“এটা কোনো কাজ করলো! এমন একটা ম্যাচ দেবে মিরপুরে, তা নয় বিকেএসপিতে এত দূরে এই খেলা দেখতে আসলাম”।
আবাহনী লিমিটেড কেবলই লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের বিপক্ষে ৩৭৪ রান তুলে ড্রেসিংরুমে ফিরেছে। এখন চলছে ইনিংস বিরতি। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) তিন নম্বর মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে আক্ষেপের সুরে এই কথা বলছিলেন এক সমর্থক। ঢাকা লিগের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ। এমন গুরুত্বপূর্ণ খেলাটি দেওয়া হয়েছে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরের ভেন্যুতে। আক্ষেপ তাই থাকতেই পারে। কিন্তু আরও ঘণ্টা তিনেক পর সেই আক্ষেপ রূপ নিয়েছিল আনন্দে। শিরোপা জয়ের আনন্দে। রূপগঞ্জের বিপক্ষে ৯৪ রানের বিশাল জয় নিয়ে এক বছরের ব্যবধানে লিগের শিরোপা জিতল আবাহনী। গুনে গুনে ১৯ বার!
স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হওয়া এই মর্যাদাপূর্ণ লিগ এখন আন্তর্জাতিকভাবে লিস্ট ‘এ’ মর্যাদাপূর্ণ। সেখানে এমন অর্জন মুখের কথা নয়। ধানমণ্ডি পাড়ার ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে এই শিরোপা জয়ের ম্যাচটিও মনে রাখার মতোই করলো আবাহনী। তাতে সঙ্গী মাশরাফি বিন মুর্তজা-নাসির হোসেন-এনামুল হক বিজয়-নাজমুল হোসেন শান্তর মতো যোদ্ধারা।
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে ১৬ ম্যাচে সবচেয়ে কম ৪টিতে হেরে ও ১২ ম্যাচে জয় তুলে নিয়ে সর্বোচ্চ ২৪ পয়েন্ট নিয়ে লিগ শেষ করেছে আকাশি-হলুদ জার্সিধারীরা। অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে শক্ত রণপরিকল্পনার ম্যাচে নিজেদেরকে আকাশেই উড়িয়ে দিলেন মাশরাফিরা। তাতেই উড়লো আবাহনী। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলো শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব।
বৃহস্পতিবারের আগ পর্যন্ত আসরের চ্যাম্পিয়ন দল ছিলো গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স। এবার তারা সুপার লিগেই সন্তুষ্টি খুঁজেছে। তার আগের আসরে অর্থাৎ ২০১৬ আসরের চ্যাম্পিয়ন দল ছিলো এই আবাহনী। এ বছর লড়াইটা তাই শিরোপা ফিরিয়ে আনার; এমনটা বলাই যায়। সেভাবেই শুরু থকে দল গুছিয়েছে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। শাইনপুকুর থকে মাশরাফিকে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে তাসকিন আহমেদ, সাকলাইন সজীব, এনামুল হক বিজয়, নাসির হোসেন, নাজমুল হোসেন শান্ত, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মেহেদী হাসান মিরাজসহ সব মিলিয়ে যেন একটা জাতীয় দল গড়েছিল আবাহনী। দলের ৯০% ক্রিকেটার কোনো না কোনো সময়ে জাতীয় দলে খেলেছেন বা খেলছেন।
ত্রিদেশীয় সিরিজের পর থেকে গড়িয়েছে ঢাকা লিগ। এই সময়ে আবার ঘরের মাঠেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি খেলেছে বাংলাদেশ। তাই জাতীয় দলের বেশ কিছু নিয়মিত সদস্যকে দলে পায়নি আবাহনী। তারপরও মাশরাফি বিন মুর্তজা, নাসির হোসেন, এনামুল হক বিজয়দের হাতে দূর্বার গতিতে এগোচ্ছিলো ক্লাবটি। জাতীয় দলের খেলা শেষে আরও শক্তিশালী দল হয়েছে তারা। পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। সেখান থেকে শেষপর্যন্ত শীর্ষেই ছিলো আকাশি-হলুদ জার্সিধারীরা। অতঃপর চ্যাম্পিয়নের ট্রফি উঠলো।
বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠে যখন ৩৭৪ রান করলো আবাহনী, ততক্ষণে মাঠে প্রায় শ’পাঁচেক দর্শক। সবাই আবাহনীর সমর্থক। জিতলেই চ্যাম্পিয়ন। টাই হলেও চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু হারলে শিরোপা হারানোর ঝুঁকি ছিলো। সেটাও অবশ্য বড় ব্যবধানে হারতে হতো। লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ আগে ব্যাট করতে নামলে প্রায় ৫০০ রানের উপরে করতে হতো তাদেরকে। অন্যদিকে মিরপুরে শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাবকেও জিততে হতো। খাতা-কলমের এই অঙ্কের জটিলতায় আম্পায়ারদের পড়তে দেয়নি আবাহনী। সহজেই জয় তুলে নিয়েছে। আর বিকেএসপির ওই মাঠের আঙ্গিনা রূপ নিয়েছিলো এক টুকরো মিরপুরে। ব্যান্ড বাদকরা তুলেছিলো সুর, হৈ-হুল্লোড় আর ছবি তোলার প্রতিযোগিতা ঢাকা লিগের হারানো যৌবনের বাঁক টের পাওয়া যাচ্ছিলো।
আবাহনী আগে ব্যাট করে ৩৭৪ রান তোলে নাজমুল হোসেন শান্ত আর নাসির হোসেনের জোড়া সেঞ্চুরিতে চড়ে। আর ওপেনার এনামুল হক বিজয় হাফ সেঞ্চুরি করেন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মাশরাফি জোড়া সেঞ্চুরির চেয়ে বিজয়ের হাফ সেঞ্চুরিকেই এগিয়ে রেখেছেন।
তিনি বলেন, ‘আসলে এই ধরনের ম্যাচে খেলার চেয়ে মানসিক চাপটাই বেশি থাকে। আমার কাছে মনে হয় ওই মুহূর্তে ওটা (চাপ) হেল্প করেছে আজকে। ব্যাটিংয়ে যখন বিজয় এটাকিং হয়েছে তখন প্রেশার কিন্তু এমনিতেই কম হয়ে যায়। প্রতিদিনই একজনকে ইনিশিয়েটিভ নিতে হয় যেটা বিজয় আজকে নিয়েছে। শেষে আবার শান্ত-নাসির সেঞ্চুরি করেছে। তাদেরকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি স্টার্টিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তো আমার কাছে মনে হয় বিজয়ের ইনিংসটাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
ঠিক চার ম্যাচ আগে দলের অধিনায়ক নাসির হোসেন বলেছিলেন, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই দল গড়েছেন তারা। চ্যাম্পিয়ন হতেই চান। শিরোপা জয়ের ঠিক কতটা দূরে আছে আবাহনী লিমিটেড? উত্তরে নাসির বলেছিলেন, ‘আর চার ম্যাচ দূরে আছি’।
অর্থাৎ, যেকোনো মূল্যেই চ্যাম্পিয়ন হতে চেয়েছিলো তারা। দল হিসেবে শক্তির দিকটা মানসিকভাবেও এগিয়ে নিয়েছিলো মাশরাফিদের। যেটা তিনিও স্বীকার করেছেন। বৃহস্পতিবারের ম্যাচ শেষে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আবাহনী দলটা সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ। এই দল নিয়ে চ্যাম্পিয়ন না হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। এখন ভালো দল নিয়েও চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না। অনেক সময় ছোট দলগুলোও ভালো ক্রিকেট খেলে। এই অবস্থায় বড় দলগুলোকে সতর্ক থাকতে হয়। এগুলো নিয়ে আমাদের একটা ভয় ছিলো। আমরা ওই পথে চলেও আসছিলাম। সব মিলিয়ে শেষপর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন জিততে পেরেছি, এটাই বড় কথা। দলে প্রত্যেকেরই কন্ট্রিবিউশন ছিল। যার যার জায়গায় সে তার সর্বোচ্চটা দেওয়া চেষ্টা করেছে। কিছু ম্যাচে হয়তো আমাদের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। তারপরও আমার কাছে মনে হয় বিজয়, শান্ত, মিঠুন কয়েকটা ম্যাচ ভালো খেলেছে।’
‘কমিটির দল’ বলে আবাহনীকে মাঝে মাঝে ‘বাড়তি’ সুবিধার খোঁটা সহ্যও করতে হয়। তাই সমালোচনা হয়। ঠিক দুই ম্যাচ আগে এই বিকেএসপিতেই প্রাইম ব্যাংক দোলেশ্বর ক্লাবের বিপক্ষে বৃষ্টি আইনে জয় পান মাশরাফিরা। সেই ম্যাচে আম্পায়াররা কতটা বৃষ্টি আইন মেনেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ম্যাচ রেফারিদের ঘরে গিয়ে আবাহনীর কর্মকর্তারা চাপ প্রয়োগ করেছেন বলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমর্থকদের অনেকেই অভিযোগ তুলেছে। প্রতি লিগে এমন দুয়েকটা প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনা থাকে। ঢাকা লিগের জন্মলগ্ন থেকেই এমনটা হয়ে আসছে। তাই এগুলো যেন ডালভাত হয়েছে।
পুরো লিগে বোলিং-ব্যাটিংয়ে নজর কেড়েছে আবাহনী। বল হাতে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ১৬ ম্যাচে একাই ৩৯ উইকেট নিয়েছেন। লিগের ইতিহাসে এক মৌসুমে এত উইকেট কেউ আগে পায়নি। এছাড়া সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় প্রথম দুজনই আবাহনীর। সবার উপরে আছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। অনূর্ধ্ব-১৯ খেলে আসা এই ক্রিকেটার এখন জাতীয় দলে ক্রিকেটার। একটি টেস্টও খেলেছেন তিনি। পুরো লিগে ১৬ ম্যাচে ৭৪৯ রান করেছেন এই ওপেনার। সেঞ্চুরি তুলেছেন চারটি, হাফ সেঞ্চুরি দুটি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এনামুল হক বিজয়ের মোট রান ৭৪৪। দুটি সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরি চারটি।
তরুণ ওপেনার শান্তকে নিয়ে আশাবাদী মাশরাফি। আবাহনীর এই ক্রিকেটারকে ভবিষ্যৎ জাতীয় দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে দেখছেন তিনি। তবে এখনই শান্তকে জাতীয় দলে নেওয়ার অনেকটা বিপক্ষে মাশরাফি। তিনি বলেছেন, ‘শান্তকে এই মুহূর্তে জাতীয় দলে চিন্তা করা খুব দ্রুত হয়ে যাবে। ওর কাছ থেকে যেটা প্রত্যাশা সেটা যেন হারিয়ে না যায়। আমি নিশ্চিত শান্ত লম্বা রেসের ঘোড়া। বিপিএলে মোটামুটি পারফরম্যান্স করেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে করছে। এটা ওর জন্য সেরা সময় নিজেকে মেনটেইন করার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে তৈরি করার। এখান থেকে যেন আরেক স্টেপে নিয়ে টিকে থাকতে পারে, তেমনভাবে প্রস্তুত হতে হবে। যাতে দীর্ঘদিন দেশকে সার্ভিস দিতে পারে। স্বপ্নটা যেন ছোট না হয়।’
প্রতি আসরেই আবাহনী কিছু যোদ্ধা পায়, যাদের লড়াইয়ে শেষ মাইলফলকটা ছুঁতে পারে তারা। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ লিস্ট ‘এ’ মর্যাদা পাওয়ার পর থেকে এবার পঞ্চম আসর অনুষ্ঠিত হলো, যার মধ্যে দুবার আবাহনী শিরোপা জিতেছে। সব মিলিয়ে ১৯ বার। আবাহনীর পরেই অবস্থান মোহামেডানের, যারা নয়বার শিরোপা জিতেছে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বিমান। তাদের শোকেসে শিরোপা উঠেছে ছয়বার।
ফিচার ইমেজ- Daily Star/Firoz Ahmed