বেজে উঠেছে আইপিএলের বাজনা।
এবারও আইপিএল নিলামে আর সব বছরের মতোই উঠেছে নিলাম ঘরের ঝড়। হঠাৎ করেই টাকার সমুদ্রে পড়ে গেছেন অচেনা কোনো কোনো তারকা। অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না, কোত্থেকে এলেন এসব অচেনা ক্রিকেটার? আর কীভাবেই বা তারা হয়ে উঠলেন হঠাৎ করে এত দামী?
এই বছর আইপিএল নিলামে এসব অচেনা ক্রিকেটারের হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি অন্য বছরগুলোর চেয়ে যেন একটু বেশি ঘটেছে। ক্রিকবাজের সৌজন্যে চলুন জানা যাক কারা পেলেন এই লটারি, আর কোত্থেকে উঠে এসেছেন এসব আইপিএল বিষ্ময়রা!
বরুণ চক্রবর্তী
৮.৪ কোটি রুপি
কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব
বরুণ চক্রবর্তী কেবল নিলাম ঘরে ঝড় তুলে ৮.৪ কোটি রুপিতে বিক্রি হয়েছেন বলে নয়; এমনিতেই দারুন এক গল্পের বিষয়। তার জীবনটাই এক গল্পের মতো।
বরুণ ছিলেন একজন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে খেলা ছেড়ে দিয়ে হয়ে গিয়েছিলেন কর্পোরেট কর্মকর্তা। সেই বরুণ ফিরে এসেছেন এক রহস্যময় স্পিনার হয়ে।
তামিলনাড়ু থেকে উঠে আসা এক রহস্যময় স্পিনার হলেন বরুণ চক্রবর্তী। ১৩ বছর বয়সে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিকেট শুরু করেন। স্কুল ক্রিকেটে ভালো করছিলেন। কিন্তু পড়াশোনার কারণে হুট করেই ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে মনোযোগী ছাত্রে পরিণত হন। কলেজ জীবনে আর প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলেননি। চেন্নাইয়ের এসআরএম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করেন। এখান থেকে পাশ করার পর একটা আর্কিটেকচার ফার্মে দুই বছর চাকরিও করেছেন। আর তারপরই আবার ক্রিকেটে ফিরে আসেন, তবে এবার ফাস্ট বোলার হয়ে।
এখানেও বরুণের গল্পের শেষ হলো না।
কিছু ক্লাব ক্রিকেট ম্যাচ খেলার পর হাঁটুর চোটের কারণে আবার ক্রিকেট ছাড়তে বাধ্য হলেন। তবে এবার আর পুরোপুরি ছেড়ে দিলেন না খেলাটা। ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার এই সময়কে কাজে লাগালেন। গলি ক্রিকেটে টেনিস বল দিয়ে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে হয়ে উঠলেন একজন স্পিনার।
বরুণ বলছিলেন, “আমি গলি ক্রিকেট খেলার সময় টেনিস বল দিয়ে অনেক রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতাম। আমি চামড়ার বল দিয়েও ওসব করার চেষ্টা করেছি।“
একবার ইনজুরি থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার পর বরুণ আর পেস বেল করার চেষ্টা করেননি। তিনি বলছিলেন, “ইনজুরি থেকে ফেরার পর আমি আর কখনো পেস বল করতে চাইনি। ফলে আমি স্পিনার হয়ে গেলাম।“
আর এই সিদ্ধান্তটা জাদুর মতো কাজ করলো।
ক্লাব স্তরে বরুণ ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে সাত ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ডেলিভারিতে বল করতে শুরু করলেন। তার বৈচিত্রের কথা ছড়িয়ে পড়লো অল্প সময়েই। চেন্নাই সুপার কিংস ও কলকাতা নাইট রাইডার্সের নেটে বল করার সুযোগ পেলেন তিনি। আর এখান থেকে বড় ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে বল করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন বরুণ। এই জ্ঞান তাকে ২০১৮ তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগে অন্যতম সেরা ক্রিকেটারে পরিণত করলো। সেই সাথে বরুণ বিজয় হাজারে ট্রফির প্রথম পর্বে ২২ উইকেট নিয়ে সেরা বোলার হয়ে উঠলেন।
কয়েক বছর আগে শখের বসে আবার ক্রিকেট শুরু করা সেই বরুণ আজ কেবল পেশাদার ক্রিকেটার নন। এবার আইপিএলের বড় আকর্ষণও বটে।
শিবম দুবে
৫ কোটি রুপি
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু
মুম্বাই থেকে উঠে আসা একজন মিডিয়াম পেস বোলিং অলরাউন্ডার শিবম দুবে। এই আইপিএল নিলাম ঘরের ঝড়ের আগে তেমন পরিচিত নাম ছিলেন না ভারতীয় ক্রিকেটে।
দুবে একজন ডান হাতি বোলার এবং বাম হাতি ব্যাটসম্যান। বেশ লম্বা, শক্তিশালী এই অলরাউন্ডার গত বছর মুম্বাই টি-টোয়েন্টি লিগে বড় বড় ছক্কা মেরে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। এরপর গত ঘরোয়া মৌসুমে প্রতি স্তরেই ধারাবাহিক পারফর্ম করেছেন দুবে। বড় ছক্কা মারার ব্যাপারটি তার ভেতর ছোটবেলা থেকেই ছিলো। কিন্তু মুম্বাইয়ের ময়দানে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে তেমন বড় কোনো নাম ছিলেন না তিনি।
মুম্বাইয়ে তার স্কুল হানসরাজ মোরারজিকে অনুর্ধ্ব-১৪ জাইলস শিল্ড জেতানোর পথে দুবের ভালো পারফরম্যান্স ছিলো। কিন্তু এরপর ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে প্রায় ৫ বছর বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলতে পারেননি। তবে অনুর্ধ্ব-২৩ স্তরে এসে আবার দারুণ পারফরম্যান্স করায় মুম্বাই সিনিয়র দলে জায়গা করে নেন দুবে।
২০১৮ সালে তিনি মুম্বাইয়ের সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হন। এর পাশাপাশি তিনি হয়ে ওঠেন শক্তিশালী এবং খুব পরিবর্তিত একজন বোলার। ধারাবাহিক ও শৃঙ্খলাপরায়ণ এই বোলার মুম্বাইয়ের বিজয় হাজারে ট্রফি জয়ের পেছনে বড় অবদান রাখেন।
মুম্বাই টি-টোয়েন্টি লিগে প্রবীন তাম্বেকে ৫ ছক্কা মেরে আলোচনায় আসেন। আইপিএল নিলামের একদিন আগে রঞ্জি ট্রফিতে বরোদার স্বপ্নীল সিংকেও ৫টি ছক্কা মেরেছেন এক ওভারে।
মুম্বাইয়ের কোচ বিনায়ক সামন্ত, যিনি দুবের অনুর্ধ্ব-২৩ দলেও কোচ ছিলেন, তিনি বলছিলেন, “ওর ফিটনেসের মারাত্মক উন্নতি হয়েছে। ও এখন লম্বা স্পেলে বল করতে পারে। আর ব্যাটসম্যান হিসেবে এখন সে আরও ভরসা করার মতো। সে দলের যেকোনো পরিকল্পনার সাথে মানিয়ে নিতে পারে।“
প্রয়াস রায় বর্মণ
১.৫ কোটি রুপি
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু
বাংলা থেকে উঠে আসা একজন লেগস্পিনার হলেন প্রয়াস। এ বছরই বিজয় হাজারে ট্রফিতে সিনিয়র দলের হয়ে অভিষেক হয়েছে প্রয়াসের। আর অভিষেক টুর্নামেন্টেই ৯ ম্যাচে ১১ উইকেট তুলে নিয়েছেন তিনি ৪.৪৫ ইকোনমি রেটে। অভিষেক ম্যাচে জম্মু ও কাশ্মীরের বিপক্ষে মাত্র ২০ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে দলের অসাধারণ জয় নিশ্চিত করেন।
বিজয় হাজারে ট্রফিতে এই পারফরম্যান্সই প্রয়াসকে আলোচনায় নিয়ে আসে।
আনমোলপ্রিত সিং
৮০ লাখ রূপী
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স
আনমোলপ্রিত সিং তুলনামূলক পরিচিত নাম। ভারতের সাবেক হ্যান্ডবল দলের অধিনায়কের ছেলে এই আনমোলপ্রিত। পাঞ্জাব থেকে উঠে আসা এই মারকুটে ব্যাটসম্যান ভারতীয় যুবদলের সদস্য ছিলেন। ২০১৮ বিশ্বকাপে তিনি ভারতীয় অনুর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন।
ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় প্রথম শ্রেণীর ম্যাচেই অসাধারণ এক সেঞ্চুরি করেন আনমোলপ্রিত। তার টি-টোয়েন্টি রেকর্ড এমন কিছু ভালো নয়। অন্যান্য ফরম্যাটে দারুণ করার সুবাদে উঠে এসেছেন ভারতীয় ‘এ’ দলে। এখন ভারতের অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল ব্যাটসম্যান বলে তাকে বিবেচনা করা হয়। উত্তরাঞ্চলের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে টি-টোয়েন্টি খেলা ক্রিকেটার তিনি। তবে আনমোলকে নিয়ে বিস্ময়ের কারণ হলো, তার টি-টোয়েন্টিতে বলার মতো কোনো পারফরম্যান্স না থাকার পরও তাকে নিয়ে মুম্বাইয়ের আগ্রহ।
হিমন্ত সিং
৬৫ লাখ রূপী
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু
হিমন্ত সিং হলেন দিল্লি থেকে উঠে আসা ২২ বছর বয়সী একজন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। এখন ভারতের অন্যতম সেরা তরুণ প্রতিভা মনে করা হয় হিমন্তকে। সনেট ক্রিকেট ক্লাব থেকে উঠে এসেছেন তিনি। তার একটি বড় পরিচয় হলো, তিনি কোচ তারক সিনহার একজন ছাত্র। এই তারক সিনহা এ অবধি ১২ জন টেস্ট ক্রিকেটার তৈরি করেছেন। দিল্লির সব বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলেই উঠে এসেছেন হিমন্ত। দিল্লির অনুর্ধ্ব-১৬ ও অনুর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। তিনি এখন ভারতের অনুর্ধ্ব-২৩ দলের সদস্য ও দিল্লি সিনিয়র দলের নিয়মিত মুখ।