দাবা বিশ্বকাপ ২০২৩ শুরু হয়ে গেছে সম্প্রতি। অনেকেই ক্রিকেট ফুটবলের মতই দাবাতেও বিশ্বকাপকেই ভাবেন দাবার দুনিয়ার সবথেকে বড় আসর। তবে দাবার সবথেকে মর্যাদাপূর্ণ আসর যেটি, সেটি ক্লাসিক্যাল দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ। আমাদের আজকের আর্টিকেল সেই সম্পর্কেই। যার বিজয়ীকে দাবার দুনিয়ায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বলে মানা হয়। নতুন এক বিশ্বচ্যাম্পিয়নের দেখা পেয়েছে এবার দাবাবিশ্ব, সেটিও আবার এক দশকেরও বেশি সময় পর, ম্যাগনাস যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে…। সব মিলিয়ে বেশ ঘটনাবহুল ছিল এবারের চ্যাম্পিয়নশিপ! তবে চলুন শুরু করা যাক!
এ বছরের দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজিত হয় কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানা শহরে, ৯-৩০ এপ্রিল। অংশ নেন দুজন দাবাড়ু, ওয়ার্ল্ড #২ এবং ওয়ার্ল্ড #৩ যথাক্রমে ইয়ান নেপোমনিয়াশি এবং ডিং লিরেন (তখনকার র্যাঙ্ক অনুযায়ী)। তারা দুজন কোয়ালিফাই করেন ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিজয়ী এবং ২য় স্থান অর্জন করে। সাধারণত ক্যান্ডিডেটস এর বিজয়ীই হন চ্যালেঞ্জার, যিনি কিনা বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে চ্যালেঞ্জ করেন। কিন্তু এবারে ঘটে যায় একটি ব্যতিক্রম, কারণ সেসময়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন ঘোষণা করেন, তিনি আর তার টাইটেল ডিফেন্ড করবেন না। তাই, বিশ্ব দাবা ফেডারেশন ফিদে জানায়, ক্যান্ডিডেটস এর শীর্ষ দুজন প্রতিযোগীই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার জন্য লড়বেন।
ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট ২০২২
স্পেনের মাদ্রিদ শহরের প্যালেস সান্তোনা-তে ১৬ জুন থেকে ৫ জুলাই বসেছিল দাবার জগতের ২য় মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্টটি। এখানে অংশ নেন ৮ জন বাঘা বাঘা টপ রেটেড সব দাবাড়ু। তাদের নাম এবং কোয়ালিফিকেশন মেথড নিম্নরূপ:
১. ইয়ান নেপোমনিয়াশি [২০২১ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের রানার-আপ]
২. তৈমুর রাজাবভ [ফিদে প্রদত্ত ক্যান্ডিডেট]
৩. ইয়ান ক্রিস্তফ দুদা [২০২১ বিশ্বকাপ বিজয়ী]
৪. আলিরেজা ফিরৌজা [২০২১ ফিদে গ্র্যান্ড সুইস বিজয়ী]
৫. ফাবিয়ানো কারুয়ানা [২০২১ ফিদে গ্র্যান্ড সুইসের রানার-আপ]
৬. হিকারু নাকামুরা [২০২১ গ্র্যান্ড প্রিক্স বিজয়ী]
৭. রিচার্ড রাপোর্ট [২০২১ গ্রান্ড প্রিক্স রানার-আপ]
৮. ডিং লিরেন [মে ২০২২ এ সর্বোচ্চ রেটেড দাবাড়ু]
১৪ রাউন্ডের এই ম্যারাথন রাউন্ড রবিন টুর্নামেন্ট শেষে সবথেকে বেশি ৯.৫ পয়েন্ট নিয়ে বিজয়ী হন ইয়ান নেপোমনিয়াশি। ৮ পয়েন্ট নিয়ে ২য় স্থান নিশ্চিত করেন ডিং লিরেন। যেহেতু ম্যাগনাস কার্লসেন ঘোষণা করেছিলেন, তিনি আর এবার তার বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট ডিফেন্ড করবেন না, সেহেতু ফিদে ঘোষণা করে এই দুজনের মাঝেই হবে পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ। প্রথমার্ধ বাজে কাটিয়েও দ্বিতীয়ার্ধ দারুণ ভালো দিয়ে ৩য় হন তৈমুর রাজাবভ। হিকারু শেষ রাউন্ড হেরে ৪র্থ হন, নতুবা তার সুযোগ ছিল ২য় পজিশনের জন্য টাই করার। ফাবি, আলিরেজা, দুদা আর রাপোর্ট পরবর্তী স্থানগুলো অর্জন করেন।
ম্যাগনাস কার্লসেন হারালেন তার মসনদ
ম্যাগনাস আসলে মসনদ ঠিক হারাননি, বরং ত্যাগ করেছেন। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম তৎকালীন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন ম্যাগনাস। এরপর চলতে থাকে তার জয়রথ। তিনি আনবিটেবল ভাবে একটার পর একটা চ্যাম্পিয়নশিপ টাইটেল ডিফেন্ড করে যেতে থাকেন ২০১৪, ২০১৬, ২০১৮ এবং ২০২১ সালে। পাঁচ পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হবার পর ম্যাগনাসের মনে হতে থাকে এটি আর তার কাছে ততটা গুরুত্ববহ নয়। ২০২১ সালে নেপোকে হারিয়েই তিনি জানান, টাইটেল ডিফেন্ড করতে তিনি আর আগের মত মোটিভেটেড ফিল করছেন না। একবার পাবলিকলি জানিয়ে দেন শুধু আলিরেজা ফিরৌজা ক্যান্ডিডেটস জিতে তাকে চ্যালেঞ্জ করলেই কেবল খেলবেন তিনি, নচেৎ নয়। শেষমেশ, ২০২২ সালের জুলাই মাসে ম্যাগনাস তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফিদেকে জানান যে, তিনি আর খেলছেন না বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে। এরপর ফিদে ক্যান্ডিডেটস এ ২য় স্থান অর্জনকারী ডিং লিরেনকে আমন্ত্রণ জানায়, নেপোর সাথে টাইটেল অর্জনের লড়াইতে!
প্রতিযোগীগণ
২০২৩ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন র্যাঙ্কিং এর ২ এবং ৩, অর্থাৎ নেপো আর ডিং। তাদের ব্যাপারে সবিস্তারে জানবো এই অংশে, সাথে জেনে নেবো হেড টু হেড তাদের পরিসংখ্যানও!
ইয়ান নেপোমনিয়াশি
নেপো ইতিহাসের ২য় ব্যক্তি হিসেবে ব্যাক টু ব্যাক টাইটেল ম্যাচ খেলার জন্য কোয়ালিফাই করেন! এর আগে মাত্র ভাসিলি স্মিস্লভ ২ বার টানা ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট জেতেন। ম্যাগনাসের সাথে ২০২১ সালে হেরেও দমে যাননি নেপো, এরপরের ক্যান্ডিডেটসেও রেকর্ড পরিমাণ পয়েন্ট স্কোর করে কোয়ালিফাই করেন। এবারে নেপোর একটু ব্যাকগ্রাউন্ড ঘেঁটে আসি চলুন। মাত্র ৪ বছর বয়সে দাদার কাছে দাবায় হাতেখড়ি নেপোর। ছোট থেকেই প্রডিজি ছিলেন নেপো, শুধু দাবাতেই নয় অন্যান্য অনেক বিষয়েও বয়সভিত্তিক পর্যায়ে পুরস্কার জেতেন নেপো। এমনকি এককালে ফ্রস্টনোভা নিকনেমে ডোটাতেও কম্পিটটিভ পর্যায়ে খেলা শুরু করেন, কিন্তু পরবর্তীতে দাবাকেই ক্যারিয়ার পাথ হিসেবে বেছে নেন। জিএম হন ২০০৭ সালে। এরপর থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ওয়ার্ল্ড #২ র্যাঙ্কিং এ উন্নীত হন, এবং ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ রেটিং ২৭৯৫ ইলো অর্জন করেন।
ডিং লিরেন
চীনের ইতিহাসের সবথেকে বেশি রেটিংধারী দাবাড়ু ডিং লিরেন ১৯৯২ সালে ওয়েনজু শহরে জন্ম নেন। শৈশব থেকেই ট্যালেন্টেড ডিং মাত্র ১৬ বছর বয়সে চাইনিজ চ্যাম্পিয়ন হন [চীনের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ]। গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবও লাভ করেন সেবছরই, ২০০৯ সালে। ২০১১, ২০১২ সালে টানা দুবছর আবারও চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ২০১৭ সালে তিনি চীনের ইতিহাসে ১ম দাবাড়ু হিসেবে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন, দাবা বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার মাধ্যমে। এর পরের বছর তিনি ২৮০০ রেটিং এর মাইলফলক স্পর্শ করেন। ২০১৭-১৮ সালে তার ১০০+ গেম আনবিটেন থাকার স্ট্রিক ছিল তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড (যা অবশ্য পরে ম্যাগনাস ভাঙেন)!
হেড টু হেড লড়াইয়ে কে এগিয়ে?
নেপো – ডিং
ক্লাসিক্যাল ৩-২ [৯ ড্র]
র্যাপিড ৪-২
ব্লিটজ ৪-১ [২ ড্র]
অনলাইন ইভেন্ট ২৬.৫-১৯.৫
উল্লেখ্য, সবগুলো পরিসংখ্যানই নেপোর অনুকূলে!
মূল ম্যাচ: ১৪ গেমের দক্ষযজ্ঞ
৯ এপ্রিল ২০২৩, এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ২০১৩ এর পর ১ম কোনো দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ হতে যাচ্ছে, ম্যাগনাস কার্লসেনকে ছাড়া। মুখোমুখি ২ ক্যান্ডিডেট ইয়ান নেপো আর ডিং লিরেন। ১ম গেম শান্তিপূর্ণ ড্র হলেও, ২য় গেম জিতেই লিড নিয়ে নিলেন নেপো! সেটিও আবার কালো ঘুঁটি নিয়ে। ডিং-ও ঘুরে দাঁড়াতে আর সময় নিলেন না। ৩য় রাউন্ড ড্র করে ৪র্থ রাউন্ড জিতেই ট্র্যাকে ফিরলেন। কিন্তু না, এরপরই শুরু হল ধারাবর্ণনার ভাষ্য অনুযায়ী ‘ব্লাডবাথ’! ৫ম, ৬ষ্ঠ আর ৭ম রাউন্ড জিতে নিলেন যথাক্রমে নেপো, ডিং আবারও নেপো! এখন স্কোর দাঁড়ালো নেপোর ফেভারে ৪-৩!
৮ম থেকে ১১ তম পর্যন্ত ৪টি রাউন্ড ড্র হলো। এ পর্যন্ত নেপো এগিয়ে আছেন ৬-৫ পয়েন্টে, আর বাকি ৩ রাউন্ড! ১২তম রাউন্ড জিতে আবারও সমতা আনলেন ডিং! শেষ রাউন্ড দুটি ড্র হলো। ১৪ রাউন্ড শেষে ৭-৭ পয়েন্টে টাই, খেলার ভাগ্য গিয়ে দাঁড়ালো র্যাপিড টাইব্রেকারে!
টাইব্রেক
নেপো বরাবরই শর্টার টাইম ফরম্যাটে ফেবারিট, অতীত ট্রাক রেকর্ডও তা-ই বলে! তাই বোদ্ধারা এবার ধরেই নিচ্ছিলেন যে, ক্লাসিক্যালে যখন খেলার ভাগ্য নির্ধারিত হলো না, র্যাপিডে নেপোই হতে চলেছেন ম্যাগনাস উত্তর যুগে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। কিন্তু না! সকল জল্পনা কল্পনাকে দূরে সরিয়ে ৩ রাউন্ড ড্র-য়ের পর ৪র্থ রাউন্ডটি জিতে নিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট নিজের করে নেন ডিং!
ডিং লিরেন হলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন
ইতিহাসে ১ম চাইনিজ বিশ্বচ্যাম্পিয়নের দেখা পেল দাবাবিশ্ব! হাজার বছরের ইতিহাসে দাবার দুনিয়া কখনও কোনো চাইনিজ দাবাড়ুকে দেখেনি গোটা দাবাবিশ্ব শাসন করতে! এবার ইতিহাসের পাতাকে নতুন করে লেখার পালা। নারীদের দাবায় যদিও চাইনিজ আধিপত্য বেশ আগে থেকেই। অনেক নারী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আছেন চাইনিজ, কিন্তু ওপেন সেগমেন্টে ডিং লিরেনই ছিলেন ১ম ক্যান্ডিডেট! প্রথমবারের ক্যান্ডিডেট থেকে প্রথমবারেই বাজিমাত… ১ম চাইনিজ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! পরে জানা যায়, ডিং তার স্বপ্ন হিসেবে বলেছিলেন, তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে চান। তার ইচ্ছা পুরো বিশ্বের দাবা অঙ্গনে পূর্ববর্তী লেজেন্ড বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের সাথে তার গেমগুলোও স্টাডি করানো হোক। গ্যারি ক্যাসপারভ, আনাতলি কারপভ, ম্যাগনাস কার্লসেন, ববি ফিশার, হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কাদের পাশে তার ছবিও শোভা পাক সারা বিশ্বের দাবা ক্লাবগুলোতে! নিশ্চয়ই তার এই অভিপ্রায় পূর্ণ হয়েছে। সাড়া বিশ্ব এখন বিনা বাক্যে ডিং-স্তুতিতে মত্ত!
শেষকথা
বর্তমানে চলছে দাবা বিশ্বকাপের ২০২৩ সালের আসর। আজারবাইজানের বাকুতে পুরো বিশ্বের ৮০টি দেশের ৩০৯ জন প্রতিযোগী অংশ নেন এই টুর্নামেন্টে! বাংলাদেশ থেকেও অংশ নিয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব, ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ফাহাদ রহমান, উইমেন ফিদে মাস্টার নোশিন আঞ্জুম, উইমেন ক্যান্ডিডেট মাস্টার জান্নাতুল ফেরদৌস এই চারজন দাবাড়ু। বাংলাদেশের দাবাড়ুদের পারফরম্যান্স এবং বিশ্বকাপের সার্বিক আপডেট নিয়ে আগামীতে নতুন কোনো আর্টিকেলে আশা করি জানাবো। উল্লেখ্য, এই ফিদে বিশ্বকাপও কিন্তু দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়নের চ্যালেঞ্জার তথা ক্যান্ডিডেট বাছাই করারই অন্যতম একটি টুর্নামেন্ট!