বিজ্ঞানমনষ্ক কিংবা অমনষ্ক, সাধারণ কিংবা অসাধারণ মানুষ- যে ধরনের মানুষই হোক না কেন, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর নাম একবার শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আজীবন গবেষণা করে গেছেন যিনি, তিনি স্টিফেন হকিং। যিনি এক সূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন পুরো মহাবিশ্বকে। বের করতে চেয়েছিলেন আমাদের এই রহস্যময় মহাবিশ্বের উৎপত্তির কারণ। লিখেছেন ‘থিওরি অব এভ্রিথিং’, ‘দ্য ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ এবং আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক বিক্রিত ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ নামক অমর গ্রন্থ, যা সারা পৃথিবীব্যাপী সকল বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত।
সেই প্রতিভাধর বিজ্ঞানী আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন এই বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ। ভাবতেই অবাক লাগে, যে মানুষটির মৃত্যু হওয়ার কথা ছিলো আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে, সেই মানুষটি নিজেকে বিজ্ঞানের প্রতি উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন শেষ সময়গুলো বিজ্ঞান সাধনার কাজে। কিন্তু তিনি সেই বেঁধে দেয়া সময়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জীবিত ছিলেন পরবর্তী ৩৩টি বছর। এবং শেষপর্যন্ত ৭৬ বছর বয়সে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
বিজ্ঞানী হকিং-এর জন্ম-মৃত্যুর তারিখগুলো একটু রহস্যময়। তাঁর জন্ম তারিখ ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি। সেই সময় থেকে ৩০০ বছর পূর্বে অর্থাৎ, ১৬৪২ সালের এই একই দিনে জানুয়ারির ৮ তারিখে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও মৃত্যুবরণ করেন। আবার হকিং যেদিন মৃত্যু বরণ করেন, অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ, ১৮৭৯ সালের এই একই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আপেক্ষিকতার জনক বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। ওই একই দিন আবার পাই দিবস পালন করা হয়। অনেকটা কাকতালীয় ব্যাপার।
তো তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করা এই লেখার উপজীব্য নয়। যখন তাঁর বয়স ২১ বছর, তখন তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববদ্যালয়ে কসমোলজির উপর পড়াশোনা ও গবেষণা করছিলেন। সেই সময়ে হঠাৎ হঠাৎ তাঁর হাত থেকে পানির গ্লাস পড়ে যেত, বক্তৃতা দেয়ার সময় গলার স্বর পরিবর্তিত হয়ে যেত, হাঁটতে গিয়ে পিছলে যেতেন কিংবা জুতার ফিতা বাঁধতে গিয়ে হাত ফস্কে যেত। বিষয়টা একসময় মারাত্মক আকার ধারণ করলো। তার শরীরে ধরা পড়লো এ্যামিওট্রোফিক ল্যাটারাল স্লেরোসিস বা লু গেরি’স ডিজিজ।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে যে স্নায়ুগুলো মাংসপেশীসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে তারা আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে পড়তে শুরু করে এবং একসময় একেবারে নিস্তেজ হয়ে যায়। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের শরীরের মাংসপেশী নিয়ন্ত্রণে অক্ষম হয়ে পড়ে। তো এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তারগণ তাঁকে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিলো, তিনি আর মাত্র আড়াই বছর বেঁচে থাকবেন। কিন্তু হকিং এতে থেমে থাকেননি। পদার্থবিদ্যা এবং সৃষ্টিতত্ত্বের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
এই অবস্থায় অর্থাৎ মোটর নিউরন রোগাক্রান্ত অবস্থায় প্রথম দিকে তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। তিনি না পারতেন ঠিকভাবে কথা বলতে, না পারতেন নড়াচড়া করতে। তাঁর কেবল মস্তিষ্ক এবং ডানহাতের দুটি আঙ্গুল ছিলো কর্মক্ষম। আজীবনের মত তিনি আশ্রয় নিলেন তাঁর হুইলচেয়ারে।
প্রথমদিকে যখন তিনি হুইলচেয়ারে আশ্রয় নিলেন তখনো তাঁর গলার স্বর একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু তাঁর গলার স্বর হয়ে পড়েছিলো সাধারণদের বোঝার পক্ষে খুবই অস্পষ্ট। কেবল যারা তাঁকে খুব কাছে থেকে চিনতো তারাই তাঁর কথাগুলো কোনোরকম বুঝতে পারতেন। তাঁর গবেষণার কাজে তাঁকে সাহায্য করতো তাঁরই একজন ছাত্র। কিন্তু বিধি বাম, ১৯৮৫ সালে শ্বাসনালীতে অস্ত্রোপচার করার ফলে তিনি তাঁর গলার স্বর পুরোপুরি হারিয়ে ফেললেন।
গলার স্বর হারানোর ফলাফল হেতু তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। তখন তাঁর এই অবস্থা নজর কাড়লো ক্যালিফোর্নিয়ার একজন কম্পিউটার প্রোগ্রামারের। এই কম্পিউটার প্রোগ্রামার তৈরী করেছিলেন এমন একটি কথা বলার প্রোগ্রাম যা কিনা চোখ ও মাথার নড়াচড়ার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে পারে। এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানী হকিং-এর কিছুটা সুবিধাই হলো বটে। কারণ তিনি কম্পিউটার স্ক্রীনের উপর থেকে কোনো শব্দকে নির্বাচন করতে পারলেন এবং সেটা পরবর্তীতে ভয়েস সিন্থেসাইজার এর মাধ্যমে অডিও হিসেবে শোনার ব্যবস্থা করা হলো। অনেকটা এখনকার গুগল ট্রান্সলেটর এর অডিও প্রোগ্রামের মত।
যদিও তিনি তাঁর শরীরের প্রায় সকল মাংসপেশীর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু ডান হাতের দুটি আঙ্গুল তখনো তিনি ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু ২০০৮ সালের দিকে এই আঙ্গুল দুটিও প্রোগ্রাম চালানোর জন্য খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। পরে সেই প্রোগ্রামটি এমনভাবে সেট করা হয় যার দ্বারা তিনি গাল ও চোয়ালের নড়াচড়ার সাহায্যে প্রোগ্রামটি চালাতে পারেন। তাঁর চোয়ালে লাগিয়ে দেয়া হয় একটি সেন্সর যার অপরপ্রান্ত চশমার সাথে যুক্ত।
তো কিভাবে কাজ করে এই প্রোগ্রাম, সেই সম্পর্কে জানা যাক তাহলে এখন।
১৯৯৭ সাল থেকে বিজ্ঞানী হকিং এর কম্পিউটার ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে ইন্টেল কর্পোরেশন। মূলত তাঁর হুইলচেয়ারের এক হাতলের উপর তাঁর দিকে মুখোমুখি একটি ট্যাবলেট কম্পিউটার যুক্ত করা হয়। এই কম্পিউটার চলতো হকিং এর হুইলচেয়ারের ব্যাটারির সাহায্যে। জরুরী মুহূর্তের জন্য অতিরিক্ত ব্যাটারির ব্যবস্থাও ছিলো।
তো এই কম্পিউটার ও তাঁর মধ্যে যে ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো সেটি মূলত ইন্টেল কর্তৃক লিখিত একটি মুক্ত প্রোগ্রাম (ওপেন সোর্স প্রোগ্রাম)। কম্পিউটার পর্দায় ছিলো একটি কীবোর্ড সফটওয়্যার যেখানে একটি কার্সর কীবোর্ডের উপরে নিচে এবং আগে পিছে অর্থাৎ সারি অনুযায়ী এবং একইসাথে কলাম অনুযায়ী চলাচল করতে পারে। যখন কোনো একটি অক্ষর নির্বাচনের দরকার পড়তো তখন তিনি সেই অক্ষরের উপর কার্সর গেলে গালে লাগানো সেন্সরের সাহায্যে কার্সরটি থামিয়ে দিতেন এবং সেই অক্ষরটি নির্বাচিত হত। এখন সমস্যা হচ্ছে এভাবে এক এক করে প্রতিটি অক্ষর নির্বাচনের জন্য প্রচুর সময়ের প্রয়োজন। সেই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এই প্রোগ্রামে ছিলো ‘ওয়ার্ড প্রেডিকশন সিস্টেম’। অর্থাৎ, দুই-একটি অক্ষর নির্বাচনের সাথে সাথে আনুমানিক সব শব্দ দেখা যেত কম্পিউটার পর্দায়। কাজেই তখন সেখান থেকে শব্দ বাছাই করা তাঁর পক্ষে সহজ ছিলো।
তাঁর গালের নড়াচড়া শনাক্ত করার জন্য ছিলো একটি ইনফ্রারেড সেন্সর যা তাঁর চশমার সাথে যুক্ত ছিলো এবং ওয়ার্ড প্রেডিকশন এলগরিদম তৈরী করা হয়েছিলো মূলত তাঁর লেকচার এবং বইয়ের উপর ভিত্তি করে, যেন বিজ্ঞানভিত্তিক শব্দগুলোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা না হয়। যখন এভাবে একে একে শব্দ বাছাই করার শেষে একটি বাক্য তৈরী হত, তখন তিনি সেগুলোকে পাঠিয়ে দিতেন ভয়েস সিন্থেসাইজার নামক অংশে। ভয়েস সিন্থেসাইজার ছিলো মূলত ‘স্পিচ প্লাস’ নামক সংস্থার তৈরী একটি আলাদা হার্ডওয়্যার। যখন একেকটি বাক্য এই সিন্থেসাইজারে প্রেরণ করা হত, তখন এই যন্ত্রটি সেই লিখিত বাক্যকে শব্দে রূপান্তরিত করে আমাদের শোনার উপযোগী করে তুলতো। যতক্ষণে এই শব্দ শোনা যেত, ততক্ষণে তিনি আরেকটি বাক্য তৈরী করে ফেলতেন এবং সেটাও ভয়েস সিন্থেসাইজারে প্রেরণ করতেন। এভাবে চলতো তাঁর কথা বলা।
এই ওপেন সোর্স প্রোগ্রামটির মাধ্যমে তিনি যে কেবল শব্দ থেকে বাক্য তৈরী করতেন আর সেটা অডিও হিসেবে শোনা যেত এমন না। তিনি এই প্রোগ্রামের সাহায্যে মাইক্রোসফট আউটলুকে নিজের মেইল চেক করতে পারতেন, পারতেন ফায়ারফক্স ইন্টারনেট ব্রাউজারে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে। এমনকি এর সাহায্যে তিনি মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে নিজের লেকচার লেখালেখি করতেও পারতেন। পরে ইন্টেল তাঁর জন্য একটি নতুন কম্পিউটার তৈরী করে যেখানে ওয়েবক্যাম যুক্ত করা হয়। এর সাহায্যে তিনি স্কাইপ ব্যবহার করে কাছের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন। তাঁর কাছের মানুষেরা তাঁর মুখের অভিব্যক্তির সাথে খুব পরিচিত ছিলেন, ফলে তাদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুব একটা সমস্যা হতো না।
তিনি লেকচার দেয়ার জন্যও ব্যবহার করতেন এই মুক্ত সফটওয়্যারটি। এই প্রোগ্রামে লেকচার ম্যানেজার নামক একটি অংশ আছে। তিনি প্রথমে তার লেকচার তৈরী করে রাখতেন, পরে একেকটি প্যারাগ্রাফ আকারে সেগুলো প্রেরণ করতেন অডিও অংশে অর্থাৎ ভয়েস সিন্থেসাইজার যন্ত্রে। যদিও পরে তাঁর জন্য আরো বেশ কিছু পরীক্ষামূলক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, যেমন চোখের নড়াচড়ার মাধ্যমে কিংবা মস্তিষ্কের দ্বারা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এমন সব পদ্ধতি। কিন্তু হকিং এর মতে তাঁর এই ‘চিক সুইচ’ অর্থাৎ গালের মাংসপেশীর নড়াচড়ার দ্বারা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিটি তাঁর কাছে সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিলো।
হকিং এর প্রযুক্তিতে পরিপূর্ণ দুটি হুইলচেয়ার ছিলো। প্রতিটি হুইলচেয়ারে যেসব যন্ত্র যুক্ত ছিলো সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ইন্টেল কর্তৃক উদ্ভাবিত ACAT ইন্টারফেস সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল ব্লিংক সুইচ, পেটার বেনি কর্তৃক লিখিত সফটওয়্যার স্পিচ ইম্যুলেটর যা রাস্পবেরী পাই ৩ কম্পিউটারে রান করা হয়, স্পিচ প্লাসের হার্ডওয়্যার স্পিচ সিন্থেসাইজার, সাউন্ড রিসার্চ সংস্থার স্পিকার ও এ্যামপ্লিফায়ার, লেনোভো ল্যাপটপ এবং বাদবাকী সব হার্ডওয়্যার ইন্টেল কর্তৃক সরবরাহকৃত।
বিজ্ঞানী আইন্সটাইনের পরে যে প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর নাম বলতে হয় তিনি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। কিন্তু শুধুমাত্র তাঁর প্রতিভাই তাঁকে এত বিখ্যাত করেনি। বরং তাঁর অক্ষমতা থাকার পরেও তিনি চালিয়ে গেছেন তাঁর গবেষণা। যে ব্যক্তির শেষ দিন বেঁধে দিয়েছিলেন ডাক্তারগণ, সেই ব্যক্তিই কিনা বর্তমান পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন। এই তো মার্চের ১৪ তারিখে এই নক্ষত্র মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু হুইলচেয়ারে বসে আর এতসব প্রযুক্তির সাহায্যে অনেকটা কৃত্রিম জীবনযাপনের পরেও তিনি বিজ্ঞানে তাঁর অপরিসীম অবদান রেখে গেছেন, যা সত্যিই অকল্পনীয়।
ফিচার ইমেজ: howitworksdaily.com