
ক্রিকেট যেমন একটি খেলা, ফুটবলও তা-ই। কিন্তু ফুটবলাররা যখন অনুশীলনে ক্রিকেট খেলেন না, ক্রিকেটারদের কেন ফুটবল খেলতে হবে? উত্তরে তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে। বিতর্কের মূল কারণ, ফুটবল খেলতে গিয়ে ক্রিকেটারদের ইনজুরিতে পড়ার লাইনটা দীর্ঘ হচ্ছে নিয়মিত। তালিকার সর্বশেষ দুটি নাম বাংলাদেশের। শুরুতে নাসির হোসেন, তারপর মুশফিকুর রহিম। পরপর একই দলের দুই ক্রিকেটারের এমন কাণ্ডে ধার কমেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে।
তবে ফুটবল খেলতে গিয়ে ক্রিকেটারদের ইনজুরিতে পড়ার ব্যাপারটি নতুন কিছু নয়। মূলত, সাধারণ ওয়ার্ম-আপ করার চেয়ে ফুটবল খেললেই বেশি কাজ হয়। সঙ্গে ম্যাচের আগে আগে খানিকটা সময় ফুটবল খেললে তা দলে ঐক্য বাড়ায় বলেও মনে করেন একাধিক ক্রিকেটার। তাই খেলাটি ক্রিকেটারদের অনুশীলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু ভুল পদক্ষেপের কারণে এই ফুটবলই ইনজুরির কারণ হচ্ছে বারবার। ফুটবল খেলতে গিয়ে ক্রিকেটারদের ইনজুরিতে পড়ার এমন কিছু গল্প নিয়ে এই আয়োজন।
নাসির হোসেন (বাংলাদেশ)

ইনজুরির পর বিসিবি কার্যালয়ে নাসির হোসেন; Source: Daily Star
বাংলাদেশ জাতীয় দলের এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার মূলত কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গিয়ে চোটে পড়েন। ঢাকায় ফিরে পরীক্ষা করে জানা যায়, তার হাঁটুর লিগামেন্টই ছিড়ে গেছে। সাধারণত এ ধরনের ইনজুরিগুলো পেসারদের হয়ে থাকে। নাসিরের ইনজুরি এতটাই গুরুতর যে, তাকে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে এবং অন্তত মাস ছয়েক মাঠের বাইরে থাকতে হবে। তার এই ইনজুরি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অফিসিয়াল চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী পরামর্শ দিয়েছেন, ক্রিকেটারদের ফুটবল না খেলাটাই ভালো, অন্তত অনুশীলনে। সেক্ষেত্রে অনুশীলনের আগে ওয়ার্ম আপের জন্য ব্যাডমিন্টন, টেনিস কিংবা টেবিল টেনিস খেলা যেতে পারে।
ইনজুরির কারণে চলমান বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) পাশাপাশি জাতীয় দলের পরবর্তী সিরিজগুলোতে বিবেচিত হতে পারছেন না নাসির হোসেন। যদিও তিনি দলে জায়গা পাওয়া নিয়ে লড়াই করছিলেন।
মুশফিকুর রহিম (বাংলাদেশ)

কোচ ও সতীর্থের সঙ্গে ফুটবলে মজেছেন মুশফিকুর রহিম; Source: Daily Sun
নাসিরের পর এই কাতারে পড়েছেন দলের সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। চলমান বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) খেলতে গিয়ে গোড়ালির চোটে পড়েছেন তিনি। সেই খেলাটা ক্রিকেট নয়, ফুটবল। উত্তরাঞ্চলের হয়ে খেলতে গিয়ে অনুশীলনে ফুটবল খেলছিলেন মুশফিকরা। সেখানে দলের সতীর্থ নাজমুল হোসেন শান্তর সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যান এবং বড় ধরনের চোট পান তিনি। সে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন মুশফিক। পরের ইনিংসে ব্যাট করার আগে চোট পান। যদিও তার ব্যাট করার প্রয়োজন হয়নি।
বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরী এই চোটকে অ্যাঙ্কেল স্প্রেইন বলে অভিহিত করেছেন। পরপর দুজন ক্রিকেটারের ইনজুরির কারণ ফুটবল, এই ব্যাপারটা তাকেও ভাবাচ্ছে। জানিয়েছেন, মুশফিককে অন্তত সপ্তাহখানেক এই চোটের কারণে দলের বাইরে থাকতে হবে। সুখবর এই যে, নাসিরের মতো তাকে ছুরিকাঁচির নিচে যেতে হচ্ছে না।
যুবরাজ সিং (ভারত)

যুবরাজ সিং; Source: One India
ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ সালে ঢাকার মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের আগে খালি পায়ে ফুটবল খেলছিলেন যুবরাজ। মূলত দলের ট্রেইনার সুদর্শনের পরামর্শেই খালি পায়ে ফুটবল খেলা। তিনি ক্রিকেটারদের অনুশীলনে একটি ব্যতিক্রমী কিছু করাতে চাইছিলেন। তাতেই ইনজুরিতে পড়েন যুবরাজ। এই ঘটনাও বেশ আলোড়ন তুলেছিল। সংবাদ সম্মেলনে ঘুরেফিরে যুবরাজের খালি পায়ে ফুটবল খেলা নিয়ে প্রশ্ন আসছিল। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি বলেছিলেন, “আমাদের টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে তাই খালি পায়ে ফুটবল খেলেছি।”
ম্যাট প্রিয়র (ইংল্যান্ড)

ম্যাট প্রিয়র; Source: Sky Sports
ইংল্যান্ডের সাবেক উইকেটরক্ষক ও ব্যাটসম্যান ম্যাট প্রিয়রও ফুটবল খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েছিলেন। ব্রিজটনে জাতীয় দলের অনুশীলনের সময় ২০০৯ সালে এই ঘটনা ঘটে। পিঠে চোট লেগেছিল তার। অ্যাশেজ সিরিজের মাঝামাঝি সময়ে এমন একটি ঘটনা দলকে বেশ চাপের মুখে ফেলে দেয়। চতুর্থ ম্যাচে এর ফলটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল ইংলিশরা। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১০২ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল তারা। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ জিতেছিল এক ইনিংস ও ৮০ রানের বিশাল ব্যবধানে।
দুর্ভাগ্যের সেখানেই শেষ নয়। ম্যাট প্রিয়রের সতীর্থ জো ডেনলিও এক মাস পর ফুটবল খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়েছিলেন। অবশ্য তার ইনজুরি নিয়ে বেশ বিতর্ক হয়েছিল ইংল্যান্ডে। ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের আগে অনুশীলনে ফুটবল খেলতে গিয়ে হাঁটুতে চোট পান ডেনলি। বলা হচ্ছিল, এর দায় ছিল ওয়াইস শাহর। ডেনলির ইনজুরির পর ওয়াইস শাহকে বেশিদিন ইংল্যান্ডের জার্সিতে দেখা যায়নি।
রোহিত শর্মা (ভারত)

ফুটবল অনুশীলনে রোহিত শর্মা; Source: NewIndianExpress
চলতি ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৫ টেস্ট খেলেছেন রোহিত শর্মা। কাগজে-কলমে তার অভিষেক হয়েছিল ২০১৩ সালে। মজার ব্যাপার হলো, তার অভিষেক হতে পারতো আরো সাড়ে তিন বছর আগে ২০১০ সালে। কিন্তু ফুটবল তাকে পিছিয়ে দিয়েছিল। ঘরের মাঠ নাগপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট ক্যাপ পরিধান করার কথা ছিল রোহিতের। কিন্তু হয়নি। অনুশীলনে ফুটবল খেলতে গিয়ে গোড়ালিতে চোট পেলেন, সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়লেন। ফিরেছিলেন দ্রুতই। কিন্তু সাদা পোশাকের টেস্ট খেলতে অপেক্ষা করতে হলো আরো অনেকটা সময়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘটা সেই ঘটনার পর থেকে রোহিত শর্মার সমর্থক এবং এমনকি পুরো টিম ম্যানেজমেন্টও তার ফুটবল খেলা নিয়ে আতঙ্কে থাকে। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, রোহিত যেহেতু ফ্যান্টাসি ফুটবলের পাগল, তাই তার সোফাতে বসে ভিডিও গেমেই ফুটবল খেলা উচিত। এটা তার জন্য অনেক বেশি নিরাপদ।
কাইরন পোলার্ড (উইন্ডিজ)

আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অনুশীলনে চলছে পোলার্ডের ফুটবল খেলা; Source: Mumbai Indians
উইন্ডিজের মারকুটে ব্যাটসম্যান কাইরন পোলার্ডেরও ফুটবল খেলতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনিও নাসিরের মতো ৬ মাস মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাননি এ কারণেই। নিজের দেশে এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচে অংশ নিয়ে বড় ধরনের চোট পান এবং জাতীয় ক্রিকেট দল থেকে ছিটকে পড়েন। এই ইনজুরি নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া ছিলো বেশ মজার। পোলার্ড বলেছিলেন,
“ফুটবল আমাকে এমন এক ইনজুরি এনে দিলো যা ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি। ৬ মাস মাঠের বাইরে থেকে এর মূল্যটা ভালো করেই দিতে হবে আমাকে। এমন কিছু ব্যাপারে আপনাকে শিক্ষা নিতেই হবে। কিন্তু দিন শেষে, আমি ফুটবল খেলা দেখবোই। আমি একজন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পাঁড় সমর্থক। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”
মারলন স্যামুয়েলস (উইন্ডিজ)

মারলন স্যামুয়েলস; Source: proudjamaica.com
পোলার্ডের সতীর্থ মারলন স্যামুয়েলস খুব সহজেই জ্যামাইকান জাতীয় ফুটবল দলে নিজের ভাগ্য খুঁজে নিতে পারতেন। কিন্তু পারেননি ইনজুরির কারণে। এ প্রসঙ্গে একবার স্যামুয়েলস বলেছিলেন, “আমি কিংস্টন কলেজে যেতাম ফুটবল খেলতে। কিন্তু আমি একবার আমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে খুব খারাপভাবে চোট পাই। চিকিৎসক আমাকে আজীবনের জন্য ফুটবল খেলা ছাড়তে বলেছেন। …তারপর থেকে আমি মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবে আসি এবং ক্রিকেট খেলা শুরু করি।”
ফুটবল খেললে কতটা সফল হতেন স্যামুয়েলস, তা আন্দাজ করা শক্ত। কিন্তু ক্রিকেট খেলার সিদ্ধান্তটা যে একেবারেই ভুল ছিল না, সেটা ওয়েস্ট উইন্ডিজের জার্সিতে ৭১ টেস্ট, ১৯৯ ওয়ানডে আর ৬৩টি-টোয়েন্টি খেলে প্রমাণ করেছেন আগেই।
ফিচার ইমেজ:BCB