১
ম্যাচটি নিয়ে কারো মাঝে তেমন কোনো উত্তেজনা ছিল না। সাধারণত উত্তেজনা সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তা থেকে। যখন কোনো ম্যাচের আগে সেই অনিশ্চয়তাটুকু শেষ হয়ে যায়, তখন সেটার প্রতি মানুষের আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। পরিস্থিতি ঠিক এমনটাই ছিল ১৯৯৬ সালে কেনিয়ার মাঠে হওয়া সেই টুর্নামেন্টে।
অথচ কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে হওয়া চার জাতির সেই টুর্নামেন্টের পাকিস্তান বনাম শ্রীলঙ্কার গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটি ছিল অনেকটাই অলিখিত সেমিফাইনালের মতো। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অস্বাভাবিক ফর্ম আর পাকিস্তানের অফ ফর্মের কারণে ম্যাচটির রেজাল্ট মোটামুটি অনুমেয়ই ছিল। কেনিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শ্রীলঙ্কা ছিল ফুরফুরে মেজাজে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বিশাল ব্যবধানে (৬২ রান) হারার পর কেনিয়ার বিপক্ষে প্রতিটা ১৪৮ রান তাড়া করতে গিয়েও পাকিস্তানকে হারাতে হয় ৬টি উইকেট। এই পাকিস্তানের পক্ষে শ্রীলঙ্কাকে হারানো তাই একটু কঠিনই মনে হচ্ছিল।
অনিশ্চয়তার বিষয়টি কমে যাওয়ার পেছনে আসলে আরেকটি কারণ ছিল। পাকিস্তানকে শুধু জয় পেলেই হবে না, রান রেটে এগিয়ে যাবার জন্য জিততে হবে বিশাল ব্যবধানে। ৯৬ বিশ্বকাপ জেতার পর ফর্মে থাকা শ্রীলঙ্কাই তখন ফেভারিট। মাস ছয়েক আগেই সিঙ্গাপুরের মাঠে হওয়া টুর্নামেন্টে এই পাকিস্তানের বিপক্ষেই সবচেয়ে কম বলে (১৭ বল) অর্ধশত আর কম বলে (৪৮ বল) শতরানের রেকর্ডটা গড়েছেন জয়াসুরিয়া।
শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইন আপ তখন এতটাই ফর্মে যে, তাদের বিপক্ষে ৩০০ রানও নিরাপদ স্কোর নয়। সেই শ্রীলঙ্কাকে বিশাল ব্যবধানে হারানো তাই আকাশকুসুম কল্পনা বলেই মনে হচ্ছিল। তবুও কাগজ কলমে যেহেতু সুযোগ একটা আছে এবং সাথে আছে পাকিস্তানের অসম্ভবকে সম্ভব করার রেকর্ড, সেকারণে ম্যাচটির প্রতি অল্প কিছু মানুষের আগ্রহ ছিল। বলা যায়, সেই আগ্রহ নিয়ে যারা ম্যাচটা দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তারা হতাশ হননি।
২
ক্রিকেটে চাপমুক্ত থাকতে চাওয়ার একটি অলিখিত শর্ত হচ্ছে টস জিতে ব্যাটিং করা। শ্রীলঙ্কার রান তাড়া করার সক্ষমতার কথা মাথায় রেখেও পাকিস্তানি অধিনায়ক সাঈদ আনোয়ার টস জিতে তাই ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্তই নিলেন। ওপেনিংয়ে নামলেন সাঈদ আনোয়ার আর সেলিম এলাহী, সেলিম সেসময় পর্যন্ত ওয়ানডেতে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করা মাত্র চারজন ব্যাটসম্যানের একজন। ওপেনিং জুটিতে এলো ৬০ রান, সেটা মাত্র ৬১ বলে হলেও চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। প্রথম উইকেট পড়ার পর মাঠে নামার কথার রমিজ রাজার, যিনি কিনা কিছুটা ধীর গতিতে ব্যাটিং করার জন্য পরিচিত। কিন্তু নামলেন সম্পূর্ণ অচেনা এক তরুণ, যিনি লেগ স্পিনার হিসেবে মুশতাক আহমেদের ইনজুরির সুবাদে দলে জায়গা পেয়েছিলেন। এই ধারণাটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। রান রেট বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য মাঝেমাঝেই মোটামুটি ব্যাটিং করতে পারে এমন বোলারদেরকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দিয়ে উপরে উঠিয়ে আনা হয়। শহীদ খান আফ্রিদি নামক সেই তরুণকে আনার উদ্দেশ্য এমনটাই ছিল।
কুমারা ধর্মসেনার প্রথম বলটিতে কোনো রান হলো না, কিন্তু দ্বিতীয় বলেই লেগ সাইড দিয়ে বিশাল একটা ছক্কা মেরে তরুণটি বুঝিয়ে দিলেন, পাকিস্তান শ্রীলঙ্কাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য চেষ্টার ত্রুটি করবে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম রান ছক্কা মেরে শুরু করার পরে আরও কয়েকটি ওভারে এই তরুণের তাণ্ডবই চলল। পাকিস্তানের প্রথম ৫০ রান হয়েছিল যেখানে ৫৩ বলে, পরের ৫০ রান হয়ে গেল মাত্র ২৭ বলে। একটু পর আফ্রিদির ব্যক্তিগত অর্ধশত রানও পূরণ হয়ে গেল, সেটিও মাত্র ১৮ বলে, যা কিনা তখনকার বিশ্বরেকর্ডের চেয়ে মাত্র ১ বল কম। এই ১৮টি বলের মাঝে ১১টি ছিল স্কোরিং শট, তার মানে বাকি ৭টি বল ছিল ডট। এর মাঝে ৭টি ছয় আর ১টি চারে এসেছে ৪৬ রান, বাকি ৩ বলে দৌড়ে নিয়েছে ৪ রান। সেই মুহূর্তে তো কেউ ভাবতে পারেনি যে এই ছেলে পরবর্তীতে তার পুরো ক্যারিয়ারে রানের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে একেবারেই পছন্দ করবেন না, শুধু বাউন্ডারি থেকেই রান করতে চাইবেন। তবে তখনো তার কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
অর্ধশত করার পর যেন তার পেটানোর ইচ্ছেটা আরও তীব্র হলো। পরের অর্ধশত করলেন মাত্র ১৯ বলে, এরপর ৩৭ বলেই করে ফেললেন সেঞ্চুরির রেকর্ড! এর আগের রেকর্ডটি ছিল ৪৮ বলে জয়াসুরিয়ার। মজার বিষয় হচ্ছে, রেকর্ডটি গড়ার সময় আফ্রিদি সবচেয়ে বেশি ছয় মেরেছিলেন এই জয়াসুরিয়ার বিপক্ষেই। জয়াসুরিয়া সেই ম্যাচে ১০ ওভার বল করে রান দেন ৯৪। আরেকটি মজার বিষয় ঘটে সেটি হলো, জয়াসুরিয়ার বলে আফ্রিদি দুটি এমন বড় ছক্কা মারেন যে সেগুলো মাঠের বাইরে থাকা গাড়ির কাচ ভেঙে ফেলে। শেষপর্যন্ত নিজের খেলা ৪০তম বলে তুলে মারতে গিয়ে ক্যাচ আউট হয়ে ফেরত আসলেন তিনি। ততক্ষণে সবচেয়ে কম বলে সেঞ্চুরির রেকর্ডের পাশাপাশি এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কা (১১টি) মারার রেকর্ডটিও স্পর্শ করে ফেলেছেন তিনি।
আফ্রিদি নেমেছিলেন ১০.১ ওভার পর দলীয় ৬০ রানের সময়, আউট হলেন ১৯.৫ ওভারে দলীয় ১৮৬ রানের সময়। মাঝের ৬০ বলে ১২৬ রানের জুটিতে তার অবদানই ১০১। সাঈদ আনোয়ারের মতো একজন স্ট্রোকমেকারও সেদিন ছিলেন সাপোর্টিং অ্যাক্টরের ভূমিকায়।
পরবর্তীতে সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরি, সেলিম মালিকের ৪০+ রান আর লোয়ার অর্ডারের কিছু ক্যামিও ইনিংসের সুবাদে পাকিস্তান দাঁড় করায় ৩৭১ রানের একটা বিশাল স্কোর। সেই সময় ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে বেশি দলীয় রানের ইনিংসে হিসাবে এটি ছিল দ্বিতীয়। তবে তখনও পুরো কাজ সম্পন্ন হয়নি।
৩
শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইনআপ সম্পর্কে সেই সময় একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, তাদেরকে ৪০০ রান তাড়া করতে দিলেও সেটি করে ফেলাটা বিচিত্র কিছু নয়। অবশ্য কথাটি শুধুমাত্র তাদের রান তাড়া করতে পারার সামর্থ্যের একটি উপমা কিংবা উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ৩৭২ রান তাড়া করা খুব কঠিন হলেও অন্তত ২৯০ রান করাটা খুব বেশি কঠিন ছিল না সেই শ্রীলঙ্কার জন্য। হ্যাঁ, ফাইনালে যাবার জন্য এই ২৯০ রানটুকুই যথেষ্ট ছিল শ্রীলঙ্কার জন্য। কিন্তু এই কাজটাই কঠিন বানিয়ে ফেললেন ওয়াকার ইউনুস। শ্রীলঙ্কার দুই টর্নেডো জয়াসুরিয়া আর কালুভিথরানাকে আউট করে ফেললেন ২৬ রানের মাঝে। এরপর আরও দুই ব্যাটিং নির্ভরতা গুরুসিনহে আর রোশান মহানামাকেও ফেরালেন যথাক্রমে ১ আর ০ রানে। মাত্র ২৭ রানেই চার উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা তখন নাবিকহারা জাহাজের মতো রানের উত্তাল সমুদ্রে ভেসে ভেড়াচ্ছে।
হাল ধরার কাজটি সেই মুহূর্তে করলেন অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান অর্জুনা রানাতুঙ্গা আর অরবিন্দ ডি সিলভা। এই দুজন মিলে দলকে নিয়ে গেলেন ১৫১ রান পর্যন্ত। সেই সময়ে ব্যক্তিগত ৫২ রানের মাথায় রানাতুঙ্গা আউট হয়ে যাবার পর দ্রুত হাসান তিলকারত্নেও ফিরে গেলে শ্রীলঙ্কার রানের গতি শ্লথ হয়ে যায়। কুমারা ধর্মসেনাকে নিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যান অরবিন্দ ডি সিলভা। ব্যক্তিগত ১২২ রানের মাথায় যখন ডি সিলভা আউট হন, তখন ফাইনালে যাবার জন্য শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন মাত্র ২০ রান। চামিন্দা ভাসের ১৩ বলে এক ছক্কা আর দুই চারে ১৬ রানের এক ক্যামিওর সুবাদে শ্রীলঙ্কা লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিল।
ফাইনালে যাওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ছিল ২ বলে মাত্র ১ রান। ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়াকার ইউনুসের একটা অসাধারণ বলে ক্রস খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান শেষ ব্যাটসম্যান চামিন্দা ভাস। ওয়াকার ইউনুস ম্যাচে পায় ৫ উইকেট আর সাকলাইন মুশতাক ৪ উইকেট। ম্যাচটি পাকিস্তান ৯২ রানে জিতলেও ফাইনাল নিশ্চিত করে সেই শেষ বলের বোল্ডটাই। পরবর্তীতে শহীদ আফ্রিদির সেঞ্চুরিটি হাইলাইটেড হলেও ম্যাচের মূল রোমাঞ্চটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
৪
সবাইকে চমকে দিয়ে ফাইনালে গেলেও শেষপর্যন্ত ফাইনালটা হেরে যায় পাকিস্তান দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে, সেটিও একতরফাভাবেই। পাকিস্তান প্রথমে ব্যাটিং করে মাত্র ২০৩ রানেই অল আউট হয়ে যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা ৩৯.৩ ওভারেই সেটি পার হয়ে যায় ৩ উইকেট হারিয়ে। তবে সেই টুর্নামেন্ট থেকেই আবির্ভাব হয় শহীদ আফ্রিদি নামক এক ধূমকেতুর, যিনি কিনা পরবর্তী ১৯ বছর ক্রিকেট বিশ্বকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে এন্ডারসন ৩৬ বলে সেঞ্চুরি আর ডি ভিলিয়ার্স ৩১ বলে সেঞ্চুরি করে বল আর রানের পার্থক্যটাকে আরও কমিয়ে নিয়ে আসলেও, প্রতিপক্ষ আর পরিস্থিতির গুরুত্বের বিচারে শহীদ আফ্রিদির ইনিংসটাই এগিয়ে থাকবে- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ফিচার ইমেজ: Twitter