Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইডেনে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের ক্লাইম্যাক্স

২০০১ সালে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া ভারত সফরে এসেছিল। সিরিজের প্রথম টেস্টে ব্যাকফুটে স্বাগতিক ভারত। ওয়াংখেড়েতে হার দিয়ে সিরিজ শুরু সৌরভ গাঙ্গুলীর দলের। ১০ উইকেটে জিতে সিরিজে ১-০তে এগিয়ে যায় সফরকারীরা। প্রথম ইনিংসে অজি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ১১২ বলে ১২২ রানের একটা টর্নেডো ইনিংস খেলেছিলেন। ১০৮.৯৩ স্ট্রাইকরেটের সেই ইনিংসে ছিল ১৫ চারের সাথে চারটি ছয়ের মার। প্রথম টেস্টের ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ ও ওই অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।

সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। টিম ইন্ডিয়ার সিরিজ বাঁচানোর লড়াই এই টেস্ট। কারণ, প্রথম টেস্ট জিতে তিন ম্যাচ সিরিজের ১-০ লিড নিয়েছে অজিরা। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। দুই ওপেনার মাইকেল স্ল্যাটার এবং ম্যাথু হেইডেন ইনিংসের গোড়াপত্তনে নামেন। জহির খানের বলে মাইকেল স্ল্যাটার উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন, ভাঙে ১০৩ রানের উদ্বোধনী জুটি। ব্যক্তিগত ৪২ রানে ফিরে যান স্ল্যাটার। এরপর জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে নিয়ে আরো ৯০ রান যোগ করেন হেইডেন। ১৯৩ রানের সময় সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৩ রান দুরে থাকার সময় আউট হন হেইডেন। অস্ট্রেলিয়ার স্কোর দাঁড়ায় ১৯৩/২।

Image Credit: HAMISH BLAIR VIA GETTY IMAGES

উইকেটে আসেন মার্ক ওয়াহ। ওয়াহ-ল্যাঙ্গার জুটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি। ২১৪ রানের সময় ৫৮ রানে সাজঘরে ফিরে যান ল্যাঙ্গার। ল্যাঙ্গার ফেরার পর দলীয় ২৩৬ রানের সময় আউট হন মার্ক ওয়াহ। তবে এক প্রান্ত আগলে রাখেন তারই সহোদর স্টিভ ওয়াহ।

২৩৬ রানে ৪ উইকেট পরার পরও বড় রানের দিকেই ছুটছিল অস্ট্রেলিয়া। উইকেটের একপাশে স্টিভ ওয়াহ, আরেক পাশে নতুন ব্যাটসম্যান রিকি পন্টিং। ৭২তম ওভারে বোলিংয়ে আসেন হরভজন সিং। অস্ট্রেলিয়ার স্কোর তখন ২৫২, স্ট্রাইক প্রান্তে রিকি পন্টিং।

ওভারের দ্বিতীয় বলে ব্যক্তিগত ৬ রানের মাথায় লেগ বিফোরের ফাঁদে পন্টিং। পরের বলেই আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান গিলক্রিস্টও লাইন মিস করে প্যাডে বল লাগান। আবারো আবেদন, এবং আউট। হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন হরভজন। নতুন ব্যাটসম্যান শেন ওয়ার্ন ও প্রথম বলেই সদাগোপান রমেশের হাতে ক্যাচ দিলে বুনো উল্লাসে ফেটে পড়েন হরভজন।ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট হ্যাটট্রিক বলে কথা! যা ঘটনাচক্রে ভারতের হয়ে প্রথম টেস্ট হ্যাটট্রিক।

২৫২/৪ থেকে মুহূর্তেই ২৫২/৭। ২৬৯ রানে অষ্টম উইকেটের পতন ঘটলে ৩০০ রানের আগেই অলআউটের শঙ্কা। লোয়ার অর্ডারে জেসন গিলেস্পিকে নিয়ে স্টিভ ওয়াহর ১৩৩ রানের জুটি কক্ষপথে ফেরায় অজিদের। ৪০২ রানের সময় গিলেস্পি আউট হলেও আরেক প্রান্তে অবিচল স্টিভ ওয়াহ। শেষ উইকেট জুটিতে ম্যাকগ্রাকে নিয়ে আরো ৪৩ রান যোগ করেন ওয়াহ। এরই মাঝে তুলে নেন ক্যারিয়ারের ২৫তম টেস্ট শতক। শেষ পর্যন্ত ৪৪৫ রানের সময় ব্যক্তিগত ১১০ রানে হ্যাটট্রিক-ম্যান হরভজনের শিকার ওয়াহ। প্রথম ইনিংসে ৪৪৫ রানে অলআউট অস্ট্রেলিয়া। হরভজন একাই নেন ৭ উইকেট।

Eden Test 2001
Image Credit: HAMISH BLAIR VIA GETTY IMAGES

প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে টিম ইন্ডিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ। ১০০ রানের আগেই সাত ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে ম্যাকগ্রা-গিলেস্পির পেস আর ওয়ার্নের ঘূর্ণির কাছে টিম ইন্ডিয়ার অসহায় আত্মসমর্পণ। কিন্তু এটাই যে দ্বিতীয় ইনিংসে শাপেবর হয়ে দাঁড়াবে, সেটা হয়তো কারো কল্পনাতেও ছিল না।

মাত্র ১৭১ রানে অলআউট ভারত। অজিরা ২৭৪ রানের বিশাল লিড নিয়ে ফলোঅন করায় ভারতকে। দ্বিতীয় ইনিংসে আবার ব্যাটিংয়ে নামে ইন্ডিয়া। আসল ক্লাইম্যাক্সের শুরু এখান থেকেই। এবারও শুরুতেই উইকেট হারায় ভারত। ১১৫ রান তুলতেই নেই তিন ব্যাটসম্যান। ওপেনার সদাগোপান রমেশ এবং শিবসুন্দর দাস উইকেটে সেট হয়েও ইনিংস লম্বা করতে ব্যর্থ। শচীন টেন্ডুলকারও বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেননি। ইনিংস ব্যবধানে হার চোখ রাঙানি দিচ্ছে। ইডেনের উইকেট যেন বুঝে উঠতেই পারছে না ইন্ডিয়া। অথচ এই উইকেটেই অজিরা প্রথম ইনিংসে তুলেছে ৪৪৫ রান। চতুর্থ উইকেট জুটিতে গাঙ্গুলীকে নিয়ে এগুতে থাকেন লক্ষ্মণ। প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার চেষ্টা। ২৩২ রানের সময় সৌরভ আউট হলে ভারতের পরাজয় যেন সময়ের ব্যাপার হয়েই দাঁড়ায়। ব্যক্তিগত ৪৮ রানে ম্যাকগ্রার বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে আউট হন টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক। স্কোর তখন ২৩২/৪।

Eden Test 2001
Image Credit: Getty Images

উইকেটে আসেন নতুন ব্যাটসম্যান ‘দ্য ওয়াল’ খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়। ততক্ষণে উইকেটে সেট হয়ে গেছেন লক্ষ্মণ। একের পর এক লক্ষ্মণের কপিবুক স্ট্রেট ড্রাইভ, অন ড্রাইভ, কব্জির মোচড়ে দৃষ্টিনন্দন ফ্লিক দেখে মনে হচ্ছিল, ইডেনের উইকেট যেন মুুুহূর্তেই ব্যাটিং স্বর্গে পরিণত হয়েছে। দ্রাবিড় প্রথমে খানিকটা সময় নেন, এরপর তিনিও ম্যাকগ্রা-গিলেস্পি-ওয়ার্নদের পড়ে ফেলেন। ইডেনে উপস্থিত এক লাখ দর্শক সেদিন লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়দের ক্লাসিক শো’তে বুঁদ হয়ে ছিলেন। সোজা ব্যাটে দ্রাবিড়ের চোখ-ধাঁধানো ফ্রন্টফুট ড্রাইভ, ব্যাকফুট ড্রাইভে সেদিন হয়তো ম্যাকগ্রাও মুগ্ধ হয়েছিলেন। নিখুঁত প্লেসমেন্টে পয়েন্ট আর গালির ফাঁক গলে একের পর এক সীমানা ছাড়া করেছেন অজি পেসারদের। পঞ্চম উইকেটে দ্রাবিড়-লক্ষ্মণের ৩৭৬ রানের মহাকাব্যিক জুটি। লক্ষণের ২৮১ রানের ‘ভেরি স্পেশাল’ ইনিংসে চাপা পড়ে যায় দ্রাবিড়ের ১৮০ রানের ঝলমলে ইনিংস। তবে গুরুত্বের বিচারে কোন অংশেই কম ছিল না দ্রাবিড়ের ইনিংসও।

দ্রাবিড়-লক্ষ্মণের ব্যাটে চড়ে রানের পাহাড়ে চড়ে ভারত। ৬০৮ রানের সময় লক্ষ্মণ যখন কাভারে দাঁড়ানো পন্টিংয়ের হাতে ক্যাচ দিয়ে মাঠ ছাড়ছেন, ইডেনের লক্ষাধিক দর্শক তখন যেন তাকে কুর্নিশ করছে। করতালিতে ফেটে পড়ে পুরো ইডেন গার্ডেন। ততক্ষণে ভারতের লিড দাঁড়ায় ৩৩৪ রান। ৬৩৮ রানের মাথায় দ্রাবিড় রানআউটে কাটা পড়লে তাকেও সম্মান জানাতে কার্পণ্য করেনি উপস্থিত দর্শকরা। ড্রেসিংরুমে দাঁড়ানো সৌরভ-শচীনরাও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন, দ্রাবিড় যখন ফিরছিল। শেষ পর্যন্ত সাত উইকেটে ৬৫৭ রান বোর্ডে তোলার পর সৌরভ ড্রেসিংরুম থেকে হাত নাড়িয়ে উইকেটে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যানদের ইনিংস ঘোষণার বার্তা দেন। ৬৫৭ রানে থামে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস। তিনটি উইকেট নেন গ্লেন ম্যাকগ্রা।

Image Credit: ARKO DATTA VIA GETTY IMAGES

জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩৮৪ রান। হেইডেন-স্ল্যাটারের সাবধানী শুরু। দলীয় ৭৪ রানের সময় অজিদের প্রথম উইকেটের পতন। প্রথম ইনিংসের হ্যাটট্রিককারী হরভজনের বলে গাঙ্গুলীর হাতে ক্যাচ দেন স্ল্যাটার। খানিক বাদে জাস্টিন ল্যাঙ্গারকেও ফেরান হরভজন। দ্বিতীয় ইনিংসে আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন হরভজন। অজি ব্যাটসম্যানরা যেন হরভজনের দুসরা-গুগলি সব গুলিয়ে ফেলছেন। আসা-যাওয়ার মিছিলে যোগ দেন পন্টিং, মার্ক ওয়াহ এবং গিলক্রিস্ট। তিনজনই ফেরেন শূন্য রানে। হরভজনের স্পিন-বিষে নীল অজি শিবির। ১৬৭ রান তুলতেই নেই ৬ উইকেট। জয় থেকে তখনও ২১৭ রান দূরে, হাতে মাত্র ৪ উইকেট। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে উইকেটে আছেন ম্যাথু হেইডেন। ১৭৩ রানের সময় সেই গলার কাঁটা হেইডেনকেও সরিয়ে ফেলেন টেন্ডুলকার। ইডেনের দর্শকরা ততক্ষণে জয়োৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। লোয়ার অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা হারের ব্যবধান কমালেও ভারতের জয় আটকাতে পারেনি। ২১২ রানেই অলআউট হেইডেন, পন্টিং, ওয়াহ, গিলিদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী অজি ব্যাটিং লাইনআপ। প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেট নেওয়া হরভজন দ্বিতীয় ইনিংসেও ৬ উইকেট নিয়ে অজিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। ১৭১ রানের বিশাল জয় পায় সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারত। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হোন ২৮১ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলা ভিভিএস লক্ষ্মণ।

Image Credit: Hamish Blair

ফলোঅনে পরেও ৪ দিনে ভারতের টেস্ট জয়, যার পরতে পরতে ছিল রোমাঞ্চ আর ক্লাইম্যাক্স। ঐতিহাসিক সেই ইডেন টেস্ট আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতির পাতায় চির অমলিন। মহানাটকীয়তার সেই ইডেন টেস্টের ১৯ বছর পূর্ণ হল সদ্যই। ভারতের ক্রিকেট মানচিত্র বদলে যাওয়ার শুরু সেদিনই। 

This article is in Bangla language. It is about the miracle at Eden Gardens, where VVS Laxman & Rahul Dravid composed wonderful poetry against Australia.

Featured Image Credit: Getty Images

Related Articles