“আমি ওকে দ্রুতই কল করেছিলাম। ও বুঝতে পারছিল না কী করবে, পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিল।”
কথাগুলি বলছিলেন পার্থ স্করচার্চের ব্যাটার নিক হবসন। আইপিএলে দল পাওয়ার সময় টিম ডেভিড ছিলেন পাকিস্তানে। পিএসএলে খেলার সময়েই হোটেলরুমে বন্দী অবস্থায় এই সুখবর পান ডেভিড। আর ডেভিডকে প্রথম প্রহরেই ফোনকলে অভিনন্দন জানান নিক হবসন, যিনি কি না দীর্ঘদিন ডেভিডের টিমমেট ছিলেন। ডেভিড অবশ্য নিককে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারেননি। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। এত কাড়াকাড়ি করে আইপিএলে দল পাওয়া অবশ্য যেকোনো ক্রিকেটারের জন্যই স্বপ্ন। টিম ডেভিড তো আর আলাদা কেউ নন। অবশ্য আপনি যদি গত ফেব্রুয়ারিতে ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে দেওয়া ডেভিডের সাক্ষাৎকার দেখে থাকেন, তাহলে এসব আপনার কাছে মোটেও বাড়াবড়ি মনে হবে না। জীবনে কখনও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেননি, ক্রিকেট বলতে ডেভিড বোঝেন বাউন্ডারিটাই। সেই সাক্ষাৎকারেই যেমনটা বলছিলেন তিনি,
“আমার নিজেকে এমনভাবে তৈরি করব, যেন আমি যেন যখন চাই তখনই বাউন্ডারি মারতে পারি।”
আইপিএল ২০২২
২০২২ আইপিএল নিলামের আগের বছরই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছেন টিম ডেভিড। আপনার যদি দেশ-বিদেশের ক্রিকেটের টুকটাক খবর নেওয়ার এতটুকুও অভ্যাস থেকে থাকে, তাহলে টিভি পর্দাতে ভিন্ন কন্ডিশনে টিম ডেভিডকে একের পর এক ছয় মারতে আপনার দেখতে পারার কথা।
২০২১ সালের কথাই ধরা যাক। মহামারী পরবর্তী বছরে এই ফরম্যাটে তার সংগ্রহ ৭০৬ রান। স্ট্রাইক রেট ১৫৩, গড়টাও উপরের দিকে – ৩১! টিম ডেভিডের সবচাইতে বড় গুণ হচ্ছে, যেকোনো ব্যাটিং পজিশনেই তিনি পেস এবং স্পিনের বিপক্ষে সমানভাবে পারদর্শী। ২০২১ সালেই মাত্র একজনই ছিলেন যিনি টিম ডেভিডকে টেক্কা দিতে পেরেছিলেন। অবশ্য মোহাম্মদ রিজওয়ান যে রকম অতিমানবীয় ফর্মে ছিলেন, তাতে সেটাতে এতটুকুও অবাক হওয়ার অবকাশ নেই। রিজওয়ান আইপিএল নিলামে নাম দিতে পারেননি বটে, কিন্তু টিম ডেভিড পেরেছেন। আর বলাই বাহুল্য, তিনি ছিলেন নিলামের হটকেক!
নিলামে সবাই ডেভিডকে চাইছিল। কিন্তু সবাই চাইলেই তো আর ডেভিড সবার হয়ে খেলতে পারবেন না। ডেভিডের শেষ অব্দি ঠাই হয়েছে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে। ৮.২৫ কোটি রুপিতে মুলতান থেকে ডেভিড সোজা চলে এসেছেন মুম্বাইতে। আইপিএলে শুরু হয়েছে টিম ডেভিডের পথচলা।
কিন্তু এত সুবর্ণ শুরুর পরও কিন্তু ডেভিডের জন্যে অপেক্ষা করছিল কালো মেঘের ভেলা। মাত্র ১১ টা বল, দুই ম্যাচে দুই পরাজয়েই মুম্বাই ভেবে নিয়েছিল – যথেষ্ট হয়েছে। টিম ডেভিডকে তারা একাদশ থেকে বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। সে সময় অবশ্য টিম ডেভিডকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হতো যে ইস্যুতে, সেটা হলো ডেভিড নাকি স্পিন খেলতে পারেন না। অথচ এর আগে পৃথিবীর তাবৎ স্পিনারদের টিম ডেভিড একা হাতে শাসন করেছেন। আপনি যদি তখন অব্দি ডেভিডের স্পিনের বিপক্ষে পরিসংখ্যান দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন –
-
রশিদ খানের বিপক্ষে ১৯ বল মোকাবেলায় ডেভিড তুলেছিলেন ৩৬ রান। এর মধ্যে একবারও ডিসমিসালের রেকর্ড নেই।
-
সন্দ্বীপ লামিচানের বিপক্ষে ২৪ বল মোকাবেলায় ডেভিড তুলেছিলেন ৩৫ রান, এখানেও একবারও ডিসমিস হননি।
-
ইমরান তাহিরের বিপক্ষে ১৯ বল মোকাবেলায় ডেভিড তুলেছেন ২৩ রান, তাহির একবারও ডেভিডকে আউট করতে পারেননি।
আর সেজন্যই যারা বলতেন টিম ডেভিডের স্পিনের বিপক্ষে দুর্বলতা আছে, তারা যে নিতান্তই খোঁড়া যুক্তি পেশ করতেন, সেটা প্রমাণিত হতে সময় লাগেনি।
তবে মুম্বাই ডেভিডকে ড্রপ করলেও ডেভিড কিন্তু নিজের প্রতি কমিটমেন্ট ধরে রেখেছিলেন বেশ ভালোভাবেই। আর সেজন্যই হয়তো যে দু’টি ম্যাচে রাজস্থান রয়্যালস আর গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে যখন দলে ফিরলেন ডেভিড, সেখানেই নিজের জাত চেনালেন। রাজস্থানের বিপক্ষে ৯ বলে তিনি করেছিলেন ২০ রান। ইনিংস শেষে জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছেন তিনি। গুজরাটের বিপক্ষেও এর কোনো নড়চড় হয়নি। ২১ বল মোকাবেলায় ৪৪ রান করে এ দফায়ও দলের জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছেন ডেভিড।
অবশ্য ডেভিডের ওপর যারা হতাশ হয়ে গেছিল, তাদের একটুখানি পেছন ফিরে ডেভিডের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে চোখ বুলানো উচিত ছিল। ২৬ বছর বয়সী সিঙ্গাপুরের এই ক্রিকেটার এখন অব্দি ১৫টার বেশি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলেছেন। এর মধ্যে শুধু নেগেটিভ ব্যাটিং ইমপ্যাক্ট আছে ২০২১ আইপিএলে। সেখানে ডেভিড নেমেছিলেনই মাত্র এক ম্যাচে। এছাড়া তিনি যেখানেই খেলেছেন, জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছেন। টিম ডেভিডের ওপর তাই মুম্বাইয়ের দীর্ঘমেয়াদী ভরসা রাখা উচিত। এই মৌসুমটা অবশ্য মুম্বাইয়ের জন্যে ভাল যায়নি; কে জানে, সামনের মৌসুমেই হয়তো টিম ডেভিড হবেন মুম্বাইয়ের শিরোপা জয়ের কান্ডারি!
কৌশল
আপনি যদি সিডনি সিক্সার্সের সাথে হোবার্ট হারিকেন্সের ম্যাচটা দেখে থাকেন, তাহলে সেখানে টিম ডেভিডের তাণ্ডব চালানো ব্যাটিংয়ের মাঝে একটা সূক্ষ্ম অভ্যাস খেয়াল করবেন। টিম ডেভিডের ব্যাটিং বুঝতে আসলে আমরা এই ম্যাচটিকে উদাহরণ হিসেবে নিচ্ছি। যা হোক, সাধারণত ডেভিড যখন পেস বোলারদের মুখোমুখি হন, তখন ডেভিড নিজের পায়ের পজিশন প্যারালালি আনেন না। এটা একটা পায়ের সাথে অন্যটা অনেকটা ‘ইনক্লাইনড’ অবস্থায় থাকে (অবশ্যই মাটি থেকে না, দুই পায়ের সাপেক্ষে)। কিন্তু বোলার যখন বল ডেলিভারি করে ফেলেন, তখন দেখা যায় ডেভিডের পা প্যারালালি চলে এসেছে। নিচে এই ব্যাপারটা বোঝার জন্যে একটা ছবি জুড়ে দিলাম।
এখন ডেভিডের এই টেকনিকের ফলে কী হয়? যখন পা এই প্যারালাল অবস্থায় চলে আসে, তখন পায়ের ‘ফোর্স অ্যালাইনমেন্ট’ও সমান্তরালে চলে আসে। এতে করে যেটা হয়, গ্রিপের জন্যে ব্যাটারের যে ‘নরমাল ফোর্স’-এর প্রয়োজন হয় সেই ‘নরমাল ফোর্স’ ডেভিড একটু বেশিই পান। এতে করেই ডেভিড নিজের শটে অতিরিক্ত পাওয়ার যোগ করতে পারেন।
তবে ডেভিডের এই টেকনিকের অবশ্য সমস্যাও হতে পারে। যদি বোলার কখনও আউটসুইংয়ে লেগসাইডে ডেলিভারি দিয়ে ফেলেন (যেটা কি না ওয়াইড হবে না), তখন এই ফোর্স অ্যালাইনমেন্টের জন্যে বলের দিক ব্যাটারের সাপেক্ষে রিভার্স অ্যাঙ্গেলে চলে যাবে। তখন অবশ্য ডেভিডকে ধুঁকতে হতে পারে।
তবে ডেভিড যে এই ফোর্স এলাইনমেন্ট নিয়ে সাফল্য পাচ্ছেন, তারও একটা বিশেষ কারণ আছে। আর সেটা হল ডেভিডের টাইমিং। ডেভিড এমন সময়ে নিজের ফুটওয়ার্ক দেখাচ্ছেন, যখন বোলারের পক্ষে আর অনুমান করে নিজের বলের গ্রিপের দিক বদলানো সম্ভব হয় না।
তবে স্পিন সামলানোর সময়ে টিম ডেভিডের এই ফুটওয়ার্কের কিছুটা ব্যত্যয় দেখা যায়। সেখানে দেখা যায়, টিম ডেভিড নিজের পা একেবারে সোজাসুজি না নিয়ে এসে কিছুটা আড়াআড়ি করে রাখেন। নিচের ছবি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে।
এখানে টিম ডেভিড যেটা করতে চান, সেটা হলো ফোর্স এলাইনমেন্টকে কিছুটা কোণাকুনি রেখে পেছনের পা দিয়ে একটা টর্ক তৈরি করতে চান। তাতে অবশ্য লাভই হয় টিম ডেভিডের – তিনি ভালোভাবে বাউন্ডারি পার করতে পারেন।
কিন্তু সমস্যা হলো, আইপিএলের প্রথম দুই ম্যাচে তিনি কেন ব্যর্থ হলেন? একদম প্রথম ম্যাচের দিকে যদি আপনি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে পাবেন – দিল্লী ক্যাপিটালসের বিপক্ষে খলিল আহমেদের যে বলটাতে তিনি আউট হয়েছেন, সেখানে তিনি নিজের চিরায়ত ব্যাটিং টেকনিক থেকে দূরে সরে গেছেন। পেস বলের বিপক্ষে ডেভিডের শক্তির যে জায়গাটা, সেই জায়গাটাতেই তিনি স্থির থাকতে পারেন নি। যেহেতু তার পা সোজাসুজি ছিল না, তাই চিরায়তভাবে তিনি বাউন্ডারিতে যে শক্তিটা পান, সেটা পাননি।
আবার দ্বিতীয় ম্যাচেই তিনি আউট হয়েছিলেন চাহালের বলে। এর কারণটাও খুব স্বাভাবিক। একটু আগে স্পিনের বিপক্ষে টিম ডেভিডের যে ছবিটা দেখালাম, সেখানে টর্কের কথা বলেছিলাম। কিন্তু সমস্যা হলো, চাহাল বলের ডেলিভারি লাইনটা একদম লেগ সাইডে সরিয়ে এনেছিলেন। এতে করে টিম ডেভিডের টেকনিকের বৈরী অবস্থা তৈরি হওয়ায় টিম ডেভিডকে বলটা ডিফেন্স করতে হয়েছিল। কিন্তু ডিফেন্সে যথেষ্ট শক্ত না হওয়ায় ডেভিড বলের লাইন বুঝতে ভুল করে লেগ বিফোরের চক্করে পড়ে যান।
কিন্তু চাহাল যে বুদ্ধিটা প্রথম ম্যাচে করলেন, একই ভুল তিনি করলেন ডেভিডের সাথে দ্বিতীয় ম্যাচে। অবশ্য সে ম্যাচে শুধু চাহাল না, রাজস্থানের বেশিরভাগ বোলারই ডেভিডকে স্ট্যাম্প বরাবর নয়তো অফের দিকে বল করছিল। টিম ডেভিডকে আউট করতে হলে তাই লেগ সাইডে ডেলিভারি দিয়ে ডিফেন্স করতে বাধ্য করতে হবে। তাহলেই, মারমুখী ব্যাটার থেকে রক্ষা পেতে পারে বোলাররা।
তবে এখানেও সমস্যা থেকে যায়। আর সেটা হলো টিম ডেভিডের রিফ্লেক্স আর টাইমিং। মুহূর্তের মধ্যে নিজের পা দুটো শিফট করে ফেলতে পারেন তিনি। টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে বড় আবেদনটা আসলে এখানেই। এই একটা ব্যাপার – ‘রিফ্লেক্স’ই যেকোনো ব্যাটারকে উৎরে দিতে পারে। যেমনটা হয়েছে টিম ডেভিডের ক্ষেত্রে; তিনি হয়তো প্রথম দুই ম্যাচে ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু পরের সুযোগ পাওয়া প্রথম দুই ম্যাচেই কিন্তু ঠিকই সাফল্য পেয়েছেন।
এখন শুধু দেখার ব্যাপার, ডেভিড কতটা দূরে যেতে পারেন!
(সকল পরিসংখ্যান ৮ মার্চ অবধি)