স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের ১১৯ বছরের ইতিহাসে যে কয়েকজন কিংবদন্তির নাম উঠে আসে, তাদের মধ্যে চেন্ডো, গুতি, ভিসেন্তে দেল বস্ক, ইকার ক্যাসিয়াস, রাউল, মিচেল এদের নাম অবশ্যই উল্লেখ থাকে। তাদেরই ফুটবল জাদুতে আজ রিয়াল মাদ্রিদের এত অর্জন। উপরোক্ত যে সকল কিংবদন্তিদের কথা বলা হয়েছে, তারা সকলেই স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের ইয়ুথ অ্যাকাডেমি ‘লা ফ্যাব্রিকা’র গড়ে তোলা খেলোয়াড়। চলুন আজ জেনে নেয়া যাক রিয়াল মাদ্রিদের এই আঁতুড়ঘর ‘লা ফ্যাব্রিকা’র ব্যাপারে।
যেভাবে শুরু হলো ‘লা ফ্যাব্রিকা’
১৯৪৩ সালের ১৯শে জুন স্পেনের দুই জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার মধ্যকার ম্যাচের ফলে সমর্থকদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দরুন স্পেন সরকার দুই ক্লাবের প্রেসিডেন্টকে তাদের পদ থেকে অবসর নিতে বাধ্য করে। ঘটনার শুরু আরো কিছুদিন আগে, যখন রিয়াল মাদ্রিদকে বার্সেলোনা ৩-০ গোলে পরাজিত করে। ইউরোপের অন্য যেকোনো দেশগুলোর তুলনায় স্প্যানিশ ফুটবলের সঙ্গে দেশটির রাজনীতি বেশ ভালোভাবেই জড়িত। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার মধ্যকার লড়াইয়ে রাজনীতি থেকে শুরু করে সংস্কৃতি, ইতিহাস সবকিছু যেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। আর এমনই একটি উদাহরণ হলো ১৯৪৩ সালের কোপা দেল জেনেরালিসিমো (বর্তমানে কোপা দেল রে) সেমিফাইনাল।
সেমিফাইনালের প্রথম লেগ অনুষ্ঠিত হয়েছিল বার্সেলোনার লেস কর্টস স্টেডিয়ামে। ৩-০ গোলে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে বার্সেলোনা জয় লাভ করে ফাইনালের পথে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয় লেগে বার্সার জন্য যে দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল, তা তাদের জানা ছিল না। ম্যাচ শেষে রেফারি ফোম্বোনা ফার্নান্দেজের বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগও এনেছিল মাদ্রিদ। এছাড়া পুরো ম্যাচজুড়ে বার্সার সমর্থকরা রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে যাচ্ছিল। স্বায়ত্বশাসন ও স্পেন থেকে আলাদা হতে চাওয়া কাতালোনিয়ার ক্লাব বার্সার সেই জয় স্পেনের ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর পছন্দ হলো না। তাই হয়তো রিয়াল মাদ্রিদের তৎকালীন হোম গ্রাউন্ড এস্তাদিও চামার্তিনে দ্বিতীয় লেগের ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে ফ্রাঙ্কো সাম্রাজ্যের ডিরেক্টর অফ স্টেট সিকিউরিটি বার্সার ড্রেসিংরুমে গিয়ে দলকে হুমকি দিয়ে এসেছিলেন। আর রিয়াল মাদ্রিদের ক্ষিপ্ত উন্মত্ত সমর্থক তো ছিলই। তারা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে তারা বার্সা প্লেয়ারদের মাথা কেটে ফেলার কথাও বলছিল। সবকিছু মিলিয়ে বার্সার প্লেয়ারদের মধ্যে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তারই প্রতিফলন পড়ল স্কোরলাইনে। ১১-১! এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে বার্সার সবচেয়ে বেশি গোল হজমের রেকর্ড এটা।
বার্সেলোনার টিমবাস যখন হোটেল ত্যাগ করছিল, তখন মাদ্রিদের ক্ষিপ্ত সমর্থক টিমবাস লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করছিল। এছাড়া তখন বার্সার সমর্থকদের মাদ্রিদে যাতায়াতের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। এতসব কাহিনীর পরও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে স্পেন সরকার দুই ক্লাবের সভাপতিদের তাদের পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। ঠিক তখনই রিয়াল মাদ্রিদের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন উক্ত ক্লাবেরই সাবেক খেলোয়াড় সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি বুঝতে পারলেন, ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সালে স্পেনে ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের ফলে ক্লাব যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তার রেশ তখনও কাটেনি। উক্ত গৃহযুদ্ধে রিয়াল মাদ্রিদের স্টেডিয়াম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, যার ফলে স্টেডিয়ামটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ক্লাবের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যুদ্ধের পর আর ক্লাবে ফিরেনি। এমনকি রিয়াল মাদ্রিদের অর্জন করা বেশ কিছু ট্রফিও চুরি হয়ে গিয়েছিলো। এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য সরকার থেকেও রিয়াল মাদ্রিদ কোনো সাহায্য পায়নি।
এরকম অবস্থা থেকেই সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ক্লাবের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে তিনি ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড়, পরিচালক এবং অন্যান্য সদস্যদের খোঁজ করেন এবং ক্লাবের পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। তিনি প্রত্যেক স্তরে বয়সভিত্তিক দল গঠন করলেন এবং প্রত্যেক দলের জন্য আলাদা আলাদা প্রশিক্ষক নিয়োগ দিলেন। ১৯৪৭ সালে উদ্বোধন করলেন নতুন স্টেডিয়াম ‘এস্তাদিও রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব দে ফুটবল’ যা আজকের রিয়াল মাদ্রিদের হোম গ্রাউন্ড ‘এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যু’।
১৯৪৮ সালে মাদ্রিদের একটি স্থানীয় দল ‘আগরুপাসিওন দেপোর্তিভো প্লাস আল্ট্রা’কে আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে নিজেদের ফিডার ক্লাব হিসেবে চুক্তির আওতায় আনে রিয়াল মাদ্রিদ। এখান থেকে একটু অতীতে চলে যাওয়া যাক। ১৯৩০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাবলো ফিলিপ ও অগাস্টিন মার্টিন ‘প্লাস আল্ট্রা ইন্সুরেন্স কোম্পানি’র কর্মীদের জন্য একটি ফুটবল ক্লাব ‘আগরুপাসিওন দেপোর্তিভো প্লাস আল্ট্রা’ বা সংক্ষেপে এডি প্লাস আল্ট্রা গঠন করেন। প্রথমদিকে ব্যবসায়িক স্বার্থের জন্য ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করলেও ১৯৪৩ সালে ‘প্লাস আল্ট্রা গ্রুপ’ কাস্তেলানা ফুটবল ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হয় এবং একই বছরে রিয়াল মাদ্রিদের এস্তাদিও চামার্তিন ক্রয় করে নেয়। কাস্তেলানা ফুটবল ফেডারেশনের সাথে যুক্ত হওয়ার ৪ বছরের মাথায় এডি প্লাস আল্ট্রা ১৯৪৭ সালে তেরসেরা (স্পেন ফুটবলের ৪র্থ টায়ার) ডিভিশনে খেলার সুযোগ অর্জন করে, যা রিয়াল মাদ্রিদের নজর কেড়েছিল। দেরি না করে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে ‘এডি প্লাস আল্ট্রা’কে আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে রিয়াল মাদ্রিদের ফিডার ক্লাব হওয়ার আহবান জানান। ১৯৪৮ সালে ‘আগরুপাসিওন দেপোর্তিভো প্লাস আল্ট্রা’ রিয়াল মাদ্রিদের ফিডার ক্লাব হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করে। এরই মাঝে ১৯৪৯ সালে তেরসেরা ডিভিশনের টাইটেল নিজেদের করে নেয় এডি প্লাস আল্ট্রা। জায়গা করে নেয় লা লিগার সেকেন্ড ডিভিশনে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে এডি প্লাস আল্ট্রা রিয়াল মাদ্রিদের রিজার্ভড টিম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এত সব অর্জনের মাঝে ১৯৫৩ সালে রেলিগেশন পেয়ে আবার তেরসেরা ডিভিশনে চলে যায় মাদ্রিদের রিজার্ভ টিম।
তখন মাদ্রিদের হেড অফ ফুটবল ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক খেলোয়াড় মিগুয়েল মালবো। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই মালবো রিয়াল মাদ্রিদের ইয়ুথ অ্যাকাডেমির পরিকল্পনা শুরু করেন। তার পরিকল্পনা বাস্তব রূপ ধারণ করে যখন এডি প্লাস আল্ট্রা মাদ্রিদের ফিডার ক্লাব হিসেবে যুক্ত হয়। কেননা এডি প্লাস আল্ট্রার তরুণ খেলোয়াড়রা ছিল সম্ভাবনাময়। তাদের আরো উন্নত মানের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজনে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তের নেতৃত্বে মিগুয়েল মালবো গঠন করেন ইতিহাসের অন্যতম ইয়ুথ অ্যাকাডেমি ‘লা ফ্যাব্রিকা’, যা ‘কান্তেরা’ নামেও পরিচিত। স্প্যানিশ শব্দ ‘La Fábrica’র বাংলা করলে হয় ‘কারখানা’। এ যেন নামের সাথে কাজের মিল!
স্বর্গীয় এক ট্রেনিং অ্যাকাডেমি
মানুষ সৌন্দর্যের পূজারী। আর এই প্রবাদটাকেই যেন সত্য প্রমাণ করল মাদ্রিদের বারায়াস বিমানবন্দরের পাশে অবস্থিত রিয়াল মাদ্রিদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র সিউদাদ রিয়াল মাদ্রিদ। যদিও পূর্বে রিয়াল মাদ্রিদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র পাসেও দে লা কাস্তেলানায় অবস্থিত ছিল, যা সিউদাদ দেপোর্তিভো নামে পরিচিত ছিল। ১৯৬৩ সালে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তে এটি নির্মাণ করলেও ক্লাবের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে সিউদাদ দেপোর্তিভোর জায়গা বিক্রি করে দেন এবং ২০০৫ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর মাদ্রিদের ভালদেবেবাসে পৃথিবীর অন্যতম প্রশিক্ষণকেন্দ্র সিউদাদ রিয়াল মাদ্রিদ উদ্বোধন করেন, যার আয়তন প্রায় ১,২০,০০০ বর্গ কিলোমিটার।
কী নেই এই সিউদাদ রিয়াল মাদ্রিদে? হাসপাতাল থেকে শুরু করে সিনেমা থিয়েটার, রিহ্যাব সেন্টার, হাইড্রোথেরাপি (জল চিকিৎসা) সেন্টারসহ চিত্তবিনোদনের নানা ব্যবস্থা। আর প্রশিক্ষণের জন্য যা যা প্রয়োজন, তা তো আছেই। আবার যে সকল খেলোয়াড়দের পরিবার মাদ্রিদে থাকে না, তাদের জন্য অ্যাকাডেমির ভিতর রয়েছে আবাসন ব্যবস্থা। রয়েছে ‘লা কান্তেরা’ নামক ৭০০ বর্গ কিলোমিটারের রেস্তোরা, যেখান থেকে সমর্থকরা চাইলে খেলোয়াড়দের ট্রেনিং সেশন উপভোগ করতে পারবে। প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রয়েছে ১২টি ফ্লাডলিট পিচ, যার ১১টিরই আয়তন হুবহু সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়ামের পিচের মতো। ১২টি পিচের ৮টিতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু স্টেডিয়ামের ন্যায় হল্যান্ড থেকে প্রাকৃতিক ঘাস এনে লাগানো হয়েছে, বাকি ৪টিতে টার্ফ বসানো হয়েছে। পুরো অ্যাকাডেমির আবহাওয়া সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে একটি আবহাওয়া কেন্দ্র। ফুটবলের পাশাপাশি বাস্কেটবল প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে আলাদা স্পোর্টস সেন্টার। আছে ৬০০০ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন আলফ্রেড ডি স্টেফানো স্টেডিয়াম। ‘লা ফ্যাব্রিকা’ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সিউদাদ রিয়াল মাদ্রিদের প্রসঙ্গ উঠে আসার কারণ হলো, সিউদাদ রিয়াল মাদ্রিদের বিরাট একটা অংশ নিয়েই স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ‘লা ফ্যাব্রিকা’। এখানেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয় রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব কর্তৃক নির্বাচিত ‘লা ফ্যাব্রিকা’র সম্ভাবনাময় তরুণদের।
নিয়মের উর্ধ্বে নয় কোন কিছুই
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের অন্যতম শর্ত হচ্ছে, নিয়ম মেনে সব কিছু করতে হবে। আর কোনো খেলাধুলাই নিয়মের উর্ধ্বে নয়। পৃথিবীর অন্য ক্লাবগুলোর অ্যাকাডেমি বিভিন্ন নিয়মের মধ্য দিয়ে গেলেও ‘লা ফ্যাব্রিকা’র নিয়ম শুধু একটাই, আর সেটা হলো জয়। নতুন কেউ যখন প্রশিক্ষণের জন্য অ্যাকাডেমিতে আসে, তখন প্রথম দিনে তাকে বলা হয়, ‘তুমি এখন আর কেবল তোমার বাবা-মার সন্তান নও, আজ থেকে তুমি রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়।’ শুরু থেকেই খেলোয়াড়দের ভিতর জয়ের মানসিকতা তৈরির কাজ শুরু দেয় অ্যাকাডেমি। মূলত এখানেই অন্য অ্যাকাডেমি থেকে আলাদা ‘লা ফ্যাব্রিকা’। অন্য অ্যাকাডেমিগুলো নিজের প্রধান দলের খেলার কৌশলের সাথে মিল রেখে খেলোয়াড় প্রস্তুত করার চেষ্টা করলেও ‘লা ফ্যাব্রিকা’ খেলোয়াড়দের এমনভাবে প্রস্তুত করে যেন তারা যেকোনো ধরনের কৌশলে ফুটবল খেলতে পারে।
‘একজন রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়কে বল সর্বদা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, প্রতিপক্ষের অর্ধেক মাঠে খেলতে হবে এবং সেই খেলার তারকা হতে হবে।’
এমন একটি বার্তা খেলোয়াড়দের প্রভাবিত করার জন্য প্রশিক্ষণের সময় ব্যবহার করা হয়। প্রশিক্ষণের সময় ব্যবহার করা হয় চমৎকার কিছু পন্থা। একটি বৃত্তের মাঝখানে একজন খেলোয়াড় রেখে বৃত্তের বাইরে অন্য খেলোয়াড়দের রাখা হয়। এরপর বৃত্তের বাহিরে থাকে খেলোয়াড়রা বৃত্তের ভিতরের খেলোয়াড়ের কাছ থেকে বলটি দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে ছোট জায়গায় খেলার ও বল নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল শেখানো হয় অ্যাকাডেমিতে। আপনার যদি অল্পতে হার মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকে, তবে ‘লা ফ্যাব্রিকা’ আপনার জন্য নয়। ফুটবল খেলায় প্রতিটি পজিশনের জন্য কোচ যেমন এর বিকল্প তৈরি করে রাখে, ঠিক তেমনভাবে ‘লা ফ্যাব্রিকা’তে প্রতিটা খেলোয়াড়ের বিকল্প তৈরি করে রাখা হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। দুর্বলদের স্থান সবসময় সবলরা দখল করে নিবে। অ্যাকাডেমিতে যোগদানের পর থেকেই মনস্তাত্ত্বিক কৌশলের উপর ঝালিয়ে নিতে হয়।
খেলাধুলার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার প্রতিও বিশেষ নজর দেয় অ্যাকাডেমি। এজন্য স্পেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান Colegio SEK-El Castillo’র সাথে চুক্তিবদ্ধ আছে রিয়াল মাদ্রিদ, পাশাপাশি অ্যাকাডেমিতে রয়েছে বিশেষ ক্লাসরুম ও লাইব্রেরি। অ্যাকাডেমির সকলকে রুটিনমাফিক চলতে হবে, সকালে নাস্তার পর ক্লাসে যেতে হবে। ক্লাসশেষে অল্প কিছু সময় দেয়া হয় বিশ্রামের জন্য। এরপর শুরু হয় খেলাধুলার ট্রেনিং। প্রতিটি ট্রেনিং সেশন ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের। ছাত্রদের ১৪টি দলে ভাগ করে দেয়া হয়, যেখানে প্রতিটি দলে ২০ জন থাকে। ট্রেনিংয়ের প্রতিটি ফিল্ডে থাকে বিশেষ মেডিকেল টিম। প্রতি বেলার খাবারেও মেনে চলতে হবে নির্দিষ্ট ডায়েট। রাত ১১টায় সবাইকে নিজ নিজ বিছানায় থাকতে হবে। অ্যাকাডেমিতে কোনোভাবেই নিয়মের হেরফের করা যাবে না। যে বয়সে বাবা-মার কাছে অতি আদর যত্নে বেড়ে ওঠার কথা, সে বয়সে লা ফ্যাব্রিকার কোনো এক পিচে খেলোয়াড়রা প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় রিয়াল মাদ্রিদের প্রথম দলের খেলোয়াড় হওয়ার, অথবা একজন লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েট হয়ে অ্যাকাডেমি থেকে বিদায় নেয়ার। আর যদি ভাগ্য সহায় না হয়, তবে ব্যর্থতা নিয়েই তাদের অ্যাকাডেমি ছাড়তে হয়। কেননা, লা ফ্যাব্রিকাতে শুধু যোগ্যরাই টিকে থাকে।
ফুটবল গ্রেটদের জন্ম যেখানে
রিয়াল মাদ্রিদ কাস্তিয়ার (রিয়াল মাদ্রিদ রিজার্ভ টিম) বর্তমান ম্যানেজার, রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসের অন্যতম সেরা স্প্যানিশ ফরোয়ার্ড ‘এল আনহেল দি মাদ্রিদ’ (মাদ্রিদের দেবদূত) রাউল গঞ্জালেস অথবা ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলকিপার, রেকর্ড পাঁচবার IFFHS World’s Best Goalkeeper খেতাবধারী ইকার ক্যাসিয়াস, অথবা রিয়াল মাদ্রিদের অন্যতম অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার গুতি — এই লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েটরা বিভিন্ন সময়ে ফুটবল বিশ্বে নিজেরা রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রাজত্ব করে গেছেন।
রাউল প্রথমে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের যুব অ্যাকাডেমিতে থাকলেও ক্লাবটি আর্থিক সমস্যার জন্য যুব অ্যাকাডেমি বন্ধ করে দিলে প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ রাউলকে নিজেদের অ্যাকাডেমিতে নিয়ে আসে। খুব দ্রুত জুভেনাইল সি, বি, এ পার করে মাত্র ১৭ বছর বয়সে মূল দলে অভিষেক হয় রাউল গঞ্জালেসের। রাউলের অসংখ্য অর্জনের মাঝে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯৮-২০০২ — এই ৫ বছরে মাদ্রিদিস্তাদের ৩ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ উপহার দিয়েছিলেন রাউল। রিয়াল মাদ্রিদে নিজের ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে রাউল গঞ্জালেস ৩টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ৬টি লিগ টাইটেল ও দুইটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল শিরোপা অর্জন করেছেন।
ফুটবল বিশ্বের অন্যতম সেরা ও স্পেনের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা গোলকিপার ইকার ক্যাসিয়াস মাত্র ৯ বছর বয়সে লা ফ্যাব্রিকাতে যোগ দিয়েছিলেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফুটবল মাঠের শেষ প্রান্তের রক্ষক হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে অভিষেক হয়। অসাধারণ রিফ্লেক্স, দুর্দান্ত পজিশনিং এবং পা ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়ে পুরো ইউরোপ শাসন করেছিলেন তিনি। ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে রোবেনের সাথে ওয়ান-টু-ওয়ান সিচুয়েশনে ক্যাসিয়াসের সেই নিশ্চিত গোল সেইভ করা আজও ফুটবলপ্রেমীরা স্মরণ করে। ইকার ক্যাসিয়াস মাদ্রিদের হয়ে ৩টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৫টি লিগ টাইটেল, ২টি কোপা দেল রে, ২টি উয়েফা সুপার কাপ, ৪টি সুপার কোপা দি স্পানা, একটি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ ও একটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল শিরোপা অর্জন করেছেন।
অন্যদিকে, রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠে খেলা গুতি হারনান্দেস নিঃসন্দেহে ব্লাঙ্কোদের হয়ে খেলা সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন। তিনি ১০ বছর বয়সে লা ফ্যাব্রিকাতে যোগদান করে ২০ বছর বয়সে রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে খেলার সুযোগ পান। গুতি তার পুরো ক্যারিয়ারে ১৫টি শিরোপা জিতেছেন, যার মধ্যে ৩টি চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ৫টি লা লিগা টাইটেল রয়েছে।
তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না ১৯৮৩ সালে কাস্তিয়ার হয়ে ‘সেগুন্দা ডিভিশনের’ শিরোপা জিতে নেয়া লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েট এমিলিও বুত্রেগেনো, মিচেল, সাঞ্চিস, মিগেল পারদেজা এবং রাফায়েল মার্টিন ভাস্কেজকেও। ১৯৮৩-৮৪ সিজনে রিয়াল মাদ্রিদের ‘বি’ টিম কাস্তিয়া দ্বিতীয় ডিভিশনের চ্যাম্পিয়ন হয়েও প্রমোশন পায়নি, কেননা একই টায়ারে একটি ক্লাবের দুইটি দল খেলতে পারবে না। কিন্তু কাস্তিয়ার কিছু তরুণের অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য তাদের একে একে মূল দলে ডাকা হয়। ৬০-এর দশকে রিয়াল মাদ্রিদের টানা ৫ বার লিগ জয়ের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে। ‘৮০-র দশকের মাদ্রিদের সেই দলটির ৫ জন খেলোয়াড় এমিলিও বুত্রেগেনো, মিচেল, সানচেজ, মিগেল পারদেজা এবং রাফায়েল মার্টিন ভাস্কেজ উঠে এসেছিল লা ফ্যাব্রিকা থেকে। অ্যাকাডেমি থেকে উঠে আসা ৫ জনের এই দলকে বলা হতো ‘লা কুইন্তা দেল বুত্রে’ বা শকুনের দল। শকুনের মতো ক্ষীপ্রতা ও তীক্ষ্ণতার কারণে এমিলিও বুত্রেগেনোকে ‘এল বুত্রে’ ডাকা হতো। তার সাথে বাকি চারজনকে মিলিয়ে দলটির নাম দেয়া হয়েছিল ‘লা কুইন্তা দেল বুত্রে’। পরবর্তীতে মিগেল পারদেজা রিয়াল জারাগোজাতে চলে গেলেও এমিলিও বুত্রেগেনো, মিচেল, সানচেজ এবং রাফায়েল মার্টিন ভাস্কেজ দাপটের সাথে রিয়াল মাদ্রিদ মূল দলে খেলে গিয়েছেন। বুত্রেগেনো, মিচেল ও ভাস্কেজ দলের আক্রমণাত্মক ভাগে খেললেও সানচেজ ছিল মূল রক্ষণভাগের প্রাণকেন্দ্র। ২টি উয়েফা কাপ ও ৫টি লা লিগা টাইটেল জেতা ‘লা কুইন্তা দেল বুত্রে’ বা শকুনের দল হিসেবে খ্যাত লা ফ্যাব্রিকার এই পাঁচ গ্র্যাজুয়েটের নাম রিয়াল মাদ্রিদ ও স্প্যানিশ ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
সেকালের অন্যতম রাইটব্যাক, রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ১টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৭টি লিগ টাইটেল, ২টি কোপা দেল রে ও ২টি উয়েফা কাপ অর্জন করা চেন্ডো এবং স্পেনের বিশ্বকাপ ও ইউরোজয়ী কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কও একজন লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েট। রিয়াল মাদ্রিদ যখন ২০০০ ও ২০০২ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা নিজেদের ঘরে তোলে তখনও রিয়াল মাদ্রিদের কোচ ছিলেন ভিসেন্তে দেল বস্ক।
রিয়াল মাদ্রিদ মূল দল নাকি গন্তব্য অন্য কোথাও?
লা ফ্যাব্রিকাতে একজন খেলোয়াড় প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে সে রিয়াল মাদ্রিদের মূল দলে জায়গা করে নেবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা কেউ কখনো দেবে না, সেটা সম্ভবও নয়। বাঘা বাঘা সব খেলোয়াড় অ্যাকাডেমিতে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করতে পারে, তাকেই মূল দলে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যায় যে, রিয়াল মাদ্রিদ নিজের অ্যাকাডেমি থেকে প্রধান দলে খেলোয়াড় নেয়ার চেয়ে ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা সহ বিভিন্ন জায়গায় স্কাউট নিয়োগ দিয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের দলে ভেড়াতেই বেশি আগ্রহী থাকে। তাই হয়তো মূল দলে জায়গা পেয়েও ক্লাবের আর্থিক অবস্থাকে বেগবান করার জন্য অনেক গ্র্যাজুয়েটকে পাড়ি দিতে হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদের বাইরে। এরকম কয়েকজন হচ্ছেন আলভেরো মোরাতা, আশরাফ হাকিমি, অস্কার রদ্রিগেজ, মার্কোস লরেন্তে, জেসি রদ্রিগেজ, রাউল ডি টমাসসহ আরো অনেকে। ২০১৭ সালে ৬০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে মাদ্রিদ ছেড়ে চেলসিতে পাড়ি জমান লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েট আলভেরো মোরাতা। বর্তমানে পিএসজির খেলোয়াড় লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েট আশরাফ হাকিমিকে ২০২০ সালে রিয়াল মাদ্রিদ ৪০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইন্টার মিলানের কাছে বিক্রি করে দেয়। অস্কার রদ্রিগেজও ১৩.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে সেভিয়াতে পাড়ি জমান, যদিও রদ্রিগেজের ২৫% স্বত্ত্ব এখনো রিয়াল মাদ্রিদের হাতে। মার্কোস লরেন্তে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে, জেসি রদ্রিগেজ ২৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে ও রাউল ডি টমাস ২০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বেনফিকাতে পাড়ি জমান।
অ্যাকাডেমির খেলোয়াড় বিক্রি করা ছাড়াও মাদ্রিদ বিভিন্ন সময়ে খেলোয়াড়দের বিভিন্ন দলে লোনে পাঠিয়ে থাকে, যার মাধ্যমেও বিরাট একটা অর্থ মাদ্রিদ আয় করে।
শেষ কথা
সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ইয়েস্তের তৈরি করে দিয়ে যাওয়া ‘লা ফ্যাব্রিকা’ আজ সাফল্যের শীর্ষে। রিয়াল মাদ্রিদ নিজেদের খেলোয়াড় বানানোর কারখানাকে সত্যি বলতে এখন টাকা আয়ের অন্যতম উৎস হিসেবেই দেখে। তবে এটা ঠিক যে, লা ফ্যাব্রিকা গ্র্যাজুয়েটরা বেশ ভালো খেলোয়াড় হিসেবেই অ্যাকাডেমি থেকে বের হয়, যার ফলে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে তাদের বেশ ভালো চাহিদা থাকে। এর পাশাপাশি একাডেমির গ্র্যাজুয়েটদের অন্য ক্লাবগুলোতে বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন হয়, তা রিয়াল মাদ্রিদ নিজেদের প্রথম দলের জন্য ভালো মানের খেলোয়াড় কেনাতে ব্যয় করতে পারে। ‘লা ফ্যাব্রিকা’ শুরু হওয়ার পর থেকে এর গ্র্যাজুয়েটরা রিয়াল মাদ্রিদের অর্জনে বিরাট অবদান রেখেছে। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে, রিয়াল মাদ্রিদ আটটি লা লিগা শিরোপা, একটি কোপা দেল রে এবং ছয়টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছে। এসব অর্জনে সিংহভাগ অবদান রেখেছে লা ফ্যাব্রিকার গ্র্যাজুয়েটরা, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পেড্রো ক্যাসাডো, এনরিক মাতেওস, গ্রেগরিও বেনিতো, হুয়ান সান্টিস্তেবান, ম্যানুয়েল ভেলাস্কুয়েজ, রামন গ্রোসো, ফার্নান্দো সেরেনা এবং রামন মার্সাল। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে রিয়াল মাদ্রিদ পরপর পাঁচটি লা লিগা শিরোপা জিতেছিল, পরপর দুটি উয়েফা ইউরোপা লিগ এবং পরপর তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল এমন দল নিয়ে, যার সিংহভাগ লা ফ্যাব্রিকার তৈরি করা খেলোয়াড়।
রিয়াল মাদ্রিদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার ইয়ুথ অ্যাকাডেমি ‘লা মাসিয়া’র মতো সুপরিচিত না হলেও ইতিহাস জানে, ‘লা ফ্যাব্রিকা’ রিয়াল মাদ্রিদ ও ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক ইয়ুথ অ্যাকাডেমি।