ইতিহাস সবসময়ই রচনা করে বিজয়ীরা। সুতরাং গ্রিক, রোমান কিংবা মিশরীয়দের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় সুবিধাই বটে। কিন্তু প্রাচীন যুগে শুধু এরাই নয়, বরং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অন্যান্য সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা সাম্রাজ্যগুলোও মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই গড়ে তুলেছে আশ্চর্য সব শহর, নিজেদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানেও এগিয়েছে বহুদূর। এসকল সাম্রাজ্যের দুর্ভাগ্যই বলা যায় যে এদের অনেককেই শত্রুকে গুড়িয়ে দেওয়া রোমান লিজিয়ন কিংবা গ্রিক হোপলাইট বাহিনীর সামনে পড়তে হয়েছে, আবার অনেককেই মুখোমুখি হতে হয়েছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের। আবার অনেকের সভ্যতার পতনটাও রহস্যময়, যেভাবে একদিন উদিত হয়েছিল ঠিক সেভাবেই অস্তমিত হয়েছে। আর এসব কারণেই তাদেরকে হারিয়ে যেতে হয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এখানে তুলে ধরা হলো এমন ৭টি সভ্যতা সম্পর্কে যারা হয়তো অন্যান্যদের তুলনায় মানবসভ্যতাকে খুব একটা এগিয়ে নিতে সাহায্য করেনি। কিন্তু বাণিজ্য, স্থাপত্যকলা আর যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাসে তাদের অবদান কম নয়।
খেমার সাম্রাজ্য
বর্তমান ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস আর থাইল্যান্ডের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় সভ্যতাগুলোর একটি। পানিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বেশিরভাগ সভ্যতা, আর এই পানিকে কাজে লাগিয়েই সবচেয়ে দ্রুত নিজেদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে ৮০০ থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত উন্নতির শিখরে থাকা এই খেমার সাম্রাজ্য। মেকং নদীর কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা রাজধানী অ্যাংকরকে বলা যায় প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিশাল শহর, যা দখল করে রেখেছিল ১,০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা আর আশ্রয় দিয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে।
শহরের অসাধারণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সাহায্যে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে গিয়েছিলো। পানিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেই শহরের পানির ব্যবস্থা ছিল স্বয়ংক্রিয়, যে কারণে ইতিহাসবিদরা একে উপাধি দিয়েছেন হাইড্রলিক শহর নামে। শক্তিশালী অর্থনীতির জোরে খেমার সাম্রাজ্য কম্বোডিয়া ছাড়িয়ে প্রবেশ করলো লাওস, থাইল্যান্ড আর ভিয়েতনামে, সংস্পর্শে আসলো পশ্চিমের সুতখোনিয়া সাম্রাজ্য আর পূর্বে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী শ্যামের। খেমারদের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় জয়বর্মন শ্যামদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন, দখল করে নিলেন বেশ বড় এলাকা। বিশাল বড় সাম্রাজ্যকে ভাগ করা হলো ২০টি প্রদেশে, চীনের সাথে বাণিজ্য-ব্যবসা তুঙ্গে উঠলো। কাঠ, আইভরি, মশলা, মোম, সোনা, রূপা আর সিল্ক রপ্তানির অর্থের ভারে অ্যাংকর ডুবে যেতে থাকলো। তবে এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনি, কিছুদিনের মধ্যেই খেমারদের পতন ঘটল। কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় তিনটি বিষয়কে। প্রথমত, ক্রমবর্ধমান বৌদ্ধধর্মের সংস্পর্শে এসে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছিল। দ্বিতীয়ত, অ্যাংকরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও ক্রমশ কমে আসছিল। আর শেষটি হলো, তাদের ক্রমেই বেড়ে চলা বিশাল সাম্রাজ্য সহজেই অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল।
টিওয়ানাকু
পেরুর পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে নিজেদের কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে রেখেছে ইনকারা, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৫৩২ সালের স্প্যানিশ আক্রমণ পর্যন্ত নিজেদের গৌরব বজায় রেখেছিল তারা। কিন্তু তার আগেও চিলি, পেরু আর বলিভিয়ার মাটিতে আরো একটি সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, নাম টিওয়ানাকু। টিওয়ানাকুদের শহরগুলো এতটাই সুদৃশ্যভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল যে, ইনকারা তা আবিষ্কার করার পর মনে করেছিলো নিশ্চয় দেবতারা এসব শহর নির্মাণ করে গিয়েছে। টিওয়ানাকুদের তৈরি সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে কালাশসায়ার মন্দির আর আকাপানার পিরামিড, যেটি একইসাথে মন্দির আর আকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো। শুধু মাটির উপরের সুবিশাল স্থাপনাই নয়, টিওয়ানাকুর শহরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, এমনকি চক্রাকারে বাঁধানো রাস্তাও ছিল!
দশ হাজারেরও বেশি জনগণ রাজধানীতে (একেও টিওয়ানাকু বলা হয়) বসবাস করতো, যাকে ধরা হয় পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন শহর হিসেবে। টিটিকাকা হ্রদের পানির সম্ভারে আন্দিজের পাদদেশ হয়ে উঠেছিলো উর্বর, আর সেটাই কাজে লাগিয়ে দক্ষ কৃষকজাতি হিসেবে পরিণত হয়েছিল টিওয়ানাকুরা। শুধু রাজধানীতেই ৫০ হাজারেরও বেশি কৃষিজমি ছিল, যা পুরো জাতিকেই পেটপুরে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে পরিণত হওয়া টিওয়ানাকুরা পরের শতাব্দীতেই মুখ থুবড়ে পড়ে।
হঠাৎ করেই এই সভ্যতার পতন কেন হলো তা আজও একটি রহস্য। তবে অনেকেই মনে করেন, একই জমির অত্যধিক ব্যবহারের ফলে জমি ক্রমেই অনুর্বর হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ করে জলবায়ুর পরিবর্তন ডেকে এনেছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, না খেয়ে বিলীন হতে হয়েছিলো সমগ্র জাতিকে। কোনো লেখার ব্যবস্থা না থাকা আর স্প্যানিশদের মুখোমুখি না হওয়া এই সভ্যতা আসলেই হারিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
এট্রুরিয়া
এট্রুসকানদের গল্পটা শুরু হয়েছিল লৌহ-পরবর্তী যুগে, ইতালিতে। তৎকালীন সময়ে টুসকানি নামে পরিচিত ঐ এলাকা তখন খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ, সাথে রয়েছে প্রচুর গাছপালা আর উর্বর জমি। একটি শক্তিশালী সভ্যতা গড়ে তোলার জন্য যা যথেষ্ট ছিল। খ্রিস্টপূর্ব নবম আর অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যাত্রা শুরু হয় প্রাচীন এট্রুসকান সভ্যতার, আর তা শিখরে পৌঁছায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে, যখন ১২টি নগররাষ্ট্র মিলে গঠন করে এট্রুসকান লীগ, অনেকটা প্রাচীন গ্রিকদের মতো।
খনি থেকে উত্তোলিত লোহা আর তামা গ্রিক আর কার্থেজে রপ্তানি করে বেশ ভালোই কামাচ্ছিলো তারা। এট্রুসকানরাই পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর একটি, যেখানে রাষ্ট্রের প্রধান কোনো রাজা কিংবা বাদশাহ ছিলেন না, বরং ছিলেন একদল অভিজাত বিচক্ষণ ব্যক্তি। রোমানরা তাদের স্থাপত্যকলা গ্রিকদের কাছ থেকে যতটা আয়ত্ত করেছিলো, এট্রুসকানদের কাছ থেকেও তার চেয়ে কম করেনি। রাস্তা আর সেতুর সাথে উন্নত শহর পরিকল্পনা এট্রুসকানদের কাছ থেকেই পেয়েছিল রোমানরা। এমনকি ল্যাটিন অক্ষরও এট্রুসকান হাত ধরে রোমানদের কাছে এসেছে।
অ্যাড্রিয়াটিক আর এজিয়ান সাগরে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়া এট্রুসকানরা কর্সিকা, সার্ডিনিয়া, এমনকি স্পেনেও নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। রোমানরা, যারা এট্রুসকানদের কাছে অনেকটাই ঋণী, তাদের জন্যই মূলত এট্রুরিয়ার পতন নেমে আসে। শক্তিশালী রোমান বাহিনীর কাছে এট্রুসকান লীগের পতন ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দে, আর রোমান রিপাবলিকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় এট্রুরিয়ার নাম।
হিট্টাইট সাম্রাজ্য
নিজেদের সেরা সময়ে হিট্টাইটরা প্রাচীন মিশরীয়দের জন্য বেশ বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাদেশের যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর তাই ফারাও দ্বিতীয় রামসেসকে বাধ্য হয়েই হিট্টাইটদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে হয়েছিল। যদিও হিট্টাইটদের পতনটাও হয়েছিল খুব দ্রুত, অ্যাসিরীয়দের উত্থানের সাথে সাথে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যায় তাদের নাম। মূলত রথ তৈরির দক্ষতার জন্যই হিট্টাইটরা বেশ খ্যাতি লাভ করেছিল।
বর্তমান তুরস্ক, সিরিয়া আর ইরাকের একটা বড় অংশ নিয়ে হিট্টাইটরা তাদের সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। অন্যান্য অনেক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মতোই হিট্টাইটদের সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়েছিল বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রে, যেগুলোর নিজেদের মধ্যে কোনোরকম রাজনৈতিক একতাই ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ১১৬০ অব্দের দিকে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েই হিট্টাইটদের পতন শুরু হয়, নিজেদের মধ্যেই রাজমুকুটের দখল নিয়েই মারামারি শুরু হয়। যোগ্য নেতার অভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিট্টাইটদের নাম মুছে যায় শেষমেশ খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, যুদ্ধবাজ অ্যাসিরীয়রা দখল করে নেয় তাদের রাজত্ব।
অ্যাসিরিয়া
মেসোপটেমিয়া জুড়ে (বর্তমান ইরাক, তুরস্ক এবং সিরিয়া) ছিল অ্যাসিরীয়দের রাজত্ব, ভাগাভাগি করে নিয়েছিল ব্যাবিলনীয়দের সাথে। ব্যাবিলনিয়াতে যখন রাজ্য চালাত পুরোহিতরা, অ্যাসিরিয়া তখন চলতো রাজা আর সেনাপতিদের মাধ্যমে। ফলে অ্যাসিরীয়রা কিছুদিনের মধ্যেই বেশ বড় একটা সামরিক পরাশক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় এবং নিজেদের সাম্রাজ্যও বড় করে তোলে। নিনেভেহ আর আরবেলের উর্বর জমির মধ্যে অ্যাসিরীয়দের জনসংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছিল, বিশেষ করে আরবেল, আসুর আর নিমরুদ শহর লোকজনের পদভারে ছিল মুখরিত। আক্কাদীয় ভাষাভাষী অ্যাসিরীয়রা পৃথিবীর প্রথম সভ্যতাগুলোর একটি যারা নিজেদের গল্পগুলো পার্চমেন্ট, প্যাপিরাস আর পাথরে খোদাই করে লিখে গিয়েছে।
জন্তু-জানোয়ার সংরক্ষণেও অ্যাসিরীয়দের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল, অ্যাসিরীয় রাজা টিগলাথ-পিলেজারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেশ কিছু চিড়িয়াখানাও গড়ে উঠেছিল অ্যাসিরিয়ায়। ব্রোঞ্জ আর লোহার অস্ত্রের সাহায্যে সহজেই হিট্টাইটদেরকে নিহরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করে অ্যাসিরীয়রা। অ্যাসিরীয়দের নিয়ম ছিল দখল করা জায়গা থেকে স্থানীয়দের বিতাড়িত করা, যেন পরে কোনো বিদ্রোহের সূচনা না হয়। শুধুমাত্র বিজ্ঞানী-পণ্ডিত কিংবা যারা অ্যাসিরীয়দের কাজে লাগতে পারে এরকম ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সবাইকেই অন্যত্র পাঠিয়ে দিত অ্যাসিরীয়রা। কম করে হলেও ৪ কোটি লোককে তাই নিজেদের বাসভূমি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে হয়েছে অ্যাসিরীয়দের এই নীতির কারণে। অ্যাসিরীয়দের অন্যতম অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হলো শিক্ষাব্যবস্থা, ৩৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘স্কুল অব নিসিবিস’-কে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরেন অনেক ইতিহাসবিদ।
১,৮০০ বছর ধরে মেসোপটেমিয়া শাসন করা অ্যাসিরীয়রা গড়ে তুলেছিল বিশাল সব নগরী, শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নগরীর চারপাশে পুরু দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল, বিশেষ করে রাজধানীর চারপাশের দেয়ালই ছিল ১৫ মিটার পুরু! অ্যাসিরীয়দের পতন কীভাবে ঘটেছিল তা এখনো একটা রহস্য। তবে ধারণা করা হয়, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে চলতে থাকা যুদ্ধ তাদের ক্রমেই দুর্বল করে তুলছিলো। অ্যাসিরিয়া সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য তা দখল করে নেয়।
মাইনোয়া
হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাগুলোর মধ্যে মাইনোয়ানরাই সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় ছিল। এজিয়ান সাগরের উপরের ভেসে থাকা ক্রিট দ্বীপের উপর নিরুপদ্রবেই কেটে যাচ্ছিল মাইনোয়ানদের দিন। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলো থেকে মাইনোয়ানরা ক্রিটে আস্তানা গাড়ে, আর ইউরোপের মাটিতে সূচনা হয় প্রথম সভ্যতার।
ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে ভূমধ্যসাগর আর এজিয়ান উপসাগর চষে বেড়ানো মাইনোয়ানরা অন্যান্য অনেক সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছে, বিশেষ করে মিশরের কথা না বললেই নয়। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া মাইনোয়ানদের তৈরি জিনিসপত্র থেকেই বোঝা যায় মাইনোয়ানদের সাথে হেলাডিকদের গভীর সম্পর্ক ছিল। এছাড়াও মাইসিনের বিভিন্ন সমাধি থেকে মাইনোয়ান জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আনাতোলিয়া, মিশর এমনকি সুদূর মেসোপটেমিয়াতেও মাইনোয়ানদের তৈজসপত্রের প্রমাণ মেলে। মাইনোয়ানরা যে তৎকালীন সময়ে কিংবা তার পরের অনেক সময় পর্যন্ত শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল তা বলাই বাহুল্য।
মাইনোয়ানদের স্থাপত্যকলার নিদর্শনগুলো দেখা যায় রাজাদের জন্য তৈরি বিশালাকার প্রাসাদগুলোতে। এছাড়া ‘থোলোস’ নামে পরিচিত সমাধিগুলোতেও মাইনোয়ানরা তাদের চিত্রকর্ম সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতো। কুমোর শিল্পতেও মাইনোয়ানদের জুড়ি মেলা ভার। বহিরাগত শত্রুর কোনো রকম উপদ্রব না থাকায় ক্রিটের শহরগুলোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। প্রাসাদগুলোও ছিল সাধারণ, অন্যান্য সভ্যতার মত দুর্গের আকার দেওয়া হয়নি। তবে এমনিতে প্রাসাদের পাথরের দেওয়াল আর থামগুলো বেশ শক্তিশালী ছিল। প্রাসাদের নিচে গড়ে ওঠা নসোস শহরের বাড়িগুলোও ছিল মজবুত, ইট-পাথরের মিশ্রণে তৈরি দুই-তিনতলা দালানে বাস করত মাইনোয়ানরা। এজিয়ান উপসাগরে ভূকম্পন খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না, মাইনোয়ানরাও ভূকম্পনকে স্বাভাবিকভাবে নিত। কিন্তু ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে ভয়াবহ এক ভূকম্পনে নসোস তো ধূলিসাৎ হয়ই, মাইনোসের প্রাসাদও অনেকাংশে ভেঙে পড়ে।
ভূমিকম্পের পর মাইনোয়ানরা আবার নতুন করে শহর নির্মাণ করার কাজে হাত দেয়, মাইনোসের জন্য তৈরি করা হয় নতুন চোখধাঁধানো প্রাসাদ। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭ থেকে ১৬ শতক ছিল মাইনোয়ানদের সোনালী যুগ, এ সময় মাইনোয়ান সভ্যতা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। পুরো ভূমধ্যসাগরে মাইনোয়ানরা ইতিহাসে সর্বপ্রথম ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি গড়ে তোলে। নৌ-বহরের আকার আরও বড় হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে প্রাণচঞ্চল এবং ব্যাপক পরিসরের। চিত্রকলা এবং ভাষারও যুগপৎ পরিবর্তন ঘটে। ১৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হঠাৎ করেই ক্রিটের শহরগুলো আবারও ধ্বংস হয়ে যায়। ঠিক কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় থেরার অগ্ন্যুৎপাত অথবা এজিয়ান সাগরের সুনামিই এর জন্যে দায়ী।
ফিনিশিয়া
স্থল পরিবহণ প্রচলন হওয়ার আগে পানিতে চলাফেরা করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো প্রাচীন যুগের মানুষেরা, হোক সেটা বাণিজ্য কিংবা সামরিক অভিযান। আর ফিনিশীয়রাই সর্বপ্রথম এ কাজে দক্ষতা লাভ করে। লেবানন আর ইজরায়েল জুড়ে থাকা ফিনিশীয়রা মেসোপটেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছিলো পরবর্তী কয়েক হাজার বছর, শেষমেশ এর পতন ঘটে মেসিডন সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের হাতে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে যাত্রা করা ফিনিশীয়রা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতাগুলোর একটি।
সিডন আর টায়ার সহ বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত শহর গড়ে তোলে ফিনিশীয়রা, ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে তৈরি করা এই শহরগুলোই ছিল ফিনিশীয়দের বাণিজ্য কেন্দ্র। আলাদা আলাদা শহর হলেও ফিনিশীয়দের মধ্যে কোনোরকম দ্বন্দ্ব বা বিদ্বেষ ছিল না, এর কারণ হয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের নিজেদের স্বার্থ। বাণিজ্যের উপর নির্ভর করেই চলতে হতো তাদেরকে, তাই নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ-বিগ্রহ তাদের বাণিজ্যের উপর প্রভাব ফেলতো। ভূমধ্যসাগর কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিশাল বাণিজ্য-ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতো ফিনিশীয়রাই। গ্রিস, মিশর কিংবা মাইনোয়া-মাইসিনিয়া, এমনকি বর্তমান সময়ের সুদূর স্পেন-পর্তুগালকেও বাণিজ্যের জন্য ফিনিশীয়দের দ্বারস্থ হতে হতো। বিখ্যাত কার্থেজ শহর, রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু, তৈরি করেছিল এই ফিনিশীয়রাই।
ফিনিশিয়াকে হিব্রু ভাষায় বলা হয় ‘কেনান’, ‘ফিনিশিয়া’ নামটি আসে গ্রিকদের কাছ থেকে। ফিনিশিয়ায় তৎকালীন সময়ে প্রচুর পরিমাণে রক্তবেগুনি রঙ ব্যবহার করা হতো, তা দেখেই গ্রিকরা এর নাম রাখে ‘ফোইনিকস’, যার অর্থ রক্তবেগুনি। পরবর্তীতে গ্রিস আর রোমেও এই রঙ অভিজাতদের রঙ হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। আলেকজান্ডারের আগে পারসিকরা ফিনিশিয়া দখল করে নিয়েছিল, তবে আলেকজান্ডারের বাহিনীর সামনে ফিনিশিয়া ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। মেসিডোনিয়ার পতনের পর ফিনিশিয়া রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় আর হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি আয়ত্ত করে।
ফিচার ইমেজ: Heraklion Crete