Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আর্জেন্টিনার লড়াই শুধু ফ্রান্সের বিপক্ষে নয়, ইতিহাসের বিরুদ্ধেও

১.

কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা হয় না, তবে এরপরও সেই ঘটনা যখন বার বার ঘটে তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত ব্যাখ্যা খোঁজা শুরু করেন।

ক্রিকেটে পাকিস্তান বনাম ভারতের পরিসংখ্যানটা লক্ষ্য করুন। দুই দলের মুখোমুখি ১২৯ বার লড়াইয়ে চারটি ম্যাচে কোনো ফলাফল না আসলেও বাকি ম্যাচগুলোতে পাকিস্তানের জয় ৭৩টি আর ভারত ৫২ টিতে; সেটিও বিগত পাঁচ বছরে ভারতের এগিয়ে যাওয়া আর পাকিস্তানের পিছিয়ে থাকার সুবাদে

অথচ দুই দল যখন আইসিসি আয়োজিত ‘বিশ্ব’ নামধারী টুর্নামেন্টে অংশ নেয়, তখন কোনো এক বিচিত্র কারণে পাকিস্তান আর পেরে উঠে না। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান আর ভারত মুখোমুখি হয়েছে মোট ৬ বার, প্রতিবারই  ভারত জিতেছে। অথচ প্রতিটি টুর্নামেন্টে কিন্তু ভারত ফেভারিট ছিল না। ১৯৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হয় আর ভারত গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল। কিন্তু গ্রুপ পর্বের দেখায় ঠিকই পাকিস্তানকে হারিয়েছিল ভারত। ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও পাকিস্তান ফাইনাল খেলেছিল, আর ভারত বাদ পড়েছিল সুপার সিক্স থেকে। তবুও সুপার সিক্সের লড়াইয়ে পাকিস্তানকে হারিয়ে ছিল ভারত। শুধু ওয়ানডেতেই নয়, টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টেও ভারতের জয়জয়কার। পাঁচবারের দেখায় পাঁচবারই পাকিস্তানকে হারিয়েছে ভারত।

বিশ্বকাপে ভারত কখনোই হারেনি পাকিস্তানের কাছে; Source: livemint.com

এই হারের অনেক কারণই বের করা সম্ভব। তবে একটি কারণ বেশি উল্লেখযোগ্য, বিষয়টা এই মূহুর্তে মনস্তাত্ত্বিক হয়ে গেছে। পাকিস্তান যখনই বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামবে, তখন অতীত ইতিহাস তাদেরকে মানসিকভাবে কিছুটা হলেও পিছিয়ে দেবে। ঠিক একই কারণে অতীত ইতিহাস কিছুটা হলেও ভারতকে চাঙ্গা রাখবে।

এই জিনিসটাই হলো মনস্তাত্বিক লড়াই।

২.

প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বকাপের আজকের ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা কেন মনস্তাত্ত্বিকভাবে পিছিয়ে থাকবে? দুই দলের মুখোমুখি ১১টি লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা জয়ী ৬ বার আর ফ্রান্স ৩ বার; বাকি ২টি ম্যাচ ড্র হয়েছিল। বিশ্বকাপের ইতিহাসেও আর্জেন্টিনা এগিয়ে। ২ বারের লড়াইয়ে একটি করে জয় আর ড্র, কোনো হার নেই। এতসব ইতিহাস জানার পর মনস্তাত্ত্বিকভাবে অন্তত কাউকে এগিয়ে রাখতে হলে, সেটা নিশ্চয়ই ফ্রান্স নয়। দলগত শক্তি কিংবা বর্তমান টুর্নামেন্টের পারফর্মেন্সের হিসেবে আর্জেন্টিনার তুলনায় ফ্রান্সকে কিছুটা এগিয়ে রাখা গেলেও, আর্জেন্টিনার সমস্যা আসলে আর্জেন্টিনা নিজেই।

১৯৮৬ বিশ্বকাপে সর্বশেষ আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, পরের বিশ্বকাপে রানার্স আপ। ১৯৯৪ বিশ্বকাপেও ম্যারাডোনার উপস্থিতিতে শুরুটা দুর্দান্তই হয়েছিল। ম্যারাডোনার আচমকা বহিষ্কারের পর মনোবল হারিয়ে ফেলা আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় পর্বেই টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে। এরপর থেকে পাঁচটি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা কেবল মাত্র ১৯৯৮ বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে ইংল্যান্ডকে হারানো ছাড়া কোনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলকে হারাতে পারেনি।

৯৮ এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর আর কোন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা; Source: Sports Illustrated

১৯৯৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা গ্রুপ পর্যায়ে হারায় ক্রোয়েশিয়া, জাপান আর জ্যামাইকাকে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ইংল্যান্ডকে টাইব্রেকারে হারানোর পর কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ পড়ে নেদারল্যান্ডের কাছে। ২০০২ বিশ্বকাপে গ্রুপ থেকেই বাদ পড়ে যায়। গ্রুপ পর্বে তাদের সঙ্গী ছিল ইংল্যান্ড, সুইডেন আর নাইজেরিয়া। প্রথম ম্যাচ নাইজেরিয়ার সাথে জিতলেও ইংল্যান্ডের কাছে হারের পরেই আর্জেন্টিনা চাপে পড়ে। শেষ ম্যাচে এই চাপে পড়া দলটিকে হারিয়ে দেয় সুইডেন।

২০০৬ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট আর সার্বিয়াকে হারিয়ে পরের পর্বে যায় আর্জেন্টিনা। সেখানে দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোকে হারালেও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানদের সাথে টাইব্রেকারে বাদ পড়ে। ২০১০ বিশ্বকাপে গ্রুপে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া আর গ্রিসকে হারিয়ে দ্বিতীয় পর্বে মুখোমুখি হয় আবার মেক্সিকোর। মেক্সিকোকে হারাতে পারলেও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানদের কাছে ৪-০ গোলের একটা হার মেনে নিতে হয় তাদের। ২০১৪ বিশ্বকাপেও গ্রুপে মুখোমুখি হয়ে বসনিয়া, ইরান আর নাইজেরিয়াকে হারায় তারা। দ্বিতীয় পর্বে সুইজারল্যান্ড আর কোয়ার্টারে বেলজিয়ামকে হারিয়ে সেমিতে নেদারল্যান্ডের সাথে জয় পায় টাইব্রেকারে। কিন্তু ফাইনালে জার্মানির কাছে আবার হেরে যায়।

এতদিন পর আবার সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের বিপক্ষে নামার সময় আর্জেন্টিনার মনে একটু দুশ্চিন্তা আসলেও সেটিকে দোষ দেওয়া যাবে না।

৩.

এ তো গেলো দলগত বিষয়, ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ও আজ কাজ করবে। ভাঙাচোরা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফ্রান্স নিশ্চিতভাবেই ফেভারিট। তবে বিশ্বকাপে ফেভারিট দলকে হারানোর রেকর্ড অতীতে প্রচুর রয়েছে। সেক্ষেত্রে কেবল কোনো একজন নায়ককে অতিমানবীয় পারফর্মেন্স করতে হবে। সেই রকম একজন নায়ক আর্জেন্টিনাতে ইতিমধ্যেই রয়েছে, তার নাম লিওনেল মেসি। আর বাকি থাকে পারফর্মেন্স।

সমস্যাটা এখানেই। লিওনেল মেসি খুব দুর্দান্ত খেলোয়াড় হলেও, কোনো এক অজানা কারণে বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে এখনো তিনি গোলের খাতা খুলতে পারেননি। অথচ এর আগেই তার তিনটি বিশ্বকাপ খেলা হয়ে গেছে। ২০০৬ এর নক আউট রাউন্ডে অবশ্য খুব বেশি সুযোগ তিনি পাননি। দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোর বিপক্ষে ম্যাচের ৮৪তম মিনিটে বদলী হিসেবে যখন মাঠে নেমেছিলেন লিও, তখন ম্যাচের স্কোরলাইন ১-১। আর্জেন্টিনা শেষপর্যন্ত রদ্রিগেজের অতিরিক্ত সময়ের গোলে জয়লাভ করেছিল। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষের ম্যাচটিতে মেসিকে নামানো হয়নি। আজও সেই ম্যাচ হারার পেছনে আর্জেন্টাইন ভক্তরা পেকারম্যানের এই সিদ্ধান্তকেও দায়ী করে থাকে।

২০০২ বিশ্বকাপে প্রথম পর্বেই বাদ পড়ার পর হতাশা; Source: elintransigente.com

২০১০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোকে ৩-১ গোলে হারালেও কোনো গোল পাননি লিওনেল মেসি। কোয়ার্টার ফাইনালের জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচটিতেও স্বাভাবিকভাবে কোনো গোল তিনি পাননি।

২০১৪ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচের অ্যাসিস্টটি ছিল মেসির। কোয়ার্টারে আর্জেন্টিনা জিতে বেলজিয়ামের বিপক্ষে হিগুয়েনের একমাত্র গোলে। সেমিতে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে গোলশূন্য ম্যাচ জিতে টাইব্রেকারে আর ফাইনালে জার্মানির কাছে হারে ১-০ গোলে।

খুব কাছাকাছি গিয়েছিল ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে; Source: diariodecuyo.com.ar

নক আউটে ৭টি ম্যাচ পাওয়া সত্ত্বেও একটি গোলও না পাওয়াটা মেসির মতো খেলোয়াড়ের সাথে ঠিক মানানসই নয়।

এই বিষয়টি কি লিওনেল মেসিকে একটুও চাপে রাখবে না?

৪.

একজন অ্যাথলেটের জন্য চাপ প্রতিনিয়তই সঙ্গী। তবে অতিরিক্ত চাপের সাথে অনেক খেলোয়াড়েরই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। একজন খেলোয়াড় যত বড় চাপকে ভালোভাবে সামাল দিতে পারবেন, তিনি গ্রেটনেসের দিকে ততটাই এগিয়ে যাবেন।

লিওনেল মেসি কি সেরকম গ্রেট?

ফ্রান্সের প্রজন্মটা অসম্ভব প্রতিশ্রুতিশীল; Source: WSB Blog – World Sports Betting

লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়ের গ্রেটনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বোকামি। অতীতে ইংলিশ ক্লাব চেলসির বিপক্ষে মেসির গোল না পাওয়া নিয়েও অনেক সমালোচনা করা হয়েছিল। গত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আগ পর্যন্ত চেলসির বিপক্ষে আটটি ম্যাচে কোনো গোল করতে পারেননি। গত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় পর্বে যখন বার্সেলোনা আর চেলসি মুখোমুখি হলো, তখন কোন দল জয়ী হবে সেটির আগে যেন মিডিয়া মেতে উঠলো মেসি গোল পাবেন কিনা সেটা নিয়ে।

প্রথম লেগে চেলসির মাঠে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে বার্সার পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন মেসি। এরপর দ্বিতীয় লেগে চেলসিকে ৩-০ গোলে হারানো ম্যাচের দুটো গোলই মেসির।

চেলসির বিপক্ষে গোলখরার সমালোচনার জবাবটা দূর্দান্ত ভাবেই দিয়েছিলেন লিওনেল মেসি; Source: FC Barcelona

কাজেই লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে কখনো অনুমান করা যায় না। যেকোনো অনুমানকে ভুল প্রমাণ করার অদ্ভুত শক্তি তাদের মতো খেলোয়াড়ের খুব ভালোভাবেই রয়েছে।

বিশ্বকাপের নক আউট ম্যাচে গোল করার জন্য আজকের ম্যাচটিকেই বেছে নিলে ফ্রান্সকে হয়তো দুর্দান্ত একটা প্রতিশ্রুতিশীল স্কোয়াড নিয়ে দ্বিতীয় পর্বেই থেমে যেতে হবে।

৫.

ইতিহাস সবসময়েই এগিয়ে থাকা দলকে অনুপ্রেরণা দেয় আবার পেছনে থাকা দলকে দেয় অস্বস্তির অনুভূতি। তবে খেলার মাঠে যখন দুই দল নামবে, তখন ইতিহাসকে পেছনে ফেলেই নামবে। আর ইতিহাস পাল্টান গ্রেট খেলোয়াড়রাই।

মেসি যে ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়, সেটির প্রমাণ তিনি বহুবার দিয়েছেন ক্যারিয়ারে। কিন্তু মেসির কাছ থেকে বিশ্বকাপে একটি গ্রেট পারফর্মেন্স যেন পাওনা রয়ে গিয়েছে। বয়স যা হয়েছে, তাতে এটিই হয়তো মেসির শেষ বিশ্বকাপ।

তবে কি তাহলে মেসি আর আর্জেন্টিনা ইতিহাস ভাঙতে চলেছে? উত্তর মিলবে আজ রাতেই।

ফিচার ইমেজ: Anepress 

Related Articles