![](https://assets.roar.media/assets/Vv4UdOAtxTTZ8KoV_feature-2-imp-moments-of-chess-source-nadyn-dot-biz.jpg?w=1200)
চৌষট্টি খোপের দাবার ইতিহাসের কালজয়ী কিছু ঘটনা আমরা আলোচনা করছিলাম। গত পর্বে আমরা দাবার বিশ্বায়ন দেখেছি। কবে চতুরঙ্গ থেকে শতরঞ্জ হয়ে আজকের দাবায় রূপান্তর হয়েছে তা দেখেছি, দেখেছি কুইনের ক্ষমতায়ন, পৃথিবীর প্রথম দাবার ইনফরমাল টুর্নামেন্ট আয়োজন দেখেছি। সাথে বিস্ময়কর যন্ত্র দ্য টার্ক এবং স্টন্টনের ঘুঁটি অবধি আশা শেষ আমাদের। এসব অবলোকন করতে করতে ঊনবিংশ শতকের মাঝ পর্যন্ত কিন্তু ভ্রমণ করে ফেলেছি আমরা। এবারে আমরা আধুনিক যুগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত দেখব।
৫. চেস ক্লকের যাত্রা শুরু – ১৮৬১
ভাবুন তো, কেমন হবে যখন চৌদ্দ ঘণ্টা একটা দাবার গেম চলতে থাকবে, কোনো টাইম লিমিট থাকবে না! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ঊনবিংশ শতকের আগ পর্যন্ত দাবা এভাবেই লোকে খেলত।
![tumbling clock](https://assets.roar.media/assets/e28pqQRbvVEeW0BS_%E2%80%99tumbling%E2%80%99%E2%80%99-chess-clock-source-woochess.jpg)
এমনকি বিপক্ষকে হারানোর উপায় এমনও ছিল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত অপর পক্ষ ক্লান্ত হয়ে খেলা না ছেড়ে দেয়! এর অবসান ঘটাতে ত্রাতা হিসেবে ১৮৬১ সালে চেস ক্লকের পূর্বপুরুষ হিসেবে স্যান্ড আওয়ারগ্লাস তথা বালিঘড়ি প্রথম ব্যবহৃত হয়। এতে তিন ঘণ্টার সমপরিমাণ বালি ভরে দেয়া হতো। আরেকটু উন্নত ‘টাম্বলিং’ ঘড়ি চালু হয় আর কিছু পর, ১৮৮৪ সালে পেটেন্টকৃত এই ঘড়িতে ছিল দারুণ সিস্টেম। একজনের ঘড়ি চালু হতো ঠিক অপরজনেরটা বন্ধ হবার সাথে সাথে। টাম্বলিং ঘড়ির পর ‘টুইন ঘড়ি’গুলো ব্যবহৃত হতে থাকে অনেকদিন পর্যন্ত।
![twin clock](https://assets.roar.media/assets/ox6bGLO2WbX0blve_twin-chess-clock-source-woochess.jpg)
১৯৬৪ সালের আগ পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ঘড়ি বাজারে আসেনি অবশ্য। ইলেকট্রনিক ঘড়ির সাথে চলে আসল আরও সূক্ষ্মতা, সময়ের উপর আরও দখল। কালের পরিক্রমায় বৈদ্যুতিক গতির দাবার সাথে পরিচিত হলো দুনিয়া, এক মিনিটের ব্লিটজ গেম দাবায় রাজত্ব করতে চলে এলো। প্রযুক্তির উন্নতির সুবাদে সেকালের ব্যয়সাপেক্ষ দাবার ঘড়ি এখন যে কেউ প্লে-স্টোর থেকে ফ্রিতেই ডাউনলোড করে নিতে পারেন।
![electronic chess clock](https://assets.roar.media/assets/ul0NCVJB89Tq2v4d_1280px-DGT_2010_digital_chess_clock.ajb-commons.jpg)
৪. উইলহেম স্টেইনিজ, প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন – ১৮৮৬
দাবার দুনিয়ায় প্রথম রাজমুকুট পরেন অস্ট্রো-আমেরিকান দাবাড়ু উইলহেম স্টেইনিজ। ১৮৮৬ সালে জোহানেস জুকারফোর্টের সাথে আনডিসপিউটেড চ্যাম্পিয়নশিপে জয় ছিনিয়ে নেন তিনি। তাকে ‘ফাদার অফ মডার্ন চেস’ও বলা হয়। উইলহেম স্টেইনিজই প্রথম বুঝতে শিখেছিলেন যে, দাবা একটা জটিল খেলা হলেও এরও কিছু না কিছু নিয়ম-কানুন বেঁধে দেয়া সম্ভব। তার আগের দাবাড়ুরা কোনো এক দিকে শুধু ফোকাস করে যাচ্ছিলেন, যেমন ফিলিদর তার ‘Pawns are the soul of a chess game’ নীতিতে অটল ছিলেন।
স্টেইনিজের মূল্যায়নে ক্লাসিক্যাল দাবায় ১৪তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিক বলেন,
“তিনি গভীর চিন্তাশীল ছিলেন এবং অভিনব আর মৌলিক সব তত্ত্ব নিয়ে হাজির হতেন। স্টেইনিজের আগে দাবা শুধুই একটা খেলা ছিল, তিনিই প্রথম একে স্টাডি করেছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সবসময় তার সব প্রচেষ্টাই ফলপ্রসূ হতো না, এটা স্বাভাবিক। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়নের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই আমি বলতে চাই, স্টেইনিজ কোনো চেস স্কুল অফ থটের প্রতিষ্ঠা করে যাননি বটে, তবে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত এক্সপেরিমেন্টর। তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন যে, দাবাও অনুশীলনের এবং গবেষণার বিষয়, চাইলে এখানেও কিছু প্যাটার্ন খুঁজে বের করা সম্ভব।”
![steinitz](https://assets.roar.media/assets/LlhyrJglpTh5dnJx_wilhelm-Steinitz-source-Austrian-national-library-via-chessbase.jpg)
৩. দাবার সেনসেশন – ফিশার, কারপভ হয়ে ক্যাসপারভ – ১৯৭২-৮৫
মাত্র ছয় বছরে দাবায় হাতেখড়ি ঘটে রবার্ট জেমস ফিশারের, লোকে যাকে ববি ফিশার নামেই বেশি চেনে। পনের বছর ছ’মাস বয়সে সেকালের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে বিশ্বরেকর্ড করেন ববি। ১৯৭২ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যেবার বরিস স্পাস্কিকে হারিয়ে ফিশার রাজমুকুট লুফে নেন, দাবার ইতিহাসে সেটি সর্বকালের সেরা ইভেন্ট হিসেবে স্বীকৃত। ফিশারেই এত বছরের সোভিয়েত-কর্তৃত্ব কাটাতে সক্ষম হয় দাবা বিশ্ব। কোল্ড ওয়ারের উত্তাপ যখন তুঙ্গে, সে সময় এই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ দাবাকে আরেক ঘরানার যুদ্ধের স্বাদ দেয়। সেই ম্যাচ জিতে বলাই বাহুল্য, ফিশারের জনপ্রিয়তা তখন গগণচুম্বী। এমতাবস্থায় তিন বছর পর রি-ম্যাচের সময় আয়োজকগণ উচ্চাভিলাষী ববির চাহিদামতো পেমেন্ট করতে অক্ষম হওয়ায় তিনি খেলতে অস্বীকৃতি জানান এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। শেষে ২০০৮ সালে এভাবে গণমানুষের অগোচরে থেকেই ৬৪ বছর বয়সে ববি দেহত্যাগ করেন।
ববি ফিশারের ব্যাপারে ক্রামনিক বলেন,
“যে পাঁচ বছর তিনি ফর্মের চূড়ায় ছিলেন, সে সময়েই এটা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, চ্যাম্পিয়ন তিনিই হতে যাচ্ছেন! … একটা সময় তিনি সবাইকে সবকিছুতে টেক্কা দিয়েছিলেন, এনার্জি, ফোর্স, প্রিপারেশন, প্লেইং স্ট্রেংথ সবকিছুতে। … হাই প্রেশার চেস ফিশারই প্রথম শুরু করেন, পরে যা ক্যাসপারভও গ্রহণ করেন। ববিই প্রথম দাবাড়ু যিনি প্রথম চাল থেকে শেষ চাল পর্যন্ত বোর্ডে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা বজায় রাখতে সক্ষম ছিলেন। ববি খুব এনার্জেটিক দাবা খেলতেন।”
![spassky fischer](https://assets.roar.media/assets/vb9iyOqAkxmSNqL6__109999766_spassky_fischer_alamy-bbc.jpg)
ফিশারের পর দাবার জগতে কিছুকাল বেশ দাপটের সাথে রাজত্ব করেন আনাতোলি কারপভ। এরপর আবার সুপারহিরোর আবির্ভাব হয় দাবা-পাড়ায়, গ্যারি ক্যাসপারভ দৃশ্যপটে এসেই হিসাবনিকাশ পাল্টে দেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপসহ একের পর এক টুর্নামেন্ট জিতে নেন তিনি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবেও গ্যারিকে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেন অনেক দাবাবোদ্ধাই।
কারপভের প্রশংসায় উচ্চকিত ক্রামনিক বলেন,
“কারপভের দম অনেক বেশি, তার মতো ফাইটিং স্পিরিট খুব কম দাবাড়ুরই সম্ভব! ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে খেলে যেতে পারেন তিনি। আর আগের গেমে কী হয়েছে, তা বেমালুম ভুলে যেতে পারেন। তার সাথে ইকুয়াল গেম ড্র হলে প্রতিপক্ষ স্বস্তি পেত যে, মানসিক অত্যাচারটা শেষ তো হলো! কোনো ধরনের মুড সুইং জাতীয় বিষয় তাকে কখনও থামাতে পারেনি; এলেন, বসলেন, খেলা শুরু করলেন – এমন গতিতে এগোতেন তিনি।”
অপরদিকে ক্যাসপারভের মূল্যায়নে ক্রামনিকের ভাষ্য,
“তার শেখার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ, অন্য যে কাউকে তিনি এই দিক থেকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি যেন ছিলেন স্পঞ্জের মতো, যেকোনো কিছু শুষে নিতে সক্ষম। যেকোনো পরিবর্তনে মানিয়ে নিতে পারতেন ক্যাসপারভ। তিনি ছিলেন ফ্লেক্সিবল। এক সময় এমন হয়ে গিয়েছিল যে তার পক্ষে কোনোকিছুই আর অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। তার উইকনেসও ছিল; এমন নয় যে ছিল না। তবে এগুলো ছিল আপেক্ষিক, তিনি দ্রুতই নিজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে পারতেন। যেকোনো সমস্যা খুঁজে বের করে ২-৩ মাসের মধ্যে তা ঠিক করে ফেলার সক্ষমতা ছিল তার। এ কারণেই তিনি ফাস্ট-চেঞ্জিং।”
![the legends in a frame](https://assets.roar.media/assets/zDNVxgE8HZbBLalc_1078px-Schakers_Kasparov%2C_Karpov_en_Timman_%28v.l.n.r.%29_op_OZ_Voorburgwal_bij_bezoek_aan_%2C_Bestanddeelnr_933-9647.jpg)
২. সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যন্ত্রের কাছে মানবের হার – ১৯৯৭
আইবিএম ১৯৮৯ সালে এক দল ইঞ্জিনিয়ার হায়ার করে, যারা এমন কোনো দাবা ইঞ্জিন বানাবে যেটি যেকোনো মানুষকে এমনকি বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে পর্যন্ত হারাতে সক্ষম। তারা এমন একটি দারুণ যন্ত্র ‘ডিপ থট’ বানিয়েও ফেলে। কিন্তু তৎকালীন দাবার দুনিয়ায় রাজ করতে থাকা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি ক্যাসপারভ বলেন,
“একটা ইঞ্জিনের পক্ষে এখনও অনেক দেরি আছে সেরা মানব-মানবীকে দাবায় হারিয়ে দেয়া!”
ক্যাসপারভ কিন্তু তার কথার উপযুক্ত কাজও করে দেখান সেবার। ৬ গেমের এক ম্যাচে ক্যাসপারভ ‘ডিপ থট’কে হারিয়ে দেন ১৯৮৯ সালে। পরে তারা আরও কাজ করে ডিপ থটকে নিয়ে, এবং এর উন্নত ভার্সন বাজারে আনে ১৯৯৬ সালে ‘ডিপ ব্লু’ নামে। কিন্তু সেটাকেও গ্যারি হারান ‘৯৬-এর ম্যাচটায়।
কিন্তু পরের বছর ১৯৯৭ সালে রি-ম্যাচে ডিপ ব্লু দাবা-বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়, ৩.৫-২.৫ পয়েন্টে ক্যাসপারভকে হারিয়ে দেয়। তৎকালীন সেই ‘ডিপ ব্লু’ সেকেন্ডে ২০০ মিলিয়ন মুভ অ্যানালাইজ করতে পারতো। যদিও আজকের দিনের নরমাল চেস ইঞ্জিনগুলো খুব সহজেই ডিপ ব্লুকে হারাবে, কিন্তু সেকালের নিরিখে এটি ছিল এক পট-পরিবর্তনকারী ঘটনা। হালের দাবা ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রি অনেক এগিয়ে গেছে, ইলো রেটিং দেখলেই সেটা বোঝা যায়। বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনের রেটিং (২,৮৪৭ – মার্চ, ২০২১) বা সবসময়ের নিরিখে যেকোনো মানবের পক্ষে সেরা রেটিং যদি ধরি, সেটাও ম্যাগনাসেরই ২০১৯ সালের আগস্টে অর্জিত ২,৮৮২ পয়েন্ট। আর বর্তমানের সেরা চেস ইঞ্জিন স্টকফিশ-এর সর্বোচ্চ রেটিং ৩,৪৩৮ পয়েন্ট, প্রায় ছ’শ পয়েন্ট মার্জিনে এগিয়ে!
![kasparov vs deep blue](https://assets.roar.media/assets/58UWglSPFF0wg8RC_deep-blue-vs-kasparov-1997-source-peter-morgan-via-reuters.png)
১. ম্যাগনাস কার্লসেন যুগের সূচনা — ২০১৩
দাবার ইতিহাসে তর্কসাপেক্ষে ইতিহাসের সেরা প্রডিজি হলেন ম্যাগনাস কার্লসেন। সর্বকালের সব থেকে বেশি ইলো রেটিংধারীও তিনিই (২,৮৮২ – আগস্ট ২০১৯)। শিশু ম্যাগনাসের লক্ষণ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি একজন ‘গিফটেড চাইল্ড’। মাত্র দু’বছর বয়সেই ৫০ পিসের জিগস’ পাজল সলভ করতে থাকেন ‘ছোট্ট’ ম্যাগনাস। বাবার হাত ধরে পাঁচ বছরে দাবায় হাতেখড়ি হয় ম্যাগনাসের, তারপর মাত্র তের বছর বয়সে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ নর্ম অর্জন করেন তিনি। ২০১৩ সালে বিশ্বনাথন আনন্দকে হারিয়ে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন, এবং এখনও তিনিই সিংহাসন ধরে আছেন। তিনিই একমাত্র দাবাড়ু যিনি কি না ক্লাসিক্যাল, র্যাপিড, আর ব্লিটজ — দাবার তিন ফরম্যাটেই চ্যাম্পিয়ন হন।
![magnus 2016 wcc](https://assets.roar.media/assets/m4y1txo48ceHp21K_magnus-wins-2016.jpg)
মডেলিং বা ফ্যাশন জগতেও কাজ করেছেন ম্যাগনাস। বর্তমানে তিনি মাত্র ৩০ বছর বয়সী, আরও কমপক্ষে এক দশক তিনি শক্ত হাতে খেলবেন, এ কথা বলাই যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার অর্জনগুলোর জন্যই তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ভাবেন অনেকে। ক্যারিয়ার শেষে কোন পর্যায়ে যাবেন তিনি, সেটা ভিন্ন আলোচনা। ইতিহাসের সেরা দাবাড়ু কে, এ নিয়েও দাবা-পাড়ায় তর্কের শেষ নেই। তবে গ্যারি ক্যাসপারভ, ম্যাগনাস কার্লসেন আর ববি ফিশার যে সর্বকালের সেরা তিনজন, এ বিষয়ে প্রায় সবাই নিঃসন্দেহ। যাক, আর কথা না বাড়াই। এ বিষয়ে সামনে এক বড়সড় সিরিজ আসছে, সাথেই থাকুন!