ব্যাট, বল আর ২২ গজের ক্রিকেটের মাঠে ২২ জন খেলোয়াড় খেললেও এই খেলায় একা হাতে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন যেকোনো খেলোয়াড়ই। যুগে যুগে ক্রিকেটে ম্যাচ উইনারের অভাব কখনোই ছিল না। ভিভ রিচার্ডস থেকে শুরু করে জয়াসুরিয়া, টেন্ডুলকার, কিংবা হালের কোহলি বা আফ্রিদি। তবে বড় ম্যাচ কিংবা টুর্নামেন্টে ম্যাচ উইনার হতে হলে যোগ্যতার পাশাপাশি চাপ সামলে খেলারও একটি ব্যাপার থাকে। তো সেই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি জয়ী হয়েছেন কারা? আজ আমরা দেখবো, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সর্বাধিক ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পুরস্কার পাওয়া খেলোয়াড়দের।
ল্যান্স ক্লুজনার (দক্ষিণ আফ্রিকা) – ৫ বার
ক্রিকেটের ‘ট্র্যাজিক হিরো’, কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার আফসোসের নাম যা-ই বলুন, সবার প্রথমে ভেসে আসবে ক্লুজনারের নাম। ১৯৯৯ সালে দুর্দান্ত খেলেও দলকে শিরোপা জেতাতে পারেননি স্রেফ ভাগ্যের খেলায় হেরে। ক্লুজনারের জেতা ৫টি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পুরস্কারের ৪টিই এসেছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে, অন্যটি ২০০৩ সালে।
নিজের প্রথম ম্যান অফ দ্য ম্যাচ বাগিয়ে নেন শ্রীলঙ্কার সাথে অলরাউন্ড নৈপুন্যে। সেই ম্যাচে এক পর্যায়ে ১১৫ রানে সাত উইকেট হারিয়ে হাঁসফাঁস করছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্লুজনারের চওড়া উইলো থেকে ৪৫ বলে ৫২ রানের এক কার্যকরী ইনিংস আসে বিধায় দলের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৯৯ রানে। পরবর্তীতে বল হাতেও মূল্যবান ৩ উইকেট নিয়ে ১১০ রানে গুড়িয়ে দেন লঙ্কানদের। এছাড়াও ওডিআই ক্রিকেটে ক্লুজনারের সেরা বোলিং ফিগারও এসেছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে। কেনিয়ার বিপক্ষে মাত্র ২১ রানে ৫ উইকেট তুলে নেন এই দক্ষিণ আফ্রিকান অলরাউন্ডার। ২০০৩ বিশ্বকাপে ক্লুজনারের শিকারে পরিণত হয় কেনিয়া। সেই ম্যাচের পুরস্কারটিও আসে কেনিয়ার বিপক্ষে ১৬ রানে ৪ উইকেট নেওয়ার ফলশ্রুতিতে।
এবি ডি ভিলিয়ার্স (দক্ষিণ আফ্রিকা) – ৫ বার
ল্যান্স ক্লুজনারের মতো ৫টি ম্যাচ উইনারের পুরস্কার জিতলেও এবির সাথে ক্লুজনারের একটি জায়গায় তফাৎ ছিল। ক্লুজনারের মতো এক বিশ্বকাপে নয়, বরং তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বকাপে কমপক্ষে একটি করে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার জিতেছেন এই জিনিয়াস ব্যাটসম্যান।
২০০৭ বিশ্বকাপে ডি ভিলিয়ার্স জিতেন নিজের প্রথম ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৩০ বলে ১৪৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ভর করে সে ম্যাচটিতে ৬৭ রানে জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে মজার বিষয় হলো, এবির পাওয়া ৫টি পুরস্কারের তিনটিই এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তার মধ্যে ২০১৫ বিশ্বকাপের ইনিংসের কথা বলতেই হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের পাড়ার বোলারে নামিয়ে এনে বেধড়ক পিটিয়ে ৬৬ বলে এবি ডি ভিলিয়ার্স করেন ১৬২ রান। স্বাভাবিকভাবেই ২৫৭ রানের বিশাল জয় নিয়ে সেদিন মাঠ ছাড়ে প্রোটিয়ারা।
ভিভ রিচার্ডস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ) – ৫ বার
২০০০ সালে ১০০ সদস্যের একটি প্যানেল সেই সময়ে ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা ৫ খেলোয়াড়ের একজন হিসেবে ভিভ রিচার্ডসের নাম ঘোষণা করেন। নিজের সময়ে বোলারদের জন্য ত্রাসের সঞ্চার করা এই খেলোয়াড় প্রথম চারটি বিশ্বকাপই খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে। তবে ১৯৭৫ সালে দলগত শিরোপা জিতলেও কোনো ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পাননি সেবার।
নিজের প্রথম ম্যাচ উইনারের পুরস্কারটি জেতেন ১৯৭৯ বিশ্বকাপে, একেবারে মোক্ষম সময়ে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচে দ্রুতই প্রথম চার ব্যাটসম্যানকে হারায় উইন্ডিজরা। সেই ধাক্কা সামাল দিয়ে ভিভ রিচার্ডস খেলেন অপরাজিত ১৩৮ রানের এক মূল্যবান ইনিংস। আর তাতে উইন্ডিজের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৮৬ রান। ব্যাটিংয়ে নেমে ভালো শুরু করলেও মাত ১১ রানে শেষ ৮ উইকেট হারিয়ে ম্যাচটি হেরে বসে ইংল্যান্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে নেয় তাদের টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। অনুমিতভাবেই, ম্যান অফ দ্য ফাইনাল নির্বাচিত হন ভিভ রিচার্ডস।
গ্রাহাম গুচ (ইংল্যান্ড) – ৫ বার
১৯৭৯ ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের ইনিংসের বিপরীতে পাল্লা দিয়ে দারুণ ইনিংস খেলে দলকে সঠিক পথেই রেখেছিলেন গ্রাহাম গুচ। কিন্তু তার বিদায়ের পর ১৮৩/২ থেকে ১৯৪ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। সেই বিশ্বকাপে শিরোপা না জিতলেও নিজে দুর্দান্ত খেলেছিলেন গুচ, জিতেছেন দুইটি ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার। নিজের প্রথম পুরস্কারটি জেতেন প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। গুচের অর্ধশতকে ভর করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬ উইকেটের জয় তুলে নেয় ইংল্যান্ড।
তবে গ্রাহাম গুচ হয়তো আরো ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পেতে পারতেন, যদি না নিষেধাজ্ঞার জন্য ১৯৮৩ বিশ্বকাপ মিস করতেন। তবে ১৯৮৭ সালে এসেই টানা তিনটি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ জিতে বুঝিয়ে দেন, ফুরিয়ে যাননি এখনো। বলে রাখা ভালো, ওই তিন পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ উইনারের পুরস্কার। তার করা ১১৫ রানে ভর করেই ভারতকে ৩৫ রানে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছায় ইংল্যান্ড। তবে দুঃখজনকভাবে ফাইনালে মাত্র ৭ রানে হারে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ১৯৯২ সালে নিজের ও ইংল্যান্ডের তৃতীয় ফাইনাল খেলেন গ্রাহাম গুচ। বলা বাহুল্য, পাকিস্তানের সাথে সেই ফাইনালটিও হারে গুচবাহিনী।
মার্ক ওয়াহ (অস্ট্রেলিয়া) – ৫ বার
মার্ক ওয়াহ নিজের প্রথম ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পুরস্কার জেতেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ১৯৯২ বিশ্বকাপে। কিন্তু সেই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তবে ১৯৯৬ সালে ব্যাট হাতে নিজের রুদ্রমূর্তি নিয়ে আবির্ভাব হন মার্ক ওয়াহ। সেই বিশ্বকাপে যথাক্রমে কেনিয়া, ভারত ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি শতক হাঁকান ওয়াহ। তার ব্যাটিংয়ে ভর করেই আবারও বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছায় অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু আন্ডারডগ শ্রীলঙ্কাই শেষ পর্যন্ত শিরোপা জিতে নেয়।
১৯৯৬ সালে তিনটি ম্যাচ উইনারের পুরস্কার জিতলেও মার্ক ওয়াহ’র কাছে স্মরনীয় হয়ে থাকবে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। কারণ সেবারই মার্কের ভাই স্টিভের নেতৃত্বে নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া।
সনাৎ জয়াসুরিয়া (শ্রীলঙ্কা) – ৫ বার
‘মাতারা হারিকেন’ নামে খ্যাত সনাৎ জয়াসুরিয়া ১৯৯৬ বিশ্বকাপজয়ী শ্রীলঙ্কান দলে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তেমন কিছু করতে না পারলেও গ্রুপপর্বে পাঁচটি ম্যাচই জিতে নেয় জয়াসুরিয়ার কল্যাণে। সেই বিশ্বকাপে ১৩০ স্ট্রাইকরেটে ২২১ রান করা জয়াসুরিয়া ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান দুইবার। প্রথম পুরস্কারটি আসে ভারতের বিপক্ষে। টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি সত্ত্বেও জয়াসুরিয়ার কার্যকরী অর্ধশতকে ম্যাচটি জিতে নেয় শ্রীলঙ্কাই। পরের বিশ্বকাপে ৩টি সেঞ্চুরির জন্য ৩টি ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতলেও জয়াসুরিয়ার বিশ্বকাপের সেরা ইনিংস কিংবা সেরা ম্যাচসেরার পুরস্কারটি এসেছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ২৩৫ রানের লক্ষ্যে সেদিন এই ওপেনারের ৪৪ বলে ৮২ রানে ভর করেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয় লঙ্কানরা। পরবর্তীতে সেবার শিরোপাই জিতে নেয় রানাতুঙ্গার দল।
গ্লেন ম্যাকগ্রা (অস্ট্রেলিয়া) – ৬ বার
একমাত্র খাঁটি বোলার হিসেবে এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং কিংবদন্তি গ্লেন ম্যাকগ্রা। আর থাকবেই বা না কেন! বিশ্বকাপ সবচেয়ে বেশি ৭১টি উইকেট তো তারই দখলে। তারপরও ম্যাকগ্রার আমলে অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইনআপ থাকলেও তাদের টপকে ৬ বার ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হওয়াটাও মুখের কথা নয়।
১৯৯৬ বিশ্বকাপে ম্যাকগ্রা খেললেও তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি, সাত ম্যাচে নিয়েছিলেন মাত্র ৬ উইকেট। তবে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে নিজের আসল রূপ দেখান তিনি, ১০ ম্যাচে নেন ১৮ উইকেট। সেইবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৪ রানে ৫ উইকেট নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার টানা তিন বিশ্বকাপ জয়েই বোলিং বিভাগকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ম্যাকগ্রা। ২০০৭ বিশ্বকাপে তো টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কারও বগলদাবা করেন তিনি। সেই বিশ্বকাপে ১১ ম্যাচে ২৬ উইকেট নিয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপাজয়ে অনস্বীকার্য অবদান রাখেন এই বিখ্যাত বোলার।
শচীন টেন্ডুলকার (ভারত) – ৯ বার
এই তালিকায় এক নাম্বারে কে থাকার কথা, তা হয়তো সবার কাছেই অনুমিতই। শচীন টেন্ডুলকারকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। এই মাস্টার ব্লাস্টার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির পাশাপাশি সর্বোচ্চ ম্যাচসেরা পুরস্কারেরও মালিক। এর পাশাপাশি ২০০৩ বিশ্বকাপে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টসেরাও।
নিজের প্রথম ম্যাচসেরার পুরস্কার পান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে, ১৯৯২ বিশ্বকাপে। তবে শুধু সেবারই নয়, ২০০৩ ও ২০১১ বিশ্বকাপেও পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ উইনার ছিলেন টেন্ডুলকার। ৯টি ম্যাচসেরার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালে পাওয়া পুরস্কারটি। শচীনের করা ৮৫ রানের ফলেই পাকিস্তানের দুর্দান্ত বোলিং সত্ত্বেও ২৬০ রান তুলতে সক্ষম হয় ভারত। পরবর্তীতে ম্যাচটি ২৯ রানে জিতে ফাইনালে পা রাখে ভারত। ফাইনালে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে পাঁচ বিশ্বকাপ অপেক্ষার পর এই লিটল মাস্টার উঁচিয়ে ধরেন বিশ্বকাপ শিরোপা।