একটা সহজতম প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক। বলুন তো, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রানসংগ্রাহক ব্যাটসম্যানের নাম কী? খুব বেশিই সোজা হয়ে গেলো বোধহয়। ১১ হাজারেরও বেশি রান নিয়ে সে জায়গাতে রীতিমতো পাকাপোক্তভাবে বসে আছেন ‘দ্য গ্রেট’ ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল, আর সহসাই সে জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র নড়াচড়ার সম্ভাবনাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু মাত্র চার বছর আগে এই প্রশ্নটা করলে উত্তরটা বদলে যেত। এমন একটি নাম, যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন বিস্মৃতপ্রায়। কেনই বা মনে রাখবে সবাই? ৬টি মাত্র টেস্ট, ২৫টি ওয়ানডে আর ১৫টি আন্তর্জাতিক টি২০ খেলা একজন ব্যাটসম্যানের নাম মনে রাখার কোনো মানে হয়?
হয় না বলেই বিশ্বক্রিকেটে ব্র্যাড হজ এখন বিস্মৃতপ্রায় একটি নাম। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই ব্যাটসম্যান অবসর নিয়ে ফেলেছেন, সেটাও কম দিন হলো না। সময় যত গড়িয়েছে, টিটোয়েন্টিতে একসময়ের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক নেমে গেছেন তালিকার সাত নম্বরে। গেইল, ম্যাককালাম, পোলার্ড, শোয়েব মালিক, ওয়ার্নার, ডোয়াইন স্মিথরা তাকে ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছেন, রায়না-কোহলিরা ছুঁই ছুঁই করছেন। একসময় তালিকাতে অনেকটা দূরে চলে যাবেন, এতটা দূরে যে কেউ তাকে হয়তো খেয়ালও করবে না। হয়তো একদিন হারিয়ে যাবেন বিস্মৃতির অতলে। এটাই যেন তার ভবিতব্য।
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না! তার সামর্থ্যের অভাব ছিল না বিন্দুমাত্র, টেম্পারামেন্ট নিয়েও সংশয় ছিল না। পারফরম্যান্সও ছিলো নজরকাড়া, যে ছয়টি টেস্ট খেলেছেন তাতেই গড় ৫৫.৮৮। এমন একজন ব্যাটসম্যান কিনা আর টেস্টই খেলতে পারলেন না! এমনকি টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হওয়ার পরও জাতীয় দলে যথেষ্ট সুযোগও পেলেন না! নেহায়েত দুর্ভাগ্য পিছু না নিলে এমনটা যে খুব সচরাচর দেখা মেলে না।
ক্লাইভ রাইস, ডেভিড হাসি, চার্লস কর্টরাইট, রাজিন্দর গোয়েলদের মতো প্রতিভা কোনোদিন টেস্ট ক্রিকেটের স্বাদ পাননি। আবার স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল, রঙ্গনা হেরাথ, সাঈদ আজমলদের জাতীয় দলে প্রতিষ্ঠিত হতেই চলে গেছে অনেকগুলো বছর। ব্র্যাড হজ ঠিক এই দুই শ্রেণীর কোনোটাতেই ঠিক পড়েন না। বরাবরই তিনি সেরাদের একজন বলে স্বীকৃত ছিলেন, টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বিপদজনক ব্যাটসম্যানদের একজন বলে তার সুনাম ছিল, তবু কেন যেন ভাগ্যচক্রে বাধা পেয়েছেন বারবার। আর এখানেই সবচেয়ে বড় হতাশা; যে মানুষটা হতে পারতেন দেশের সবচেয়ে ‘ক্ল্যাসিক্যাল’ ব্যাটসম্যান, হতে পারতেন ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা পারফরমার, তাকে কিনা আমাদের এখন জানতে হয় ‘টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালা’দের একজন হিসেবে!
কিন্তু দোষটা আসলে কার? স্রেফ দুর্ভাগ্য, নাকি অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচকমণ্ডলীর খামখেয়ালি ব্যবস্থাপনার শিকার তিনি? হয়তো দুটোই। কিন্তু বাস্তবটা এই যে, যে পরিমাণ সুযোগ তার প্রাপ্য ছিল, সেটার ধারেকাছেও তিনি পাননি। কিংবা বলা ভালো, তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। অবশ্য সেটা পাবেনই বা কিভাবে, জন্মটা যে হয়েছিল বড্ড ভুল সময়ে! অস্ট্রেলিয়া দলে তখন নক্ষত্রের ছড়াছড়ি; হেইডেন, ল্যাঙ্গার, পন্টিং, ডেমিয়েন মার্টিন, মাইকেল ক্লার্ক, মাইক হাসি, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের যুগে তিনি তাই ছিলেন ব্রাত্য। অথচ অন্য কোনো দেশে, নিদেনপক্ষে দুই-এক দশক আগে-পরে জন্ম নিলেও তিনি হয়তো খেলে ফেলতে পারতেন অন্তত শ’খানেক টেস্ট! অন্তত যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, পারফরম্যান্সের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ঝলসে দিতে কখনোই ভুল করেননি।
ঝলমলে এক ক্যারিয়ার শেষে স্টিভ ওয়াহর অবসর যখন অস্ট্রেলিয়া দলে সৃষ্টি করলো একটা শূন্যতার, অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো সেই শূন্যতা পূরণ করতে সক্ষম একজন ক্রিকেটার খুঁজে বের করা। সে তালিকায় থাকা নামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য দুটো নাম ছিলো মাইকেল ক্লার্ক এবং ব্র্যাড হজ। ২০০৪ সালের ভারত সফরে যাওয়ার আগে দ্বিধান্বিত নির্বাচকেরা বেছে নেন দারুণ প্রাণোচ্ছ্বল এবং সম্ভাবনাময় তরুণ ক্লার্ককেই, আর ক্লার্কও সুযোগটা লুফে নিলেন অভিষেকেই দারুণ একটি শতরানের মাধ্যমে। ব্যস, দুর্ভাগ্যের শুরু সেখান থেকেই।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তার শুরুটা হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, একমাত্র ইনিংসে ৬০ রানের ঝকমকে একটা ইনিংস খেলে নিজের আগমনী বার্তা শোনালেন। ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টে মুখোমুখি হলেন শন পোলক, মাখায়া এনটিনি, চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট এবং আন্দ্রে নেলকে নিয়ে গড়া বিধ্বংসী এক পেস বোলিং লাইনআপের সামনে, সেটাও আবার পার্থের উন্মত্ত পেসস্বর্গে। খেললেন ২০৩ রানের অপরাজিত এক ‘ক্ল্যাসিক’ ইনিংস, ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটাই নিয়ে গেলেন দুইশ’র ঘরে! টেম্পারামেন্টের প্রমাণ দিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের শুরুতেই, এরপর ওই সিরিজে ৭৭ গড়ে তিন শতাধিক রান সংগ্রহ করলেন। কিন্তু তাতে পিঠ বাঁচলো না ঠিক, ডেমিয়েন মার্টিন-মাইকেল ক্লার্কের প্রত্যাবর্তনে খড়গ পড়লো হজের ঘাড়েই। এরপর আড়াই বছরের জন্য টেস্ট দলের বাইরে।
টেস্ট দলের বাইরে থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ সুযোগ এলো ওয়ানডে দলে, রিকি পন্টিংয়ের বিশ্রামের সুবাদে ডাক পেলেন নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে। সুযোগটা লুফে নিলেন হজ, পরপর দুটো ইনিংস খেললেন ৯৭* এবং ৯৯* রানের। দুটো ইনিংসই খেলেছিলেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, ব্যাটিংশৈলীও ছিল দর্শনীয়। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ দলে জায়গাটা তাই পাওনা হয়ে গিয়েছিলো, সেখানে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে ৮৯ বলে ১২৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংসের পরও গোটা টুর্নামেন্টে আর একটি ম্যাচেও সুযোগ পাননি হজ। এরপর ভারত সফরটা জঘন্য যাওয়ার ফলস্বরূপ ওয়ানডে দল থেকে চিরতরে নাম কাটা যায় তার।
২০০৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আরেকবার ডাক পান টেস্ট দলে, খেলতে নেমে প্রথম টেস্টেই খেলেন ৬৭ রানের একটি ইনিংস। তবু দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়ে না তার, প্রবল বিস্ময়ে পরের দুই টেস্টে নিজেকে সাইডবেঞ্চে আবিষ্কার করেন হজ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কোনো এক অজানা কারণে এরপর আর কোনোদিনই ‘ব্যাগি গ্রিন’ মাথায় তোলার সুযোগ আসেনি হজের সামনে। টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষটা হলো রহস্যঘেরা এক দুর্ভাগ্যের হাত ধরে।
কিন্তু হজ থামেননি, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে রানবন্যা বইয়ে দিয়েছেন। শুধু একটা ব্যাপার খেয়াল করুন, ক্যারিয়ারের শেষ দুই মৌসুমে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে গড় ছিল যথাক্রমে ৬১.৭৬ এবং ৬৯। অন্যদিকে ওয়ানডেতে শেষ তিন মৌসুমে গড় যথাক্রমে ৫২, ৬২.২২ এবং ৬৯। দিন যত গিয়েছে, নিজেকে শাণিত করে তুলেছেন বহুগুণে। লাভের লাভ কিচ্ছু হয়নি, নির্বাচকমণ্ডলীর মন গলাতে ব্যর্থ হয়েছেন হজ। ব্যর্থমনোরথ হয়ে খেদমেশানো কণ্ঠে বলেছেন, “দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমি কোনো দলের নির্বাচক নই, অন্তত অস্ট্রেলিয়া দলে তো না-ই। যদি হতাম, তাহলে এতদিনে আমি জাতীয় দলেই থাকতাম।”
মোটামুটি সব ব্যাটসম্যানকেই একটা কথা শুনতে শুনতে বড় হতে হয়েছে, “বল দেখে খেলো।” কিন্তু মূল প্রশ্নটা হলো, এটা করে ক’জন? সাবেক অস্ট্রেলীয় ওপেনার এড কাওয়ান ক্রিকেট মান্থলিকে বলেছিলেন, ১৩ মৌসুম ধরে শিল্ড ক্রিকেট খেলে কাউকে কস্মিনকালেও দেখেননি বলটাকে একদম বোলারের হাত থেকে দেখা শুরু করতে। কেউ রানআপ থেকে ধারণা পেতেন, কেউ বল ডেলিভারির পর বুঝতে পারতেন বলটা কোথায় পিচ করতে যাচ্ছে। ঘুরেফিরে মোটামুটি সবারই বল দেখার প্যাটার্নটা একইরকম ; কিছু ব্যতিক্রম তো আছে অবশ্যই, তবে সেগুলো তো উদাহরণ হতে পারে না!
কিন্তু অন্তত একজন ছিলেন, যিনি বলটাকে একদম বোলারের হাত থেকে একদম পুরোটা সময় নিখুঁতভাবে দেখে ব্যাটিং করতেন। পুরোটা সময় বলতে, বোলার যখন বল নিয়ে তার বোলিং এন্ডে হেঁটে হেঁটে ফিরে যাচ্ছেন, ঠিক তখন থেকে বল ডেলিভারি পর্যন্ত। লক্ষ্য ছিলো একটাই, চোখ থেকে যেন কোনোমতেই বলের সিমের পজিশনটার উপর কেন্দ্রীভূত ফোকাসটা না হারায়। যদি সিম দেখতে না পান, বলটাই যে ঠাহর করে উঠতে পারবেন না – তিনি যে বর্ণান্ধ! লাল বলটাকে দেখতে হলে যে তাই সিম খুঁজে বের করতেই হবে! ব্র্যাড হজ, বর্ণান্ধতার অভিশাপকে মাথায় চড়ে বসতে না দিয়ে জয় করেছেন সেই প্রতিবন্ধকতা।
বর্ণান্ধতা যেকোনো মানুষের জন্যই বিশাল এক অভিশাপ, বিশেষ করে একজন ক্রিকেটারের জন্য তো বটেই। ছোট থাকতে ঠিক কিভাবে বল দেখতেন, হজ ঠিক মনে করতে পারেন না। তবে যখন থেকে বুঝতে শিখলেন বলের সিম দেখার গুরুত্ব, জীবনটাই বদলে গিয়েছিল তার। আর সে কৃতিত্বের অনেকটাই তিনি দেন ডিন জোন্সকে।
১৯৯৩-৯৪ মৌসুমের গ্রীষ্ম। মাত্রই ভিক্টোরিয়ার শিল্ড দলে ঢুকেছেন ১৮ বছর বয়সী ব্র্যাড হজ। একদিন শুনলেন তারই এক বয়োজ্যেষ্ঠ সতীর্থ বল ‘দেখা’ নিয়ে কথা বলছেন, “বলটাকে শুধু দেখলেই হবে না, বলের সিমটার দিকে নজর রাখতে হবে।” শব্দগুলো উচ্চারণ করেছিলেন ভিক্টোরিয়ার অধিনায়ক, তথা তৎকালীন ভিক্টোরিয়া শিল্ড দলের সেরা ব্যাটসম্যান ডিন জোন্স। ৫২ টেস্ট এবং ১৫০ ওয়ানডে, দুই ফরম্যাটেই ৪৫-এর বেশি গড় – ডিন জোন্স শুধু হজের অধিনায়ক ছিলেন না, ছিলেন তার শৈশবের মহানায়ক এবং একজন জ্ঞানী মন্ত্রণাদায়ী অভিভাবক। সে কথাটাই বদলে দিলো হজকে।
প্রথম মৌসুমেই রানের ফোয়ারা ছোটালেন, ঐ মৌসুমেই প্রায় সহস্র রানের মাইলফলক পেরিয়ে যাচ্ছিলেন। সেটা হয়নি বটে, তবে ভিক্টোরিয়া দলে চার নম্বর জায়গাটা পাকাপোক্ত হয়ে গেল এ পারফরম্যান্সে। পরের বছরগুলোতে এই মধুচন্দ্রিমা স্থায়ী না হলেও উতরে গেলেন হজ, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও সেটা কাটিয়ে ফিরলেন আরো পরিণত হয়ে। পরিপূর্ণ একজন ব্যাটসম্যান, সাথে ধ্রুপদী ব্যাটিং টেকনিক, আর মাঠের চারদিকে ছড়িয়ে খেলার সামর্থ্য- অস্ট্রেলিয়া তখন ব্র্যাড হজে ভবিষ্যৎ এক তারকাকে খুঁজে ফিরছিলো। দারুণ ধারাবাহিক পারফরমারও ছিলেন, তবে এক মৌসুমে সহস্ররানের মাইলফলকটা ছুঁয়ে ফেলতে পারছিলেন না ঠিক। সে অর্জন ধরা দিল ২০০০-০১ মৌসুমে, পিউরা কাপে কুইন্সল্যান্ডের জিমি মাহেরের সঙ্গে যুগ্মভাবে জিতলেন ‘প্লেয়ার অফ দ্য সিজন’ খেতাব এবং চলে এলেন জাতীয় দলের রাডারে।
এরপর কিছুদিন ডারহামের হয়ে খেলার পর পাড়ি জমালেন লেইস্টারশায়ারে, সেখানে দুটো সফল মৌসুম কাটিয়ে ২০০৪ সালের ঘরোয়া ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ট্রফি ও ঐ কাউন্টির পক্ষে সর্বোর্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড (৩০২*) উপহার দিয়ে চলে গেলেন ল্যাঙ্কাশায়ারে। প্রথমবারের মতো ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চুক্তিতে এলেন, ভারত সফরে দলেও অন্তর্ভুক্ত হলেন। প্রথম ম্যাচে হয়তো খেলেও ফেলতেন, তবে একটুর জন্য ক্লার্কের সঙ্গে ইঁদুরদৌড়ে পিছিয়ে পড়লেন বলে সে যাত্রায় অভিষেকটা হলো না। ক্লার্কও এলেন, দেখলেন, জয় করলেন- দুর্ভাগ্যের বেড়াজালে জড়িয়ে গেলেন হজ।
টি-টোয়েন্টি দিয়ে তাকে চিনেছে বিশ্ব। বলা হয়, টি-টোয়েন্টি নাকি তারুণ্যের জয়গান গায়। গোটা তত্ত্বটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন হজ, সারা বিশ্বে ক্রিকেট ‘ফেরি’ করে বেড়ানোর ফাঁকে রানবন্যা বইয়ে দিয়েছেন। তবু তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা বাঁধা পড়ে গেছে মাত্র আটটি টি-টোয়েন্টিতেই, অস্ট্রেলিয়া তার প্রতিভার মূল্যায়ন করতে পারেনি। কারণটা কি ছিলো তার বয়স? তাহলে সেক্ষেত্রে ব্র্যাড হগের কথাই ধরা যাক না! হগ যদি চল্লিশ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক দলে ফিরতে পারেন, সেখানে ৩৫ বছর বয়সী হজ কেন ফিরতে পারলেন না সে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক নয় কি?
নিরন্তর রান করে গেছেন, তবু যখন দলে সুযোগ আর আসছিলো না, একসময় হজ বুঝতে পারলেন, তার চেষ্টা নির্বাচকদের কাছে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারছে না। মেনে নিলেন নিজের দুর্ভাগ্য, মেলবোর্ন কাপ জিতে দুর্দান্ত আরেকটা মৌসুম শেষ করার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সম্ভাবনার প্রশ্নে উত্তর দিলেন, “যা মনে হচ্ছে, এর চেয়ে বরং পরের সপ্তাহে আরেকটা মেলবোর্ন কাপ জেতার সম্ভাবনাই বোধহয় বেশি।” হজের ক্যারিয়ার হাইলাইটস নিজ মুখেই বলে ফেললেন এতটা অনায়াসে, স্রেফ কয়েকটা শব্দে বাঁধা পড়া কিছু হতাশা, আবেগ, প্রচেষ্টা এবং অভিমানের কাব্য। সে কাব্যের সারমর্মে ছিলো নিগুঢ় কিছু দর্শন, হয়তো দুর্লভ কোনো দৃশ্যপট; অথচ সে কাব্য এখন সার্থকতা খুঁজে ফেরে, মেলে না হিসাব।
মার্ক হাওয়ার্ডের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে হজ একটা গল্প বলেছিলেন, ঘটনাটা তার টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ার বছরখানেক পরের ব্যাপার। কেয়ার্নসে অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের হয়ে সফররত অবস্থাতেই একদিন ডেভিড বুনের সঙ্গে গল্প করতে করতে হজ জিজ্ঞেস করে বসলেন, “ভাই, সমস্যাটা কোথায় ছিল? আমার বাদ পড়ার কারণটা কী ছিল আসলে? স্লিপে লোপ্পা ক্যাচটা মিস করেছিলাম বলেই কি? নাকি দিনের শেষ বলে ব্যাট-প্যাডে লেগে কট আউট হয়েছিলাম বলে? এরকম কিছুই কি?” প্রত্যুত্তরটা স্তব্ধ করে দিয়েছিলো হজকে, “ইউ নো হোয়াট… কোনো কারণ নেই, আমরা ডেমিয়েন মার্টিনকে স্রেফ তোমার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি!” কথাটার মধ্যে যদি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ দেখতে না পান, তবে হজ একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে মার্টিন খুব একটা ভালো সময় কাটাচ্ছিলেন না, শিল্ড ক্রিকেটে মাত্র ১৪ গড়ে রান করছিলেন। সেই ১৪ গড়টাও উঠেছিলো একটি ফিফটির বদৌলতে। অন্যদিকে হজ পঞ্চাশোর্ধ্ব গড়ে রান করেছিলেন জাতীয় দলে, পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন ছিলো না তার। তবুও বাদ পড়তে হয়েছিলো, কেননা মার্টিন ছিলেন পোড় খাওয়া সৈনিক। মার্টিন সেই আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ফিফটি এবং পরের টেস্টে ম্যাচ-জেতানো এক সেঞ্চুরিতে নিজের সামর্থ্যের যোগ্যতম প্রত্যুত্তরই দিয়েছিলেন মার্টিন। হজের হিসেব তাই মিললো না এবারও; ভাগ্যটাই এমন, তার পরিবর্তে যে যখনই দলে ঢুকেছেন, নজরকাড়া সব পারফরম্যান্সে দলে জায়গাটা দখল করে ফেলেছেন।
পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মিলাতে মিলাতেই ২০০৯-১০ মৌসুমে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক শিল্ড ম্যাচে ১৯৫ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলার পথে বোলারের মাথার উপর দিয়ে ছক্কা উড়িয়ে মারার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ উপলব্ধি করলেন, দীর্ঘপরিসরের ক্রিকেটে ঠিক নিজেকে উপভোগ করতে পারছেন না। টানা ষোল বছর ধরে ক্রিকেটের শীর্ষ পর্যায়ে নিজেকে উজাড় করে খেলেছেন, সে সম্মানজনক ক্যারিয়ারের সূর্যাস্ত পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে চাইলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার ‘ক্রিকেটের পর্যটক’ই হবেন, খেলবেন শুধুই টি-টোয়েন্টি। ব্যাগি গ্রিনের মোহ তুলে রাখলেন শোকেসে, বিশ্বজুড়ে ঝলমলে সব টুর্নামেন্টে আলো ছড়াতে শুরু করলেন।
অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সেরা এক ক্রিকেট প্রতিভা কোনো এক অদ্ভুত ইন্দ্রজালে বিদ্ধ হয়ে বনে গেলেন ফ্রিল্যান্স ক্রিকেটার, তখন কনসেপ্টটা নিতান্তই নতুন। সে সিদ্ধান্তে যে কতটা সফল ছিলেন, সেটা তো পরিসংখ্যানই উত্তর দেয়! পরের কয়েক বছর কলকাতা নাইট রাইডার্স, বরিশাল বার্নার্স, কোচি টাস্কার্স, রাজস্থান রয়্যালস, মেলবোর্ন স্টার্স এবং নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্টসের হয়ে মাঠ মাতিয়েছেন। কলকাতার জার্সি গায়ে ঠিক সেভাবে সুবিধা করে উঠতে না পারলেও বরিশালের হয়ে ৪২, মেলবোর্নের হয়ে ৪৩, রাজস্থানের হয়ে ৪০, কোচির হয়ে ৩৬, এবং নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্টসের হয়ে দুর্ধর্ষ মৌসুম কাটিয়ে ৬৫ গড় নিয়ে শেষ করেছেন। শ্রেষ্ঠত্ব বিচারের জন্য পরিসংখ্যানে যথেষ্ট উপাত্ত জমিয়ে রেখেছিলেন বৈকি!
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে এখন একটাই। সম্ভাব্য সেরা পারফরম্যান্স করার পরও হজকে ডাকা কেন হলো না? আর কী-ইবা করতে পারতেন তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ না হলেও আপাতত একটি সম্ভাব্যতা মাথায় ঘুরছে, দেশের সেরা ছয় ব্যাটসম্যানের একজন হওয়া।
১৯৯৩ সালে হজের ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক হওয়ার পর থেকে আরো আঠারোজন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের মাথায় উঠেছে অস্ট্রেলিয়ার ‘ব্যাগি গ্রিন’ টুপি। জাস্টিন ল্যাঙ্গার থেকে শুরু করে মার্কাস নর্থ, তালিকাটা নিতান্ত কম ওজনের নয় বৈকি। আর এই আঠারোজনের মধ্যে মাত্র ১১জনই পেরেছেন বিশটির বেশি টেস্ট খেলতে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম গড় গ্রেগ ব্লিউইটের (৩৪.০২)।
হজের সমসাময়িকদের মধ্যে মার্ক ওয়াহ এবং ডেমিয়েন মার্টিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় যথাক্রমে দুই এবং এক বছর আগে, এছাড়া মার্ক টেইলর এবং স্টিভ ওয়াহও দারুণভাবে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন স্বীয় পারফরম্যান্সের বদৌলতে। প্রত্যেকেই ধীরে ধীরে নিজেকে কিংবদন্তীতুল্য করে তুলেছেন, দলে কারো জায়গা নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন ছিলো না। উল্লেখিত ওই এগারোজনের ছোট্ট লিস্টটাতে সর্বকালের অন্যতম সেরা কিছু ব্যাটসম্যানের নাম রয়েছে সে কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও ধরে নেওয়া যায় তর্কযোগ্যভাবে অন্ততপক্ষে ব্লিউইটের তুলনায় হয়তো হজ আরেকটু যোগ্যতর ছিলেন। সে দাবির পক্ষে সাক্ষ্য দেয় হজের ৫৫.৯০ গড়। ব্লিউইটের পারফরম্যান্সের হিসেবটা আমলে নিলে কি এ সিদ্ধান্তে আসা যায়, হজ আসলেই প্রচণ্ড দুর্ভাগা ছিলেন? একদিক থেকে উত্তরটা ‘হ্যাঁ’, যদি ধরে নেওয়া নেওয়া হয় হজ আর কয়েকটা বছর আগেপরে হলেও হয়তো কয়েকটা টেস্ট বেশি খেলতে পারতেন। কিন্তু একতরফা এই বিচার অন্য অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হবে না, হওয়ার কথাও নয়।
প্রথম সেঞ্চুরিটাই হজ ডাবলে পরিণত করেছিলেন, সেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। যেটা উল্লেখ করা হয়নি, সেটা হলো ওই ইনিংসটা ক্যারিয়ার থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে নিলে পঞ্চাশোর্ধ্ব গড়টা এক ধাক্কায় নেমে আসে ৩৩.৩৩-এ। এবার গড়টাকে ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না নিশ্চয়ই? আর তাছাড়া তাকে খেলাতে হলে জাস্টিন ল্যাঙ্গার, ম্যাথু হেইডেন, ডেমিয়েন মার্টিন, মাইকেল স্ল্যাটার, ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক, মাইক হাসি, মার্ক টেলর, মার্ক ওয়াহ ও স্টিভ ওয়াহর মতো কয়েকজন খেলোয়াড়ের অন্তত একজনকে সরে দাঁড়াতে হতো। ভেবে দেখুন তো, কাকে বাদ দিতে পারতেন আপনি?
তবে আরো কিছু ব্যাপারও হয়তো কাজ করেছিলো হজের বাদ পড়ার পিছনে। প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ান কোচ বব সিম্পসন আবিষ্কার করেছিলেন হরহামেশাই হজের অহেতুক সব ড্রাইভ খেলার প্রবণতা, সেটা চোখে পড়ে আরো অনেকেরই। তার ব্যাটিং নিখুঁত ছিল না তো বটেই, বরং তার শক্তির জায়গাটাই কাল হয়ে এসেছিল যেন। সিডনিতে আন্দ্রে নেলের বাউন্সারে দিনের শেষ বলে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসাটা ছিলো দারুণ দৃষ্টিকটু, তখনই পড়ে গিয়েছিলেন নির্বাচকদের ব্যাডবুকে। তাছাড়া অপরাজিত দ্বিশতকের মাত্র চার ইনিংস পরই এমসিজিতে ৭ ও ২৪, এরপর এসসিজিতে ৬ ও অপরাজিত ২৭ রানের ইনিংসগুলোর পর আর জায়গা ধরে রাখতে পারেননি হজ, নামটা চিরতরে কাটা যায় টেস্টজগৎ থেকেই।
একবার মার্ক হাওয়ার্ডকে হজ বলেছিলেন, “মানুষ এই কথাটা তুললে খুব খারাপ লাগে মাঝেমধ্যে। পেছন ফিরে যখন দেখতে যাই, একটা জিনিসই শুধু চোখে পড়ে। আমার ছোট্ট আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাতে ২৩ রানের কমে আউট হয়েছি মাত্র তিনবার… খারাপ তো লাগবেই, না?” তিনি আরো যোগ করেন, “মানুষ দল থেকে বাদ পড়ে যখন সে চাপের মুখে পারফর্ম করতে পারে না, কিংবা ফর্মহীনতায় ভোগে। আমার ক্ষেত্রে তো এসব কিছুই ছিলো না! আমার রানসংখ্যার দিকে একটু তাকিয়ে দেখুন… সেটাই তো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট চেয়েছিলো আমার কাছে, এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা দিতে পারতাম আমি!”
আরো একটু সুযোগ কি প্রাপ্য ছিল হজের? তিনি কি হয়ে উঠতে পারতেন কিংবদন্তীদের একজন? উত্তরটা ধনাত্মক আসুক কিংবা ঋণাত্মক, তাতে এখন আর হজের কিছুই যায় আসে না। মানসিক দিক থেকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হজের আকুতি শুনতে পাননি অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকেরা। বড্ড ভুল সময়ে, খুব সম্ভবত ভুল কোনো দেশে জন্ম নিয়ে ফেলেছিলেন ব্র্যাড হজ। সম্ভাবনার কুঁড়িটুকু তাই শতদল হয়ে ফুটতে পারলো না কোনোদিনই, আক্ষেপ এবং দুর্ভাগ্যের কাঁটাতারে আটকে পড়লেন গোটা ক্যারিয়ারজুড়েই!
Featured Image Credit: Cricketcountry