করোনা মহামারীর পরবর্তী সময়ে ইউরোপ ফুটবলে দলবদলের ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তার একটা ছোট্ট নমুনা ছিল গত বছরের গ্রীষ্মকালীন দলবদল মৌসুম। মহামারীর কারণে খেলা বন্ধ, মাঠে দর্শক নেই। এছাড়া জার্সি বিক্রি, টিভিসত্ত্ব থেকে ক্লাবগুলোর আয় প্রায় অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছিল। তাই এই ক্ষতি সামলে উঠতে পারেনি অনেক বড় ক্লাব। এজন্য একাদশে খেলোয়াড়-স্বল্পতা থাকার পরও খেলোয়াড় কিনতে পারেনি তারা। এছাড়াও বড় ক্লাবে দেনার পরিমাণও থাকে আকাশছোঁয়া। কিন্তু তাদের নিয়মিত আয় এই অঙ্ককে খবরের কাগজে পাতা শিরোনাম হতে দেয় না। তবে এবার এই দেনার অবস্থা প্রকাশ্যে এসেছে। মহামারীর কবলে পরে স্পেনের অন্যতম দুই ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার দেনার পরিমাণ ১ বিলিয়ন ইউরোর আশেপাশে।
যদিও বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদের মতো অবস্থা হয়নি প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর। আর্সেনাল, টটেনহ্যাম হটস্পার, ম্যানচেস্টার সিটি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড গত বছর খেলোয়াড় কিনতে খরচ করেছিল ৫০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি। তবে এদের ভেতর চেলসি ছিল বেশি খরুচে। দলকে ঢেলে সাজাতে মহামারীর ভেতরও তারা ব্যয় করেছে ২০০ মিলিয়ন ইউরো।
তবে আজকের বিষয় ক্লাবের অবস্থা বা পুরো ট্রান্সফারের খবর নয়। গত বছর ক্লাবের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দলবদলের হাল-হকিকত বিশ্লেষণ করে দেখা হবে আজকের আয়োজনে।
স্পেন থেকে শুরু করা যাক। এক্ষেত্রে উহ্য থাকবে রিয়াল মাদ্রিদ। কারণ, গত বছর তারা কোনো খেলোয়াড়ই কেনেনি। তবে বার্সেলোনা যে খুব খরুচে স্বভাবে ছিল, তাও নয়। ক্লাবের রক্ষণে ধুঁকতে থাকা নেলসন সেমেদোকে উলভারহ্যাম্পটনের কাছে বিক্রি করে, ঐ অর্থ দিয়েই দলে ভিড়িয়েছিল সার্জিনো দেস্তকে। তবে বড় কাণ্ড ঘটেছিল লুইস সুয়ারেজকে ঘিরে। নতুন কোচ রোনাল্ড ক্যোমান এসে ঘোষণা দিলেন, তার পরিকল্পনায় সুয়ারেজ নেই। অগত্যা নতুন স্ট্রাইকার না কিনেই ক্লাবের ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলোয়াড়কে তারা ছেড়ে দিল বিনামূল্যে। এরপর থেকেই কাতালানরা স্ট্রাইকারখরায় ভুগছে। গ্রিজমান একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার নন, ব্রাথওয়েটও খুবই গড়পড়তা মানের স্ট্রাইকার। বর্তমানে চলা শীতকালীন দলবদলেও বার্সা নতুন খেলোয়াড় কিনতে পারবে না। তাই ব্রাথওয়েট ও গ্রিজমানকে দিয়েই দায়সারা কাজ চালাতে হবে তাদের।
কিন্তু বার্সেলোনা থেকে বিনা মূল্যে পাওয়া সুয়ারেজকে নিয়ে একরকম উড়ছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। ওয়ান্দা মেট্রোপলিটানোতে এসে প্রথম ম্যাচ থেকেই দুর্দান্ত খেলছেল এই উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার। ১২ গোল করে লা লিগার বর্তমান সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। আর এক ম্যাচ কম খেলেও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রিয়াল মাদ্রিদ থেকে এগিয়ে আছে ৭ পয়েন্টে। ট্যাক্টিক্যাল দিক ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে হয়তো সুয়ারেজের প্রস্থান বার্সেলোনার সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের জন্য তা ভাগ্য পরিবর্তনের।
এবার অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ থেকে সোজা আর্সেনালে চলে যাওয়া যাক। কারণ গানার্সরা দলবদলের একদম শেষদিনে এসে এখান থেকেই টমাস পার্টেকে দলে ভিড়িয়েছিল ৪৫ মিলিয়ন ইউরো রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করে। পার্টে প্রথাগত হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেন, অন্তত সেটাই ধারণা করা হতো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে থাকাকালীন সময়ে। তবে দলের আসার পর বেশ কয়েকটি মাস পার হয়ে গেলেও পার্টেকে ব্যবহার করতে পারেননি মিকেল আরতেতা। তার কারণ ইনজুরি ও দলের সাথে মানিয়ে নিতে না পারা। আরতেতার ফুটবল দর্শনে যোগ্য একটি পজিশন খালি আছে পার্টের জন্য। তাই ইনজুরি থেকে ফিরে নতুন ক্লাবে মানিয়ে নিতে পারলে পার্টে গানার্সদের মধ্যমাঠের জন্য ভরসা পাত্র হয়ে উঠতে সক্ষম।
তবে গত বছরে বড় ট্রান্সফারগুলো ভেতর সবচেয়ে জ্বলজ্বলে হয়ে আছেন পর্তুগিজ ডিফেন্ডার রুবেন দিয়াসের নাম। পেপ গার্দিওলা তার চাহিদামতো খেলোয়াড় আনতে সবসময় বিশাল বড় অঙ্ক খরচ করতে দ্বিতীয়বার ভাবেন না। বেনফিকা থেকে তাই এই ডিফেন্ডার এসেছে ৬১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিয়মে।
প্রথমে মনে করা হয়েছিল দিয়াস সিটিতে এসে জুটি বাঁধবেন লাপোর্তের সাথে। কিন্তু প্রথমেই লেস্টার সিটির সাথে ৫-১ গোলে হার দিয়াসের উপর থেকে ভরসা উঠিয়ে দেয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর লাপোর্ত ইনজুরিতে আক্রান্ত হলে দিয়াসের নতুন সঙ্গী হন জন স্টোনস। এরপর খুব ধীরে ধীরে সিটিজেনদের রক্ষণ সমস্যা এই জুটি সমাধান করে ফেলেছে। রক্ষনভাগে স্টোনস নতুন জীবন পাবার পর ধারণা করা হচ্ছে, দিয়াসই হচ্ছে সেই পরশপাথর, যা কয়েক বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছিলেন পেপ গার্দিওলা। স্টোনস ও দিয়াস একত্রে যখন নেমেছে সিটিজেনরা, এক ম্যাচেও হারেনি। ১০ ম্যাচে ৯ জয় ও ১টি ড্রয়ের ভেতর সিটির রক্ষণভাগ ক্লিনশিট ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ৮টি ম্যাচেই।
তবে রুবেন দিয়াসের ক্যারিয়ারের অনেক পথই বাকি। কিন্তু মৌসুমের এই মধ্যগগনে পেপ গার্দিওলার নতুন সাইনিং ইউরোপের অন্যতম সফল সাইনিং বলা যায়।
লিভারপুলের তিনটি সমস্যা দৃশ্যমান ছিল। আক্রমণভাগে বিকল্প খেলোয়াড় ছিল না, আর মধ্যমাঠে একজন বক্স-টু-বক্স ঘরনার মিডফিল্ডার ও নতুন ডিফেন্ডারের প্রয়োজন ছিল। তবে ক্লপ অন্তত দু’টি সমস্যার সমাধান করতে পেরেছিলেন। জোটাকে ৪১ মিলিয়ন ও থিয়াগো আলকানতারাকে ২৬ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কেনার পর দলের ভীত আবার শক্তপোক্ত হতে শুরু করেছিল। বিশেষ করে জোটা সবার ধারণাই পাল্টে দিয়েছিলেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে কয়েক ম্যাচ ও প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে বেঞ্চ থেকে নেমে জোটা চমকে দিয়েছিলেন।
তবে ইনজুরি এই চমককে স্থায়ী হতে দেয়নি। জোটা লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে। ইনজুরি ও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর থিয়াগোও থিতু হতে পারেননি। তাই পুরনো তিন সমস্যা নিয়ে লিভারপুলের এবারের চলার পথ একদম মসৃণ হতে পারছে না। তবে নতুন ক্লাবে অল্প সময়ের তাদের পারফরম্যান্স এটা পরিষ্কার করে, গত বছরের সাইনিং অন্তত বিফলে যায়নি। ইনজুরি থেকে ফিরে দলে নিয়মিত হতে পারলে জোটা ও থিয়াগো ক্লপের চিন্তাকে নির্মূল করার দক্ষতা রাখেন।
স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে আসা যাক। আর্সেনালের জন্য পার্টে, ম্যানচেস্টার সিটির জন্য দিয়াস ও লিভারপুলের জন্য জোটা ব্যয়বহুল সাইনিং। কিন্তু চেলসির জন্য বিষয়টি ভিন্ন। টিমো ভার্নার, হাকিম জিয়েখ, কাই হার্ভাজ ও বেন চিলওয়েল সবাইকে বড় ধরনের অর্থের বিনিময়ে কেনা হয়েছিল ল্যাম্পার্ডের সাথে নতুন প্রজেক্টের কথা ভেবে। মৌসুমের শুরুর দিকে ল্যাম্পার্ডের কথা ও সাইনিংগুলো দেখে মনে হওয়া শুরু করেছিল, চেলসি এবার বড় কিছু করতে চলেছে। কিন্তু ফুটবলের অদ্ভুত নিয়মে মৌসুমের মধ্য সময় শুরু হতে না হতেই ল্যাম্পার্ড আর চেলসির বিচ্ছেদ। বিপরীতে প্রিমিয়ার লিগে ব্লুজরা তালিকার অষ্টম স্থানে।
তবে আপাতদৃষ্টিতে চেলসি নতুন খেলোয়াড় ও ল্যাম্পার্ডের সমস্যা কোথায় ছিল? প্রথমত, উদাহরণ হিসেবে ভার্নারের কথায় আসা যাক। গত দুই মৌসুমে তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখে বার্সেলোনা ও লিভারপুলের মতো ক্লাব তাকে কিনতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু একদম শেষ সময়ে তারা আর এগোতে না চাইলে ভার্নারকে নিয়ে নেয় চেলসি। কিন্তু লাইপজিগে নিয়মিত গোল করার অর্থই যে চেলসিতেও এক ফর্ম থাকবে, তা নয়। ভার্নারের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। প্রিমিয়ার লিগের প্রচণ্ড চাপ, সাথে তালিকার উপরে ওঠার জন্য বেশ কয়েকটি বড় দলের লড়াই এবং প্রত্যেকটি ক্লাবের কার্যকর ট্যাকটিক্সের কবলে পড়ে ভার্নারের অবস্থা শোচনীয়। তার এমন চরম মুহূর্তে পাশে দাঁড়াতে পারেননি ল্যাম্পার্ড। তরুণদের সুযোগ দেন বলে খ্যাতি আছে তার; জেমস রিস, কার্ট জুমা, আব্রাহাম বা মাউন্টরা দলে স্থায়ী হয়েছেন তারই দৌলতে। তবে একজন খেলোয়াড় পরিবর্তনের সাথে কীভাবে মানিয়ে নেবেন, সে কাজে সাহায্য করাতে ল্যাম্পার্ডের ব্যক্তিগত দক্ষতা নেই বললেই চলে।
ভার্নারের মতোই অবস্থার শিকার লেভারকুসেন থেকে আসা প্লেমেকার বা সেকেন্ড ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলা হার্ভাটজের। সাধারণত একজন প্রথাগত স্ট্রাইকারের ঠিক নিচে তিনি তার স্বভাবত খেলাটা খেলতে পারেন। কিন্তু ল্যাম্পার্ডের একাদশে এমন ভূমিকা তিনি পাননি, তাকে খেলতে হয়েছে দলে টিকে থাকা যুদ্ধে লড়তে থাকা ভার্নারের সাথে। সাথে পেয়েছেন জিরু ও আব্রাহামের মতো স্ট্রাইকার, যারা আসলে নিচে নেমে একজন সেকেন্ড স্ট্রাইকার বা প্লেমেকারের সাথে খেলা গড়েন না।
এবার ল্যাম্পার্ড প্রসঙ্গে আসা যাক। মৌসুমের প্রথমে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বা একজন চেলসি লেজেন্ড হয়ে তার যেভাবে চিন্তা করার কথা ছিল, তিনি তা করেননি। আসলে তিনি নিজেই ভাবেননি, তার একাদশে একজন ল্যাম্পার্ডের প্রয়োজন। তিনি দুইজন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারকে কান্তে বা জর্জিনহোর উপরে খেলার চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য তার মধ্যমাঠ মাঝে মাঝেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ত। অথচ হার্ভাটজ, মাউন্ট, জর্জিনহো, কান্তে ও কোভাচিচদের নিয়ে বিকল্প চিন্তাই বদলে দিতে পারতো চেলসি এবং তার ভাগ্য।
চেলসির গত বছরের বাকি ব্যয়বহুল ট্রান্সফার ছিল চিলওয়েল ও হাকিম জিয়েখ। জিয়েখ চেলসিতে আসার পর নিয়মিত হতে পারেননি ইনজুরি সমস্যার কারণে। আর চিলওয়েল মধ্য মৌসুম পর্যন্ত ব্যক্তিগতভাবে ভালো খেলেছেন। কিন্তু পুরো দলের ব্যর্থতার দিনে তার সফলতা আলোর মুখ দেখেনি।
গত গ্রীষ্মকালীন দলবদলের পর চরম ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছে একমাত্র চেলসি। মৌসুমের শুরুতে ল্যাম্পার্ডকে ঘিরে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেই ল্যাম্পার্ডের স্থলে এসেছেন নতুন কোচ। মৌসুম যখন মাত্র জট পাকাতে শুরু করেছে, টমাস টুখেলকে তখন ভাবতে হবে একদম নতুনভাবে। এক্ষেত্রে চেলসিতে অনেকের কপালও পুড়তে পারে। মাউন্ট, কার্ট জুমা ও আব্রাহামের আগের মতো সুযোগ পাওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র।
ইংল্যান্ডের অন্য দুই বড় ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও টটেনহ্যাম হটস্পার মৌসুম যেভাবে শুরু করেছিল, বর্তমানে তারা অবস্থান করছে তার উল্টো দিকে। ব্রুনো ফার্নান্দেজের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে ওলে গানার সলশায়ের তার দলকে বেশ গুছিয়ে এনেছেন। তবে গত মৌসুমে তাদের কেনা খেলোয়াড়গুলো সেভাবে একাদশে সুযোগ পাচ্ছেন না। আয়াক্স থেকে আসা ভ্যান দি বিক আড়ালে চলে যাচ্ছেন ব্রুনো ফার্নান্দেজের তুলনাহীন পারফরম্যান্সে। আর ইনজুরি সমস্যা থাকায় ফুলব্যাক অ্যালেক্স তেলেস একাদশে সুযোগ পান কালেভদ্রে।
স্পার্সের সূচনা এবার দুর্দান্ত ছিল। গোল ও অ্যাসিস্টের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন সন ও কেইন। ব্যয়বহুল সাইনিং নয়, তবে যথাযথ সাইনিং হিসেবে মৌসুমের শুরু থেকে চমকে দিয়েছিলেন মিডফিল্ডার পিয়েরে এমিল হোইবিয়া, যা এখনও তিনি ধরে রেখেছেন। সিটির দিয়াসের পর ব্যয়বহুল ট্রান্সফার না হলেও হোইবিয়ার সাইনিং এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ সফলতা বয়ে এনেছে। তবে স্পার্স হুট করে পয়েন্ট হারানো শুরু করেছে। কিছু সমস্যা ও খেলোয়াড়স্বল্পতা তাদের ধারাবাহিকতাকে বাধা দিচ্ছে। এই দলেই এমন সমস্যা অনেক পুরোনো। পচেত্তিনো পারেননি, এখন ‘স্পেশাল ওয়ান’ খ্যাত জোসে মরিনহোর হাতে স্পার্সের ভাগ্যের নাটাই।
ইংল্যান্ড ছেড়ে এবার ইতালির দিকে যাওয়া যাক। ইতালিতে গত মৌসুমে বড় ধরনের দলবদল ঘটেছে খুবই কম, তার ভেতর দুটোই জুভেন্টাসের দখলে। গত বছরে অন্যতম আলোচিত ট্রান্সফার ছিলো পিয়ানিচের বার্সেলোনাতে যাওয়া ও তরুণ ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার আর্থুরের জুভেন্টাসে আসা। কাগজে-কলমে এ দুটো ট্রান্সফারে ৬০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি দেখানো হলেও ফুটবলের ভাষায় তা আসলে ‘সোয়াপ ডিল’। এই সমালোচিত দলবদলে অবশ্য উভয় দলই সেভাবে লাভবান হয়নি। নতুন কোচ পিরলোর অধীনে আর্থুর কিছুটা সুযোগ পাচ্ছেন বটে, তবে বার্সাতে আসা বছরে নিজের যে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন, তা এখনও ছুঁতে পারেননি। অথচ শালকে থেকে লোনে আসা মিডফিল্ডার ওয়েস্টন ম্যাককেনিই বেশি নজর কেড়ে নিয়েছেন ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে। বার্সাতে পিয়ানিচের অবস্থাও অনেকটা আর্থুরের মতো, ক্যোমানের একাদশে ডাক পান কালেভদ্রে।
তবে গত বছর ইতালির সব থেকে আলোচিত ট্রান্সফার ছিল ভিক্টর ওসিমহেন। লিঁলের হয়ে এক মৌসুমে ১৩ গোল ও ৪ অ্যাসিস্টের পারফরম্যান্স দেখে নাপোলি তাকে দলে ভেড়ায় ৭০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। তাই নাপোলিতে তার খেলার ধরন প্রায় সকল ফুটবলবোদ্ধার নজরে ছিল। কিন্তু ইনজুরি বেশ কয়েক ম্যাচ মিস করার পর ওসিমহেন এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। কোচ গাত্তুসোও দর্শকদের ওসিমহেনকে নিয়ে খুব বেশি আশা করতে বারণ করেছেন। ওসিমহেন সম্পর্কে তার মন্তব্য,
“এমটা নয় যে আমরা পেলে বা ম্যারাডোনাকে কিনে এনেছি। আমরা একজন সাধারণ খেলোয়াড় কিনেছি, যে আহামরি কিছু না করলেও দলগতভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারবে।”
ওসিমহেন লিগে খেলেছেন ৭ ম্যাচ, তাতে গোল করেছেন মাত্র ২টি। এছাড়া চ্যাম্পিয়নস লিগে ৫ ম্যাচে ২টি গোল আছে তার। ইদানিং হিরভিং লোজানো দুর্দান্ত ফর্মে আছেন, নিয়মিত গোলের পাশাপাশি অ্যাসিস্টও করে যাচ্ছেন। ফর্মে থাকা একজন খেলোয়াড়ের বদলে অবশ্যই হুট করে ওসিমহেনকে নামানোর পাত্র নন কোচ গাত্তুসো। তাই গত বছরের সব থেকে আলোচিত ফুটবলার মৌসুমের মধ্য সময়ে এসে একাদশে ফেরার লড়াইয়ের সাথে যুদ্ধ করছেন, যেখানে তার উচিত ছিল নাপোলির যোগ্য স্ট্রাইকারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া।
পিএসজির হয়ে লোনে ‘১৯-‘২০ মৌসু্মে ২৪ ম্যাচে ৩০ গোল করেছিলেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার মাউরো ইকার্দি। এমন পারফরম্যান্সে মুদ্ধ হয়েই তাকে পাকাপাকিভাবে কিনে নেবার চুক্তি করে ক্লাবটি। ক্লাবের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার কাভানি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি জমান, ইকার্দি আসেন ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। কিন্তু চুক্তির পরই পুরনো সুরটা কেটে গেছে। ক্লাবের সাথে অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যার সাথে তুখেলের একাদশে খুব কম সময়ের জন্যই তাকে দেখা গেছে। স্বদেশী কোচ পচেত্তিনো আসার পরও তার ভাগ্য খুব একটা খোলেনি। একাদশের শুরুতে থাকছেন মইস কিন, যদিও পচেত্তিনোর অধীনে পিএসজির দ্বিতীয় ম্যাচে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন ইকার্দি। সে ম্যাচে গোলও এসেছিল তা পা থেকে। হয়তো মৌসুমের বাকি সময়েও স্বদেশী কোচের ভরসার পাত্র হয়ে উঠবেন তিনি। নাহলে সমালোচিত ক্যারিয়ারের ইতিহাসে আরও একটি সমালোচনার বিষয় যোগ হবে তার।
গত গ্রীষ্মকালীন দলবদলের পর ছয় মাসও পার হয়নি। কিন্তু বড় অঙ্কের বিনিময়ে দলে ভেড়ানো খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স বিবেচনা করা শুরু হয়ে গেছে। অথচ একজন খেলোয়াড়ের নতুন পরিবেশে এসে মানিয়ে নিতেই ছয় মাস লেগে যাবার কথা। কিন্তু এই ধারণা বদলে দিয়েছে ফুটবল ক্লাবগুলোর অর্থ খরচ ও অযাচিত ট্রান্সফার। তাই চোখের পলকে সাফল্যের দেখা না পেলে, খুব সহজেই খেলোয়াড়দের প্রতি বিরূপ মন্তব্য এসে পড়ে।
চেলসির কাই হার্ভেটজ বা নাপোলির ভিক্টর অসিমেহেন ৭০ বা ৭৫ মিলিয়ন অর্থ দিয়ে কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এই অর্থ ছাড়া এদের পাওয়া সম্ভবও ছিল না। তাই বিপুল অর্থ যেহেতু খরচ করা হয়েছে, তাই তাৎক্ষণিক সফলতা সবাই আশা করে। কিন্তু সবার জন্য তা সম্ভব হয় না, অন্তত তাৎক্ষণিকভাবে তো নয়ই।
তাই হার্ভেটজ, ভার্নার বা অসিমহেনের মতো ট্রান্সফারগুলোকে বাকি সময়ের জন্য সফলতার দিকে টেনে নিতে পারেন একমাত্র সে দলের কোচ। টমাস টুখেল যদি তার খেলোয়াড়ের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেন, বা পচেত্তিনো আবার ইকার্দির মতো স্ট্রাইকারকে তার একাদশে রাখতে শুরু করেন, হয়তো বছর শেষে দেখা যাবে মৌসুম শেষে এদের থেকেই কেউ ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করে ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে নিয়েছেন।