঝি বিসর্জন দিতে হয়! কিন্তু হাল একেবারে ছেড়ে দেননি সিলভা। স্যান ফার্নান্দোর হয়ে ফুটবল খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। আর সেজন্য হয়তো ঈশ্বরও মুখ তুলে তাকান। বছর দুয়েক পরই নিজেদের যুব একাডেমিতে যোগ দেওয়ার অফার নিয়ে সিলভার দ্বারস্থ হয় আরেক বিখ্যাত স্প্যানিশ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া। কিন্তু নিজ বাড়ি থেকে ২০০০ কিলোমিটার দূরে ভ্যালেন্সিয়া যাওয়া নিয়েও সংশয় ছিল তার মনে। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছা ও সমর্থনেই মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভ্যালেন্সিয়ায় পাড়ি জমান ডেভিড সিলভা। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই স্প্যানিয়ার্ডকে।

ভ্যালেন্সিয়াতে সিলভা; Image Credit: Heino Kalis/ REUTERS

যে বছর ভ্যালেন্সিয়ায় যোগ দেন সিলভা, সেবারই তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো লা লিগা শিরোপা ঘরে তোলে ভ্যালেন্সিয়া। জিতে নিয়েছিল উয়েফা কাপও। তৎকালীন সময়ে ভ্যালেন্সিয়ার স্কোয়াড ছিল পরিপূর্ণ আর প্রতিভায় ভরপুর। সেই স্কোয়াড ভেঙে দলে জায়গা করে নেওয়া একজন কিশোরের পক্ষে আক্ষরিক অর্থেই ছিল কষ্টসাধ্য। ভ্যালেন্সিয়া ‘বি’ টিমের হয়ে ১৪ ম্যাচ খেললেও কতৃপক্ষ চেয়েছিল মূল দলে খেলে সিলভা যাতে নিজেকে আরো শাণিত করতে পারেন। তাই দ্বিতীয় বিভাগের দল এইবারে ধারে পাঠানো হয় তাকে। নিজের সামর্থ্যের পরিচয় দিয়ে সেই মৌসুমে এইবারকে লিগ টেবিলে চতুর্থ স্থানে নিয়ে আসেন তিনি। যা কি না সেই সময় পর্যন্ত ছিল এইবারের সর্বোচ্চ সাফল্য। এইবারের হয়ে পুরো মৌসুমে গোল করেন ৫টি।

সিলভার পারফরম্যান্সে যারপরনাই আনন্দিত ভ্যালেন্সিয়া সিদ্ধান্ত নিল তাকে লা লিগার কোনো ক্লাবে খেলানোর। সেবার সদ্য উত্তীর্ণ হওয়া সেল্টা ভিগোতেই নিয়মিত খেলার সুযোগ পাবেন বিধায় ধারে সিলভার আগমন সেল্টাতে। আবারও নিজের ক্যারিশমা দিয়ে সদ্য উত্তীর্ণ হওয়া সেল্টা ভিগোকেই লিগ টেবিলে নিয়ে যান ষষ্ঠ স্থানে। পাইয়ে দেন উয়েফা কাপ খেলার টিকেটও। মৌসুমশেষে ৩৫ ম্যাচে গোল করেন চারটি, আর সাথে মাঝমাঠের ম্যাজিকটাও থাকে অক্ষত। অন্যদিকে, সিলভার অনুপস্থিতি ভালোভাবেই টের পায় এইবার। সেগুন্দা ডিভিশনে আগেরবার চতুর্থ হওয়া এই ক্লাব সিলভাকে হারিয়ে পরের মৌসুমে অবনমিত হয়ে নেমে যায় তৃতীয় বিভাগে।

টানা দুই মৌসুমের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের উপহার হাতেনাতেই পেয়ে যান সিলভা। ভ্যালেন্সিয়া ফিরিয়ে আনে তাকে। ম্যানেজার কিকে সানচেজ ফ্লোরেস সেই মৌসুমে সব মিলিয়ে ৪৮টি ম্যাচে খেলান সিলভাকে। নয় গোলের পাশাপাশি সাতটি গোলেও সহায়তা করেন তিনি। ডেভিড ভিয়া ও জোয়াকিনকে সাথে নিয়ে ভ্যালেন্সিয়াকে নিয়ে যান চতুর্থ স্থানে। তবে দিনকয়েক পর পর কোচ পরিবর্তন করার ফলস্বরূপ ট্র্যাকচ্যুত হয়ে পড়ে ক্লাবটি। পর্যাপ্ত প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও পরের মৌসুমে ক্লাবের অবস্থান দাঁড়ায় লিগ টেবিলে দশ নাম্বারে। যদিও মন্দের ভালোর মধ্যে সেবার কোপা দেল রে জিতে নেয় ভ্যালেন্সিয়া, যেটি কি না সিলভার ক্যারিয়ারের প্রথম মেজর শিরোপা।

ম্যানচেস্টার সিটির প্রাণভোমরা ছিলেন এই মিডফিল্ডার; Image Credit: Goal.com

কিন্তু দিন দিন ভ্যালেন্সিয়া হয়ে উঠছিল আরো অসহায়। অর্থনৈতিক দৈন্যতায় ভুগে খেলোয়াড় বিক্রি করা শুরু করে তারা। প্রথমে ডেভিড ভিয়াকে বার্সেলোনার কাছে বিক্রয় করার পর সিলভাকে তারা ছেড়ে দেয় ম্যানচেস্টার সিটির কাছে। যদিও নিজ থেকে ক্লাব ছাড়তে চাননি সিলভা। তবে ক্লাব ছাড়ার আগে ভ্যালেন্সিয়ার হয় ৬ মৌসুম ১১৯ ম্যাচ খেলে সিলভা করেন ২১ গোল। 

২৫ মিলিয়নের বিনিময়ে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই সিটিজেনদের হয়ে নাম লেখান সিলভা। ইয়াইয়া তোরে ও মারিও বালোতেল্লির সাথে সেই মৌসুমে ক্লাবে যোগ দেন সিলভা। ম্যানচেস্টার সিটির জাগরণের শুরুটাও হয় এদের হাত ধরেই। সিটিজেনদের উত্থানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন যে তিনজন, তাদের মধ্যে অন্যতম ডেভিড সিলভা। বাকি দুইজন হলেন আগুয়েরো ও ইয়াইয়া তোরে।

শুরুতে সবাই সিলভার শারীরিক দিক দেখে আশঙ্কা করছিল, প্রিমিয়ার লিগের গতিময় ফুটবলের সাথে হয়তো টিকতে পারবেন না তিনি। কিন্তু সব কথাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে প্রিমিয়ার লিগের গত এক দশকের অন্যতম সেরা মাঝমাঠের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বলের উপর দুর্দান্ত দক্ষতা আর নিখুত পাস দেওয়ার সামর্থ্য সিলভাকে করে তুলেছে অতুলনীয়। সেটপিসেও ছিলেন ভয়ঙ্কর। প্রতিপক্ষের জটলার মাঝেও জায়গা খুঁজে পাওয়া যেন ডালভাত ব্যাপার ছিল তার জন্য। সময়ের সাথে সাথে সিলভা নিজেকে মেলে ধরেছেন পূর্ণরূপে।

প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা হাতে; Image Credit: Manchester City FC

২১ নাম্বার জার্সি পরিহিত সিলভার প্রিমিয়ার লিগ অভিষেক হয় হোয়াইট হার্ট লেনে। ১৪ আগস্টের সেই ম্যাচে টটেনহ্যামের সাথে গোলশূন্য ড্র করে সিটিজেনরা। শুরুতে তৎকালীন সিটি কোচ রবার্তো মানচিনি সিলভাকে উইঙ্গার হিসেবে খেলালেও পরবর্তীতে আরো গুরুভার দিয়ে দেন সিলভার কাঁধে। উইং থেকে সিলভাকে নিয়ে আসেন মাঝমাঠে, যেখানে সিলভার রোল ছিলো ত্রেকোয়ারতিস্তা। যারা মূলত সেন্ট্রাল মিডফিল্ড ও ফরোয়ার্ডদের মাঝে খেলে অফেন্সিভ ফুটবলে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন, তাদেরকে ত্রেকোয়ারতিস্তা বলে সম্বোধন করা হয়, যেটির আরেক নাম ফ্যান্তাসিস্তি। এই রোলে সিলভা হয়ে উঠেন দুর্নিবার। পুরো মাঠ আগলে রেখে নিজেকে মাঝমাঠের নিউক্লিয়াসে রূপান্তর করেন তিনি। সেই মৌসুমশেষে সিটি স্ট্রাইকার কার্লোস তেভেজ ঘোষণা দিয়ে বসেন, সিটিজেনদের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাইনিং এই ডেভিড সিলভাই। 

কার্লোস তেভেজ যে ভুল বলেননি, তার প্রমাণ পরের মৌসুমেই দিয়ে বসেন সিলভা। ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ৬-১ ধ্বংসযজ্ঞে ৩ অ্যাসিস্ট করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এই স্প্যানিয়ার্ড। এরই মধ্যে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার মতো দলগুলো টাকার বস্তা নিয়ে সিলভার পেছনে ছোটা শুরু করে। কিন্তু ম্যানসিটিকে আপন করে নেওয়া সিলভা থেকে যেতে চাইলেন ইতিহাদেই। সেই মৌসুমে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা উঁচিয়ে ধরে ম্যানচেস্টার সিটি। লিগে ১৫ গোলে সহায়তা করেন সিলভা, যেটি কি না ২০১১-১২ মৌসুমে কোনো খেলোয়াড়ের করা সর্বোচ্চ। তাতেই বোঝা যায়, সেবার লিগ জয়ে সিলভার অবদান ছিল কতটুকু। এরই ফলশ্রুতিতে মৌসুমের সেরা দলে নিজেকে জায়গা করে নেওয়ার পাশাপাশি পাঁচ বছরের নতুন চুক্তিও পাকা করেন সিটিজেনদের সাথে সেবার।

গোলের পর উদযাপনরত সিলভা; Image Credit: Diario AS

সম্প্রতি টাইম সাংবাদিক বিল এডগার জানিয়েছেন, সিটিজেনদের হয়ে টানা ২৫ জয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে রেকর্ড গড়েছেন সিলভা। সিলভা খেললেই সিটিজেনদের জয় নিশ্চিত, মাঝখানে ব্যাপারটি যেন এমনই দাঁড়িয়েছিল। ২০১০ সালে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেয়ার পর খেলে ফেলেছেন ৩০৮ টি প্রিমিয়ার লীগের ম্যাচ। এই ৩০৮ ম্যাচে গোল করেন ৬০ টি এবং এসিস্ট করেন ৯৩ টি। ম্যাচপ্রতি ৬০.৮৬ করে মোট ১৮৭৪৫ টি সফল পাস দেন। ৩২ টা হলুদ কার্ড পেলেও সিটিজেনদের হয়ে কখনো লাল কার্ড দেখেন নি তিনি। সিলভার খেলা ৩০৮ টি ম্যাচের মধ্যে ২১৩ টিতে জয় পায় সিটি। সিটির হয়ে ৪ টা লীগ জিতেন এবং প্রতিটাতে ছিলেন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। নিঃসন্দেহে গত দশকের প্রিমিয়ার লীগের অন্যতম সেরা প্লেমেকার ডেভিড সিলভা। অপ্টার মতে, ২০১০ সালে সিলভার প্রিমিয়ার লিগে আগমনের পর থেকে তার চেয়ে বেশি চান্স তৈরি করতে পারেননি আর কোনো খেলোয়াড়। এমনকি সিলভার আগমনের পর প্রিমিয়ার লিগে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক গোলে সহায়তাও করতে পারেনি কেউই। অথচ ডি ব্রুইন থেকে শুরু করে মেসুত ওজিল, সেস ফ্যাব্রিগাস, ল্যাম্পার্ড, জেরার্ডের মতো অনেক রথী-মহারথীরাও খেলেছেন প্রিমিয়ার লিগে। প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত সিলভা’র অ্যাসিস্ট ৯৩টি, যেখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা ডি ব্রুইন আর ওজিলের অ্যাসিস্ট যথাক্রমে ৬৪ ও ৬১টি। তাইতো ডি ব্রুইন সতীর্থ সিলভাকেই মেনে নিয়েছেন নিজের ‘মেন্টর’ হিসেবে।

ইতিহাদের পরশমনি হয়ে থাকা সিলভা জাতীয় দলেও ছিলেন সমান কার্যকর। ২০০৬ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার পর থেকে দলে নিয়মিত ছিলেন রাশিয়া বিশ্বকাপ পর্যন্ত। বিশ্বকাপ শেষেই আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বুটজোড়া তুলে রাখার ঘোষণা দেন তিনি। যে সময়টাতে স্পেন জাতীয় দলে সিলভার আগমন, সেই সময়টাতে স্প্যানিশ ফুটবলে আদতেই চলছিল মাঝমাঠের বিপ্লব। জাভি-ইনিয়েস্তা ছাড়াও বুস্কেটস, আলোনসো, ফ্যাব্রেগাস, কাজোরলা, নাভাস, মাতাসহ একঝাঁক প্রতিভাবান ফুটবলারদের ভিড়েও জাতীয় দলে টিকে ছিলেন সিলভা। স্পেনের জার্সি গায়ে খেলেছেন ১২৫টি ম্যাচ। গোল করেছেন ৩৫টি, যা কি না জাতীয় পর্যায়ে একজন মিডফিল্ডারের জন্য রীতিমতো ঈর্ষণীয় পরিসংখ্যান। শুধু ঈর্ষণীয় বললে ভুল হবে, মাঝমাঠে খেলে আন্তর্জাতিক ম্যাচে এত গোল করতে পারেননি আর কোনো খেলোয়াড়ই। ৯০ ম্যাচে ৩৪ গোল নিয়ে এক্ষেত্রে সিলভার ঠিক পিছনেই রয়েছেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা।

ইউরো জয়ের পর; Image Credit: Getty Image

সিলভার ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান যদি হয় এত এত স্প্যানিশ মিডফিল্ডারদের ভিড়েও নিজের জাত চেনানো, তাহলে সে পরীক্ষায় দশে দশই পাবেন এই স্প্যানিশ। দেল বস্কের অধীনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা স্পেন দলের সদস্য হয়ে সিলভা জিতেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ ও দুইটি ইউরোপিয়ান কাপ। ব্যাক টু ব্যাক ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো জিতে ইতিহাস তৈরি করা ঐতিহাসিক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন সিলভা।

চারটি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, পাঁচটি লিগ কাপ ও দুইটি এফএ কাপ জয়ী ৩৪ বছর বয়সী সিলভার চুক্তির মেয়াদ শেষ হলো এই মৌসুম শেষেই। চুক্তি মতে ৩০ জুন ছিলো সিটিজেনদের হয়ে তাঁর শেষ দিন। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবে সব পিছিয়ে গেলে মাঝে আর বুটজোড়া পায়ে উঠেনি সিলভার। অন্যদিকে লিগ হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে পাখির চোখ করা গার্দিওলাও চাননি তাঁর তুরুপের অন্যতম তাসটি ছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে নামতে। তাই পুনর্বিবেচনা করে সিলভা চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন সিটিজেনদের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ যাত্রা শেষ হওয়া পর্যন্ত। শেষ একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের জন্য এই আকুল চেষ্টা। তারপর কি বুটজোড়া তুলে রাখবেন, নাকি ফিরে যাবেন স্পেনের কোনো ক্লাবে? অথবা এমএলএস কিংবা চাইনিজ ক্লাবেও যেতে পারেন। তা সময়ই বলে দিবে। তবে ভ্যালেন্সিয়াতে কলি হয়ে ফোটা আর ম্যানচেস্টারে এসে ফুল হয়ে সৌরভ ছড়ানো সিলভা ফুটবলের ইতিহাসের পাতায় থাকবেন স্বর্নাক্ষরেই। হয়তো মাঠে মেসি রোনালদোর মতো চোখে পড়বেন না তিনি অথবা ইউটিউবেও পাওয়া যাবেনা দূর থেকে করা গোলার মত কোনো গোলের ভিডিও কিন্তু সিলভাকে ফুটবলপ্রেমীরা মনে রাখবেন সিলভার মতো করেই। নীরবে, আড়ালে থেকে যাওয়া এক জাদুকর হিসেবে। 

This Bangla article is about spanish footballer David Silva. Necessary references are hyperlinked inside the article.

Feature Image: BestHQwallpapers

Related Articles