Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাহুল দ্রাবিড়: ক্রিকেটের এক মহাপ্রাচীরের নাম

প্রথম ১৫ মিনিটের মধ্যেই আপনি তার উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করুন যদি তা না পারেন তাহলে বাকিদের উইকেট নেওয়ার চেষ্টা করুন।

তাকে নিয়ে এমনই উক্তি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের এক কিংবদন্তী ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহ। বলছিলাম রাহুল দ্রাবিড়ের কথা। ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভার মালিক হয়তো তিনি ছিলেন না। কিন্তু খেলার মাঠের একাগ্রতা, সহনশীলতা, একনিষ্ঠ ব্যাটিংই তাকে বানিয়েছে ক্রিকেটের অন্যতম এক সেরা ব্যাটসম্যান ।

রাহুল দ্রাবিড়: ক্রিকেটের এক মহাপ্রাচীর; ছবিসূত্র :indianexpress. com

১.

২০১২ সালের মার্চের ঘটনা। হঠাৎ করেই ব্যাঙ্গালোরের চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ডাকলেন এক প্রেস কনফারেন্স। ততক্ষণে সবার মাঝে একটা বলাবলি শুরুই হয়ে গিয়েছিল এর নেপথ্যে কারণ। দীর্ঘ দিনের সতীর্থ অনিল কুম্বলে, তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এর সভাপতি এন শ্রীনিবাসন বোর্ড কর্মকতা এদের সকলের সমীপেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। কিছুটা ম্লান মুখ নিয়েই বসে ছিলেন সাংবাদিকদের সামনে।

প্রেস কনফারেন্সে দ্রাবিড়; ছবিসূত্র:espncricinfo

“যে জায়গায় আমি ১৬ বছর ধরে আছি সেটা ছেড়ে দেওয়াটা এতটা সহজ নয়। আমি যা অর্জন করেছি তাতে আমি খুশি। এটাই উপযুক্ত সময় নতুনদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার।”

কিছুটা গম্ভীর গলাতেই কথাগুলো বলেছিলেন দ্রাবিড়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন আজ হঠাৎ করেই সে জায়গায় থেকে দূরে সরে যাওয়ার কষ্টটা নিজের মধ্যেই ধরে রেখেছেন তিনি। তবে এ সিদ্ধান্ত তিনি হঠাৎ করেই নিয়েছিলেন কি? এর আগে ২৪-২৮ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার সাথে ২য় টেস্টে দুই ইনিংসে করেন ১ ও ২৫ রান। তখন কেই বা জানতে এটিই হবে দ্রাবিড়ের শেষ আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ। একমাত্র তিনিই হয়তো জানতেন, ভারতীয় ক্রিকেটে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। সেই সিরিজে ভারত হারে ৪-০ ব্যবধানে। এর আগে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেন। সেবছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

২.

১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এক মারাঠি পরিবারে তার জন্ম ।পুরো নাম রাহুল শারদ দ্রাবিড়। তবে বাবা-মায়ের কাজের সুবাদে তাদের ব্যাঙ্গালোর চলে আসতে হয়। বাবা ছিলেন এক জ্যাম কোম্পানির কর্মকতা, মা স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপিকা। ছোট বেলায় খুব জ্যাম খেতে পছন্দ করতেন বলে সবাই তাকে আদর করে জ্যামি বলে ডাকতো। মূলত স্কুল ক্রিকেট দিয়েই তার ক্রিকেটের হাতে খড়ি শুরু। চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে একবার সামার ক্যাম্প চলছিল। সেখানেই রাহুল নজরে আসেন সাবেক ভারতীয় ক্রিকেটার কেকি তারাপোরের। এরপর কর্ণাটকের হয়ে খেলছেন অনুর্ধ ১৫, ১৭ ও ১৯ দলে।

কলেজে পড়াকালীন কর্ণাটকের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে তার অভিষেক। সেই দলে তার সাথে খেলেছিল ভারতের আর এক সাবেক ক্রিকেটার অনিল কুম্বলে। বেশ কয়েক বছর রঞ্জি ট্রফিতে ভাল খেলার সুবাদে ভারতীয় নির্বাচকদের নজরে আসেন তিনি। ১৯৯৬ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। অভিষেক ম্যাচ খুব একটা সুখের ছিল না। তবে টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেকেই দ্রাবিড় ঠিকই নিজের জাত চিনিয়েছেন। সেই বছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তার টেস্ট অভিষেক।

সেঞ্চুরি থেকে তখন দ্রাবিড় মাত্র ৫ রান দূরে। এমন সময় ক্রিস লুইসের ছোঁড়া এক বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। সেই বছর শেষে সাউথ আফ্রিকার কাছে প্রথম টেস্টে মাত্র ৬৬ রানে অল আউট হয় ভারত। দ্রাবিড় করেন ২৭ রান। পরবর্তীতে তাকে ৩ নং পজিশনে খেলতে দেওয়া হয়। ৩য় টেস্টে দ্রাবিড় তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট শতক।

দ্রাবিড়ের একটি দৃষ্টিনন্দন শট; ছবিসূত্র: sportskeeda.com

৩.

১৯৯৭ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে চেন্নাই এ করেন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। মাঝখানে টেস্ট ক্রিকেটে ভাল করলেও একদিনের ক্রিকেটে তার পারফর্মেন্সে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে শচীনকে সাথে নিয়ে গড়েছিলেন ২৩৮ রানের পার্টনারশিপ। সেই ম্যাচে নিয়মিত উইকেটরক্ষক নয়ন মংগিয়া ইঞ্জুরির কবলে পড়লে গ্লাভস হাতে তিনিই নেমে পড়েন উইকেটকিপিং করতে। পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সৌরভ-দ্রাবিড় এর ৩১৮ রানের জুটি; যা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ। এতে দ্রাবিড়ের অবদান ছিল ১৪৫। ২০০০ সালে শচীন অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করলে অধিনায়কের দায়িত্ব আসে সৌরভ গাঙ্গুলির হাতে। দ্রাবিড় নির্বাচিত হন সহ-অধিনায়ক হিসেবে। ২০০১ সালে ইডেন গার্ডেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভিভিএস লহ্মণকে সাথে নিয়ে গড়েন ঐতিহাসিক ৩৭৬ রানের জুটি

ঐতিহাসিক সেই জুটির পর রাহুল ও লহ্মণ; ছবিসূত্র: the hindu.com

২০০৫ সালে সৌরভ অধিনায়কত্ব থেকে পদত্যাগ করলে দ্রাবিড়কে অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। ২০টি টেস্ট এবং ৬২টি একদিনের ম্যাচে ভারতের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ২০০৭ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়লে ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে তিনি অধিনায়কত্বের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।

৪.

২০১০ সালে মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২য় টেস্টের ২য় দিনে বাংলাদেশি পেসার শাহাদত হোসেনের ছোঁড়া বাউন্সারে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মাঠ ছাড়েন। আঘাত এতটাই বেশি ছিল যে, পরবর্তীতে তাকে রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শাহাদতের বাউন্সারে মাঠে লুটিয়ে পড়ে দ্রাবিড়; ছবিসূত্র:getty images

৫.

২০০৩ সালে বিয়ে করেন ডা. বিজেতা পেন্ডারকারকে। দুই পরিবারের মধ্যে জানাশোনা আগে থেকেই ছিল। বিয়েটা হয়েছিল ঐতিহ্যবাহী মারাঠী রীতিতে। তবে তাদের পরিবারের অনুরোধে তাদের বিয়ের ছবি মিডিয়া প্রকাশ করেনি। ২০০৫ সালে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান সামিত। ২য় সন্তান অভয় জন্ম নেয় ২০০৯ সালে। সামিত এখন কর্ণাটক অনূর্ধ্ব-১৪ টিমের হয়ে খেলছে।

দ্রাবিড় পরিবারের সদস্যরা; ছবিসূত্র: marathi tv.com

৬.

১৬ বছরের ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন ১৬৪টি, রান করেছেন ১৩,২৮৮টি। মাঠে কাটিয়েছেন ৪৪,১৫২ মিনিট। ৩৩৪টি ওডিআই ম্যাচে তার রান সংখ্যা ১০,৮৮৯। টেস্ট এবং ওডিআই ম্যাচে ভারতের এক আস্থার প্রতীক ছিলেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটটা অনেকের কাছে বোরিং লাগলেও তিনি যেন টেস্ট ক্রিকেটেই খুঁজে পেয়েছিলেন ক্রিকেটের আসল অর্থ। ১৬৪টি ম্যাচে সম্মুখীন হয়েছেন ৩১,২৬৮টি বলের, যা শচীনের চাইতেও ঢের বেশি। টেস্ট ক্যারিয়ারের ৫টি ডাবল সেঞ্চুরি প্রত্যেকটির স্কোর ছিল আগেরটির থেকে বেশি।

পিচে তার ব্যাট যেন ছিল এক এক অভেদ্য দেওয়াল। যে দেওয়াল ভেদ করে তাকে আউট করাটা ছিল বোলারদের জন্যে রীতিমত এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ‘দ্য ওয়াল’ নামটা যেন একমাত্র তার নামের সাথেই মানায়। ফিল্ডার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার কৃতিত্বটাও তার। মোট ক্যাচ নিয়েছেন ২১০টি। তার নেওয়া স্লিপে অসাধারণ সব ক্যাচ নিমিষেই ঘুরিয়ে দিতো ম্যাচের মোড়। টেস্ট ক্রিকেটে কখনো শূন্য রানে আউট হননি তিনি। সবগুলো টেস্ট প্লেয়িং দলের বিরুদ্ধেও তার রয়েছে সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারে প্রাপ্তির সংখাও নেহায়েত কম নয়। ১৯৯৮ সালে পান অর্জুনা অ্যাওয়ার্ড। ২০০০ সালে ভূষিত হন ‘উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ এ। ২০০৪ সালে পদ্মী শ্রী, ২০১৩ তে পদ্মভূষণ অর্জন করেন। ২০১৭ সালে এনডিটিভি তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে।

৭.

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) এ খেলেছেন রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর এবং রাজস্থান রয়েলসের হয়ে। অবশ্য কখনো আইপিএলের শিরোপা হাতে ছোঁয়া হয়নি। ৮৯টি আইপিএল ম্যাচে তার রান ২,১৭৪। দ্রাবিড় আইপিএলে শেষবারের মত কাজ করেছেন দিল্লী ডেয়ারডেভিলসের মেন্টর হিসেবে।

রিশাভ প্রান্ত ও রাহুল দ্রাবিড়; ছবিসূত্র: im.rediff.com

৮.

২০১৫ সালে নিয়োগ পান ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ হিসেবে। কাজ করেছেন এ দল নিয়েও। মাঝখানে ভারতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবেও তার নামের গুঞ্জন উঠেছিল। সব কিছুকে ভিত্তিহীন বলে তিনি জানান, ছোটদের নিয়ে কাজ করতে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। জাতীয় দল নিয়ে তিনি এখন ভাবছেন না। রিশাভ পান্ত, করুণ নায়ার এর মতো উদীয়মান ক্রিকেটাররা তার হাতেই তৈরি। সম্প্রতি তার অধীনে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দল।

ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক পৃথ্বীশ এর সাথে কোচ রাহুল দ্রাবিড়; ছবিসূত্র: Hindustantimes.com

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতার ফলে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ৩০ লাখ এবং কোচিং স্টাফদের ২০ লাখ রুপি করে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করে। প্রধান কোচ দ্রাবিড় হওয়ার দ্রাবিড়কে ৫০ লাখ রুপি দেওয়ার ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি দ্রাবিড়ের কাছে বৈষম্যের মনে হয়। তার মতে, দলকে জেতাতে দলের অন্যান্য কোচিং স্টাফরাও সমান ভূমিকা রেখেছে। তবে এই বৈষম্য কেন? পরে তার অনুরোধে দ্রাবিড়সহ দলের অন্যান্য কোচিং স্টাফদের সবাইকে ২৫ লাখ রুপি অর্থ পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়।

এত বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারে যে কখনো সমালোচনার মুখোমুখি হননি তা কিন্তু নয়। ২০০৪ সালে মুলতান টেস্ট চলাকালীন শচীন ১৯৪ রানে অপরাজিত থাকাকালীন দ্রাবিড় ইনিংস ঘোষণা করেন। তার এমন আচরণ ক্রিকেট ভক্তকূলে অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

গত বছরের ২৭ জানুয়ারি ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ডক্টরেট উপাধি দেওয়ার বিষয়ে একটা প্রস্তাব পাঠায়। তবে তিনি সেটি নাকচ করে দেন। দ্রাবিড় জানায়, তিনি এই পুরস্কারের যোগ্য নন। পড়াশোনা কিংবা গবেষণার মাধ্যমে যেদিন তিনি যোগ্য হবেন সেদিনই নিবেন এই উপাধি।

এত প্রাপ্তির মধ্যেও দ্রাবিড়ের ক্যারিয়ারে কিছুটা অতৃপ্তি রয়েই গেছে। ক্যারিয়ারে কখনো বিশ্বকাপ কিংবা আইসিসির কোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট জেতা হয়নি তার। হয়তো একসময় তিনিই হবেন ভারতীয় জাতীয় দলের কোচ। এখন দেখার বিষয় একটাই, খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জেতার যে স্বাদ পাননি দ্রাবিড় জাতীয় দলের কোচ হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের সে স্বাদ পান কিনা।

ফিচার ইমেজ:sportzwiki.com

Related Articles