আপনাকে যদি কেউ নিজের মতামত জানায় কিংবা আপনার বিশ্বাসের বিপরীতে কিছু বলে, তাহলে আপনার কেমন লাগবে? কেউ কেউ ব্যাপারটির সত্যতা যাচাই করে বোঝার চেষ্টা করবেন যে কার কথা ঠিক। কিন্তু কিছু মানুষ এমনও আছেন, যারা নিজেদের মতামতকে কোনো বাছবিচার ছাড়াই ঠিক ধরে নেন এবং বাকিদের কথাকে পাত্তাও দেন না। বিষয়টি কে কীভাবে নেবে, সেটা তার উপরই নির্ভর করে। তবে অন্য কারো মতামত শুনে ভয় পাওয়ার বিষয়টি নিতান্তই অস্বাভাবিক। একটি কাজ করলে কে কী বলবে বা একটি বিষয়ে আপনার মত শুনে বাকিদের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা আমরা সকলেই কম-বেশি চিন্তা করি। কিন্তু এই চিন্তা এবং ভয়ের মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। এই ভয়ের মানে হলো আপনার একধরনের ফোবিয়া রয়েছে। অন্যের মতামত শোনার ফোবিয়া, যাকে বলা হয় ‘অ্যালোডক্সাফোবিয়া’।
‘অ্যালোডক্সাফোবিয়া’-এর উৎপত্তি ‘ডক্সাফোবিয়া’ থেকে হলেও দুটি শব্দ অর্থগত দিক থেকে পরস্পরের বিপরীত। ডক্সাফোবিয়া হলো মতামত ‘প্রকাশ’ করার ভয়। অন্যদিকে ‘অ্যালোডক্সাফোবিয়া’ মানে অন্য কারো মতামত ‘শোনার’ বা ‘জানার’ ভয়। তিনটি গ্রিক শব্দ ‘অ্যালো’, ‘ডক্স’ এবং ‘ফোবোস’ থেকে এই ফোবিয়ার নামটির উদ্ভব। উল্লেখ্য, ‘অ্যালো’ অর্থ ভিন্ন, ‘ডক্স’ হলো মতামত এবং ‘ফোবোস’ বলতে ভয়ের দেবতাকে বোঝানো হয়। ফোবিয়ার বিষয়টা হলো নির্দিষ্ট কোনো একটা বিষয়ের ক্ষেত্রে কারো অবাধ ভয়। সেই ব্যাপারে ভয় পাওয়াটা ভিত্তিহীন কিংবা অযৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও তা কাটিয়ে উঠতে না পারা। ফলস্বরূপ, ফোবিয়ার শিকার ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অ্যালোডক্সাফোবিয়া যাদের মধ্যে রয়েছে, তারা বাকিদের মতামত শোনার ভয়ে নিজেদের উপর নিজেরাই অনেক বিধি-নিষেধ আরোপ করে বসে। সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে সর্বদাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এই ফোবিয়া। মতামত শোনার বা জানার ভয়ের বিষয়টা শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট বয়সের মানুষদের জন্য নয়। বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও শিকার হতে এই ফোবিয়ার। কোমল শিশুদের মনেও ভয় জাগতে পারে, অন্যরা কী ভাববে তা ভেবে। আর এই অযৌক্তিক ভয় তাদের মনে শক্ত করে ঘর বেঁধে বসে। যেমন- পরীক্ষায় তাদের ফলাফল দেখলে বাকিরা কী বলবে কিংবা নিজেকে অন্যদের তুলনায় নিকৃষ্ট ও অদক্ষ মনে করে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ না করা।
অথবা হেরে গেলে বাকিরা সমালোচনা করবে, তা ভেবে ভিত্তিহীন ভয় পাওয়া। বড়দের ক্ষেত্রেও এরকম ভয় লক্ষ্য করা যায়। এই পোশাক পরলে বাকিরা কী বলবে, এই উত্তরটা এভাবে বললে সবাই তার সম্পর্কে কী ভাববে কিংবা এমনিতেই সারাক্ষণ অকারণে তার সম্পর্কে কে কী ভাবছে তা নিয়ে চিন্তা করা বা মতামতটা জেনে ফেলার যে ভয় সেগুলোই অ্যালোডক্সাফোবিয়ার অন্তর্ভুক্ত। ধীরে ধীরে এই ভীতি তাদের চেতনাশক্তিকে কবজ করে ফেলে। এতে করে তারা পরবর্তীতে নিজের মতো করে কোনো কিছু করার বা মত প্রকাশের সাহস পায় না। অ্যালোডক্সাফোবিয়া একধরনের বিরল এবং অস্বাভাবিক সামাজিক ফোবিয়া। এই ধরনের ফোবিয়া ভুক্তভোগীকে সমাজ থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং তার জীবনের, বিশেষ করে পেশাগত জীবনের ক্ষতি করে থাকে।
অ্যালোডক্সাফোবিয়ার কারণ
ফোবিয়ার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিই সাধারণত নিজেদের ভয়-ভীতির কথা বলতে চায় না। তা-ও কিছু কিছু মানুষ নিজেদের ভয়ের পেছনের কারণ জানান। এক্ষেত্রে মূলত অতীতের কোনো খারাপ ও আঘাতমূলক অভিজ্ঞতা দায়ী বলে জানা যায়। সবচাইতে দুঃখজনক বিষয় হলো মা-বাবা, শিক্ষক কিংবা পরিচিত জনের কারণেই মূলত উঠতি শিশুদের এই ফোবিয়ার সৃষ্টি হয়। সবসময় বা অতিরিক্ত খবরদারি বা সমালোচনা করলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে একজন ব্যক্তির উপর। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবহারের ফল হিসেবে মাঝে মাঝে অ্যালোডক্সাফোবিয়া লক্ষ্য করা যায়।
কৌতূহলশূন্য এবং অনুভূতিপ্রবণ ব্যক্তি, যারা সমালোচনা এবং প্রতিশোধের মতো বিষয়গুলোর প্রতি ভীত থাকে, তাদেরকেই এই ফোবিয়ার ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে এসব অপ্রিয় অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কের একটি অংশ এমিগডালায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে যেকোনো চাপে বা সমস্যায় পড়লে মস্তিষ্ক একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। এজন্য একজন ব্যক্তি নিজেকে নিরাপদ রাখতে নিজের অজান্তেই অন্যদের কাছ থেকে দূরে থাকা শুরু করে, যাতে করে অন্য কারো মতামত শোনা না লাগে।
যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা সামাজিক মাধ্যমও মতামত জানার এই ফোবিয়াকে বাড়িয়ে দিতে পারে। যেমন- খবরের কাগজ, টেলিভিশন এবং যেকোনো সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হওয়া যেকোনো মন্দ খবর অ্যালোডক্সাফোবিয়ার রোগীর জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার অনেক সময় এই ফোবিয়ার পেছনে দায়ী থাকে কোনো বংশগত ফ্যাক্টর বা জেনেটিক সমস্যা।
অ্যালোডক্সাফোবিয়ার লক্ষণসমূহ
এই ফোবিয়া হলে একজন ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণ দেখা যায়। অ্যালোডক্সাফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অবস্থা কারো মতামত শুনলে এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে এর ফলে সেই ব্যক্তি প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হতে পারে। আর মতটা যে সবসময় নেতিবাচক হয় তা-ও না। ইতিবাচক কোনো কথা শুনেও চটে যেতে পারে এই ফোবিয়ার শিকার কোনো ব্যক্তি। এর কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো ঘন ঘন হাত ঘামানো, অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বমি বমি ভাব এবং অকারণেই অসুস্থতা অনুভব করা।
এই ধরনের ফোবিয়া হলে রোগী ভালো বা খারাপ নির্বিশেষে সব রকমের মতামত শুনলেই রেগে যায়। অথবা এর উল্টোটাও হতে পারে। কারো কথা শুনতে হবে বা কেউ কি ভাবছে তা জানা লাগবে বলে কিছু অ্যালোডক্সাফোবিক ব্যক্তি সেসব স্থানে যাবেই না, যেখানে মত প্রকাশের কোনো সুযোগ থাকতে পারে। অর্থাৎ সামাজিক জীবনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে এই ফোবিয়া। আর এতে করে অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে এবং জীবনের ভালো সুযোগগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। তাছাড়া তাদের মধ্যে অনিরাপত্তা এবং আত্মসম্মানবোধের অভাবও লক্ষ্য করা যায়। একটি জরিপে দেখা যায়, ১৮ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে অ্যালোডক্সাফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেও রোগীদের সংখ্যা অনেক। সাধারণত নারীরা এই ফোবিয়ার শিকার বেশি হয়।
প্রতিকার
অ্যালোডক্সাফোবিয়ার কারণ জানা গেলে একজন ডাক্তার রোগীকে তার সমস্যা বা রোগ সেরে উঠতে সহায়তা করতে পারে। এর জন্য ব্যবহৃত থেরাপিগুলোর মধ্যে রয়েছে টক থেরাপি, সাইকোথেরাপিউটিক কাউন্সেলিং, গ্রুপ থেরাপি, সিস্টেমিক ডিসেন্টিসাইজেশন, হিপনোথেরাপি ইত্যাদি। এছাড়া অ্যালোডক্সাফোবিয়া কাটিয়ে তোলার সবচাইতে বড় অন্তরায় হলো রোগী নিজে থেকে প্রথমেই চিকিৎসা নিতে রাজি হন না। তবে এই সমস্যা সমাধানের তাগিদে রোগীর যথাযথ সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন যার জন্য পরিবারের সদস্যরা মূলত কাজ করতে পারে। একজন ফোবিককে নিজের সমস্যা বলার জন্যে উৎসাহিত করা উচিত। কেননা, অসুবিধা না বললে কখনো কারো সাহায্য করা সম্ভব নয়। অ্যালোডক্সাফোবিক ব্যক্তি প্রতিদিন তার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা ও মতামত পরিবার কিংবা আপনজনদের কাছে প্রকাশ করলে তার মধ্যে যে জড়তা কাজ করে তা কাটিয়ে তোলা সম্ভব হবে। এসব ছোট ছোট কাজই একজন ব্যক্তিকে প্যানিক না করে বড় কিছু মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে। একইসাথে একজন ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবেও গড়ে তোলে।
এই ফোবিয়ার আসলে নির্দিষ্ট বা সুষ্ঠু কোনো চিকিৎসা কিংবা ঔষধ আবিষ্কার হয়নি। এটা অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, যা সারানোর জন্য ধৈর্য এবং আশাবাদী থাকতে হবে। রোগী এবং রোগীর পরিবার উভয়ের জন্য এই কথা প্রযোজ্য। থেরাপিগুলোর মধ্যে ধ্যান করা, যোগ ব্যায়াম করা বা অন্য কোনো শারীরিক বা মানসিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত করার বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের সাথে এই বিষয়ে অবশ্যই কথা বলে পরামর্শ নেওয়া উচিত।