সিরিয়ার মাটিতে ইরান-ইসরায়েল ছায়াযুদ্ধ যেন তার খোলস ছেড়ে প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ নিতে চাইছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানী স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে ইসরায়েল একযোগে ৭০টি মিসাইল হামলা চালিয়েছে, যার ফলে নিহত হয়েছে ৩ সিরিয়ান সৈন্যসহ অন্তত ২৩ জন। ১৯৭৩ সালের চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সিরিয়ার ভূমিতে চালানো এটি ছিল ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় আক্রমণ। কিন্তু কেন এই আক্রমণ? আর কোন দিকে এগোচ্ছে ইরান-ইসরায়েলের এই সংকট? তা নিয়েই আমাদের আজকের বিশ্লেষণ।
কেন ইসরায়েল সিরিয়াতে হামলা করছে?
Israel says it hit Iranian military targets in Syria, accusing Iran of firing missiles towards its forces in the occupied Golan Heights https://t.co/9OfRLMqPoz pic.twitter.com/SABVJBH14H
— Al Jazeera English (@AJEnglish) May 10, 2018
২০১১ সালে সিরিয়াতে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন বিদ্রোহীদেরকে প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্র দেওয়া শুরু করলেও প্রতিবেশী দেশ ইসরায়েল নিজেকে এই যুদ্ধ থেকে মোটামুটি দূরে রেখেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিরিয়াতে ইরানের অবস্থান শক্তিশালী হতে শুরু করলে ইসরায়েল সেটিকে নিজের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। ইরান বাশার আল-আসাদ সরকারের অন্যতম প্রধান মিত্র। সিরিয়াতে তাদের অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি ছাড়াও তাদের কুদস ফোর্সের (বহির্বিশ্বে সক্রিয় ইরানী রেভোলিউশনারী গার্ডের সামরিক শাখা) নেতৃত্বাধীন অন্তত ৭০,০০০ মিলিশিয়া যুদ্ধরত আছে।
ইসরায়েল সিরিয়াকে সরাসরি শত্রু হিসেবে বিবেচনা না করলেও ইরান এবং হেজবুল্লাহকে সব সময়ই তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। সীমান্তের ওপারেই ইরান এবং হেজবুল্লাহর ক্রমাগত শক্তিশালী অবস্থান ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগজনক। তাই প্রাথমিকভাবে সরাসরি দায় স্বীকার না করলেও পরবর্তীতে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের একজন জেনারেল স্বীকার করেন, গত পাঁচ বছরে ইসরায়েল সিরিয়ার মাটিতে হেজবুল্লাহর অস্ত্রভাণ্ডার লক্ষ্য করে শতাধিক মিসাইল হামলা পরিচালনা করেছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়াতে হেজবুল্লাহ এবং ইরানের ঘাঁটির উপর লক্ষ্য করে ইসরায়েলের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়। এ বছর ১০ ফেব্রুয়ারি ইরানের একটি ড্রোন ইসরায়েলের আকাশে প্রবেশ করেছে দাবি করে ইসরায়েল সিরিয়াতে প্রথমবারের মতো সরাসরি ইরানী ঘাঁটিগুলোর উপর আক্রমণ করে। পরবর্তীতে এপ্রিলের ৯ এবং ২৯ তারিখে সিরিয়ার দুইটি ঘাঁটিতে ইসরায়েলের আক্রমণে যথাক্রমে ১৪ জন এবং ২৬ জন নিহত হয়। এর মধ্যে প্রথমটিতে ইরানী সেনা কর্মকর্তা ছিল সাত জন, আর দ্বিতীয়টিতে ছিল ১৮ জন। ইরান যদিও সব সময়ই এই হামলাগুলোর প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়ে এসেছে, কিন্তু বাস্তবে তারা এখনও ইসরায়েলের উপর একবারও আক্রমণ করেনি।
বৃহস্পতিবারের হামলার কারণ কী?
Missile fire in Damascus. Shadow war between Iran and Israel not so shadowy anymore.. pic.twitter.com/CW4Wt4H40Z
— ian bremmer (@ianbremmer) May 10, 2018
সাম্প্রতিক সময়ে ইরান পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করা নিয়ে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। ঐ চুক্তি বাতিলের অন্যতম প্রধান সমর্থক এবং প্ররোচক ছিল ইসরায়েল। ইসরায়েল আশঙ্কা প্রকাশ করছিল, চুক্তি বাতিল হলে হয়তো ইরান তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। এ আশঙ্কা থেকে তারা সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করেছিল।
চুক্তি বাতিলের আগেই মে মাসের ৬ তারিখে সিরিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে ইসরায়েলের আক্রমণে ৮ জন সিরিয়ান সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়। ৮ তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েল আবারও সিরিয়াতে আক্রমণ করে। দুইটি হামলাই সংঘটিত হয়েছিল সে ঘাঁটিগুলোতে, যেখানে ইরানের সেনা কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল।
Prime Minister Netanyahu: “Whoever hurts us — we will hurt them
sevenfold.” #Israel #Iran pic.twitter.com/OoPhRa8rgP— Hananya Naftali (@HananyaNaftali) May 10, 2018
গতকাল ১০ মে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ইসরায়েল দাবি করে, সিরিয়া থেকে ইসরায়েলের দখলকৃত গোলান উপত্যকা লক্ষ্য করে ২০টি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবেই ইসরায়েল এ হামলার জন্য ইরানের কুদস ফোর্সকে দায়ী করে এবং পাল্টা সিরিয়াতে ইরানী ঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। ইরান পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও লেবাননের আল-মানার টিভি থেকে ইরানের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্টের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, এ হামলার সাথে ইরানের কোনো সম্পর্ক নাই।
লন্ডন ভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস সিরিয়া থেকে গোলান উপত্যকা লক্ষ্য করে মিসাইল হামলার কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু তাদের দাবি অনুযায়ী, ইসরায়েল প্রথমে সিরিয়ার বাথ শহরে হামলা করার পরেই সিরিয়া থেকে পাল্টা হামলা করা হয়েছিল। এএফপির সাথে সাক্ষাৎকারে সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানী নেতৃত্বাধীন বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও দাবি করেছেন, ইসরায়েল আগে হামলা করেছিল।
হামলার ফলাফল কী ছিল?
গোলান উপত্যকা লক্ষ্য করে যে ২০টি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তাতে ইসরায়েলিদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, তারা চারটি মিসাইল ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে, আর বাকি মিসাইলগুলো সীমান্তের সিরিয়ার অংশেই পড়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাভিগদর লিবারম্যানের দাবি অনুযায়ী, ইসরায়েল সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানের প্রায় সবগুলো স্থাপনার উপর আক্রমণ করেছে। লিবারম্যান ইরানের প্রতি হুমকি দিয়ে বলেন, যদি ইসরায়েলে বৃষ্টি পড়ে, তাহলে ইরানে বর্ষণ ঘটবে।
This @futuretvnews update says it all about last night’s exchange between the IRGC and the IDF: “Israel destroyed in four hours what Iran took years to build in Syria.” pic.twitter.com/ZVoASdy2S2
— David Daoud (@DavidADaoud) May 10, 2018
ইসরায়েলের নিক্ষেপ করা ৭০টি মিসাইলের সবগুলো অবশ্য লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। রাশিয়ার দাবি অনুযায়ী, সিরিয়া এর অর্ধেকেরও বেশি মিসাইলকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে। সিরিয়ার সরকারের দাবি অনুযায়ী, এ হামলায় তাদের তিনজন সৈন্য নিহত হয়েছে। তবে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের বক্তব্য অনুযায়ী, মোট নিহতের সংখ্যা ২৩, যাদের মধ্যে সৈন্য ৫ জন এবং অন্যান্য মিলিশিয়া ১৮ জন।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ কি আসন্ন?
VIDEO: Tensions between Israel and Iran mount after Iranian forces allegedly fired rockets at the Israeli army in the occupied Golan Heights, prompting Israel to retaliate with missile strikes on Syria pic.twitter.com/d2FuIOndoo
— AFP news agency (@AFP) May 10, 2018
দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধের ধাপ পেরিয়ে ইরান-ইসরায়েল সংকট নিঃসন্দেহে নতুন একটি ধাপে এসে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এটি কি এখানেই থেমে থাকবে, নাকি দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্রিত মত আছে। যদিও ইসরায়েলকে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তার প্রধান কারণ ইরানকে একটি কঠোর বার্তা দেওয়া, যেন তারা সিরিয়াতে তাদের সৈন্য এবং ঘাঁটির সংখ্যা আর বৃদ্ধি না করে। কিন্তু ইরানের সাথে সরাসরি পূর্ণমাত্রার একটি যুদ্ধ হয়তো ইসরায়েল এখনই চাইবে না।
ইরানের সাথে সরাসরি যুদ্ধ বেঁধে গেলে, তা ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক কিছু হবে না। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলকে শুধু ইরান না, একইসাথে হেজবুল্লাহরও মোকাবেলা করতে হবে, যা অতীতে ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে অলাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিবারম্যানের বক্তব্যেও তাদের এই নীতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গতকালের হামলার পর তিনি বলেন, “আমি আশা করি এর মধ্য দিয়ে আমরা একটা অধ্যায় শেষ করেছি এবং সবাই একটি বার্তা পেয়েছে।” তার বক্তব্য থেকে এই ধারণা পাওয়া যায় যে, ইরান যদি সিরিয়াতে পুনরায় তাদের শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা না করে, তাহলে ইসরায়েল হয়তো ইরানের সাথে যুদ্ধের এখানেই ইতি টানবে।
Incredible photo of #Damascus last night taken by a friend from his rooftop.
In his words, “it was an intense night.”#Syria #Israel #Iran pic.twitter.com/vMmvQkOGzt— Salman Shaikh (@Salman_Shaikh1) May 10, 2018
কিন্তু ইরানের জন্য সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া খুবই কঠিন একটি সিদ্ধান্ত হবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রধান মিত্র সিরিয়া। তারা গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ধীরে ধীরে সিরিয়ায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। নিজেদের সৈন্য, মিলিশিয়া বাহিনী, অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করার ব্যাপারে বাশার আল-আসাদকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। ইরান নিজেও ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে সিরিয়ায় তাদের অর্জন হারানোর ঝুঁকি নিতে চাইবে না, কিন্তু আবার সিরিয়াতে তাদের এত বছরের বিনিয়োগ ছেড়ে ঘরে ফিরে যেতেও চাইবে না। ইরান হয়তো আবারও ধীরে ধীরে সিরিয়াতে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করবে।
তবে এই সংকটে ইরান এবং ইসরায়েলই একমাত্র খেলোয়াড় না। শেষপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করতে চাইবে, তার উপরেই অনেকাংশে নির্ভর করবে এ সংকটের ভবিষ্যত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়ভাবে কার্যকর একটি চুক্তি বাতিল করে বেরিয়ে এসেছে, যা বাতিলের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো লাভ নেই, সেই পদক্ষেপ থেকেও সন্দেহ হতে পারে, এই চুক্তি বাতিলের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হয়তো ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে।
The IDF has struck dozens of Iranian military targets in Syria in response to the Iranian rocket attack against Israel. Quds force is behind attack and has played the initial price. IDF remains ready for various scenarios but does not seek to escalate the situation. pic.twitter.com/4rC8gHK2LG
— Jonathan Conricus (@LTCJonathan) May 10, 2018
ইসরায়েল হয়তো নিজে সরাসরি ইরানের সাথে যুদ্ধ শুরু করতে চাইবে না, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে ইরানকে শায়েস্তা করার কোনো সুযোগ হয়তো তারা হাতছাড়া করবে না। সেক্ষেত্রে তাদের অন্যতম প্রধান মিত্র হতে পারে সৌদি আরবসহ আরো কয়েকটি আরব রাষ্ট্র, যারা ইরানকে এ অঞ্চলে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে এবং যাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যেই পারমাণবিক চুক্তি বাতিল ও ইসরায়েলের সিরিয়া আক্রমণকে সমর্থন জানিয়েছে।
Featured Image Source: Reuters