দিকনির্দেশনা! আমাদের বাস্তব জীবনে এ কথাটির গুরুত্ব আমরা নিজেরাই কিন্ত উপলব্ধি করতে পারি। একইভাবে ফুটবলের সাথেও একই কথাই কিন্ত খাটে। কোনো ৯০ মিনিটের খেলায় খেলোয়াড়ই দলকে জয় এনে দিতে পারে। কিন্ত সে দলের সঠিক নির্দেশনা বা ফুটবলের ভাষায় ট্যাকটিস ঠিক মতো না হলে ১১ জন তারকা খেলোয়াড় দিয়েও সাফল্য কাম্য নয়। বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কথাই ধরুন না। দলে তারকা খেলোয়াড়ের অভাব নেই। অথচ হোর্হে সাম্পাওলি তাদের কীভাবে খেলাবেন সেটা খুজে পাওয়ার আগেই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ থেকে বাদ।
এবার একটি সফল দল ও সফল কোচের দিকে আসা যায়। ক্রোয়েশিয়া এবং তাদের কোচ জ্লাৎকো দালিচ। ক্রোয়েশিয়া দলে লুকা মদ্রিচ, ইভান রাকিটিচই সেরা খেলোয়াড়। মারিও মানজুকিচ ও ইভান পেরেসিচ সারা বছর একইভাবে ফর্মে থাকেন না। আর বাকি সবাই সাধারণ ফুটবলার, সাধারণ দর্শকের কাছে যারা অতোটা পরিচিত নয়। অথচ এই ক্রোয়েশিয়া আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ডের মত দলকে হারিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলো বিশ্বকাপ ফাইনালে। এর কারণ? অবশ্যই খেলোয়াড়দের নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে লড়ে যাবার মত আত্মবিশ্বাস আর কোচ দালিচের প্রশংসনীয় ট্যাকটিস।
জ্লাৎকো দালিচের কোচ হিসেবে বড় কোন টুর্নামেন্ট বলতে গেলে বিশ্বকাপ। যদিও এর আগে কখনোই জাতীয় দলের কোচিং করাননি। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে বেশি খেলাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে তাই এই ফর্মেশনেই ব্যবহার করেছিলেন। ক্রোয়েশিয়ার দুই উইং এর দায়িত্ব ছিলো রেবিচ ও পেরিসিচের উপর। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে ক্রামারিচকে রেখে স্টাইকার হিসেবে নামিয়েছিলেন মানজুকিচকে। আর দলের বড় দুই সুপারস্টার মদ্রিচ ও রাকিটিচ ছিলেন মধ্যমাঠে, ডাবল পিভট রোলে। ক্লাবে মদ্রিচ বা রাকিটিচ কেউই এমন পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত নন। তাই নাইজেরিয়া ম্যাচে খোলস থেকে সম্পূর্ণভাবে কেউই বের হতে পারেননি। রাকিটিচ কয়েকটা আক্রমণ গড়ে দিলেও বা মদ্রিচ গোল করলেও ক্লাবের স্বাভাবিক পারফর্মেন্সটা ঠিক যেন আসছিলো না। দালিচ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। এ জন্যই পরবর্তী আর্জেন্টিনার সাথে ম্যাচে কষা ছকটা বদলে দেন।
আর্জেন্টিনার ম্যাচে দালিচ সম্পুর্ণ নতুন ৪-৩-৩ ফর্মেশর নামান যেখানে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলান ইন্টার মিলানের খেলোয়াড় ব্রজোভিচকে। আর মদ্রিচ ও রাকিটিচ ফিরে পান তাদের স্বাভাবিক পজিশন। এরপরের গল্পে আর বলার কিছু নেই। রাকিটিচ ও মদ্রিচ পুরো ৯০ মিনিট নাচিয়ে ছেড়েছে আর্জেন্টিনাকে। দুর্বল মধ্যমাঠ নিয়ে তাও যে ছোটখাটো আক্রমণ আর্জেন্টিনা করার চেষ্টা করেছিল, সেটাও করতে দেননি মাঝমাঠে দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রজোভিচ। আর মেসি? ক্রোয়েশিয়ার ডিবক্সের আশেপাশে তিনি ঠিকভাবে শটও নিতে পারেননি। একটি মাত্র শটও রক্ষণভাগ দ্বারা প্রতিহত। কোনো পাস তিনি ঠিকভাবে দিতে পারেননি, মধ্যমাঠ থেকে কোনো পাসও তার কাছে আসেনি। কারণ ক্রোয়েশিয়ার বিশেষ দুজন খেলোয়াড় সবসময় ছিলেন মেসির আশেপাশে।
আর্জেন্টিনাকে হারানোর পর দালিচ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের কাছে তিনটি উপায় ছিলো। আমি ব্রজোভিচকে ব্যবহার করার উপায় বেছে নেই। কারণ দলে একমাত্র এ পজিশনে ব্রজোভিচই সেরা। কারণ সে ইন্টারে একই পজিশনে নিয়মিত খেলে। নাইজেরিয়ার ম্যাচে লুকা ও ইভানের সামনে খেলোয়াড় ছিলো। আর আমি আর্জেন্টিনার সাথে ম্যাচে তাদের পেছনে খেলোয়াড় রাখি।” তার এ ট্যাকটিসের সুফল আমরা মাঠেই দেখেছি। লুকা মদ্রিচের সাথে ব্রজোভিচ যেমন পজিশন পরিবর্তন করে খেলেছে তেমনই ইভান স্ট্রিনিচকে সাথে নিয়ে ব্রজোভিচ রক্ষণও সামলেছেন। দালিচের বুদ্ধিদীপ্ত এ ট্যাকটিসের সামনে ভঙ্গুর আর্জেন্টিনা মাঠে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে দাঁড়াতেও পারেনি।
আইসল্যান্ডের বিপক্ষে দালিচ দলের প্রধান একাদশের বেশকিছু খেলোয়াড়কে বিশ্রাম দেন ও ফর্মেশনেও কিছুটা পরিবর্তন আনেন। তাই এই ম্যাচ নিয়ে না আলোচনা করাই যুক্তিসঙ্গত। নকআউট পর্বে ডেনমার্কের বিপক্ষে দালিচ আবারও ফিরে যান ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। যদিও ব্রজোভিচ নিস্প্রভ থাকার কারণে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের সুফল ক্রোয়েশিয়া পাচ্ছিলো না। আর রাকিটিচকেও মাঝে মাঝে ব্রজোভিচের পজিশনে খেলতে হচ্ছিলো। তবে শেষের দিকে দালিচ ৪-৩-৩ কে বদলে ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তবে এতসব পরিবর্তন ফলাফল বদলে দিতে পারেনি। ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিলো ১২০ মিনিট পর পেনাল্টি শুটআউটে।
রাশিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে আরও একবার ফর্মেশনে পরিবর্তন আনেন দালিচ। ফিরে যান তার নিজস্ব পজিশন ৪-২-৩-১ এ। রাকিটিচ ও মদ্রিচকে দেওয়া হয় ডাবল পিভট রোল। কিন্ত আন্তে রেবিচ ও ইভান পেরেসিচ বেশিরভাগ সময়ই উইং ছেড়ে রাইট-মিডফিল্ড ও লেফট-মিডফিল্ডে চলে আসছিলেন। এতে বোঝা যায় দালিচ এ ম্যাচে উইং নয় আক্রমণ করতে চাচ্ছিলেন মধ্যমাঠ দিয়েই, অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পজিশনে থাকা ক্রামারিচের মাধ্যমে। যদিও ম্যাচের শেষের দিকে দালিচ ব্রোজোভিচ, কোভাচিচকে নামিয়ে ও দুই ফুল-ব্যাক উঠিয়ে ৩-৫-২ ফর্মেশনও ব্যাবহার করেছেন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালের ম্যাচেও দালিচ ক্রোয়েশিয়াকে খেলিয়েছিলেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। কিন্ত গ্যারেথ সাউথগেটের ৩-৫-২ ফর্মেশনের সাথে ক্রোয়েশিয়া একদমই অসহায় ছিলো। এমনকি ম্যাচের প্রথমার্ধ সম্পূর্ণ ইংল্যান্ডের হাতেই ছিলো। ইংল্যান্ডের জমাট রক্ষণ ও অ্যাশলে ইয়ং ও কিরেয়েন ট্রিপিয়ারের উইং-ব্যাক রোলের সামনে ভিন্ন কিছু চিন্তা করার উচিত ছিলো দালিচের। তিনি সেটাই করলেন। ব্রজোভিচকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনে রেখে পেরেসিচ ও রেবিচকে উইং ছেড়ে একটু নিচে নেমে এসে খেলার নির্দেশ দিলেন। ফলে লেফট-মিড ও রাইট-মিড সহ ফর্মেশন দাঁড়ালো ৪-১-৪-১-এ। ক্রোয়েশিয়ার দুই ফুলব্যাক এবং পেরেসিচ ও রেবিচের একটু নিচে নেমে এসে খেলার কারণে থেমে গেল ইংলিশদের উইং আক্রমণ। ফলে চাপ পড়ে গেল হেন্ডারসন, ডেলে আলি ও লিনগার্ডদের উপর। কিন্তু তাদের বানানো আক্রমণ নষ্ট করে দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলেন ব্রজোভিচ, ভিদা ও লভরেন। খেলার মোড় ঘুরে যায় এখানেই।
সাউথগেটের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে লাগলো যখন এতোকিছুর পর মদ্রিচ ও রাকিটিচ ফর্মে ফিরতে লাগলেন। ইংল্যান্ডের উইং আক্রমণ ও মধ্যমাঠে ছন্দ হারানোর কারণে রাকিটিচ ও মদ্রিচ যথেষ্ট স্থান পেয়েছিলেন আক্রমণ করার। ইভান পেরেসিচ সমতাসূচক গোল করার পর ক্রোয়েশিয়ার জয়সূচক গোল আসে ১০৯ তম মিনিটে। জয়সূচক গোল ও ইংল্যান্ডকে রুখে দেবার পেছনের নায়ক ছিলেন ক্রোয়েশিয়ার দুই ফুল-ব্যাক, ভার্সালকো ও স্ট্রিনিচ।
জ্লাৎকো দালিচের চিন্তাভাবনা ছিলো মূল একাদশের ১১ জন খেলোয়াড় নিয়ে। তিনি কখনো বেঞ্চের খেলোয়াড়দের নিয়ে ভাবেননি। তার অনেকগুলো সাবস্টিটিউটও ছিলো একদম শেষের দিকে। দালিচের ট্যাকটিসের আরেকটি বিশেষত্ব হলো তিনি তার ফর্মেশন পরিবর্তন করেছেন প্রায় ম্যাচেই, কিন্ত সেখানে খুব পরিবর্তন এনেছেন তা নয়। এবং ফর্মেশন বদলে গেলেও খেলোয়াড় বদলের ঘটনা কখনো ঘটেনি। তিনি তার রক্ষণ সবসময় নির্দিষ্ট রেখেছিলেন। স্ট্রিনিচ, ভিদা,লভরেন ও ভার্সালকোকেই তিনি ধারাবাহিকভাবে খেলিয়ে গেছেন। যার ফলাফল তারা প্রতি ম্যাচেই আরও ভালো পারফর্মের পাশাপাশি আগের ম্যাচে ভুলগুলো শুধরে নেবার চেষ্টা করেছেন।
দালিচের স্কোয়াডে তারকা ফুটবলার ছিলেন দুইজন। ইভান রাকিটিচ ও লুকা মদ্রিচ। তবে দালিচ কখনো তার পরিকল্পনা রাকিটিচ ও মদ্রিচকে নিয়ে করেননি। তার স্কোয়াডে সুবাসিচের যেমন ভুমিকা ছিলো তেমন ভূমিকা ছিলো মদ্রিচ থেকে রেবিচেরও। রাকিটিচ ও মদ্রিচ নির্ভর দল না হলেও দালিচের টিমটি ছিলে তাদেরকে কেন্দ্র করে। যারা কখনও হাল ছাড়ে না, গোল হজম করলেও যাদের আত্মবিশ্বাস থাকতো তুঙ্গে। টানা দুই ম্যাচ ১২০ মিনিট খেলে, পেনাল্টি শুটআউটের চাপ নিয়েও ক্লান্তি তাদের স্পর্শ করেনি।
ক্রোয়েটদের ঐতিহাসিক সাফল্যের পেছনে যেমন কোচ দালিচের অবদান, একই পরিমাণ অবদান দলের খেলোয়াড়দের। তবে অতি দুঃখ নিয়ে বলতে হয় ক্রোয়েশিয়ার এ স্বর্ণালি সময়ের দিন খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ফিচার ইমেজ: FIFA