ক্রিকেটের ভৌগলিক রাজনীতি তখন আজকের মতো ছিলো না।
ক্রিকেটের কেন্দ্র ছিলো তখন ব্রিটেন। শুরু থেকে অন্তত আশির দশক অবধি ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ ছিলো ইংল্যান্ডের হাতে। তারাই ক্রিকেটের আইন ঠিক করতো, তাদের কাছেই ছিলো আইসিসির সদর দপ্তর, তারাই ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আয়োজন করতো। ইংল্যান্ডের সাথে অভিজাত সমর্থক হিসেবে ছিলো অস্ট্রেলিয়া। এছাড়া বাকি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর তেমন একটা গুরুত্ব নীতি নির্ধারণী ব্যাপারে ছিলো না।
এখান থেকেই ক্রিকেটকে বের করে আনতে চেয়েছিলো ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার একটা জোট। আর ক্রিকেটকে ইংল্যান্ডের বাইরে বের করে আনার প্রথম প্রতীক ছিলো এশিয়া কাপ।
এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতেই ১৯৮৪ সালে প্রথম মাঠে গড়িয়েছিলো এশিয়া কাপ।
ক্রিকেটের সেই রাজনৈতিক মানচিত্র এখন অনেকটাই বদলে গেছে। এখন আর ক্রিকেট ইংল্যান্ডভিত্তিক খেলা নয়। এখন ক্রিকেট প্রায়শ নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। ভারত-পাকিস্তানের সেই ক্রিকেটীয় সুসম্পর্কও আর নেই। এখন নতুন জোট তৈরি হয়েছে ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড মিলে তৈরি করেছে ‘বিগ থ্রি’। আইসিসি আবার শশাঙ্ক মনোহরের নেতৃত্বে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে এই বড় তিন দেশের কবল থেকে। এদিকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও সেরকম প্রতাপ দেখাতে পারছে না। কারণ দেশটির আদালতের আদেশে এখন বাস্তবিক অর্থে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চলছে কিছু নিরপেক্ষ কর্মকর্তার দ্বারা।
বোঝাই যাচ্ছে, এশিয়া কাপ শুরুর পর থেকে ক্রিকেটীয় রাজনীতি হরেক রকম বাঁক নিয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও সগৌরবে টিকে আছে এশিয়া কাপ। আরব আমিরাতে শুরু হয়ে গেলো সেই এশিয়া কাপের ১৪তম আসর।
এই সময়ে এশিয়া কাপের শুরু ও বিবর্তনের গল্প জেনে নেওয়া যাক
যেভাবে শুরু হলো
১৯৮৩ সালে এশিয়ার তিন টেস্ট খেলুড়ে দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা একমত হয় যে, তারা লন্ডন থেকে ক্রিকেটকে বের করে আনবে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো ইংল্যান্ডের বাইরে, উপমহাদেশে এনে বিশ্বকাপ আয়োজন করা।
এই উদ্দেশ্যে একমত হয়ে তারা গঠন করে এশিয়ান ক্রিকেট কনফারেন্স (এসিসি’র সে সময়ের নাম)। সে সময়ের হিসেবে এটা ছিলো এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। লন্ডন নামের কেন্দ্রের বাইরে গিয়ে আরেকটি ক্রিকেট কাঠামো গড়ে তুললো এই তিন দেশের কর্মকর্তারা। অবশ্য কেবল এই তিন দেশ নয়, সহযোগী দেশ হিসেবে আরও কয়েকটি দেশ রইলো সাথে।
সেই শুরুর সময় সম্পর্কে এসিসি’র প্রথম দিন থেকে গুটিয়ে যাওয়া অবধি সংগঠনটির অন্যতম প্রাণপুরুষ সৈয়দ আশরাফুল হক এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,
“প্রথম যাত্রা শুরু করেছিলাম আমরা ১৯৮৩ সালে। তখন আমাদের একত্রিত হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিলো, আমরা বিশ্বকাপকে ইংল্যান্ড থেকে বের করতে চাই। সেই সঙ্গে এশিয়ান দলগুলো চিন্তা করলো, জনপ্রিয়তার দিক থেকে তারা যেহেতু ভালো অবস্থায়, তারা একটা প্রেশার গ্রুপ তৈরি করতে চায়। সেজন্যই এশিয়ান ক্রিকেট কনফারেন্স তৈরি হলো। তো সেই প্রথম উদ্দেশ্যে তো আমরা সফল হয়েছিলামই। আমরা ১৯৮৭ সালে বিশ্বকাপ ভারতে আনতে পেরেছিলাম। একটা শক্তিশালী গ্রুপ হিসেবেই এশিয়ান ক্রিকেট দলগুলো পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিলো, আমরা এশিয়া কাপটা শুরু করতে পারলাম।”
আশরাফুল হকের কথার শেষ লাইনটা লক্ষ্য করুন। তিনি বলছেন, এসিসি’র শুরুতে সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিলো যে, তারা সংগঠন শুরু করার পরের বছরই এশিয়া কাপ আয়োজন করতে পারলেন।
এটা আসলে ছিলো ক্রিকেট বিশ্বকে দেখানো যে, আমরাও পারি। এশিয়ায় যে নিজেদের উদ্যোগে সফল টুর্নামেন্ট চালু করা যায়, তারই নজির হয়ে যাত্রা শুরু করলো এশিয়া কাপ।
প্রথম আসরে যদিও তিনটি দল অংশ নিয়েছিলো- ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। তারপরও এটা একটা মাইলফলক হয়ে রইলো।
দ্বিতীয় আসরে অংশ নিলো বাংলাদেশ। এটা ছিলো বাংলাদেশের জন্য নতুন একটা যাত্রা। এই টুর্নামেন্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু হলো বাংলাদেশের। এশিয়া কাপকে তাই বাংলাদেশের আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর প্রথম পদক্ষেপ বলে দাবি করা যায়। অন্তত তেমন দাবি করছিলেন সৈয়দ আশরাফুল হক।
বাংলাদেশ ও এশিয়া কাপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন,
“একেবারে যদি বাংলাদেশের দিক থেকে ভাবেন, এশিয়া কাপে বাংলাদেশ নিয়মিত খেলা শুরু করার কারণেই কিন্তু কোনো স্ট্যাটাস পাওয়ার আগেই একটা এক্সপোজার পাওয়া শুরু করলাম আমরা। বাইরের দেশগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে শুরু করলো। আমি তো বলবো, এটা শেষ বিচারে বাংলাদেশকে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াতেও দারুণ ভূমিকা রেখেছে। কারণ, এই সময়ে আমরা অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ এশিয়া কাপে খেলেছি; যা বাকিরা পারেনি।”
চলমান বাস্তবতা
এশিয়া কাপ যেমন শুরু হয়েছিলো এশিয়ার ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোকে একত্রিত করতে, তেমন এখানে মাঝে মাঝেই এসে হানা দিয়েছে আঞ্চলিক রাজনীতি ও অসন্তোষ।
এশিয়া কাপের দ্বিতীয় আসরেই ভারত অংশ নেয়নি শ্রীলঙ্কার সাথে তাদের টানপোড়েনের কারণে। এরকম টানপোড়েনে এশিয়া কাপ বেশ কয়েকবারই পড়েছে। ১৯৯০-৯১ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে পাকিস্তান অংশ নেয়নি ভারতের সাথে তাদের টানাপোড়েনের কারণে।
তবে এসব টানাপোড়েন অনেকটাই শান্ত করে ফেলেছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। তিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড, পরে আইসিসির প্রধান হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের জোটকে শক্তিশালী এক জোটে পরিণত করেন। ভারত ও পাকিস্তানের ভেতরে রাজনৈতিক টানাপোড়েন থাকা সত্ত্বেও নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে নতুন শতকের শুরু অবধি একটা দারুণ ক্রিকেটীয় সম্পর্ক ছিলো তাদের মধ্যে। এই সময় ভারত ও পাকিস্তান কয়েকবার পরস্পরের দেশে সফর করে এবং এশিয়া কাপ বাঁধাহীনভাবে এই এলাকার সেরা টুর্নামেন্টে পরিণত হয়। ১৯৯৫ সালে এশিয়ান ক্রিকেট কনফারেন্স নাম বদলে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল করা হয় আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার লক্ষ্যে।
ডালমিয়ার পর এহসান মানি আইসিসি সভাপতি হওয়ার পরও এই ধারা অব্যহত ছিলো।
কিন্তু এরপর থেকে আইসিসিতে নতুন কেন্দ্র তৈরি হতে শুরু করে। আইসিসি ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের তিন মোড়লের হাতে চলে যেতে শুরু করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলকে সীমিত করে ফেলা হবে।
এসিসি ইতিমধ্যে এশিয়া কাপ ছাড়াও আরো অনেক টুর্নামেন্ট আয়োজন শুরু করে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা চীন, নেপাল, হংকং, ওমান প্রভৃতি দেশে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ হাতে নেয়। কিন্তু তিন মোড়ল তত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা এন শ্রীনিবাসন জানিয়ে দেন, এসিসি’র এসব ক্ষমতা আর রাখা হবে না। সেই অনুযায়ী ২০১৫ সালে এসে এসিসিকে কুয়ালালামপুর থেকে বাস্তবিক অর্থে উচ্ছেদ করা হয়। চাকরি ছেড়ে দিতে হয় সৈয়দ আশরাফুল হককে। কর্মকর্তা, কোচদের গুটিয়ে নেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় অনেক উন্নয়ন কাজ।
তবে রাজনীতি তো থেমে থাকে না।
এর মধ্যে ভারতীয় বোর্ড ও আইসিসিতে ক্ষমতা হারান এন শ্রীনিবাসন। আইসিসিতে ক্ষমতায় আসেন শশাঙ্ক মনোহর ও ভারতীয় বোর্ডে আসেন আবার ডালমিয়া। ডালমিয়ার হঠাৎ প্রয়ানের পর ক্ষমতায় আসেন ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির এমপি অনুরাগ ঠাকুর। তারা সিদ্ধান্ত নেন, এসিসিকে আবার বাঁচিয়ে তুলতে হবে।
সেই সময় অনুরাগ ঠাকুর এই লেখকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, তারা এসিসিকে বাঁচিয়ে তুলতে চান এবং যার প্রথম পদক্ষেপ হবে এসিসির আরও বেশি বেশি টুর্নামেন্ট আয়োজন। তিনি বলেছিলেন,
“এখন আমরা অনেক বেশি টুর্নামেন্ট খেলবো এই অঞ্চলে। এশিয়া কাপ তো থাকছেই। সেটা একাধিক ফরম্যাটে (ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি) হতে পারে। এর বাইরে মেয়েদের এশিয়া কাপ, ইমার্জিং এশিয়া কাপ, অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ; অনেক কিছু থাকছে। মোট কথা, প্রতি বছর এশিয়ান অঞ্চলে একাধিক বড় টুর্নামেন্ট থাকবে। আমরা চাই এই চারটি দেশের বাইরে আরো অনেক দেশ শক্তিশালী হয়ে উঠুক। আফগানিস্তান, নেপাল, ওমান, হংকং উঠে এসে যেন বাংলাদেশ-ভারত বা পাকিস্তানের লেভেলে চলে আসতে পারে।”
তারপর আরও কিছু বদল ক্রিকেট রাজনীতিতে হয়েছে। ভারতীয় বোর্ড থেকে আদালতের আদেশে অপসারিত হয়েছেন অনুরাগ ঠাকুররা। কিন্তু এসিসি এখনও কলম্বোতে তার কাজ চালাচ্ছে। এসিসি আশায় আছে আবার আগের মতো চেহারায় ফেরার।
পদাধিকার বলে এসিসির সভাপতি এখন পিসিবির নতুন চেয়ারম্যান, আইসিসির সেই সাবেক সভাপতি এহসান মানি। ফলে এসিসি নিয়ে স্বপ্নটা এখন বড় হয়ে উঠছে। আবার এহসান মানিরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এই সংগঠনটিকে সেই ডালমিয়াদের লক্ষ্যের মতো করে গড়ে তোলার।
আর এ সবকিছুরই প্রতীক হয়ে আয়োজিত হয়ে চলেছে এশিয়া কাপ।
এশিয়া কাপ তাই কেবল একটা টুর্নামেন্ট নয়; এ এক ক্রিকেট রাজনীতির ইতিহাস।