দুনিয়ার কাছে তিনি এক ত্রাস সৃষ্টিকারী ফাস্ট বোলার। এখনও যে ফুরিয়ে যাননি, তার প্রমাণ রেখেছিলেন ক’দিন আগেই এশিয়া কাপ খেলতে গিয়ে। এখনও স্বপ্ন দেখেন বিশ্বকাপ খেলার।
সেই লাসিথ মালিঙ্গা সিলেটে যোগ দিয়েছেন খুলনা টাইটান্সের সাথে। সেখানেই ঢাকা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে মালিঙ্গা কথা বলেছেন নিজের ক্যারিয়ার, খুলনা টাইটান্স ও মুস্তাফিজকে নিয়ে।
তরুণ ফাস্ট বোলারদের আপনি কী ধরণের পরামর্শ দেন?
প্রথমত, আমি তাদের বলি, নিজের খেলাটা ঠিকমতো বিশ্লেষণ করো। দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, তাদের বুঝতে হবে যে, আন্তর্জাতিক স্তরে ভালো পারফর্ম করতে গেলে কী ধরণের বৈচিত্র্য ও স্কিল দরকার। তৃতীয়ত, তাদের এমন কিছু বিশেষ স্কিল অর্জন করতে হবে যেটা তাদেরকে আলাদা করে তুলবে। আর চতুর্থ ব্যাপার হলো, ধারাবাহিক হওয়া। সেই সাথে তাদের খেলাটায় এমন সঠিকভাবে অংশ নিতে হবে, যাতে তারা ম্যাচের চাপ সামলাতে পারে। অনুশীলন পর্বগুলোতে কোনো চাপ থাকে না, বা ম্যাচ পরিস্থিতিও বোঝা যায় না। কিন্তু খেলায় আপনাকে সত্যিকারের চাপ সামলাতে হয়। আর যেখানে এই চাপটা আছে, সেখানে খেলোয়াড়েরা মাঠে ভুল করে বসতে পারে। আপনার যদি চাপ সামলানোর যোগ্যতা থাকে, তাহলে আপনি সর্বোচ্চ স্তরে ভালো পারফর্ম করতে পারবেন, কম বাউন্ডারি হজম করবেন। ফাস্ট বোলিং খুব কঠিন একটা কাজ। একটা ফাস্ট বোলার এক ম্যাচে পিটুনি খেলে পরের ম্যাচেই হয়তো তাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। আর তাদের হয়তো আরও তিন-চার ম্যাচ অপেক্ষা করতে হয় আরেকটা সুযোগ পাওয়ার জন্য। ফলে আপনি যখন দৃশ্যপটে এসেই পড়বেন, আপনাকে নিজের মান বাড়াতে থাকতে হবে। আর তা না হলে আপনার হয়তো উন্নতির সময় পার হয়ে যাবে, সুযোগগুলোও হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আপনি গত বছর আইপিএলে মুস্তাফিজুর রহমানকে দেখেছেন। তার ব্যাপারে আপনার চিন্তা কী?
কোনো সন্দেহ নেই, এই ছেলেটা একটা পরিপূর্ণ সাদা বলের ক্রিকেটার। মুস্তাফিজুর ও জসপ্রিত বুমরাহ, এই দু’জন বোলারের স্কিল ও নিয়ন্ত্রণ আছে। আর তারা যেকোনো সময় ম্যাচ জেতানো পারফর্ম করার ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ভাগ্যবান যে, তারা মুস্তাফিজুরের মতো একজন প্রতিভাবান বোলার পেয়েছে।
আপনার ক্যারিয়ার কীভাবে শুরু হয়েছিলো?
আমি আট-নয় বছর বয়সে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতাম। আমার গ্রাম হলো গলে রাথাগামা। আমি ২০০৫ সালে প্রথম চামড়ার বলে ক্রিকেট খেলি। কারণ, আমার স্কুল ক্রিকেট দলে খেলোয়াড় কম পড়ে গিয়েছিলো। আর এভাবেই আমার চামড়ার বলে ক্রিকেট খেলা শুরু। এরপর আমি কলম্বোতে চম্পকা রমানায়েকে’র ফাস্ট বোলিং অ্যাকাডেমিতে চলে গেলাম। উনি আমাকে গল ক্রিকেট ক্লাবে একটা সুযোগ করে দিলেন। আর ওখানেই আমি আমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করলাম। উনি আমাকে সবসময় একটা সুযোগ করে দিতে চাইতেন। আর সেজন্যই আজ আমি এখানে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলা শুরু করার তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে একটা ম্যাচে আমি ৮ উইকেট পেলাম। আর সেটাই আমার ক্লাব দলে আমাকে নিয়মিত করে তুললো। এরপর আমার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আমাকে শেষ অবধি ‘এ’ দলে নিয়ে এলো, এবং অবশেষে জাতীয় দলে এলাম।
আপনি একজন ভালো ছাত্র ছিলেন। তারপরও ক্রিকেটকেই কেন ক্যারিয়ার হিসেবে নিলেন?
উচ্চতর স্তরে আমি গণিতে খুব ভালো ছিলাম। আমি এখনও পড়াশোনা করি, আর ক্রিকেট খেলি। কিন্তু সেই সময় আমাকে ক্রিকেট খেলার জন্য নিজের গ্রাম ছেড়ে কলম্বোতে আসতে হয়েছিলো, যার ফলে আমি তখন নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। তবে আমি খুশি, কারণ আমি ক্রিকেটে ভালো করতে পেরেছি এবং জাতীয় দলে খেলতে পেরেছি।
ফাস্ট বোলিং কেন বেছে নিলেন?
তখন সবাই বলতো, ক্রিকেট হলো ব্যাটসম্যানদের খেলা। কিন্তু আপনি যদি একটু সতর্ক চোখে দেখেন, আপনি বুঝতে পারবেন বোলাররাও ম্যাচের পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে এবং ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স করতে পারে।
আপনি ইয়র্কার বোলিংয়ে এতো ভালো হয়ে উঠলেন কী করে?
২০০৫ সালে আমি শ্রীলঙ্কার ওয়ানডে দলে এলাম। মাহেলা (জয়াবর্ধনে) ও (কুমার) সাঙ্গাকারা তখন দলে ছিল। চম্পকা তখন দলের ফাস্ট বোলার। মাহেলা ও সাঙ্গা আমাকে সবসময় বলতো, তুমি যদি ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও, তোমাকে স্কিল বাড়াতে হবে। বেশীরভাগ লোক এই পরিকল্পনা করে। কিন্তু তারা জানে না যে, কীভাবে স্কিল বাড়াতে হবে। ওই সময়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার কোন ধরণের স্কিল বাড়াতে হবে। আপনি জানেন, সাদা বলের ক্রিকেটে প্রথম ১০ ওভার আছে, মাঝের ওভার আছে এবং ডেথ ওভার আছে। আপনাকে সাদা বলের ক্রিকেটে এই পরিস্থিতিগুলো বুঝতে হবে। ফলে আমি বুঝলাম, আমাকে স্লোয়ার আর ইয়র্কারের মান বাড়াতে হবে। একজন ফাস্ট বোলার হিসেবে যে কেউ বাউন্সার ও লেন্থ বল করতে পারে। কিন্তু একজন পেসার হিসেবে সেরা অবস্থানে থাকতে গেলে আপনার আরও কিছু স্কিল লাগবে। তখন আমি বুঝলাম, আমাকে ইয়র্কার লেন্থের বলে আরও ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে হবে। ধারাবাহিকতাটা এখানে জরুরী। আমি কিছু পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলাম এবং প্রতিটা বল ইয়র্কার করার চেষ্টা করলাম। আর শেষ অবধি আমি খুশি যে, আমি আমার স্কিল বাড়াতে পেরেছি।
২০১৪ সালে বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কা যখন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলো, আপনি তখন অধিনায়ক ছিলেন। সেটাই কি আপনার ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত?
হ্যাঁ, অবশ্যই। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের অনুভূতিটা অসাধারণ। ওই দলে মাহেলা, সাঙ্গা, অ্যাঞ্জেলো (ম্যাথুস), দিলশান, চান্দিমাল, হেরাথ ছিল। তারা সবাই সিনিয়র ও রোমাঞ্চকর ক্রিকেটার। অধিনায়ক হিসেবে এইসব গ্রেট খেলোয়াড়ের কারণে আমার কাজটা তুলনামূলক সহজ ছিলো।
খুলনা টাইটান্সের হয়ে খেলাটা কতটা রোমাঞ্চকর হবে?
আমার তত্ত্ব হলো, যে দলেই আমি খেলি না কেন, নিজের শতভাগ দিতে হবে। গত বছর আমি রংপুর রাইডার্সের হয়ে খেলেছি, আর আমরা টুর্নামেন্ট জিতেছি। এবার খুলনা টাইটান্সের হয়ে খেলবো, এবং এবারও আমি জিততে চাইবো। কারণ আমি কোনো পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়ি না।
জয়াবর্ধনে খুলনা টাইটান্সের কোচ। তার সাথে কাজ করাটা কতটা রোমাঞ্চকর হবে?
আমি ওর সাথে লম্বা সময় ধরে ক্রিকেট খেলেছি। আমি তার কোচিংয়ে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সেও ছিলাম। আমি মনে করি, খুলনা খুবই ভাগ্যবান যে তার মতো একজন কোচ পেয়েছে। কারণ, তার মতো কোচ এই উপমহাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি এবং পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো বোঝে। সে মানুষের মন বোঝে এবং বোঝে যে পারফর্ম করতে গেলে কী দরকার। সে নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করতে পারে। আমি তার দলের একজন খেলোয়াড় হতে পেরে সত্যিই রোমাঞ্চিত।
২০১৯ বিশ্বকাপ ও ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে চান?
২০১৯ ও ২০২০ সম্ভবত শেষ দুটো টুর্নামেন্ট, যা আমার পক্ষে খেলা সম্ভব। আমি এই দুটো টুর্নামেন্ট খেলতে চাই, কারণ আমি দেশের হয়ে খেলতে ভালোবাসি।
আর এরপর আপনার পরিকল্পনা কী?
আমার ক্যারিয়ার শেষে আমি কোচ হতে চাই। জাতীয় দলের জন্য ভালো এবং চিন্তাশীল কিছু খেলোয়াড় তৈরি করতে চাই। কীভাবে নিজেকে উন্নত করা যায়, কীভাবে চাপ সামলানো যায়, এবং কীভাবে নিজের স্কিল বাড়ানো যায়, আমি তরুণ পেসারদের সাথে এ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিতে চাই।
আপনি ২০১০ সালে টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন। সেটার কারণ কী ছিল? কোনো আফসোস আছে কি না?
২০০৮ সালে আমার হাঁটুতে একটা সমস্যা হলে আমি প্রায় দেড় বছর এরপর ক্রিকেট খেলতে পারিনি। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি এর থেকে ভালো হলে তুমি ভাগ্যবান।’ আমি ভাগ্যবান যে, ২০১০ সালে আমি আবার বল করতে পেরেছি। ২০১০ সালে আমি আমার শেষ টেস্ট খেলার পর চিকিৎসক বললেন, আমি বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ আর খেললে আবার ইনজুরিতে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আর সেক্ষেত্রে আমি আর হয়তো ক্রিকেট খেলতে পারবো না। আমি যেমন বলেছি, আমি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসি। তাই ক্যারিয়ার লম্বা করার স্বার্থে ওই ফরম্যাটটা ত্যাগ করে শুধু ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলেছি। মাহেলা, সাঙ্গাসহ সব সিনিয়র ক্রিকেটারই আমাকে তখন সমর্থন দিয়েছে। আমি মনে করি, ওটা খুব ভালো একটা সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, আমি এখনও শর্টার ফরম্যাট খেলতে পারছি।