ফুটবল মাঠের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী মেসি ও রোনালদোকে নিয়ে কলমের কালি কম খরচ হয়নি। তাদের মধ্যে কে সেরা এই নিয়ে বিতর্ক হয়তো কখনোই শেষ হবে না। এ বিতর্ক প্রায়ই মাঠ ছাড়িয়ে উঁকি দেয় তাদের ব্যক্তিগত জীবনে। তাই এই দুজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও ভক্তদের মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। কার বাৎসরিক আয় কত, কে কোথায় ছুটি কাটালো, কার বাড়িতে কী কী সুবিধা আছে এসব নিয়ে সংবাদপত্রগুলো সারা বছরই সরগম থাকে।
প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের পারিশ্রমিক পাওয়া এই দুই ফুটবল তারকার গ্যারাজও যে যথেষ্ট সমৃদ্ধ থাকবে তা আর না বললেও চলে। রেকর্ড পাঁচটি করে ব্যালন ডি’অর জেতা মেসি-রোনালদোর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে একটু অন্য স্বাদে উপস্থাপন করতে আজকের লেখায় তাদের গ্যারাজে থাকা সেরা দশটি গাড়ি নিয়ে আলোচনা করা হবে। তাহলে চলুন দেখে আসা যাক কার গ্যারাজে থাকা গাড়িগুলো সেরা– মেসির নাকি রোনালদোর?
১.
রোনালদো: ফেরারি এফ-১২
ফেরারি দিয়েই শুরু করা যাক। মেসি ও রোনালদো দুজনের সংগ্রহেই ভিন্ন ভিন্ন মডেলের একাধিক ফেরারি রয়েছে। অবশ্য দুজনের স্বাদ দু’রকম। রোনালদোর যেখানে অত্যাধুনিক সুবিধার বর্তমান মডেলগুলোর প্রতি আগ্রহ বেশি, সেখানে মেসির পছন্দ কিছুটা এন্টিক ঘরানার।
২০১৭ সালের গ্রীষ্মে FERRARI F-12 গাড়িটি ক্রয় করেন রোনালদো। এজন্য তাকে গুনতে হয়েছিল পাক্কা পাঁচ লক্ষ ডলার। ৬.৩ লিটার ইঞ্জিনের দ্রুত গতির এই গাড়িটিতে রয়েছে ৭৭০ হর্সপাওয়ার। সেই সময়ে ইন্সটাগ্রামে এই গাড়িটির একটি ছবিও পোস্ট করেছিলেন রোনালদো।
মেসি: ফেরারি ৩৩৫ এস স্পাইডার স্ক্যাগ্লিয়েত্তি
মেসির গ্যারাজে থাকা FERRARI 335 S SPIDER SCAGLIETTI গাড়িটিই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাকে রোনালদোর অনেকটা কাছাকাছি রেখেছে। তা না হলে হয়তো রোনালদোর সামনে তাকে খুঁজেই পাওয়া যেত না।
১৯৫০ সালে তৈরি ফেরারির এই ভিনটেজ গাড়িটি কিনতে মেসিকে খরচ করতে হয়েছিল ২৫ মিলিয়ন ইউরো! না, আপনি ভুল শোনেননি! এই মডেলের মাত্র চারটি গাড়িই তৈরি করেছিল ফেরারি। তাই একেকটির দাম এতটা আকাশছোঁয়া।
মেসির কল্যাণে এই গাড়িটি তৎকালীন ফেরারির ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হওয়া গাড়িতে পরিণত হয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই গাড়িটির মালিক হতে মেসিকে নিলামে হারাতে হয়েছিল তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি রোনালদোকে!
২.
রোনালদো: বুগাটি চিরন
ফেরারি থেকে এবার অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। আগেই বলা হয়েছে, অত্যাধুনিক সুবিধার চোখ ধাঁধানো গাড়ির প্রতি রোনালদোর প্রবল টান রয়েছে। তাই তার সংগ্রহে বুগাটি চিরন থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক!
৩ মিলিয়ন ডলার বাজার মূল্যের বিখ্যাত এই গাড়িটি শুধু দেখতেই অসাধারণ নয়, বরং গতির ঝড় তোলার ক্ষেত্রেও এর সুখ্যাতি রয়েছে। এর সর্বোচ্চ গতি ২৬০ মাইল/ঘন্টা। ইন্সটাগ্রামে এই গাড়িটির সাথে একাধিক ছবি পোস্ট করছিলেন রোনালদো।
মেসি: মাসেরাতি গ্র্যানতুরিস্মো এমসি স্ট্রাডেল
শুধুমাত্র বাজারমূল্য বা গতি বিবেচনা করলে রোলানদোর বুগাটি চিরনের ধারে কাছেও নেই মেসির MASERATI GRANTURISMO MC STRADALE মডেলের এই গাড়িটি। তবে পরিবারের সাথে লং ড্রাইভে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে কারো পছন্দের তালিকায় শুরুর দিকেই থাকবে আকর্ষণীয় ডিজাইন এবং ৪৬০ হর্সপাওয়ারের এই গাড়িটি।
অবশ্য ১.৩ মিলিয়ন ডলার বাজারমূল্যের এই গাড়িটি মেসি বিক্রি করে দিয়েছেন বলেই শোনা যায়।
৩.
রোনালদো: বুগাটি ভেরন
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই সুপারকারটিও জায়গা করে নিয়েছে রোনালদোর গ্যারাজে। ১০০১ হর্সপাওয়ার এবং সর্বোচ্চ ২৬১ মাইল/ঘন্টা গতিবেগের এই গাড়িটির বাজার মূল্য প্রায় ১.৯ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য যার সাপ্তাহিক আয় ২০ মিলিয়ন ডলার, তার কাছে এ আর এমন কী!
মেসি: ব্লু অডি আর-৮
এবারও রোনালদোর বুগাটি ভেরনের কাছে হার মানতে হচ্ছে মেসির নীল রঙের এই অডি গাড়িটিকে। কারণ BUGATTI VEYRON এর দাম, গতি বা গ্ল্যামারের তুলনায় AUDI R8 অনেকটাই পিছিয়ে।
তবে এক্ষেত্রে অডি গাড়ির ভক্তরা দ্বিমত প্রকাশ করতেই পারেন। কারণ অডির ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই গাড়িটি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ২০৫ মাইল/ঘন্টা বেগে চলতে পারে, যা অনেক সুপারকারকেই পেছনে ফেলে দিতে যথেষ্ট।
অনেকের মতে AUDI R8–ই মেসির সবচেয়ে পছন্দের গাড়ি। পূর্বে অনেকবারই তাকে নীল রঙের এই গাড়িতে করে ক্যাম্প ন্যু–তে যেতে দেখা গেছে।
নামে-ভাড়ে বুগাটি ভেরনের মতো না হলেও প্রতিদিনকার ব্যবহারের জন্য AUDI R8 বেশ ভালো পছন্দ। রোনালদোর গ্যারাজেও এই মডেলের একটি অডি আছে বলে জানা যায়।
৪.
রোনালদো: পোর্শে ৯১১ টার্বো এস
রোনালদোর অসাধারণ গাড়ি-সংগ্রহশালার আরও একটি বিখ্যাত নাম হলো PORSCHE 911 TURBO S। তার গ্যারাজের অন্যান্য গাড়িগুলোর মতো এটিও অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন। মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে ১০০ কি.মি/ঘন্টা গতি তুলতে সক্ষম এই গাড়িটি। আর এর সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ৩৩০ কিলোমিটার।
একটু বেশিই ফাস্ট? গাড়ির মালিক যখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তখন একটু ফাস্ট তো হবেই!
মেসি: মিনি কুপার এস ক্যাবরিওলেট
কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়াই বলে দেয়া যায় যে, এবারের লড়াইয়েও এগিয়ে আছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পোর্শে। আসলে প্রায় ৫০,০০০ ডলার মূল্যের ও ১৮৯ হর্সপাওয়ারের মেসির মিনি কুপার গাড়িটিও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। কিন্তু পোর্শে ৯১১ এর মতো একটি বিস্ট (Beast) এর সাথে কোনোভাবেই এর তুলনা চলে না।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের এই গাড়িতে মেসিকে দেখা গিয়েছিল।
৫.
রোনালদো: রেঞ্জ রোভার স্পোর্ট এসভিআর
বেশিরভাগ তারকা ফুটবলারদের গ্যারাজেই স্থান পাওয়া একটি গাড়ি হলো রেঞ্জ রোভার। রোনালদোও তার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজেকে সবার সেরা ভাবেন তাই তার রেঞ্জ রোভারটিও যে আর সবার চেয়ে সেরা হবে তা তো বলাই যায়।
ফুটবল মাঠে গতির ঝড় তোলা রোনালদো তার এসইউভি হিসেবে বেছে নিয়েছেন RANGE ROVER SPORT SVR-কে। মাত্র ৪ সেকেন্ডের মধ্যে ১০০ কি.মি/ঘন্টা গতি তুলতে সক্ষম এই গাড়িটিতে রয়েছে ৫৫০ হর্সপাওয়ার। এটি ল্যান্ড রোভার ব্র্যান্ডের তৈরি সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং শক্তিশালী রেঞ্জ রোভার গাড়ি। আর এর ঝাঁ-চকচকে ধূসর-কালো রঙ গাড়িটিকে করে তুলেছে আরও আকর্ষণীয়।
মেসি: রেঞ্জ রোভার ভৌগ
মেসির রেঞ্জ রোভার গাড়িকে রোনালদোরটির চেয়ে পিছিয়েই রাখতে হবে। কারণ এটি দাম এবং গতির দিক দিয়ে RANGE ROVER SPORT SVR এর চেয়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে।
মেসির এই রেঞ্জ রোভারে রয়েছে ৫ লিটারের একটি V8 ইঞ্জিন। ০ থেকে ১০০ কি.মি/ঘন্টা গতি তুলতে এর সময় লাগে ৫.৪ সেকেন্ড। এই গাড়িটি কিনতে মেসিকে খরচ করতে হয়েছিল ১,৫০,০০০ ডলার। শপিং করা, পরিবারের সাথে লং ড্রাইভে যাওয়ার মতো প্রাত্যহিক কাজে এই রেঞ্জ রোভারটি ব্যবহার করতে দেখা গেছে মেসিকে।
৬.
রোনালদো: ল্যাম্বরগিনি এভেন্টাডর এলপি ৭০০-৪
বলা হয়ে থাকে, LAMBORGHINI AVENTADOR LP 700-4 গাড়িটিই ছিল রোনালদোর কেনা সবচেয়ে অসাধারণ গাড়ি। ছিল বলতে হচ্ছে, কারণ এটি পরবর্তীতে ৪,০০,০০০ ডলারে নানা কোয়ামে নামক একজন ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন ক্রিস্টিয়ানো।
৭০০ হর্সপাওয়ার এবং ৮,২৫০ আরপিএম টর্কের এই গাড়িটিতে ছিল V12 ইঞ্জিন। স্টাইলিশ ডিজাইন এবং চোখধাঁধাঁনো কালো রঙের এই গাড়িটির ছবি রোনালদো তার ইন্সটাগ্রাম একাউন্টে পোস্ট করেছিলেন। তাকে বেশ কয়েকবার এই ল্যাম্বোর ভেতর থেকে ভক্তদের অটোগ্রাফ দিতেও দেখা গিয়েছিল।
মেসি: অডি কিউ-৭
অডি গাড়ির প্রতি মেসির যে আলাদা টান আছে তা বলাই যায়। বিশ্বসেরা এই ফুটবলারের গ্যারাজে থাকা অডির বেশ কয়েকটি স্পোর্টস্ কারই তার প্রমাণ দেয়। এদের মধ্যে AUDI Q7 একটি। ২০১১ সালের দিকে এই গাড়িতে করে মেসিকে ন্যু ক্যাম্পে যেতে দেখা গিয়েছিল।
তবে প্রশ্ন হলো, কোনটি সেরা– LAMBORGHINI AVENTADOR LP 700-4 নাকি AUDI Q7? অবশ্যই ল্যাম্বরগিনি! লুক, বাজারমূল্য, পারফরমেন্স সব দিক দিয়েই এগিয়ে থাকবে ল্যাম্বো। যদিও মেসির এই মডেলটি অডির বর্তমান সেরা দশটি বিলাসবহুল গাড়ির একটি, কিন্তু একে এভেন্টাডরের সাথে তুলনা করা বোকামি।
তাহলে এবারও জয়ের মালা রোনালদোর গলায়!
৭.
রোনালদো: মার্সিডিজ এস৬৫ এএমজি
গাড়ি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, অথচ সেখানে মার্সিডিজ-বেঞ্জের প্রসঙ্গ উঠবে না তা কী করে হয়! তাহলে এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক মার্সিডিজের দিকে।
২০১৫ সালে রোনালদো MERCEDES S65 AMG মডেলের গাড়িটি ক্রয় করেন। এজন্য তার পকেট থেকে খসেছিল পাক্কা ২,৫০,০০০ ডলার। মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের এই গাড়িটিতে ব্যবহার করা হয়েছে ৬.২ লিটার V12 টার্বো ইঞ্জিন। ৬২১ হর্সপাওয়ারের আকর্ষণীয় এই গাড়িটি ঘন্টায় ১৮৬ মাইল বেগে ছুটতে পারে।
মেসি: মার্সিডিজ এসএলএস
স্পোর্টস্ কারের এই মজার প্রতিযোগিতায় রোনালদোর কাছে মেসিকে বার বার হারতে দেখে তার ভক্তরা হয়তো মাথার চুল ছেঁড়া শুরু করেছেন! তাহলে মেসির এই MERCEDES SLS দেখে তারা কিছুটা স্বস্তি পেতে পারেন। কারণ সব মিলিয়ে MERCEDES SLS কে রোনালদোর MERCEDES S65 AMG এর চেয়ে এগিয়ে রাখাই যায়।
১০২৫ হর্সপাওয়ারের দ্রুতগামী এই গাড়িটি মাত্র ৩.৮ সেকেন্ডের মধ্যেই ১০০ কি.মি/ঘন্টা গতি তুলতে পারে। এর সর্বোচ্চ গতি ১৯৬ মাইল/ঘন্টা। মার্সিডিজ-বেঞ্জের এই গাড়িটি কিনতে মেসির খরচ হয়েছিল প্রায় ২,৫০,০০০ ডলার। এটি অবশ্য শুধুমাত্র সংগ্রহে রাখার জন্যই কিনেছিলেন মেসি। বার্সেলোনার ব্যস্ত রাস্তায় তাকে এই গাড়িটি ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
আসলে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্যই হোক বা সংগ্রহের উদ্দেশ্যই হোক, গাড়ি সব সময়ই একটি ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। এখানে উল্লিখিত গাড়ির বাইরেও মেসি-রোনালদোর আরও অনেক অসাধারণ মডেলের গাড়ি রয়েছে। প্রতিটি গাড়ি ক্রয়ের পেছনে যেটি মূলতা কাজ করে তা হলো ব্যক্তিগত রুচিবোধ। আর তা যে দু’জনের ভিন্ন ভিন্ন হবে সেটাই স্বাভাবিক। শুধুমাত্র পাঠকদের বিনোদনের উদ্দেশ্যেই এই মজার প্রতিযোগিতা দেখানো হয়েছে।
যদি প্রতি গাড়ির পেছনে করা খরচকে বিবেচ্য ধরা হয় তাহলে রোনালদো অবশ্যই মেসির চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। কিন্তু যদি সবগুলো গাড়ির মোট খরচকে বিবেচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে মেসিই বিজয়ী হবেন তার সংগ্রহে থাকা ফেরারির সেই এন্টিক মডেলের গাড়িটির সৌজন্যে।