চিনের প্রখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াসের একটি উক্তি দিয়েই শুরু করা যাক,
“ভ্রমণ যেখানেই হোক না কেন, সেটিকে সবসময়ই হৃদয়ঙ্গম করা আবশ্যক।”
ভ্রমণ কারো কাছে নেশা, কারো কাছে পেশা আবার কেউ নিছক শখের বশে অথবা নিতান্তই বন্ধুদের অনুরোধ রক্ষার্থে বেরিয়ে পড়েন ভ্রমণে। কেউ ভালবাসেন পাহাড়ের মৌনতা, কারও পছন্দ সমুদ্রের গর্জন, আবার কাউকে হাতছানি দিয়ে ডাকে তমসাচ্ছন্ন জঙ্গলের পথ। শহরের যান্ত্রিক জীবন, প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি কিংবা হতাশ সময়ের দমবন্ধ করা অনুভূতি; এসব কিছুকে পেছনে ফেলে প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে চান অনেকে। চেনা পরিবেশের একঘেয়ে মুহূর্তগুলোকে ভুলে অচেনা সৌন্দর্যের আশায় ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার জন্য মানসিক শক্তির পাশাপাশি চাই শারীরিক সক্ষমতা। কারণ অচেনা আবহে মন প্রফুল্ল হলেও যাত্রাপথের ক্লান্তি, দুর্গম পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া, খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম- এসব কিছুর ধকল কিন্তু শরীর মহাশয়কেই সইতে হয়।
ভ্রমণকে উপভোগ্য করে তোলার জন্য দরকার শারীরিক সক্ষমতা। তাহলে অবধারিতভাবে প্রশ্ন জাগে যে, যারা বিশেষভাবে সক্ষম তাদের ভ্রমণের ধরনটা কেমন হবে? প্রিয় পাঠক, ভ্রমণের সময় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের কী কী করণীয় সেসব নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
যেসব বিষয় মাথায় রাখলে ভ্রমণ হতে পারে আরো উপভোগ্য
বিমান সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে আগে থেকেই অবহিত করে রাখা
আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রী যে এয়ারলাইনে ভ্রমণ করছেন তার কর্তৃপক্ষকে টিকেট কাটার সময় অথবা ভ্রমণের বেশ কিছুদিন পূর্বে নিজের সমস্যার কথা জানিয়ে রাখা হতে পারে চমৎকার একটি পদক্ষেপ। অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের নিজস্ব কর্মীদের নিয়োজিত করেন যাত্রীদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিদের যাত্রাকালীন যেকোনো সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিমান সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো গাইড সরবরাহ করে থাকে। এক্ষেত্রে গাইডদের দায়িত্ব হলো, যাত্রীকে এয়ারপোর্টের বাইরে থেকে বিমানে ওঠা পর্যন্ত সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া।
দৃষ্টিশক্তিহীন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এয়ারলাইনগুলো কখনও কখনও গাইড হিসেবে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর নিয়োগ করে থাকে। তবে এই সুবিধা পাওয়ার জন্য এয়ারলাইনকে ফ্লাইটের কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকেই নিজের চাহিদার কথা জানিয়ে রাখতে হয়। সাধারণত এই ধরনের সুবিধাগুলো বিনামূল্যেই সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তবে একজন যাত্রী তার চাহিদা মোতাবেক সুবিধাটি পাবেন কিনা সেটি নির্ভর করছে এয়ারলাইনের নিজস্ব কর্মীর উপস্থিতি এবং যাত্রীর সমস্যার ধরনের উপর।
নিজের সমস্যা সম্পর্কে সুস্পষ্ট এবং বিশদ বর্ণনা প্রদান
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উচিত ভ্রমণের সময় সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানকে তার নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো। একটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখবেন, সকল প্রতিষ্ঠান বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তিকে ঠিক কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন সেটা না-ও জানতে পারে।
তাই বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত হলো নিজের সমস্যা সম্পর্কে ট্রাভেল এজেন্সিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবহিত করা। একজন ব্যক্তিকে বিশেষ অবস্থায় সেবা দেওয়া শুধু তখনই সম্ভব যখন প্রতিষ্ঠান তার শারীরিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবে।
চিকিৎসককে ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে রাখা
বিশেষভাবে সক্ষম একজন ব্যক্তির ভ্রমণে বেরোবার আগে অবশ্যই নিজস্ব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দীর্ঘ যাত্রাপথ, প্রতিকূল পরিস্থিতি, পরিবর্তিত জীবনযাত্রায় একজন ব্যক্তি কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন তা চিকিৎসকই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন।
ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে তিনি রোগীর ওষুধের ধরন, পরিমাণ অথবা বিশেষ পরিস্থিতিতে করণীয়; এসব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একজন চিকিৎসক তার অধীনে চিকিৎসাধীন রোগী এবং তার ভ্রমণ সম্পর্কে সবকিছু জেনে এই ভ্রমণের সমীচীনতা সম্পর্কে জানাতে পারেন।
অভ্যস্ত জীবনধারা হোক পাথেয়
ভ্রমণপথের ক্লান্তি, সঙ্গীদের সাথে রাত জেগে গল্প, বিরতিহীন ছুটে চলা; এরকম আরও অনেক কিছুই একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন ঘটাতে পারে। কিন্তু একজন বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তির কখনোই তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে গেলে চলবে না। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে মনে করেন, একজন ব্যক্তি যে ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত তার সেটিই অনুসরণ করা উচিত এমনকি ভ্রমণের সময়ও যাতে তার ব্যত্যয় না ঘটে।
ধরা যাক, একজন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তি সবচেয়ে কর্মক্ষম থাকেন সকালে। তাহলে দিনের শুরুতেই দর্শনীয় স্থানগুলো ঘোরা হতে পারে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। আবার এরকম অনেকে আছেন যারা দিনের বেলায় হালকা ঘুমে অভ্যস্ত নন। তাদের জন্য ভ্রমণে গিয়ে আপাত ক্লান্তি দূর করার জন্য হালকা ঘুম কখনোই সুফল বয়ে আনবে না।
চিকিৎসকের সম্মতিপত্র বহন করা
ভ্রমণের আগে একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির অবশ্যই তার চিকিৎসকের অনুমতিপত্র নিয়ে নেওয়া উচিত। অনুমতিপত্রে চিকিৎসক তার রোগীর সমস্যা, সুনির্দিষ্ট জটিলতা, ওষুধ, বিশেষ চাহিদা, বর্তমান শারীরিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে দিবেন। এর ফলে ভ্রমণে গিয়ে কোনো চিকিৎসককে দেখানোর দরকার হলে এই সম্মতিপত্রটি তাকে রোগীর অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানে সক্ষম হবে। এছাড়াও যোগাযোগের উদ্দেশ্যে চিকিৎসকের নাম্বার নেওয়ার পাশাপাশি নিজের এমন একটি নাম্বারও তাকে দিয়ে আসা উচিত যেটি সবসময় সচল থাকবে।
প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সাথে নেওয়া
হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে আবশ্যিক একটি কাজ হলো ভ্রমণের সময় খুচরা যন্ত্রাংশ সাথে বহন করা। এতে যেকোনো পরিস্থিতিতে হুইল চেয়ার যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেক্ষেত্রে অল্প সময়ের মাঝেই সারিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ফলে হুইল চেয়ারের অভাবে ভ্রমণের আনন্দ আর মাটি হবে না।
প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য দরকারি জিনিসপত্র সাথে বহন করা উচিত। একটি ইমার্জেন্সি মেডিকেল কিটে জীবাণুমুক্ত পরিষ্কার কাপড়, ব্যান্ডেজ, গজ ইত্যাদি নিতে পারেন। এছাড়াও চিকিৎসকের দেওয়া প্রেসক্রিপশনের একটি অতিরিক্ত কপি এবং দরকারি ওষুধগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে নিয়ে নেওয়া উচিত।
বিচক্ষণতার পরিচয় চাই হোটেল নির্বাচনে
ভ্রমণে গিয়ে সকলের একটি আরামদায়ক থাকার জায়গার চাহিদা থাকে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এই ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে কারণ সমগ্র পৃথিবী থেকে এরকম অসংখ্য ভ্রমণে মানুষ আসেন এবং তাদের প্রত্যেকেরই চাই একটি সুন্দর আবাসন ব্যবস্থা।
তাই নিজের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্য ভ্রমণের বেশ আগেই নিজের পছন্দসই হোটেলে রুম রিজার্ভ করে রাখা উচিত। তবে হোটেল নির্বাচনের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত যেন হোটেলটি পুরো এলাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হয় এবং দর্শনীয় স্থানগুলো যাতে সেখান থেকে সহজেই যাতায়াত যায়।
আস্থা রাখুন নিজের রসিকতাবোধের উপর
নিজের কৌতুক বা রসবোধের উপর বিশ্বাস রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভ্রমণ শেষে কেউ যদি এসে বলেন, তাদের ভ্রমণ ছিল একেবারে আদর্শ এক ভ্রমণ কিংবা কোনো সমস্যা ছাড়াই তারা পুরো সময়টা উপভোগ করেছে তাহলে ধরে নিতে হবে তারা মিথ্যা বলছেন। কারণ ভ্রমণে সমস্যা হবেই আর পরিব্রাজক মাত্রই যেকোনো ঝুঁকির প্রতি থাকা চাই ইতিবাচক মনোভাব। কারো বিরূপ মন্তব্যের প্রতি রুষ্ট না হয়ে বরং হেসে উড়িয়ে দেওয়াটা বেশি কাজে দেয়।
কখনোই নিজের শারীরিক অবস্থা, মানসিক কষ্ট কিংবা যেকোনো অনুভূতি প্রিয়জনের কাছে লুকাবেন না। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি হিসেবে সবসময় চ্যালেঞ্জিং দৃষ্টিভঙ্গি রাখা দরকার, কারণ সারা পৃথিবীর কাছে নিজেকে সামর্থ্যবান হিসেবে প্রমাণ করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ। তবে যদি কেউ হতাশ হয়ে পড়েন, তাহলে আপন মানুষদের সাথে নিজের অনুভূতিটা শেয়ার করবেন।
ভ্রমণ হোক সকলের জন্য উন্মুক্ত
মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি হলো অজানাকে জানা। একজন মানুষের বিশেষ শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে জন্মানো তার ভ্রমণের ক্ষেত্রে কখনোই অন্তরায় হতে পারে না। একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরও শতভাগ অধিকার রয়েছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে দেখার। তবে তাদের এই ইচ্ছাপূরণ হতে পারে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে। ভ্রমণে গিয়ে যদি কখনও খেয়াল করেন, কোনো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তির অসুবিধা হচ্ছে, তাহলে আপনার সাহায্যের হাতটি বাড়িয়ে দিতে ভুলবেন না যেন।
ফিচার ইমেজ: smartertravel.com