
কিছুদিন আগেও হতাশা ছিল বিলাসিতার অন্য নাম। মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও মানসিক অসুস্থতাকে খুবই কম সময়েই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তবে এখন আর সেই সময় নেই। দিন যত যাচ্ছে মানুষের মধে হতাশ হওয়ার পরিমাণ আরো বাড়ছে। বাড়ছে আত্মহত্যার মাত্রা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে পৃথিবীতে হতাশায় আক্রান্ত মোট ৩০০ মিলিয়ন মানুষ বাস করছে। ২০০৫ সালের পর থেকে এই বৃদ্ধির হার হুট করে ১৮ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এই সংখ্যাগুলো কেবল কিছু সংখ্যা নয়, বরং তার চাইতেও বেশি কিছু। শরীরে কোনো সমস্যা বোধ করলে তার নির্ধারক কিছু নির্দিষ্ট চিহ্ন আছে। কিন্তু হতাশ মানুষকে চিনে নেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু সেটা কি থাকা উচিত নয়? কীভাবে খুঁজে পাবেন একজন হতাশ মানুষকে? ভাষা হতে পারে এক্ষেত্রে একটি অন্যতম মাধ্যম।

হতাশার সাথে ভাষার সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন গবেষকেরা; Source: Workopolis
হতাশা এবং মানুষের ভাষার মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সেটা বুঝতে বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা। সত্যিই কি কোনো সম্পর্ক আছে এ দুটো ব্যাপারের মধ্যে? আমরা হতাশ হলে আমাদের ব্যবহৃত ভাষায় কি কোনো পরিবর্তন আসে? প্রত্যেকটি মানুষের কথা বলার, আবেগ প্রকাশের, অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগের নিজস্ব ভঙ্গী থাকে। হতাশা এই পুরো ব্যাপারটিকেই বদলে দেয়। এমনকি মানুষের চিন্তা-ভাবনার ভঙ্গীকেও বদলে দেয় হতাশা। প্রযুক্তি সম্প্রতি ভাষা এবং হতাশার মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীদের সাহায্য করেছে।
বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি

নেতিবাচক শব্দ; Source: LinkedIn
সম্প্রতি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণানুসারে, এমন কিছু শব্দ আছে যেগুলো একজন মানুষ হতাশ নাকি না সেটা বুঝতে সাহায্য করে। এই গবেষণা করতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিখিত তথ্যের উপরে বেশি নির্ভর করতে হয়েছে। সাথে ছিল মানুষের বলা কথাগুলোও। বিভিন্ন শিল্পীর হতাশামূলক পর্যায়ে ব্যবহার করা শব্দগুলোর উপরেও জোর দেওয়া হয়েছে।
এদিক দিয়ে দেখতে গেলে মোট দুটো ভাগে হতাশার সাথে ভাষার পরিবর্তনকে যুক্ত করা যায়। প্রথমটি হল- ভাষার শব্দে এবং দ্বিতীয়টি হল ভাষা ব্যবহারের পদ্ধতিতে। হতাশ অবস্থায় মানুষ যেমন কিছু শব্দ বেশি ব্যবহার করে, ঠিক তেমনি সবসময় ব্যবহৃত শব্দগুলোকে বলার ধরনেও খানিকটা পরিবর্তন আসে এই সময়। আর এটা শুনে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, হতাশাগ্রস্থ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহারের পরিমাণ বেশি থাকে। আপনিই বলুন তো, হতাশ অবস্থায় আপনি বারবার নিজেকে ‘একা লাগছে’ কিংবা ‘ভালো লাগছে না’ কথাগুলো বেশি বলে থাকেন না? আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সময়ে মানুষ সর্বনামের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ‘আমি’, ‘আমার’, ‘আমাকে’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। আর ‘তুমি’, ‘আপনি’, ‘তোমাদের’ কিংবা অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা কথার পরিমাণ কমে যায় তুলনামূলকভাবে। এই শব্দগুলো আরো বেশি করে বুঝতে সাহায্য করে যে, মানুষটি হতাশ অন্য কারো জীবন নিয়ে নয়, বরং নিজেকে নিয়ে। মানুষ নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের সমস্যা এবং সামাজিকভাবে সহজ না হতে পারার কারণে অনেক সময় হতাশ হয়ে পড়ে। আর এই ব্যাপারগুলোই হয়তো তাকে অন্যদের দিকে নয়, বরং নিজের দিকে মনোযোগ দিতে বেশি জোর দেয়। অন্য কারো কথা নয়, বরং নিজেকে নিয়ে তার চিন্তা বেড়ে যায়। চিন্তার জগতে বিশাল পরিবর্তনের কারণে এমন হয়ে থাকে, যার প্রকাশ হয় নানাভাবে এবং সেটা তৈরিও হয় বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই।

হতাশাগ্রস্থ মানুষ; Source: Huffington Post
অন্যদিকে কেবল শব্দ নয়, শব্দ ব্যবহারের পদ্ধতিও প্রকাশ করতে পারে একজন মানুষের হতাশা। আপনি হয়তো প্রতিদিন একটি শব্দ ব্যবহার করছেন। তবে এই স্বাভাবিক শব্দটিও আপনার বলার ভঙ্গী, গলার স্বরের কারণে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে আর প্রকাশ করতে পারে আপনার হতাশা। নির্দিষ্ট কিছু শব্দ আছে যেগুলোর ব্যবহার ইতিবাচক নির্দেশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তেমনি কিছু শব্দ আছে যেগুলো নেতিবাচক নির্দেশনা দেয়। এগুলোর মধ্যে আছে- ‘সবসময়’, ‘কিছু না’ ইত্যাদি শব্দ। মানসিক স্বাস্থ্য ফোরাম অনুসারে, এই শব্দগুলোর ব্যবহার ৫০% দেখা যায় হতাশ মানুষের মধ্যে। আর এই পরিমাণ বেড়ে ৮০% এ চলে যায় আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের বেলায়। গবেষণা চালানো হয়েছিল সেসব মানুষের উপরে যাদের জীবনে একটা সময় হতাশা এসেছে এবং সেই হতাশা কাটিয়ে তারা সামনে এগিয়েছেন। তবে তাদের ব্যবহৃত শব্দের মধ্যেও সেই নির্দিষ্ট কিছু শব্দকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে যেগুলো মানুষের আবেগ প্রকাশ করে। হতাশা প্রকাশ করে এমন শব্দের ব্যবহার এই মানুষগুলোর ভেতরে কম দেখা যায় উদ্বিগ্নতা এবং হতাশায় ভুক্তভোগীদের থেকে। তবে হতাশা থেকে কেউ পুরোপুরি বের হয়ে গিয়েছে সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব না। একবার হতাশায় ভুগেছেন এমন কারো আবার একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াটা অনেক বেশি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই আপনি যদি হতাশামূলক শব্দগুলো ব্যবহার না করে থাকেন, তবু প্রতিদিন লেখার চেষ্টা করা কিংবা কথা বলার সময় নিজের বলা কথার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এতে করে পুরনো সমস্যায় আবার ফিরে যাচ্ছেন কিনা সেটা বোঝা সহজ হবে।
হতাশার প্রতিরোধ

না বলা সবসময় নেতিবাচক নয়; Source: wikiHow
হতাশার প্রতিরোধ এই শব্দের ব্যবহারেই অনেকটা করে ফেলা সম্ভব। আপনার ব্যবহার করা শব্দগুলো আপনাকে সাহায্য করবে হতাশা থেকে মুক্তি পেতে। ভাষা থেকে হতাশ মানুষকে খুঁজে বের করা সম্ভব। তবে এই ক্ষেত্রে যন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে বর্তমানে। কিন্তু এটাই কি সব? যন্ত্রের সাহায্যে উপরে বর্ণিত ব্যাপারগুলো, এই যেমন- নেতিবাচক শব্দের মাত্রা, নেতিবাচক গলার স্বর ইত্যাদি নির্ণয় করা সম্ভব না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে অনেকের মতে, যে শব্দগুলোকে হতাশার প্রকাশক হিসেবে ধরে নেওয়া হয় সেগুলো মানুষ কেবল হতাশ অবস্থাতেই বলতে পারবে তা নয়। খুব স্বাভাবিক মানসিক অবস্থাতেও এই শব্দগুলো উচ্চারণ করা সম্ভব। মূলত, আপনি ঠিক কেমন বোধ করছেন সেটার উপরেই নির্ভর করে আপনার ব্যবহৃত শব্দটি হতাশা প্রকাশক হবে নাকি হবে না। পুরো বিষয়টিই যেহেতু মানসিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত, তাই বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনেক বেশি পরিমাণে হলেও সঠিকভাবে তার কোনো ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা এখানে নেই বললেই চলে।

ভাষার ব্যবহার নির্ভর করে যে ব্যবহার করছে তার উপরে; Source: livechatinc.com
অনেকে অবশ্য এই গবেষণাকে একেবারেই বাতিল করে দিতে চেয়েছেন। তাদের মতে, নেতিবাচক শব্দ সবসময় মানুষের মনের প্রতিফলন হতে পারে না। কোনো কারণ ছাড়াই অনেক সময় আমরা খুব খুশি হওয়ার পরেও বলে বসি ‘ভালো লাগছে না’। এর মানে এই না যে, আমরা হতাশ। এছাড়া, অনেকে লেখনীতে যেখানে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করেছেন সেটার অর্থ যে নেতিবাচক হবে সবসময় তা নয়। ‘কখনো’, ‘কখনোই না’ ইত্যাদি শব্দগুলো তালিকা অনুযায়ী হতাশামূলক হলেও এটি প্রয়োজনে ইতিবাচকভাবেও ব্যবহৃত হতে পারে। কোনো ভাব বোঝানোর জন্য। সেটা নেতিবাচক ভাব হতেই হবে এমন না। তাই এই পুরো ব্যাপারটিকে ঠিক ধরে নিয়ে না এগোনোর কথা বলেছেন এরা। আপনি কোন দলে? কী মনে হচ্ছে আপনার? কোনটা বেশি যুক্তিযুক্ত?
ফিচার ইমেজ: Huffington Post