
‘ডিজঅ্যাপয়েন্টমেন্ট ইজ অ্যান আন্ডারস্টেইটমেন্ট।’
২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর টুইট করেছিলেন লিয়াম প্লাঙ্কেট। ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতার মাত্র দুই মাস পরই ইসিবির (ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড) কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়েছিলেন তিনি। চুক্তি থেকে বাদ পড়ার হতাশায় এমন টুইট করেছিলেন প্লাঙ্কেট।
গত জুলাইয়ে লর্ডসে বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতার পর ইংলিশ গণমাধ্যমে প্লাঙ্কেটকে নিয়ে খুব বেশি শিরোনাম হয়নি। বেন স্টোকসের দখলেই ছিল গণমাধ্যমের স্তুতির সর্বস্ব। কারণ ফাইনালে ধ্রুপদী ‘বীরোচিত’ ব্যাটিং করেছিলেন স্টোকস। কিন্তু ফাইনাল শেষে প্লাঙ্কেট ঠিকই বলতে পারতেন, আমিও আমার সেরাটা দিয়েছি। এবং সেই ঘোষণা বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হতো না।
লর্ডসের ফাইনালে ৪২ রানে তিন উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। নিউ জিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন, হেনরি নিকোলস ও জিমি নিশামকে ফিরিয়েছিলেন প্লাঙ্কেট। ইংল্যান্ড অধিনায়ক ইয়োন মরগানের জন্য বড় ভরসা ছিলেন তিনি। মাঝের ওভারগুলোতে গতির ঝড় তোলা, উইকেট নেয়া, কিংবা ব্রেক-থ্রু এনে দিতে সিদ্ধহস্ত এই ইংলিশ পেসার। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ইনিংসের মাঝের ওভারগুলোতে (১১-৪০ ওভার) সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলার প্লাঙ্কেট। এই সময়ে ৫৬ ম্যাচে ৫৪ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।

ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ দলে তার জায়গাও হয়েছিল অনেকজনকে টপকে। ডেভিড উইলি, ক্রিস জর্ডান, কারেন ব্রাদারসদের ছাপিয়ে দলে আসেন প্লাঙ্কেট। দুর্দান্ত ফিটনেস, বোলিংয়ের দুরন্ত গতি মিলে নির্বাচকদের পছন্দে এগিয়ে ছিলেন তিনি। পাশাপাশি লোয়ার অর্ডারে দ্রুত রানও তুলতে পারেন। দীর্ঘদেহী এই পেসারের উচ্চতা ৬ ফিট ৩ ইঞ্চি, ফলে উচ্চতাজনিত সুবিধা তো রয়েছেই।
মজার বিষয়, বিশ্বকাপে ৭টি ম্যাচ খেলেছিলেন ৩৪ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। যার সবকটিতেই জিতেছিল ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপে ওভারপ্রতি ৪.৮৫ রান দিয়েছিলেন তিনি। গড় ছিল ২৪.১১, উইকেট নিয়েছিলেন ১১টি।
বলা বাহুল্য, লর্ডসের ওই ফাইনালের পর (২০১৯, ডিসেম্বর পর্যন্ত) আর ইংল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডে খেলতে পারেননি প্লাঙ্কেট। তবে বঙ্গবন্ধু বিপিএলে চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে খেলতে এসেছিলেন এই ইংলিশ ক্রিকেটার। এর আগেও সিলেট সিক্সার্সের জার্সিতে বিপিএল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

ইংল্যান্ডের হয়ে ১৩ টেস্ট, ৮৯ ওয়ানডে ও ২২ টি-২০ খেলেছেন (২০১৯, ডিসেম্বর পর্যন্ত)। তবে দেশের জন্য প্রথমবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতাকেই নিজের ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ অর্জন বলেছেন প্লাঙ্কেট। তার সঙ্গে কথোপকথনেরই কিয়দংশ রইলো রোর বাংলার পাঠকদের জন্য:
বিশ্বকাপ জেতা নিশ্চয়ই আপনার ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত…
হ্যাঁ, শতভাগ। আমি ভালো ক্রিকেট খেলেছিলাম, কিন্তু এটাই আমার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ অর্জন। ওই দলটা ওয়ানডেতে বিশ্বের এক নম্বর দল হয়েছিল। গত তিন-চার বছরে টার্গেটই ছিল এক নম্বর দল হওয়া, এবং ফাইনালে হোম কন্ডিশনে লর্ডসে সুপার ওভারে বিশ্বকাপ জেতা… মানে এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।
বিশ্বকাপজয়ী এই দলটাই কি ইংল্যান্ডের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা দল?
আমি মনে করি, অধিনায়কত্ব ছিল খুব ভালো। দলের সব খেলোয়াড় চাইতো, সবাই ভালো খেলুক। সবাই খুব প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী ছিল। খেলাটা উপভোগ করতো। যদি আমরা শুরুতে কিছু উইকেট হারাতামও, আমরা নিজেদের গুটিয়ে নিতাম না। আমরা আক্রমণ করে গেছি, এবং রান করে গেছি। একই বিষয় বোলিংয়ের ক্ষেত্রেও। আমরা সবসময় উইকেট নেয়ার চেষ্টা করেছি।
বিশ্বকাপের আগে দারুণ ফর্মে ছিল ইংল্যান্ড। আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলেছে। আক্রমণই কি মূল মন্ত্র ছিল দলটার?
সবাই দেখেছে, ইংল্যান্ড কীভাবে খেলেছে। আমার মনে হয়, সবাই মানিয়ে নেবে। আমি বলবো, এটা একটা চক্র। অস্ট্রেলিয়া শুরু করেছে, আবার দলটা গড়ে তুলছে। তারা দারুণ ক্রিকেট খেলছে। নিউ জিল্যান্ড, ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দারুণ সব দল ছিল। এর মাঝেই বিশ্বকাপ জেতা সত্যিই বিশেষ কিছু।

বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষ দিকে ইংল্যান্ডের ড্রেসিংরুমের অবস্থা কেমন ছিল?
এটা হলো এমন জায়গা, যেখানে আপনি মানুষের কাছ থেকে শিখবেন। বিভিন্ন দল থেকে আপনি অনুপ্রেরণা পাবেন। আমি নিশ্চিত, সবাই বিশ্বকাপ ফাইনালটা দেখতে চাইবে। যখন আপনি প্রেরণা খুঁজতে চেষ্টা করবেন ওই শেষ বল থেকে। আমি মনে করি, ড্রেসিংরুমে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম। আমরা জানতাম, আমাদের কী করতে হবে। সবাই জানতো, কাজটা কীভাবে করতে হবে। যখন আপনি নিজের কাজটা করবেন, তখন আপনি জিতে যাবেন।
ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের হারটা হতাশাজনক ছিল। বাউন্ডারি বেশি মারায় ট্রফি জিতেছিল ইংল্যান্ড। নিয়মটা অবশ্য আইসিসি বাতিল করেছে। মনে হয় না আপনারা খুব ভাগ্যবান ছিলেন?
অবশ্যই তাদের (নিউ জিল্যান্ড) জন্য হতাশাজনক ছিল। কিন্তু আমরা আমাদের জয়টাই দেখবো। আপনি নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকাপ জিততে চাইবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা সেরা ক্রিকেট খেলেছিলাম বিশ্বকাপে। শেষ কয়েক বছরে ওয়ানডেতে যে ক্রিকেট খেলেছি, আমার মতে, সেটাকেই আমরা জয়ের মঞ্চে নিয়ে গিয়েছিলাম।
সুপার ওভারের আগেই আসলে জিততে পারতো ইংল্যান্ড। যদিও খুব কঠিন অবস্থা থেকে ম্যাচটা টেনে নিয়ে গেছেন স্টোকস। ড্রেসিংরুমে আপনারা কতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে স্টোকস পারবে?
আমরা বিশ্বাস করতাম, স্টোকস পারবে। এবং রশীদও খুব ভালো ব্যাটসম্যান। তার ১১টা প্রথম শ্রেণির সেঞ্চুরি আছে। সে শুধুই ব্যাটিং কম পায়, কারণ টপ-অর্ডার সত্যিই খুব ভালো করছিল। তখনও আমাদের বিশ্বাস ছিল, ওরা জেতাতে পারবে।

২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হারের পরই বদলে গেল ওয়ানডের ইংল্যান্ড দল। ওই হারটা অনেক পুড়িয়েছে ইংল্যান্ডকে…
আমি ওই বিশ্বকাপে ছিলাম না। আমি জানি না, তখন সেটা কেমন লেগেছিল। তবে সেটা খুব হতাশাজনক ছিল। আমি নিশ্চিত, তখনই গোটা দল একত্র হয়েছিল, এবং তারা ভিন্ন দিকে যাওয়ার চিন্তা করেছে। এবং সেটাই পরে ঘটেছিল।
২০০৫ সালে ডারহামের হয়ে এক মৌসুমে ৫০ উইকেট নিয়ে নজরে এসেছিলেন। ওই বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। অনেক লম্বা সময়। নিজের খেলায় দুই সময়ের পার্থক্য কী দেখেন?
আমার ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো, আমি এখন আরও বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ। আমি এখন আর নার্ভাস নই, আমি আমার সম্পর্কে জানি, আমি আমার খেলাটাকে জানি। তাই আমি এখন কিছুটা নির্ভার। যখন আপনি তরুণ, অনেক সময় আপনি কোনো কিছু পেতে তাড়াহুড়ো করবেন। আমি যেটা বললাম, আমি অনেক ক্রিকেট খেলেছি, আমার অভিজ্ঞতা আছে, সেটা আমাকে অনেক সাহায্য করে।

অনেক বছর ধরে ক্রিকেট খেলছেন। বয়সও ৩৪ হয়ে গেছে। এখনও সর্বোচ্চ পর্যায়ে পারফর্ম করছেন। নিজের ভেতর লড়াইয়ের মোটিভেশন পান কীভাবে?
আমি ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করি। আমি সবসময় চিন্তা করি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্যই আমি এসেছি, এবং এই পর্যায়ে খেলছিও। আমার কিছু বাজে সময় গিয়েছে। আমি টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে কাজ করেছি, তারপর ফিরে আসি। ২০১৪-১৫ সালের দিক থেকে জোরে বোলিংয়ের চেষ্টা করি, এবং জোরে বোলিং করেছি। তা অ্যাকুরেসি ফিরে পেতে আমাকে সাহায্য করেছে।
ইনিংসের মাঝের ওভারগুলো আপনি খুব সফল বোলার। অনেক বৈচিত্র্য থাকে আপনার বোলিংয়ে। ডেথ ওভারে বোলিংয়েও কতটা কার্যকর হতে পারে আপনার বোলিং?
আমি মিডল ওভারগুলোতে বোলিং করি। আমার মনে হয়, ডেথ ওভার আপনাকে প্রতিনিয়ত চিন্তাশীল করবে। আপনাকে অনেক বৈচিত্র্য নিয়ে বোলিং করতে হবে। ইয়র্কার করতে হবে। এখানে বিশ্বের সেরা যারা, যেমন মালিঙ্গা-ডোয়াইন ব্রাভো ইয়র্কার করে, স্লোয়ার করে। তারা ব্যাটসম্যানকে পড়তে পারে যে, ব্যাটসম্যান কী করতে যাচ্ছে। ব্যাটসম্যান এগিয়ে আসবে, নাকি পেছনে যাবে। আপনাকে অনেক সময় ব্যাটসম্যানকে পড়তে হবে। তখনই আপনি তাকে ভড়কে দিতে পারবেন। সেরা বোলাররা ঠিক এটাই করে।