৩ জুলাই, ২০০১
২০০১ সালের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়নশিপের চতুর্থ রাউন্ডে আসরের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল খেলোয়াড় পিট সাম্প্রাসের মুখোমুখি ১৯ বছরের এক তরুণ। টানা চারটি আসরের চ্যাম্পিয়ন সাম্প্রাসের কাছে সোনালী চুলের সেই তরুণ হাওয়ায় উড়ে যাবে- এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই ম্যাচের গতিপথ একটু অন্যরকম লাগছিলো। সাম্প্রাসের যে সার্ভগুলোকে সবাই অপ্রতিরোধ্য ভাবতো সেই সার্ভগুলো ১৯ বছরের সেই তরুণ বেশ অবলীলায় ঠেকিয়ে দিচ্ছিলো। সবাইকে অবাক করে প্রথম সেটটা টাইব্রেকারে জিতেই নিলো সেই তরুণ!
দর্শকরা এবার বেশ নড়েচড়ে বসলো, তবে পরের সেটেই সাম্প্রাস যখন ৭-৫ গেমে জিতলেন, তখন সবাই ভাবলো এবার হয়তো সাম্প্রাস খেলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নিয়ে নিবেন। কিন্তু পরের সেট ৬-৪ গেমে জিতে অঘটনের সম্ভাবনা আরো জোরালো করেন সেই তরুণ। চতুর্থ সেট টাইব্রেকে জিতে খেলা পঞ্চম সেটে নিয়ে যান সাম্প্রাস। তবে শেষরক্ষা আর করতে পারেননি, সেই সেট ৭-৫ গেমে জিতে উইম্বলডনের ইতিহাসে অন্যতম বড় অঘটনটি ঘটিয়ে ফেলেন সেই সুইস তরুণ।
ম্যাচজয়ের পর সেই খেলোয়াড়ের উচ্ছ্বাসটাও ছিল দেখার মতো। যাকে আজীবন নিজের আদর্শ বলে মেনে এসেছেন তার বিপক্ষে জয় পাওয়ায় এমন উচ্ছ্বাসই তো স্বাভাবিক।
একটা আকাশে কখনো একইসাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত সম্ভব নয়, কিন্তু সেদিন উইম্বলডনের মাঠে এমনটাই ঘটেছিলো! পিট সাম্প্রাসের মতো সর্বকালের অন্যতম সেরার ক্যারিয়ারের সূর্যাস্তের সাথে সেদিন ১৯ বছরের সেই তরুণের ক্যারিয়ারের সূর্যোদয়টাও ঘটেছিলো। সেদিনের ১৯ বছরের সেই তরুণই আজকের রজার ফেদেরার, যিনি কি না ইতিমধ্যে অনেক টেনিসবোদ্ধার মতে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড়ের আসনটা দখল করে নিয়েছেন।
প্রাথমিক ক্যারিয়ার
১৯৮১ সালের ৮ আগস্ট সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রজার ফেদেরার। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার ব্যাপারে ফেদেরার বেশ আগ্রহী ছিলেন। ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল বেশ ভালো খেললেও লন টেনিসের প্রতি আলাদা একটা ঝোঁক তার সবসময়ই ছিল। মূলত চার বছর বয়সে টেলিভিশনে বরিস বেকারকে উইম্বলডনের শিরোপা জিততে দেখার পর থেকেই টেনিস খেলাটাকে ভালোবেসে ফেলেন তিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে টেনিস ম্যাচ দেখতেন ফেদেরার।
ছয় বছর বয়স থেকেই নিয়মিত টেনিস অনুশীলন করে যাচ্ছিলেন ফেদেরার। শুরু থেকেই তার প্রতিভার ঝলকানি সবার চোখে পড়ছিলো। এই প্রতিভার কারণে সমবয়সীদের চেয়ে সবসময় এগিয়েই থাকতেন ফেদেরার। ১৬ বছর বয়সে জুনিয়র উইম্বলডনের শিরোপা জেতার কিছুদিন পরেই পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে ফেদেরারের যাত্রা শুরু হয়। তার প্রতিভা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ ছিল না, কিন্তু সেসময়ে খামখেয়ালী আচরণের কারণেই তার ক্যারিয়ার নিয়ে অনেকে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।
বর্তমানে রজার ফেদেরার নামটি শুনলেই সবার চোখের সামনে একজন ট্রু জেন্টলম্যান ক্রীড়াব্যক্তিত্বের ছবি ভেসে উঠে, খেলাধুলায় সবচেয়ে ভদ্র খেলোয়াড়ের তালিকা করলে সেখানে হয়তো তার নামটা উপরের দিকেই থাকবে। কিন্তু কিশোর ফেদেরার মোটেও এমন ছিল না। সেই সময়ে খুব অল্পতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলতেন তিনি। ম্যাচ হারলে র্যাকেট ছুঁড়ে মারা, ম্যাচ চলাকালীন সময়ে বারবার মেজাজ হারিয়ে ফেলা– এসব ব্যাপার হরহামেশা ঘটাতেন। তাছাড়া সে সময়ে তিনি কিছুটা অলস প্রকৃতিরও ছিলেন, অনুশীলনেও কিছুটা খামখেয়ালি মনোভাব প্রদর্শন করতেন।
ফেদেরারের যা প্রতিভা ছিল তাতে তিনি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার ক্ষমতা রাখেন- এটা সবাই বিশ্বাস করতো, এমনকি ফেদেরার নিজেও বারবার বিশ্বসেরা হওয়ার কথাটা বলতেন। কিন্তু এসব খামখেয়ালি আচরণের কারণে সেই স্বপ্ন কতটুকু সত্যি হবে এটা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। একজন মানুষ ফেদেরারের মাঝে পরিবর্তন আনার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তিনি তার তৎকালীন কোচ পিটার কার্টার।
ফেদেরারের বয়স যখন নয় বছর তখন থেকেই কার্টারের তত্ত্বাবধানে ফেদেরার নিজেকে তৈরি করছিলেন। তার এই দোষ-ত্রুটিগুলো কাটানোর ব্যাপারে কার্টার সব ধরনের চেষ্টা করেছিলেন। কার্টারের অধীনে ফেদেরার আস্তে আস্তে নিজেকে পরিণত করতে থাকেন।
২০০১ সালে মিলান ইনডোর ওপেনে জিতে পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রথম শিরোপা জিতেন রজার ফেদেরার। সে বছরেই উইম্বলডনে সাম্প্রাসের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক জয় পান ফেদেরার। পরের বছর হামবুর্গ মাস্টার্সের শিরোপা জিতে প্রথম মাস্টার্স সিরিজ জয় করেন ফেদেরার। তবে কোচের অধীনে পুরোপুরি পরিণত হওয়ার সময় ফেদেরার পাননি। এক সড়ক দুর্ঘটনায় পিটান কার্টার মারা গেলে বড়সড় এক ধাক্কা খান ফেদেরার। এই দুর্ঘটনায় খুব মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি, তবে এটাও বুঝেছিলেন যে জীবনের কঠিন যুদ্ধটা এখন থেকে তাকে একাই লড়তে হবে।
ফেদেরার নিজেকে আমূল বদলে ফেলার চেষ্টা করতে থাকেন, বদমেজাজ কিংবা খামখেয়ালীপনা– এসব দোষ থেকে বের হয়ে নিজের আচরণে রাশ টানতে শুরু করেন।
বদলে যাওয়ার সুফল
নিজের মাঝে এই পরিবর্তন আনার সুফল খুব দ্রুত পেতে শুরু করেন রজার ফেদেরার। ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো এটিপি র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ দশে জায়গা করে নেন। ২০০৩ সালে চূড়ান্ত সাফল্যের দেখা পান ফেদেরার। এবছরে অনুষ্ঠিত উইম্বলডনে শুরু থেকেই বেশ ভালো ফর্মে ছিলেন ফেদেরার। তবে সেমিফাইনালে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন তিনি। সেখানে তার প্রতিপক্ষ ছিল আরেক তরুণ সেনসেশন অ্যান্ডি রডিক।
রডিক নিজেও ঘাসের কোর্টে বেশ দক্ষ ছিলেন। তাই ম্যাচের ফলাফল কী হবে তা আগে থেকে অনুমান করা যাচ্ছিলো না। তবে সব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে রডিককে সরাসরি সেটে হারিয়ে প্রথম সুইস হিসেবে গ্র্যান্ডস্ল্যাম ফাইনালে ওঠার গৌরব অর্জন করেন ফেদেরার। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ান মার্ক ফিলিপৌসিসকে সরাসরি সেটে হারিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যামের দেখা পেয়ে যান ফেদেরার। এই গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয় তার ক্যারিয়ারের ভিতটা অনেকখানি শক্ত করে দেয়।
একক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা
২০০৩ উইম্বলডন জয়ের পর ফেদেরারকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই জয় থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে পরের বছর টেনিসে নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন ফেদেরার। মারাত সাফিনকে সরাসরি সেটে হারিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে দারুণভাবে ২০০৪ সালটা শুরু করেন ফেদেরার। এই জয়ের ফলেই ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান দখল করেন তিনি। ক্লে কোর্টের মৌসুমে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও গ্রাস কোর্টে আবারো সদর্পে ফিরে আসেন ফেদেরার।
অ্যান্ডি রডিককে ফাইনালে সরাসরি সেটে হারিয়ে উইম্বলডনের শিরোপা ধরে রাখেন ফেদেরার। তবে ২০০৪ সালের ইউএস ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে বেশ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন ফেদেরার, সাবেক নাম্বার ওয়ান আন্দ্রে আগাসিকে পাঁচ সেটের এক রোমাঞ্চকর ম্যাচে হারিয়ে সেমিফাইনালের টিকিট পান তিনি। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে অবশ্য সেই দাপুটে ফেদেরারকেই দেখা যায়। বিশেষ করে বলতে হয় ফাইনালের কথা। এ ম্যাচে লেটন হিউইটকে ৬-০, ৭-৬, ৬-০ গেমে হারিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে প্রথম ইউএস ওপেনের শিরোপা ঘরে তুলেন ফেদেরার।
২০০৪ সালে শুধুমাত্র র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান নয়, জনপ্রিয়তার দিক থেকেও বাকিদের ছাড়িয়ে যান ফেদেরার। তবে এক্ষেত্রে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। ফেদেরারের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণ শুধুমাত্র ট্রফি জয়ের জন্যই নয়। ট্রফি জয়ের সাথে তার শৈল্পিক খেলার ধরণটাও জনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ। অধিকাংশ টেনিস খেলোয়াড়ের খেলা দেখলে মনে হয় টেনিস বুঝি শুধুমাত্র শক্তির খেলা, শিল্পের জায়গাটা এখানে খুবই গৌণ। এদিক থেকেই ফেদেরার অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। সার্ভে পয়েন্ট নেওয়ার ক্ষেত্রেও পাওয়ার সার্ভে ভরসা না করে নিখুঁত সার্ভের ব্যাপারে জোর দিতেন তিনি।
ফেদেরারের সার্ভ ঠিক কীরকম হবে এটা অনুমান করাটাও প্রতিপক্ষের জন্য বেশ দুরূহ কাজ। তার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ফোরহ্যান্ড শট। অনেকের মতে, ফোরহ্যান্ড শটে ফেদেরার সর্বকালেরই সেরা! খেলার সময়ে পুরো কোর্টজুড়ে ফেদেরারের বিচরণ তার স্বভাবসুলভ খেলাটাকে আরেকটু সহজ করে দিয়েছে। এছাড়া ব্যাকহ্যান্ড, টপস্পিন, স্ম্যাশ, ড্রপশটেও বেশ দক্ষ তিনি। এসব কারণেই গ্রাস কোর্ট ও হার্ড কোর্ট– দুই জায়গাতেই সাফল্যের দেখা পেয়েছেন ফেদেরার। কঠিন সময়েও নান্দনিক সব শট খেলা ফেদেরারের অন্যতম বড় একটা গুণ। তাছাড়া কোচের মৃত্যুর পর নিজেকে আমূল বদলে ফেলার কারণে তার আচরণও বেশ মার্জিত ছিল। সবকিছু মিলিয়ে ফেদেরারের জনপ্রিয়তা এক অন্য উচ্চতায় চলে যায়।
২০০৫ সালের শুরুটাও দাপটের সাথে শুরু করেন ফেদেরার, বছরের প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যাম অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে একটা সেটেও না হেরে সেই আসরের সেমিফাইনালে চলে যান। সেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে পান মারাত সাফিনকে, এ ম্যাচেও বেশ ভালোই খেলছিলেন ফেদেরার। চতুর্থ সেটে ম্যাচ পয়েন্ট জয়ের সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু তখনই হঠাৎ ছন্দপতন! দারুণ এক লব শটে ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে ফেলেন সাফিন। শেষপর্যন্ত সাফিনের কাছে ৩-২ সেটে ম্যাচটি হেরে সেমিফাইনালেই বিদায় নিতে হয় ফেদেরারকে।
এদিকে ক্লে কোর্টের ফ্রেঞ্চ ওপেনেও সেমিফাইনাল পর্যন্ত বেশ দাপটের সাথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ফেদেরার। কিন্তু সেই বছরেই ক্লে কোর্টের রাজা হিসেবে উত্থান হয় রাফায়েল নাদালের। নাদালের সাথে আর পেরে ওঠেননি ফেদেরার। ফলে বছরের প্রথম দুই গ্র্যান্ডস্ল্যামেই হতাশ হয়ে ফিরতে হয় তাকে। সেই হতাশাকে অবশ্য খুব বেশি সময় স্থায়ী হতে দেননি। সেই বছরের উইম্বলডনের ফাইনালে অ্যান্ডি রডিককে সরাসরি সেটে হারিয়ে নিজের পঞ্চম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতে নেন। আর বছরের শেষ গ্র্যান্ডস্ল্যাম টুর্নামেন্ট ইউএস ওপেনের ফাইনালে আন্দ্রে আগাসিকে সরাসরি সেটে হারিয়ে ২০০৫ সালটাও নিজের করে নেন ফেদেরার।
পরিসংখ্যানের বিচারে ২০০৬ সালটা ছিল ফেদেরারের সেরা বছর। সেই বছরের প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যাম অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে মার্কোস বাগদাতিসের মুখোমুখি হন রজার ফেদেরার। প্রথম সেটে হেরে হোঁচট খান ফেদেরার, তবে এরপরেই নিজের চেনা রূপে ফেরেন। ৭-৫, ৬-০ ও ৬-২ গেমে পরের তিন সেট জিতে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন তিনি।
ক্লে কোর্টেও আগের বছরগুলোর তুলনায় এই বছরে ভালো খেলা উপহার দেন। ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালেও চলে গিয়েছিলেন, সেখানে রাফায়েল নাদালকে প্রথম সেটে ৬-১ গেমে হারিয়ে ভালো কিছুর ইঙ্গিতই দিচ্ছিলেন। কিন্তু পরের তিন সেটে নাদালের সাথে আর পেরে ওঠেননি। ফলে ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা সেবারও ফেদেরারের অধরাই রয়ে যায়।
ফ্রেঞ্চ ওপেনে নাদালের কাছে হারার শোধটা উইম্বলডনেই তুলে ফেলেন ফেদেরার। ফাইনালে নাদালকে ৩-১ সেটে হারিয়ে নিজের চতুর্থ উইম্বলডন শিরোপা জিতে নেন তিনি। বছরের শেষ গ্র্যান্ডস্ল্যাম ইউএস ওপেনের ফাইনালে অ্যান্ডি রডিককে ৩-১ সেটে হারিয়ে হ্যাটট্রিক ইউএস ওপেন জয়ের সাথে ২০০৬ সালটা পুরোপুরি নিজের করে নেন রজার ফেদেরার।
২০০৭ সালটাও দুর্দান্ত কাটে ফেদেরারের, একটা সেটেও না হেরে জিতে নেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা। নিজের তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের পথে ফাইনালে হারান ফার্নান্দো গঞ্জালেজকে। আগের বছরের মতো এবারো ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে ওঠেন আর দুর্ভাগ্যবশত এবারো নাদালের কাছে ৩-১ সেটে হারেন।
উইম্বলডনের ফাইনালেও সেই আগের বছরের মতো এবারও নাদাল আর ফেদেরারই মুখোমুখি হন, তবে এবার বেশ কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন নাদাল। সেই বাঁধার দেয়াল টপকে নাদালকে ৩-২ সেটে হারিয়ে টানা পাঁচবার উইম্বলডনের সোনালী ট্রফিটা হাতে তোলেন ফেদেরার।
বছরের শেষ গ্র্যান্ডস্ল্যাম ইউএস ওপেনের ফাইনালে সেসময়ের উঠতি তারকা নোভাক জোকোভিচের মুখোমুখি হন ফেদেরার। তরুণ জোকোভিচ নিজের সেরাটা দিয়ে ফেদেরারকে আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন, ম্যাচটাও বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল। কিন্তু প্রথম দুই সেটেই টাইব্রেকে হেরে যান জোকোভিচ। শেষ সেটে ৬-২ গেমের সহজ জয় নিয়ে টেনিসের উন্মুক্ত যুগের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনবার বছরে তিনটি গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের নজির গড়েন রজার ফেদেরার।
হঠাৎ ছন্দপতন
সেই ২০০৪ সাল থেকে টেনিস সার্কিটে যে একক আধিপত্য ফেদেরার স্থাপন করেছিলেন সেই আধিপত্যে বড়সড় একটা আঘাত আসে ২০০৮ সালে। টানা দশ গ্র্যান্ডস্ল্যাম ফাইনাল খেলার পর ২০০৮ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে এসে ফাইনাল খেলতে ব্যর্থ হন তিনি। সেমিফাইনালে নোভাক জোকোভিচের কাছে হেরে যান সরাসরি সেটে! ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে নাদালের কাছে সরাসরি সেটে হেরে টানা তিনবার এই আসরের ফাইনালে হারতে হয় তাকে।
তবে এই দুই আসরের পরেও ফেদেরারের ভক্তরা আশা হারাননি, কারণ তখনো যে ফেদেরারের সবচেয়ে প্রিয় টুর্নামেন্ট উইম্বলডনের খেলাটাই বাকি রয়ে গিয়েছিলো। উইম্বলডনের ফাইনালেও ফেদেরারের প্রতিপক্ষ ছিলেন রাফায়েল নাদাল। দুজনে মিলে হাড্ডাহাড্ডি এক ম্যাচ উপহার দেন। প্রথম দুই সেট নাদাল জিতে নিলেও পরের দুই সেট জিতে নিয়ে দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসেন ফেদেরার। কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। শেষ সেট ৯-৭ গেমে হেরে টানা ৬৫ ম্যাচ জেতার পর পর ঘাসের মাঠে হারেন ফেদেরার। এ ম্যাচের ব্যাপারে জন ম্যাকেনরো বলেন, “এটা আমার দেখা সর্বকালের সেরা ম্যাচ।”
২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের একক বিভাগে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিলেও দ্বৈত বিভাগে স্ট্যানিলাস ওয়ারিঙ্কাকে সাথে নিয়ে সুইজারল্যান্ডকে স্বর্ণপদক এনে দেন রজার ফেদেরার। বছরের শেষ গ্র্যান্ডস্ল্যাম ইউএস ওপেনের ফাইনালে অ্যান্ডি মারেকে সরাসরি সেটে হারিয়ে ২০০৮ সালে নিজের একমাত্র গ্র্যান্ডস্ল্যামটি জিতে নেন ফেদেরার। তবে বাকি আসরগুলোতে সাফল্য না পাওয়ায় টানা ২৩৭ সপ্তাহ র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকার পর সেই জায়গাটা হারান তিনি।
২০০৯ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে রাফায়েল নাদালের মুখোমুখি হন রজার ফেদেরার। পাঁচ সেটের কঠিন এক লড়াইয়ে নাদালের কাছে হেরে যান ফেদেরার! এই হারের পর সত্যিই ভীষণ ভেঙে পড়েন ফেদেরার, কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি! ছলছল চোখে ফেদেরার বলে ওঠেন, “হে ঈশ্বর, এই কষ্ট সত্যিই যেন আমাকে মেরে ফেলছে!” এই হারের ধাক্কা কাটিয়ে ফেদেরার কিভাবে তার স্বাভাবিক খেলায় ফিরবেন সেটা নিয়ে তার ভক্তরা বেশ চিন্তায়ই পড়ে গিয়েছিলেন।
ক্যারিয়ার গ্র্যান্ডস্ল্যাম পূরণ
তবে ঘন কালো মেঘের আড়ালেই যে সূর্যের হাসি লুকিয়ে থাকে সেটার প্রমাণ বেশ ভালোভাবেই দেন ফেদেরার। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেই হতাশা কাটিয়ে ওঠার মঞ্চ হিসেবে নিজের সবচেয়ে দূর্বল জায়গা ফ্রেঞ্চ ওপেনকেই বেছে নেন। যদিও চতুর্থ রাউন্ডে টমি হাসের বিপক্ষে ০-২ সেটে পিছিয়ে পড়ে বিদায় ঘণ্টা প্রায় বেজেই গিয়েছিলো, তবে পরের তিন সেট জিতে অসাধারণ এক প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে পরের রাউন্ডে চলে যান ফেদেরার। শেষপর্যন্ত সেই আসরের ফাইনালে চলে যান ফেদেরার, তবে আগের চারবারের মতোন এবার আর নাদাল নয়, প্রতিপক্ষ হিসেবে পান রবিন সোদার্লিংকে।
ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতার এমন সুবর্ণ সুযোগ ফেদেরার আর হাতছাড়া করেননি। সোদার্লিংকে সরাসরি সেটে হারিয়ে বহু চেষ্টার পর অবশেষে লাল মাটির দুর্গ রোলা গাঁরো জয় করেন তিনি। এই জয়টা সত্যিই ফেদেরারের জন্য বিশেষ কিছু ছিল। এই জয়ের পর সেই ২০০৩ উইম্বলডনের মতোই আবেগে কেঁদে দিয়েছিলেন তিনি। ফ্রেঞ্চ ওপেনের অধরা শিরোপা জিতে ষষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ক্যারিয়ার গ্র্যান্ডস্ল্যাম পূরণ করেন রজার ফেদেরার। শুধু তা-ই নয়, এই গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের ফলে পিট সাম্প্রাসের সর্বোচ্চ ১৪ গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের রেকর্ডেও ভাগ বসান তিনি।
সেই বছরের উইম্বলডনেও এই ভালো খেলার ধারাটা ধরে রাখেন ফেদেরার। দুর্দান্ত খেলা উপহার দিয়ে ফাইনালে চলে যান তিনি। রেকর্ড ১৫ তম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের পথে শেষ প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজের পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ডি রডিককে পান। তাকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলে দেন রডিক। প্রথম সেটটা তো রডিক ৭-৫ গেমে জিতেই নেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেট টাইব্রেকে জিতে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন ফেদেরার। তবে চতুর্থ সেট জিতে খেলাটা পঞ্চম সেটে নিয়ে যান রডিক। পঞ্চম সেটে দুজনই সমান তালে লড়তে থাকেন। ম্যারাথন সেই সেট শেষপর্যন্ত ১৬-১৪ গেমে জিতে নিজের ষষ্ঠ উইম্বলডনের সাথে পিট সাম্প্রাসকে টপকে সর্বোচ্চ গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের রেকর্ডটা নিজের করে নেন ফেদেরার।
খেলার ধরনের জন্য এমনিতেই ফেদেরারকে সর্বকালের সেরা হিসেবে ধরা হয়। এই গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের রেকর্ডের কারণে পরিসংখ্যানের দিক থেকেও সেই আসনটা নিজের করে নেন তিনি। এই শিরোপা জয় তাকে আবারো এটিপি র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান ফিরিয়ে দেয়। সেই বছরের ইউএস ওপেনের ফাইনালেও খেলেছিলেন ফেদেরার, কিন্তু দেল পোর্তোর বিপক্ষে ২-১ সেটে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ৩-২ সেটে হেরে টানা ষষ্ঠবারের মতো ইউএস ওপেন জেতার সুযোগ হারান তিনি।
২০১০ সালের শুরুটা দুর্দান্তভাবে করেন ফেদেরার। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে অ্যান্ডি মারেকে সরাসরি সেটে হারিয়ে নিজের ১৬ তম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতে নেন। কিন্তু এই শুরুটা পরে আর ধরে রাখতে পারেননি। যে খেলোয়াড় ২০০৪ সাল থেকে গ্র্যান্ডস্ল্যামের ফাইনাল খেলাটাকে হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলেছিলেন, সেই তিনিই বছরের বাকি তিন গ্র্যান্ডস্ল্যামের ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হন! এমন পারফর্মেন্সের কারণে স্বাভাবিকভাবে র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানটাও হারান তিনি।
২০১১ সালে একদমই সুবিধা করতে পারেননি ফেদেরার। সে বছর কোনো গ্র্যান্ডস্ল্যামই জিততে পারেননি! ২০০৩ উইম্বলডন জয়ের পর এই প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়হীন বছর পার করেন। বছর শেষে এটিপি ওয়ার্ল্ড ট্যুর ফাইনালস জয়ই ছিল এ বছরে ফেদেরারের বলার মতো একমাত্র সাফল্য। ২০১২ সালের শুরুটাও ভালোভাবে করতে পারেননি ফেদেরার, রাফায়েল নাদালের কাছে হেরে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের সেমিফাইনালেই বিদায় নিতে হয়। এরপর ফ্রেঞ্চ ওপেনেও সেমিফাইনালেই বিদায় নেন, এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ছিলেন নোভাক জোকোভিচ।
তবে উইম্বলডনে দারুণভাবে ফিরে আসেন ফেদেরার। এবারেও সেমিফাইনালে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন জোকোভিচ। তবে এ দফায় ফেদেরারকে আর হতাশ হতে হয়নি। জোকোভিচকে ৩-১ সেটে হারিয়ে ফাইনালে চলে যান। ফাইনালে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন অ্যান্ডি মারে। স্বাগতিকদের সমর্থন সাথে নিয়ে বেশ ভালো শুরু করেন মারে। প্রথম সেটে মারের কাছে ৪-৬ গেমে হেরে যান ফেদেরার। তবে পরের সেটের একদম শেষ গেমে সার্ভ ব্রেক করে ৭-৫ গেমে জিতে খেলায় সমতা ফেরান ফেদেরার। বৃষ্টির কারণে সেন্টার কোর্টের ছাদ ঢেকে দিয়ে খেলা শুরু করা হয়, ছাদ ঢাকার পর খেলার নিয়ন্ত্রণ পুরো ফেদেরারের কাছে চলে যায়। শেষপর্যন্ত পরের দুই সেট ৬-৩ ও ৬-৪ গেমে জিতে নিয়ে পিট সাম্প্রাসের ছয়টি উইম্বলডন জয়ের রেকর্ডে ভাগ বসান ফেদেরার। এটি ছিল তার সপ্তদশ গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়।
উইম্বলডন জয়ের ফলে দীর্ঘদিন পর আবারো র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান ফিরে পান ফেদেরার। এরপরের মিশন ছিল ২০১২ এর অলিম্পিক গেমস। সেবারের অলিম্পিক ব্রিটেনে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ফেদেরারকে নিয়ে সবার প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু নিজের প্রিয় গ্রাস কোর্টে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হন তিনি। ফাইনালে অ্যান্ডি মারের কাছে সম্পূর্ণ ধরাশয়ী হয়ে সরাসরি সেটে ম্যাচ হেরে রানার্স আপ হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকেন ফেদেরার।
এই কি তবে শেষ?
২০১২ সালের পর ফেদেরারের খেলা দেখে মনে হচ্ছিলো বয়সের ভারটা আসলেই তাকে বেশ কাবু করে ফেলেছে। ২০১২ উইম্বলডন জয়ের পর প্রায় সাড়ে চার বছর কোনো গ্র্যান্ডস্ল্যাম শিরোপা জিততে পারেননি! ২০১৩ সালে তো কোনো গ্র্যান্ডস্ল্যামের ফাইনালেই উঠতে পারেননি। ২০১৪-তে উইম্বলডনের ফাইনালে উঠলেও জোকোভিচের কাছে হার মানতে হয়। ২০১৫ সালে উইম্বলডন ও ইউএস ওপেনের ফাইনালে ওঠেন ফেদেরার, এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুটি ফাইনালেই সেই জোকোভিচের কাছে আবারো হার মানতে হয় তাকে।
হাঁটুর ইনজুরির কারণে ২০১৬ সালে ঠিকমতো খেলারই সুযোগ পাননি ফেদেরার। ফ্রেঞ্চ ওপেন, ব্রাজিল অলিম্পিক ও ইউএস ওপেনের মতো তিনটি বড় ইভেন্ট মিস করেন। এই অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো, ফেদেরারের সময় বুঝি আসলেই শেষ। এই অবস্থায় অনেক টেনিস বিশ্লেষকই ফেদেরারকে অবসর নেওয়ার কথা বলছিলেন। শুধু টেনিস বিশ্লেষকরাই নন, অনেক ভক্তও তার অবসরের কথা ভাবছিলেন!
যে ফেদেরারকে সবসময় এক নাম্বারে দেখতেই অভ্যস্ত ছিল তার ভক্তরা, সেই তিনি যখন র্যাঙ্কিংয়ে ১৬ নাম্বারে চলে যান, তখন এরকম ভাবনাটা খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। তাছাড়া জোকোভিচ, ওয়ারিঙ্কা, মারেদের মতো তরুণদের টেক্কা দিয়ে ফেদেরার আবারো গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতবেন এমনটাও সেসময় আশা করা যাচ্ছিলো না। তাই সব মিলিয়ে অবসরই তখন অবশ্যম্ভাবী ঘটনা হিসেবে মনে হচ্ছিলো।
এভাবেও ফিরে আসা যায়!
সবাই যখন সবকিছু শেষ ভেবে ফেলেছে এমনই এক সময়ে শুরু হলো ২০১৭ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। ফেদেরার ভক্তরা তখন বড় আশা করতেও ভুলে গেছে। আসলে জোকোভিচ, মারে, ওয়ারিঙ্কাদের মতো তরুণদের সাথে ৩৬ বছর বয়সী ফেদেরার ফিটনেসের দিক থেকেই মার খেয়ে যাচ্ছিলেন। তবে সেই আসরের শুরু দিকেই দুই ফেভারিট জোকোভিচ ও মারে বিদায় নিলে ফেদেরার ভক্তরা একটু নড়েচড়ে বসে। এই সেরা দুজনের বিদায়ের সুযোগে ফেদেরার কি কিছু একটা করতে পারবেন?
তবে তখনো সম্পূর্ণ আশাবাদী হওয়ার উপায় ছিল না। কারণ টুর্নামেন্টে তখনো টিকে থাকা বার্ডিচ, নিশিকোরি, ওয়ারিঙ্কাদের কাছে শেষ চার বছরে ফেদেরারের রেকর্ডটাও তো সুবিধার ছিল না। কিন্তু নতুন কৌশলে ফেদেরার যে আসলেই কার্যকরী হয়ে ফিরেছেন সেটার প্রমাণ খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যায় তার ভক্তরা। সব বাঁধা অতিক্রম করে দীর্ঘ সাত বছর পর আবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে পা রাখেন তিনি। ফাইনালে প্রতিপক্ষ হিসেবে পান নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রাফায়েল নাদালকে।
বদলে যাওয়া ফেদেরার এবার শুরু থেকেই নাদালের উপর চড়াও হয়ে খেলতে শুরু করেন। আগে নাদালের সাথে খেলা হলে ব্যাকহ্যান্ড শট খেলতে গিয়ে অনেকবার পয়েন্ট খোয়াতেন। কিন্তু প্রত্যাবর্তনের পর ব্যাকহ্যান্ড শটে ভীষণ দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। তাছাড়া আগে নাদালের সাথে দেখা হলে নার্ভাস হয়েই বহু ভুল করে বসতেন ফেদেরার, তবে এবার আর সেরকম কিছু করলেন না। নাদালকে ৩-২ সেটে হারিয়ে ১৮ তম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতে নেন ফেদেরার। অন্য সব জয়ের চেয়ে এই জয়টা হয়তো বিশেষ কিছু, কারণ সবাই শেষ ভেবে ফেললেও ৩৬ বছর বয়সে এসে ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়ানোর মাহাত্ম্যটাই যে আলাদা।
তবে ফেদেরার বুঝতে পারেন, এই বয়সে চাইলেই সব টুর্নামেন্টে খেলাটা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ কারণে ক্লে কোর্টের সিজনটা বিশ্রামে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তটা যে যৌক্তিক ছিল তার প্রমাণ সে বছরের উইম্বলডনে দেন ফেদেরার, পুরো আসরে একটা সেটও না হেরে রেকর্ড অষ্টমবারের মতো উইম্বলডন শিরোপা জেতেন তিনি। যদিও ইউএস ওপেনে দেল পোর্তোর কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয় তাকে। তবুও সব মিলিয়ে ২০১৭ সালটা ফেদেরারের জন্য ভীষণ বর্ণীল ছিল। এ বছরে খেলা ৫৭টি ম্যাচের মধ্যে ৫২ ম্যাচেই জিতেছিলেন তিনি।
এই প্রত্যাবর্তনের ধারা ২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেও ধরে রাখেন ফেদেরার। মারিন সিলিচকে ৩-২ সেটে হারিয়ে ষষ্ঠবারের মতো অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের শিরোপা জেতেন তিনি। আর নিজের গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের সংখ্যাকে নিয়ে যান ২০ এর ঘরে। আগের বছরের মতো এ বছরেও ক্লে কোর্ট সিজন মিস করেন, তবে এবার আর উইম্বলডন জয় করতে পারেননি। ইউএস ওপেনের মতো এবারো দেল পোর্তোর কাছেই হার মানেন। তবে এ বছরেই দীর্ঘদিন পর আবারো র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠেছিলেন ফেদেরার।
এই ৮ আগস্ট ৩৭ পার করে ৩৮ বছরে পা দিতে যাচ্ছেন রজার ফেদেরার। টেনিসের সেরা সময়টা ৩০ এর পরেই ফিকে হতে শুরু করে, সেদিক থেকে চিন্তা করলে এই বয়সেও ফেদেরার যেভাবে খেলে যাচ্ছেন সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। ২০টি গ্র্যান্ডস্ল্যামসহ এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৯৮টি শিরোপা জিতেছেন ফেদেরার। নান্দনিক টেনিস খেলে সাফল্যের যে চূড়ায় তিনি উঠেছেন, সেটাই তাকে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে গণ্য করার জন্য যথেষ্ট।
টেনিস সম্রাট হওয়ার জন্য আর কোনো ট্রফি হয়তো না জিতলেও চলবে। তবুও ফেদেরার ভক্তদের চাওয়া- যতদিন শরীর সায় দিচ্ছে, ততদিন তিনি খেলাটা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু তার অবসর যেন আসন্ন ছিল এতদিন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, বিদায় বলে দিলেন এই টেনিস উইজার্ড। চলতি মাসে লেভার কাপ টুর্নামেন্টেই হবে কিংবদন্তি রজার ফেদেরারের শেষ পেশাদার টেনিস ম্যাচ।
ফিচার ইমেজ : abc.net.au