‘ভয়’ শব্দটির সাথে আমরা সকলেই কমবেশি জড়িয়ে আছি। বিভিন্ন অলৌকিক বা অশরীরী ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের ‘ভূতের ভয়’ নামক অনুভূতি আবর্তিত হয়। আত্মানির্ভর বা পারলৌকিক বিষয়ের উপর কোনো চলচ্চিত্র বা গল্প বইয়ের রেশ যখন মনের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে যায়, তখন এক গা ছমছমের অনুভূতির জন্ম নেয়। কারো কাছে ব্যাপারখানা নিতান্তই রোমাঞ্চের, আবার কারো কাছে জীবন কেড়ে নেয়ার মতো হুমকিস্বরূপ। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অলৌকিক বা ভূতের অতিরিক্ত ভয়কে এক ধরনের ফোবিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার নাম ‘ফেসমোফোবিয়া‘।
ফেসমোফোবিয়া কী?
আপনি হয়তো খুব ভয়ের একটি চলচ্চিত্র দেখলেন বা একটা ভূতের বই পড়লেন। কিন্তু গল্প শেষ হয়ে গেলেও গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে অনেক বেশি একাত্ম হয়ে আছেন। গল্পের চরিত্রগুলো এতটাই জীবন্ত ছিল যে চরিত্রগুলো যেন কল্পনা থেকে বাস্তবে উঠে এসেছে। আর মনের অজান্তেই নিজের চারপাশে এক ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি করে নিয়েছেন।
রাতে যখন ঘুমোতে গেলেন, তখন গল্পের সবগুলো ভৌতিক দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। বিছানায় একা শুয়ে আছেন, কিন্তু মনে হলো কীসের যেন একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। দরজায় কেমন যেন একটা আওয়াজ হচ্ছে। ঘরের কাঠের আসবাব থেকে ঘুনে ধরার আওয়াজ আসছে। মাথার কাছে রাখা ঘড়িটার টিক টিক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে যেন। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ।
জানলার পর্দাটা খোলা ছিল বলে বাইরের ল্যাম্পপোস্টের কিছুটা আলো ঘরে ঢুকে পড়েছে। আধো আলো ছায়াতে বিছানার পাশেই যেন কারো অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে রাখতে চাইছেন, তবু কেন জানি চোখ খুলে ফেলছেন বারবার। শরীরের উপর চাদরটা দিয়ে মুখটা ভালোভাবে ঢেকে দিলেন, কিন্তু মনে হতে লাগলো কেউ একজন যেকোনো সময় চাদরটি মুখ থেকে সরিয়ে নিবে। আবার বিছানার পাশেই হয়তো গল্পের সেই সাদা মুখের বাচ্চাটি গুটি দিয়ে বসে আছে।
চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই, তবুও চোখ খুলতে সাহস হচ্ছে না। চোখ খুললেই হয়তো লাল শাড়ি পরা মেয়েটিকে দেখা যাবে, যে কিনা রাতের আঁধারে এসেই গলা টিপে দিয়ে যেত। চাইলেই বৈদ্যুতিক বাতিটি জ্বালিয়ে কিছুটা হলেও ছাড় পাওয়া যায় কিন্তু সকালেই নিন্দুকের টিপ্পনি সইতে হবে। ভীতু নামটা যেন কিছুতেই গায়ে মাখা যায় না।
হঠাৎ করেই কীসের যেন একটা আওয়াজ হলো বা ঘরের জানালাটা নড়ে উঠল। আপনিও হুড়মুড় করে উঠে পড়লেন। যে যা-ই বলুক, এভাবে তো আর থাকা যায় না। এভাবে চলতে থাকলে ভয়েই দম বন্ধ হয়ে আসবে। উঠে গিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন বাতি, আর বাকিটা রাত কিছুটা ঘুম আর কিছুটা আতঙ্ক নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। কারো কারো ক্ষেত্রে ভূতের ভয় এমনই তীব্র আকার ধারণ করে যে নিদ্রাহীনতা, হৃদরোগ, স্কিজোফ্রেনিয়া, ইনসোমনিয়ার মতো রোগেও আক্রান্ত হতে পারেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে ভূতের এই ভয়কেই ফেসমোফোবিয়া বলে আখ্যা দেয়া হয়।
লক্ষণসমূহ
ভূতের ভয় কমবেশি আমাদের সকলের মনের মধ্যে রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হলো ছোটবেলা থেকেই আমরা বড়দের কাছ থেকে ভূত-প্রেত, রূপকথা শুনে বড় হই। তাই ভূত সম্পর্কিত একধরনের অদৃশ্য ভয় আমাদের বড় হয়ে ওঠার মধ্যেই যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। অনেকের মনের মধ্যে ভূতের ভয় থাকলেও তা প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন।
তবে ফেসমোফোবিয়ায় আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে ভয়ের মাত্রাটি অনেক বেশি। তারা একা ঘরে থাকতে ভয় পায়, অন্ধকারকে অসম্ভব ভয় পায়, নিস্তব্ধতা সহ্য করতে পারে না, শহরে বাস করলে গ্রামে কোনভাবেই রাত কাটাতে চায় না, ভৌতিক গল্প, সিনেমা বা ছবি থেকে অনেক দূরে থাকেন। তবে এই ধরনের ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ প্রদর্শন করে থাকেন।
১। একা ঘুমুতে ভয় পান
২। পুরোপুরি অন্ধকার ঘরে ঘুমুতে চান না
৩। মনের মধ্যে সবসময় অলীক ভূতের ছবি ভাসতে থাকে
৪। যেকোনো পরিস্থিতিতে ভূতের অস্তিত্বের আভাস পান
৫। মাঝে মাঝে ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় এবং খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন
৬। সবসময় মুখে চিন্তার ছাপ দেখা যায়
৭। নিদ্রাহীনতায় ভুগতে থাকেন কারণ ভূতের ভয়ে ঘুমুতে পারেন না
৮। বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্রের প্রতি অনেক বেশি আসক্তি হয়ে পড়েন
করণীয়
ভূতের ভয়কে সাধারণত খুব বেশি উদ্বেগজনক বলে মনে করা হয় না। তবে ভয়ের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে অথবা এই ভয় যদি দৈনন্দিন জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলে, তবে এই বিষয়ে সতর্কতা গ্রহণ করা উচিত। তবে প্রথমেই উদ্বিগ্ন না হয়ে নিজে থেকেই চেষ্টা করতে হবে এই ফোবিয়া থেকে বের হয়ে আসার।
ভয়কে জয় করার চেষ্টা
ফেসমোফোবিয়া থেকে মুক্তির সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হলো ভূতের ভয় মন থেকে পুরোপুরি বের করে ফেলার চেষ্টা করা। ভূতের ভয়কে যত বেশি প্রশ্রয় দেয়া হবে, ভয় ততই মনের মধ্যে স্থায়ী হয়ে যাবে। তাই সর্বপ্রথম নিজের মনকে বোঝাতে হবে, ভূত বলে কিছু নেই। এটি সম্পূর্ণ নিজের মনের ভুল ধারণা। আর যদি আপনি ভূতে বিশ্বাস করে থাকেন, তবে চেষ্টা করতে হবে ভূতের দেখা পাওয়ার চেষ্টা করা। কারণ আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে ভূত যদি থেকেও থাকে, তা কখনো সরাসরি আপনাকে আঘাত করতে পারবে না, বরং একমাত্র ভয়ই হয়ে উঠতে পারে আপনার মৃত্যুর কারণ। তাই মনকে শক্ত করে ভূতের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে মনকে গড়ে তুলুন।
মনকে অনেক বেশি যৌক্তিক করে তোলা
বিজ্ঞানের এই যুগে ভূতে বিশ্বাস রাখা খুব কষ্টসাধ্য। তবুও যদি মনের মধ্যে ভূতের ভয় বাসা বাঁধে, তবে মনের বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাকে জাগ্রত করে তুলুন। কোনো কিছুর প্রমাণ ছাড়া সহজেই মেনে নেয়ার অভ্যাস দূর করতে হবে। কোনোকিছু দেখে বা অনুভব করে অথবা শব্দ শুনে ভয় পেলে তার উৎসের সন্ধান করতে হবে। কী কারণে এমন ঘটল, তা বের করলে সব কৌতূহলের সমাধান হয়ে যাবে।
ভয় থেকে মুক্তির জন্যে কৌতুকের আশ্রয় নিন
ভূতের ভয় পাচ্ছেন দেখে নিজেকে নিয়ে কৌতুক করুন। অথবা আপনার খুব পছন্দের কোনো কৌতুক চরিত্রের কথা চিন্তা করুন। নিজের জীবনের মজার কিছু স্মৃতি নিয়ে ভাবুন। ভূত সবসময় খারাপ হয় না, ভালোও হতে পারে এমন চিন্তা মাথায় আনুন। এর একটি ভালো উদাহরণ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ এর ভূতের অবয়ব।
নিজেকে নিরাপদ রাখা
অনেক কিছু করেও যদি ভূতের ভয় জয় করতে না পারেন, তবে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সাধারণত কোনো ভূতের চলচ্চিত্র দেখলে বা বই পড়লে এমনটা মাথার মধ্যে বেশি কাজ করে, যা কয়েকদিনের মধ্যে এমনিতেই মিলিয়ে যায়। তাই যদি খুব বেশি ভয় মনের মধ্যে গেঁথে যায় তবে রাতে কারো সাথে ঘুমান, অথবা বাতিটা জ্বালিয়ে রাখুন কিংবা হালকা কোনো গান চালিয়ে রাখুন।
ভূতের চলচ্চিত্র দেখা বা বই পড়া থেকে বিরত থাকা
যাদের ভূতের ভয় খুব বেশি, তারা চাইলে ভূতের চলচ্চিত্র দেখা অথবা ভূতের বই পড়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। তবে অনেকেই ভয় পেলেও ভূতের চলচ্চিত্র দেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না। তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত একা থাকার প্রবণতা কম দেখা যায়। অন্যথায় রাতের বেলা ভূতের চলচ্চিত্র না দেখে দিনের বেলা দেখে নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভূতের ভয় পাওয়ার আনন্দটাও ষোলোআনায় যে হারাতে হবে, তা বলাই বাহুল্য।
মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া
অনেকেই ভূতের ভয়ে এত বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েন, যার কারণে তাদের দৈনন্দিন জীবন অনেক বেশি ব্যাহত হয়ে থাকে। এই ধরনের ফোবিয়া থেকে মানসিক আরো জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ভূতের ভয়ের ফোবিয়া অল্পতেই বিনষ্ট করে নেয়া উচিত। কোনোভাবেই যদি ভূতের ভয় কমানো না যায় এবং এর ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে থাকে, তবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
বিজ্ঞানের এই যুগে ভূতের ভয় একধরনের বিলাসিতা বা বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সত্যটি যাদের মনে গেঁথে রয়েছে, তাদের ভূতের বিষয়টি আনন্দ ও নিছক বিনোদনের একটি বিষয়। অনেকের মতে, ভয় না পেলে ভূতের চলচ্চিত্র বা বই পড়ে লাভটাই বা কী? তবে মানুষের মন বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন হয়ে উঠতে পারে। তাই এই ফোবিয়াকে সবসময় ছোট করে দেখা উচিত নয়। ফোবিয়া খুব তীব্র হয়ে উঠলে এর উপযুক্ত চিকিৎসা নেয়া মোটেও লজ্জার চোখে দেখা উচিত নয়।
ফিচার ইমেজ- gizmodo.com