Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পাওলো রসি: নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরেই বিশ্বজয়ের গল্প

ফুটবলের সবচেয়ে আকাঙ্খিত ট্রফি অবশ্যই বিশ্বকাপ, ১৮ ক্যারট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি ৩৬.৮ সেন্টিমিটারের এই ট্রফি ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন প্রতি ফুটবলারেরই থাকে। তবে পুসকাস, ক্রুইফ, প্লাতিনি, জিকোর মতো অনেক লিজেন্ডই আছেন যারা বহু চেষ্টা করে এই বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। এমন মহারথীরা নিজেদের সামর্থ্যের পুরোটা দেওয়ার সুযোগ পেয়েও যেখানে বিশ্বকাপ জিততে পারেননি, সেখানে এমন একজন ফুটবলার আছেন যিনি কিনা বিশ্বকাপ শুরুর আগে দুইবছর ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকাপের ঠিক আগমুহূর্তে দলে ফিরে এসে দলকে বিশ্বকাপ জেতানোর ব্যাপারে রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তিনি ইতালিয়ান স্ট্রাইকার পাওলো রসি। আজ আমরা তার ক্যারিয়ারের আদ্যোপান্ত নিয়েই জানবো, জানবো কিভাবে খাদের কিনারা থেকে ফিরে করেছিলেন বিশ্বজয়।

প্রাথমিক ক্যারিয়ার

পাওলো রসির জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ইতালির প্রাটোতে। মাত্র ছ’বছর বয়স থেকেই ফুটবলে হাতেখড়ি রসির, সেসময়ে অবসরে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতে গিয়েই একসময় এই খেলার নেশায় বুঁদ হয়ে যান। একপর্যায়ে রসির জীবন পড়ালেখা ও ফুটবল- এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সান্টা লুসিয়ায় খেলতে খেলতেই আস্তে আস্তে পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার দিকে ঝুঁকতে থাকেন। এরপর অ্যাম্ব্রোসনিয়ায় কিছুদিন খেলার পর চলে যান ফ্লোরেন্সের ক্যাটোলিকা ভার্চুসে।

১৬ বছর বয়সে ক্যাটোলিকার হয়ে শিয়েতি টুর্নামেন্ট খেলার সময়েই জুভেন্টাসের তৎকালীন ম্যানেজার ইতালো অ্যালোডির নজরে পড়ে যান। জুভেন্টাস ম্যানেজারে সেসময়েই তাকে জুভেন্টাস জুনিয়র টিমের জন্য দলে ভেড়াতে চাইলেও রসির বাবা-মা তাদের ছেলেকে দূরের এক শহরে একা পাঠাতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। শেষপর্যন্ত রসির জেদের কাছে হার মানেন তার বাবা-মা, জুভেন্টাসের হাত ধরেই রসির পেশাদার ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়।

এ ব্যাপারে রসি বলেন “বাবা-মা কখনোই চাননি আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে ফুটবলের দিকে ঝুঁকে পড়ি। কিন্তু জুভেন্টাসের অফারটা আসার পর থেকেই ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম আর বুঝতে পারলাম ফুটবলই আমার জীবনের সবকিছু, এই স্বপ্নই আমাকে পরবর্তী পর্যায়ে যেতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।

কিন্তু পাওলো রসি সেসময়ে শারীরিকভাবে পেশাদার ফুটবলের জন্য পুরোপুরি তৈরি ছিলেন না, জুভেন্টাসে যোগদানের পরে তিনটি ইনজুরির কারণে দুই সিজন মাঠের বাইরেই কাটাতে হয়। শেষপর্যন্ত ১৯৭৪ সালে কোপা ইতালিয়ার এক ম্যাচে জুভেন্টাসের হয়ে অভিষেক ঘটে রসির। এরপর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাকে আরেক ইতালিয়ান ক্লাব কমোয় লোনে পাঠায় জুভেন্টাস, সেখানে সিরি আ অভিষেক ঘটে রসির, তবে কমোয় ছয় ম্যাচ খেলেও গোলের দেখা রসি পাননি।

ভিসেঞ্জায় নিজেকে প্রমাণ করা

১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে তৎকালীন সিরি বি এর ক্লাব ভিসেঞ্জায় লোনে যোগদান করেন রসি আর এই ভিসেঞ্জা অধ্যায়ই হয়ে যায় রসির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রসি মূলত রাইট উইঙ্গার হিসেবেই খেলতেন। কিন্তু তৎকালীন কোচ জিওভান বাতিস্তা ২০ বছরের রসির মধ্যে একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার হওয়ার অমিয় প্রতিভা খুঁজে পান এবং রসিকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানো শুরু করেন।

রসির ফুটবল ক্যারিয়ারে বাতিস্তার ভূমিকা ছিল বাবার মতো। বাতিস্তার ব্যাপারে রসি বলেন,মানুষ হিসেবে উনি ছিলেন অসাধারণ, আমি যাতে নতুন ক্লাবে এসে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারি, সেব্যাপারে সবকিছু তিনি করেছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম আমাকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলেন যা আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। বাবা যেমন ছেলেকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায় সেভাবেই বাতিস্তা আমাকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়েছিলেন।”

ভিসেঞ্জার কোচ জিওভান বাতিস্তার সাথে পাওলো রসি; Source : paolorossiacademy.com

রসির বলা একটা কথাও যে অত্যুক্তি ছিল না সেটার প্রমাণ পরিসংখ্যান বেশ ভালোভাবেই দেয়। আগের সিজনগুলোতে যে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলো, সেই রসিই ভিসেঞ্জায় নিজের প্রথম সিজনে করেন ২১ গোল, জিতে নেন সিরি বি এর গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। রসির এই পারফর্মেন্সের উপর ভর করেই ভিসেঞ্জা সিরি বি থেকে সিরি আ-তে উন্নীত হয়। তবে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল রসি স্ট্রাইকার হিসেবে নিজের প্রথম সিজনেই এমন সাফল্য পাবেন, এটা সম্ভবত তিনি নিজেও ভাবেননি। আসলে রসি শক্তির দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও তার ছিল গতি, অসাধারণ পজিশনিং সেন্স আর নিখুঁত শুটিং পাওয়ার। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলো দু’পায়েই শট নেওয়ার দক্ষতা। এ সবকিছুই রসিকে একজন পারফেক্ট স্ট্রাইকার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিলো।

ভিসেঞ্জাকে সিরি বি থেকে সিরি আ-তে তোলার পর সেখানেও গোলের ঝড় তোলেন পাওলো রসি। ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে ২৪ গোল করে জিতে নেন সিরি আ’র গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। পাওলো রসিই ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার যিনি টানা দুই মৌসুমে সিরি বি ও সিরি আ এর গোল্ডেন বুটের পুরস্কার জিতেছিলেন। রসির এই অতিমানবীয় পারফর্মেন্সের উপর ভর করেই সদ্য সিরি বি থেকে উঠে আসা ভিসেঞ্জা সেই মৌসুম শেষ করে সিরি আ এর রানার্স আপ হিসেবে!

আজ্জুরিদের হয়ে অভিষেক ও ১৯৭৮ বিশ্বকাপ

ক্লাবের হয়ে টানা দুই মৌসুমে গোল্ডেন বুট জয়ের পুরষ্কার হিসেবে ১৯৭৭ সালে রসি প্রথমবারের মতো ইতালি জাতীয় দলে ডাক পান। এনজো বেয়ারজটের অধীনে নিজের অভিষেক ম্যাচে বেলজিয়ামের বিপক্ষে তিনি গোল না পেলেও ইতালি ঠিকই ম্যাচটা জিতে নেয় ১-০ গোলে। ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলার কারণে এনজোর ১৯৭৮ বিশ্বকাপ দলেও সুযোগ পেয়ে যান পাওলো রসি। সেবার ফ্রাঙ্কো কসিও আর রবার্তো বেতেগার সাথে তার অ্যাটাকিং ট্রায়ো ছিল সেসময়ের অন্যতম বিধ্বংসী অ্যাটাকিং লাইনাপ। বিশ্বকাপে নিজের অভিষেক ম্যাচেই ফ্রান্সের বিপক্ষে গোল পান রসি, জাতীয় দলের হয়ে এটিই ছিল তার প্রথম গোল। ম্যাচটা ইতালি জিতে নেয় ২-১ গোলে। পরের ম্যাচে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ইতালি জয় পায় ৩-১ গোলে, এই ম্যাচেও দলের হয়ে প্রথম গোলটি করেন রসি।

জাতীয় দলে সতীর্থ অ্যান্টনিও ক্যাব্রিনির সাথে পাওলো রসি; Source: forza27.com

গ্রুপপর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে স্বাগতিক আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে সব ম্যাচ জিতেই দ্বিতীয় রাউন্ডে যায় ইতালি। এই ম্যাচে অবশ্য রসি কোনো গোল পাননি। দ্বিতীয় পর্বের নিজেদের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রিয়ার মুখোমুখি হয় ইতালি, রসির একমাত্র গোলে ১-০ গোলে ম্যাচটি জিতে নেয় ইতালি। পরের ম্যাচে সেসময়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পশ্চিম জার্মানির মুখোমুখি হয় ইতালি। এ ম্যাচে রসি কোনো গোল পাননি, আর ইতালিও ডেডলক ভাঙ্গতে না পেরে ম্যাচটা গোলশূন্য ড্র করে। দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচে ইতালি মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ডসের। পরের রাউন্ডে যেতে হলে ইতালির সামনে জয় ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এই ম্যাচে রসি জ্বলে উঠতে পারেননি। ইতালিও ডাচদের কাছে ২-১ গোলে হেরে গেলে সেবার আর ফাইনাল খেলা হয়নি রসিদের। দল ফাইনালে না উঠলেও ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের জন্য রসি জিতে নেন সিলভার বলের পুরস্কার। এছাড়া সেবার বিশ্বকাপের সেরা একাদশেও সুযোগ পান রসি।

টোটোনেরো কেলেঙ্কারিতে  জড়িয়ে পড়া এবং ক্যারিয়ারে ছন্দপতন 

বিশ্বকাপ পরবর্তী ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ভিসেঞ্জার হয়ে আগের দুই সিজনের মতো বিধ্বংসী ফর্মে না থাকলেও লিগে ঠিকই ২৮ ম্যাচে ১৫ গোল করেছিলেন। তবে আগের মৌসুমে লিগে রানার্স আপ হয়ে ইতিহাস গড়া ভিসেঞ্জা সেই মৌসুমে রেলিগেটেড হয়ে যায়। সিরি আ-তে খেলা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রসি ১৯৭৯-৮০ মৌসুমে পেরুগিয়াতে লোনে খেলতে যান এবং সেই মৌসুমে ১৩ গোল করেন।

পেরুগিয়ার হয়ে খেলার সময়ে পাওলো রসি; Source: indiscreto

তবে পেরুগিয়াতে খেলতে আসাটাই রসির জীবনে একটা কালো অধ্যায় বয়ে নিয়ে আসে। ১৯৮০ সালে ম্যাচ গড়াপেটায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় সাতটি ইতালিয়ান ক্লাব। ম্যাচ গড়াপেটার এই ঐতিহাসিক ঘটনা টোটোনেরো কেলেঙ্কারি  নামেই পরিচিত। আর এই কেলেঙ্কারিতে রসির তখনকার ক্লাব পেরুগিয়াও জড়িত ছিল। ম্যাচ গড়াপেটার দায়ে শুধু ক্লাব না, ক্লাবের খেলোয়াড় ও ম্যানেজাররাও বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি পান, যার মধ্যে পাওলো রসির নামও ছিল।

যদিও রসি সবসময়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন, কিন্তু ইতালির ফুটবল ফেডারেশন তাকে ম্যাচ গড়াপেটার দায়ে তিন বছরের জন্য সবধরনের ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করে। ফলে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় ১৯৮০ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সেবার আর খেলা হয়নি রসির। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ হওয়ায় ১৯৮২ বিশ্বকাপে খেলাটাও একরম অসম্ভবই হয়ে যায় রসির জন্য। ক্যারিয়ারের সূর্য যখন মধ্যগগনে ছিল, তখন এই অপ্রত্যাশিত কালো মেঘের ছায়ায় সবকিছু নিকষ অন্ধকারে ঢেকে যায়।

নিষেধাজ্ঞার কারণে পুরো ১৯৮০-৮১ মৌসুম ফুটবল মাঠ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিলো রসিকে। তবে এই দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়ায় পুরনো ক্লাব জুভেন্টাস। ১৯৮১-৮২ মৌসুমের একদম শেষদিকে বিশ্বকাপে খেলার কথা বিবেচনা করে ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন রসির নিষেধাজ্ঞা এক বছর কমিয়ে আনে, যার ফলে সেই মৌসুমের শেষ তিন ম্যাচে জুভেন্টাসের হয়ে মাঠে নামার সুযোগ পান রসি। বিশ্বকাপের আগে দুই মৌসুমে মাত্র তিন ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও ইতালিয়ান কোচ এনজো বেয়ারজট রসির উপরেই আস্থা রাখেন এবং তাকে ১৯৮২ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ করে দেন।

১৯৮২ বিশ্বকাপ এবং সেই রূপকথার সৃষ্টি

এনজোর আস্থার কারণে বিশ্বকাপে সুযোগ পেলেও গ্রুপপর্বে সেই আস্থার মর্যাদা একদমই দিতে পারেননি রসি। গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচ খেলে গোলের খাতা খুলতে ব্যর্থ রসি! নিজের দল ইতালির অবস্থাও তথৈবচ। তিন ম্যাচে তিন পয়েন্ট নিয়ে কোনোমতে গ্রুপ রানার্স আপ হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের ছাড়পত্র পায় ইতালি। গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলোতে রসির অবস্থা এতটাই শোচনীয় ছিল যে ইতালির এক সাংবাদিক মন্তব্য করেন “রসির খেলা দেখে মনে হচ্ছে একটা ভূত উদ্দেশ্যহীনভাবে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে।” 

দ্বিতীয় রাউন্ডে ইতালি গ্রুপসঙ্গী হিসেবে পায় এর আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা ও ‘৮২ বিশ্বকাপের হট ফেভারিট ব্রাজিলকে। আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারায় ইতালি। তবে ঐম্যাচেও গোলশূন্য ছিলেন রসি। অন্য ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে হারায় ব্রাজিল, যার ফলে শেষ ম্যাচে সমীকরণ এমন দাঁড়ায় যে সেমিফাইনালে যেতে হলে ইতালিকে ব্রাজিলের বিপক্ষে জিততেই হবে। অন্যদিকে ম্যাচটা ড্র করলেই ব্রাজিল উঠে যেত পরের রাউন্ডে।

সেবারের ব্রাজিল দলটাকে বলা হচ্ছিলো ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল আর ইতালির ছন্নছাড়া অবস্থার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তাই ইতালির ঘোরতর সমর্থকরাও জয়ের কথা জোর গলায় বলতে পারছিলো না। এমন বড় ম্যাচের আগে মিডিয়া সরব হয়ে ওঠে আগের চার ম্যাচে গোলের দেখা না পাওয়া পাওলো রসিকে একাদশ থেকে বাদ দেওয়ার জন্য। কিন্তু এনজো তার শিষ্যের উপর থেকে আস্থা হারাননি। আগের চার ম্যাচে কোচের আস্থার মান রসি দিতে পারেননি, কিন্তু এ ম্যাচে সব পাশার দান উল্টে দেন রসি নিজেই।

খেলার শুরু থেকেই ইতালিকে চেপে ধরে ব্রাজিল। কিন্তু খেলার ৫ মিনিটে অ্যান্টোনিও ক্যাব্রিনির ক্রসে মাথা ছুঁইয়ে ইতালিকে ১-০ তে এগিয়ে নেন রসি। এই গোলটি রসির আত্মবিশ্বাসের পারদকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিলো। এ ব্যাপারে তিনি বলেন “প্রথম গোলটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই গোলটার পরেই সবকিছু কল্পনাতীতভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেলো। ওই গোলটার আগে কোনোকিছুই আমার পক্ষে যাচ্ছিলো না। কিন্তু ওই গোলটার পরে সবকিছুই যেন আমার পক্ষে যাওয়া শুরু করলো। একটা গোল সবকিছু পরিবর্তন করে দিতে দিতে পারে আর আমার ক্ষেত্রে ওটা আমার পুরো জীবনকেই বদলে দিয়েছিলো। এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য।”

১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে পাওলো রসি; Source: paolorossiacademy.com

রসির একটা কথাও যে অত্যুক্তি না তা ওই ম্যাচের বাকি অংশ দেখলেই বোঝা যায়। ১২ মিনিটে সক্রেটিস ব্রাজিলকে সমতায় ফেরালেও ২৫ মিনিটের মাথায় আবারো রসির ম্যাজিক! এবার ব্রাজিলের ফ্যালকাওয়ের ভুল পাস থেকে বল পেয়ে অসাধারণ এক শটে গোল করে ২-১ ব্যবধানে ইতালিকে এগিয়ে দেন রসি। তবে ৬৮ মিনিটে দূরপাল্লার এক শটে ফ্যালকাও গোল করে ২-২ স্কোরলাইন করলে ইতালির সেমিফাইনালের স্বপ্ন প্রায় ভাঙ্গতে বসেছিলো।

কিন্তু আগের চারম্যাচে ভূত হয়ে থাকা রসি যে এ ম্যাচে ফিরেছিলেন স্বর্গের দূত হয়েই তার প্রমাণ বিশ্ববাসী পেলো খেলার ৭৪ মিনিটে। মার্কো তারদেল্লির পাস থেকে আনমার্কড রসি গোল করে ইতালিকে এগিয়ে নেন ৩-২ গোলে আর পূরণ করেন নিজের হ্যাটট্রিক। যে রসি আগের চার ম্যাচে একটাও গোল করতে পারেননি, সেই তিনিই এমন বাঁচা-মরার ম্যাচে করলেন হ্যাটট্রিক! রসির এই গোলেই সর্বকালের অন্যতম সেরা দলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায় ইতালি। আর যে রসিকে বাদ দেওয়ার জন্য মিডিয়া উঠেপড়ে লেগেছিলো, সেই তারই প্রশংসাতে পঞ্চমুখ হয়ে যায় সকল সংবাদমাধ্যম!

হট ফেভারিট ব্রাজিলকে বিদায় করার পর পুরো ইতালি দলের মনোভাবই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। এ ব্যাপারে রসি বলেন, “ব্রাজিলকে হারানোর পর আমাদের আত্মবিশ্বাস একদম চূড়ায় উঠে গিয়েছিলো, মনে হচ্ছিলো বিশ্বের যেকোনো দলকেই আমরা হারাতে পারি। যদিও তখনো সেমিফাইনাল আর ফাইনাল বাকি ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিলো ঐ দুইটা ম্যাচ শুধুই আনুষ্ঠানিকতার জন্যই।”

সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের মুখোমুখি হয় ইতালি আর সেখানেও পাওলো রসির ম্যাজিক, রসির জোড়া গোলে ভর করে পোলিশদের ২-০ গোলে হারিয়ে ইতালি চলে যায় ফাইনালে।

সেমিফাইনালে পোল্যান্ডের বিপক্ষে গোল করার পর পাওলো রসি; Source: paolorossiacademy.com

ফাইনালে ইতালির প্রতিপক্ষ ছিল তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি। দু’দলের সামনেই ব্রাজিলের তিন বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ডে ভাগ বসানোর হাতছানি। খেলার প্রথমার্ধ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে, দ্বিতীয়ার্ধের ৫৭ মিনিটে ডেডলক ভাঙ্গেন পাওলো রসি, অ্যান্টনিও ক্যাব্রিনির ক্রস বাউন্স খেয়ে রসির কাছে এলে তাতে জালে জড়িয়ে দলকে ১-০ তে এগিয়ে নেন রসি।

ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে গোল করার পর রসি; Source: paolorossiacademy.com

রসির গোলের পর পুরো ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ইতালির কাছে চলে যায়। এরপর তারদেল্লি ও অ্যাল্টোবেলির গোলে ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত হয় ইতালির আর এর সাথে সাথে নিশ্চিত হয় ইতালির তৃতীয়বারের মতন বিশ্বজয়। যে রসির বিশ্বকাপই খেলার কথা ছিল না, যিনি কিনা প্রথম চার ম্যাচে কোনো গোলই পাননি, সেই রসি শেষ তিনটা বাঁচা-মরার ম্যাচে ছয় গোল করে জিতে নেন ওই আসরের গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। শুধু তা-ই নয়, টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়ে গোল্ডেন বলও জিতে নেন পাওলো রসি। গারিঞ্চা ও মারিও কেম্পেসের পরে মাত্র তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একইসাথে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড় হওয়ার গৌরব অর্জন করেন পাওলো রসি।

বিশ্বকাপ হাতে রসি; Source : Goal.com

তবে এসব ব্যক্তিগত পুরস্কারের চেয়েও রসির কাছে মূল্যবান ছিল দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে পারাটা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যেদিন থেকে ফুটবল খেলতে শুরু করেছি সেদিন থেকে দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আসলে বিশ্বকাপ জয়ের ফলে এতগুলো মানুষকে খুশি করতে পেরে যেই তৃপ্তি পেয়েছি সেটার কাছে ব্যক্তিগত সমস্ত অর্জন তুচ্ছ।”

এভাবেই ১৯৮২ বিশ্বকাপের মাধ্যমে খলনায়ক থেকে আবারো জনতার নায়কে পরিণত হন পাওলো রসি। বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফর্মেন্সের সুবাদে রসি সেই বছর জিতে নেন উয়েফা ব্যালন ডি অর এবং ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।

রূপকথা পরবর্তী অধ্যায়

বিশ্বকাপ শেষে রসি ফিরে যান জুভেন্টাসে, সেবার ১৯৮২-৮৩ সিজনে জুভেন্টাস রানার্স আপ হলেও কোপা ইতালিয়ার শিরোপা ঠিকই ঘরে তুলে নেয় জুভেন্টাস। তবে সেবার রসি আসল খেলাটা দেখান ইউরোপিয়ান কাপে, ছয় গোল করে জুভেন্টাসকে নিয়ে যান টুর্নামেন্টের ফাইনালে। তবে ফাইনালে রসি আর গোল করতে পারেননি আর জুভেন্টাসেরও শিরোপা জেতা হয়নি। হামবুর্গের কাছে ১-০ গোলে হেরে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় রসির জুভেন্টাসকে। পরের সিজনে জুভেন্টাসের হয়ে আবারো স্কুদেত্তোর শিরোপা জিতেন রসি আর জুভেন্টাসে নিজের শেষ সিজন ১৯৮৪-৮৫ তে তিনি স্বাদ পান ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের।

জুভেন্টাসের জার্সি গায়ে রসি (সবার ডানে); Source: paolorossiacademy.com

এরপরেই নিজের কৈশোরের ক্লাব জুভেন্টাস ছেড়ে মিলানে পাড়ি জমান রসি। তবে মিলানে ১৯৮৫-৮৬ মৌসুম খেলে তেমন সুবিধা করতে পারেননি তিনি। লিগে ২০ ম্যাচ খেলে মাত্র দুই গোল করেন রসি। আসলে বয়সের প্রভাবে রসি তখন তার স্বাভাবিক ছন্দ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলো। এরপরেও পুরনো কোচ এনজো বেয়ারজট ১৯৮৬ বিশ্বকাপ দলে রসিকে ঠিকই দলে রেখেছিলেন। কিন্তু ইনজুরির জন্য সেবার আর বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তার। সেবার ইনজুরির কারণে বাদ পড়ার পর আর জাতীয় দলে খেলা হয়নি রসির। ফলে চীনের বিপক্ষে ঘরের মাঠে খেলা প্রীতি ম্যাচটাই হয়ে যায় তার জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচ।

মিলানের জার্সি গায়ে রসি; Source: paolorossiacademy.com

বর্ণিল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি

মিলানের হয়ে এক সিজন খেলার পরে রসি চলে যান হেলাস ভেরোনায়।  ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে  হেলোস ভেরোনার হয়ে খেলার পরেই সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। সান্টা লুসিয়া থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেটা শেষ হয়ে হেলোস ভেরোনায়, আর এর মাঝামাঝি সময়ের বহু সাফল্যে পাওলো রসির অর্জনের ঝুলিটা দিনশেষে বেশ ভারিই ছিল।

ক্লাব ফুটবলে সিরি বি, সিরি আ ও ইউরোপিয়ান কাপে জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট, জুভেন্টাসের হয়ে দুটি স্কুদেত্তো জয়ের পাশাপাশি জিতেছিলেন ইউরোপিয়ান কাপের শিরোপাও। ইতালি জাতীয় দলের হয়ে ৪৮ ম্যাচে ২০ গোল করেছিলেন রসি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ইনজুরির জন্য মিস করলেও আগের দুই বিশ্বকাপে ১৪ ম্যাচে ৯ গোল করে ব্যাজিও আর ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরির সাথে যৌথভাবে বিশ্বকাপে ইতালির হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড এখনও দখল করে আছেন। তবে এতসব রেকর্ডের চেয়ে রসির কাছে সবচেয়ে সম্মানজনক অর্জন নিশ্চয়ই ১৯৮২ বিশ্বকাপ জয়।

প্রায় ৮৮ বছরের ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে ফুটবল বিশ্ব অনেক রূপকথা দেখেছে, প্রত্যক্ষ করেছে অনেক হৃদয় ভাঙ্গার গল্প। কিন্তু ব্যক্তিগত গল্পের কথা বললে পাওলো রসির সেই অসাধারণ প্রত্যাবর্তন বাকি সব খেলোয়াড়ের ফিরে আসার গল্পকেই ছাড়িয়ে যাবে। ১৯৮২ বিশ্বকাপ অনেকের কাছেই একটা ট্রাজেডির নাম, যেখানে সর্বকালের অন্যতম সেরা দল ব্রাজিলের হারে জোগো বনিতার মৃত্যু হয়েছিলো। কিন্তু সেই দুঃখগাঁথার অন্যপ্রান্তে ধ্রুবতারার মতন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ২ বছর মাঠের বাইরে থেকেও বিশ্বকাপে রসির অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের গল্প। জীবনে চলার পথে কেউ আশা হারিয়ে ফেললে পাওলো রসির গল্প শুনতেই পারেন, তাহলে হয়তো চূড়ান্ত হতাশ মানুষও আবার আশা ফিরে পাবেন, সব বাঁধা অতিক্রম করে রসির মতোই তৈরি করতে পারবেন সাফল্যের রূপকথা।

 

 

Featured Image: oexplorador.com

For references please check the hyperlinks inside the article.

Description: This article is in Bangla language. It's an article about a famous Italian footballer named Paolo Rossi

Related Articles